এক কোটি মানুষ হত্যা করিয়েছিলো যে কসাই রাজা

তিনি যেন ছিলেন সাক্ষাৎ শয়তান! মানবিক গুণাবলীর খুব কম বিষয়ই তার মধ্যে অবশিষ্ট ছিল। ভালোবাসা, দয়া, মহানুভবতা- এসব শব্দের কোনো অর্থ ছিল না তার কাছে, ছিল না কোনো অস্তিত্ব। নৃশংসতার মাঝেই তিনি বেঁচে ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হলোকাস্টে হিটলার বাহিনী হত্যা করেছিল প্রায় ৬০ লক্ষ মানুষ। হলোকাস্টের কথা কতই না আলোচনা হয়, শুনলে গাঁ গুলিয়ে ওঠে। একজন ব্যক্তি কী করে এতো মানুষকে হত্যা করতে পারে? কিন্তু হিটলারের চেয়ে বড় হন্তারক যে আরেকজন জন্মেছিলেন বেলজিয়ামে, তার কথা জানেন তো? তার মন লাখের ঘরে তৃপ্ত হয়নি। তিনি হত্যা করেছিলেন এক কোটিরও অধিক মানুষ! তিনি রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ড, বেলজিয়ামের দ্বিতীয় রাজা এবং ‘কঙ্গো ফ্রি স্টেট’ এর প্রতিষ্ঠাতা ও একচ্ছত্র অধিপতি।

রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ড (১৮৩৫-১৯০৯); ছবিঃ Radio2hot.com

বেলজিয়ামের স্বাধীনতার পাঁচ বছর পর ১৮৩৫ সালের ৯ এপ্রিল রাজধানী ব্রাসেলসে জন্মগ্রহণ করেন লিওপোল্ড। রাজা প্রথম লিওপোল্ডের দ্বিতীয় স্ত্রী লোইজের গর্ভে জন্ম নেন দ্বিতীয় লিওপোল্ড। ১৮৫০ সালে নিজের বাবার মৃত্যুশোকে আচ্ছন্ন লোইজ মৃত্যুবরণ করেন। লাজুক লিওপোল্ড মায়ের মৃত্যুতে নিজেকে আরো গুঁটিয়ে নিতে শুরু করলে চিন্তিত হন তার পিতা। যেহেতু বড় ছেলে শৈশবেই মৃত্যুবরণ করেছে, সেহেতু ভবিষ্যতে সিংহাসনে বসতে হবে লিওপোল্ডকেই। লাজুক স্বভাব থেকে বের করে আনতে রাজা লিওপোল্ড তাই ছেলেকে অস্ট্রিয়ার সম্রাটের চাচাতো বোন মেরি হেনরিয়েটের সাথে বিয়ে করিয়ে দেন। মেরি ছিলেন অত্যন্ত রূপবতী এবং গুণী। গান গাওয়া এবং ছবি আঁকার পাশাপাশি তিনি ভালো ঘোড়সওয়ারও ছিলেন। তাছাড়া দয়ালু মনোভাবের জন্য তার নাম হয়ে যায় ‘রোজ অব ব্রাবেন্ট’।

দাম্পত্য জীবনে লিওপোল্ড নিজের স্ত্রীর প্রতি খুব একটা সন্তষ্ট ছিলেন না। তার অসংখ্য উপপত্নী ছিল। তবে মেরির সাথে বিচ্ছেদ ঘটে উত্তরাধিকার জন্ম দিতে পারার ব্যর্থতায়। মেরি ও লিওপোল্ডের ঘরে যে ছেলে জন্ম নিয়েছিল সে নয় বছর বয়সে নিউমোনিয়ায় ভুগে মারা যায়। তখন লিওপোল্ডের দুই কন্যা থাকলেও উত্তরাধিকার হিসেবে পুত্র সন্তানের জন্য তিনি মরিয়া হয়ে ওঠেন। শেষবারের চেষ্টায় যখন আরো একটি কন্যা সন্তানের (ক্লেমেন্টিন) জন্ম হয়, তখন তাদের বৈবাহিক জীবনের অবসান ঘটে। ১৮৯৫ সালে মেরির সাথে যখন বিচ্ছেদ হলো তখন তার বয়স ৬০ বছর। তথাপি উপপত্নীর নেশা তার মোটেও কমেনি! তার শেষ উপপত্নীর সাথে তার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল বলে শোনা যায়। ১৮৯৯ সালে লিওপোল্ড যখন মাত্র ১৬ বছর বয়সী ফরাসী পতিতা ক্যারোলিন লেক্রয়েক্সকে গ্রহণ করেন, তখন তিনি ৬৫ বছর বয়সী প্রৌঢ়! যদিও ক্যারোলিনের ঘরে দুই ছেলের জন্ম হয়, কেউই লিওপোল্ডের সন্তান হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি এবং লিওপোল্ডের রেখে যাওয়া সম্পত্তি লাভ করতে পারেনি। কারণ লিওপোল্ড ক্যারোলিনকে বিয়ে করেছিলেন তার মৃত্যুর মাত্র পাঁচদিন আগে, অত্যন্ত গোপনে। আর এই গোপনীয়তাই তার মৃত্যুর পর দুর্ভাগ্য বয়ে আনে ক্যারোলিনের জন্য।

লিওপোল্ড ও তার উপপত্নী ক্যারোলিন ল্যাক্রয়েক্স; ছবিঃ Pinterest

প্রাথমিক জীবনে লাজুক স্বভাবের হলেও বেশ সাহসী ছিলেন লিওপোল্ড। বড় ভাই শৈশবেই মারা যাওয়ায় আজন্ম তিনি ছিলেন বেলজিয়ামের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী। নয় বছর বয়সে তাকে বেলজিয়ান আর্মির একজন সাব-লেফটেনেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। সিংহাসনে আরোহণের পূর্ব পর্যন্ত তিনি বেলজিয়ান সেনাবাহিনীতে ছিলেন এবং লেফটেনেন্ট জেনারেল পদে উন্নীত হয়েছিলেন। ১৮৫৫ সালে লিওপোল্ড বেলজিয়ান পার্লামেন্টের সদস্য হন এবং বেলজিয়ামকে বাণিজ্যিকভাবে এগিয়ে নিতে কাজ শুরু করেন। পরবর্তী ১০ বছর তিনি চীন, ভারত, মিশর, আফ্রিকাসহ অনেক দেশে ভ্রমণ করেন। ১৮৬৫ সালের ডিসেম্বরে রাজা প্রথম লিওপোল্ড মারা গেলে সিংহাসনে বসেন তার ছেলে রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ড।

ইতিহাসের আরো অনেক অত্যাচারী আর স্বৈরাচারী রাজাদের দেখানো পথেই হাঁটেন লিওপোল্ড। তার রাজত্বের প্রথম ভাগটাও ছিল উন্নয়ন ও জনকল্যাণমূলক কাজে ভরপুর। তিনি রাজা হবার পরই তার রাজ্য পরিচালনার যে ইশতেহার প্রণয়ন করেছিলেন সেখানে বলেছিলেন যে বেলজিয়ামকে তিনি “স্ট্রং, প্রসপারাস, বিউটিফুল অ্যান্ড পিসফুল” একটি জাতিতে পরিণত করবেন। তিনি পার্লামেন্টে যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন তাদের সাথে সহযোগিতা করে দেশের উন্নয়ন করার শপথ করেন। এই শপথ ভালোভাবেই রক্ষা করে চলেছিলেন লিওপোল্ড। তার শাসনামলে কখনো লিবারেলরা, কখনোবা ক্যাথলিকরা ক্ষমতায় আসলেও পার্লামেন্টের কার্যক্রম চলেছে ঠিকঠাকই। অন্যদিকে তার শাসনামলেই বেলজিয়ামে উত্থান ঘটে নতুন রাজনৈতিক শক্তি ‘লেবার পার্টি’র

বেলজিয়ান পার্লামেন্টে; ছবিঃ aujourdhuilaturquie.com

লিওপোল্ডের শাসনামলের সবচেয়ে বড় অর্জন ছিল শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা। তার সহযোগিতায় ‘লেবার ইউনিয়ন’ প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি শিশু শ্রম নিষিদ্ধ করেন। তার সময়েই শ্রমিকরা দুর্ঘটনার জন্য ক্ষতিপূরণ পাবার অধিকার লাভ করেন এবং রবিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন হিসেবে প্রচলিত হয়। তার শ্রম আইনের তিনটি দিক ছিল-

  • ১২ বছরের নিচের শিশুরা কারখানায় কাজ করতে পারবে না।
  • ১৬ বছরের কম বয়সী শিশুদেরকে রাতে কাজ করানো যাবে না।
  • ২১ বছরের কম বয়সী মহিলাদের কোনো ভূগর্ভস্থ কাজে নিয়োগ দেয়া যাবে না।

রাজা লিওপোল্ড তার শাসনামলে বেলজিয়ামকে অবকাঠামোগতভাবে উন্নত করেন। তিনি অসংখ্য সরকারি ভবন ও পার্ক নির্মাণ করেন এবং সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ করেন। ব্রাসেলসে তার তৈরি হিপোড্রোম, রয়্যাল গ্যালারি আর হেনড্রিকাপার্ক এক কথায় দৃষ্টিনন্দন। অন্যদিকে ‘রয়্যাল মিউজিয়াম ফর সেন্ট্রাল আফ্রিকা’ তার এক অনবদ্য কীর্তি। তাছাড়া সিনকুয়েন্ট্রিয়াল পার্ক, ডাডেন পার্ক এবং ট্রায়াম্ফাল আর্ক তার অনন্য সৃষ্টি। তার এসব কাজ তাকে ‘বিল্ডার কিং’ খেতাব এনে দেয়। অন্যদিকে জনকল্যাণমূলক কাজের বাইরেও তিনি নিজের বিলাসবহুল জীবনের অংশ হিসেবে দেশে ও দেশের বাইরে একাধিক প্রাসাদ ও বাংলো নির্মাণ করেন।

রয়্যাল গ্যালারি; ছবিঃ commons.wikimedia.org

মৃত্যুর পর নিজের সব প্রাসাদ, জমিজমা এবং জমিদারি যেন কোনোভাবেই নিজের কন্যাদের দখলে না যায় সে ব্যবস্থা করতে ১৯০০ সালে লিওপোল্ড একটি রয়্যাল ট্রাস্ট গঠন করেন। মেয়েদেরকে ভালোবাসতেন না বলে তাদের সম্পত্তি দিতে চাননি, ব্যাপারটা মোটেও তেমন নয়। মূলত তার তিন কন্যার বিয়েই হয়েছিল বিদেশি রাজাদের সাথে। আর তিনি চাননি দেশের সম্পত্তি বাইরের কারো দখলে চলে যাক! রয়্যাল ট্রাস্টের ফলে তার অধিকাংশ জনকল্যাণমূলক স্থাপনাগুলো বেলজিয়ামের রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিতে পরিণত হয়। রাজবংশ চাইলে ব্যবহার করতে পারবে, এই শর্তেই তিনি তার সম্পত্তি রাষ্ট্রীয়করণ করেন। তবে তার এসব কাজকে একেবারে ভালো চোখে দেখার কোনো কারণ নেই। কারণ এসবই তিনি করেছেন কঙ্গোকে লুটে। বেলজিয়ামের উন্নতি হয়তো হয়েছে, কিন্তু কঙ্গোর প্রাকৃতিক সম্পদ ও খনিজ শোষণ করে তিনি কঙ্গোর অনাগত প্রজন্মের জন্য দুর্দশার ‘সুব্যবস্থা’ করেছিলেন।

মানচিত্রে কঙ্গো ফ্রি স্টেট; ছবিঃ NationStates

‘কঙ্গো ফ্রি স্টেট’, আজকের গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের জন্য এক দীর্ঘশ্বাসের নাম। প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ কঙ্গোকে শোষণ করে ফুলে ফেঁপে উঠেছিল রাজা লিওপোল্ডের বেলজিয়াম। শুরুটা ১৮৮৪-৮৫ সালে। লিওপোল্ড বার্লিন কনফারেন্সে কঙ্গোর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবন জীবিকার উন্নয়ন ঘটাবার কথা বলে কঙ্গোর লীজ আবেদন করেন। কনফারেন্সে ইউরোপের ঔপনিবেশিক দেশগুলো সে আবেদন গ্রহণ করলে লিওপোল্ড কঙ্গো ফ্রি স্টেটের একচ্ছত্র অধিপতি বনে যান। আর শুরু হয় তার অত্যাচার ও নৃশংসতা।

লিওপোল্ড সবসময়ই দেশের বাইরে কলোনি স্থাপনের স্বপ্ন দেখতেন। শুধুমাত্র কলোনি স্থাপনই বেলজিয়ামকে একটি শক্তিধর রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারে, এরকম ভাবনা ছিল তার। সে ভাবনা থেকে তিনি একাধিকবার আফ্রিকার বিভিন্ন স্থানে কলোনি স্থাপনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। অবশেষে কঙ্গোতে সাফল্য লাভ করেন। নিজ দেশের চেয়ে ৭৬ গুণ বড় কঙ্গো ফ্রি স্টেট শাসনের জন্য তিনি নিজস্ব বর্বর বাহিনী গঠন করেন, যার নাম দেন ‘পাবলিক ফোর্স’। প্রথমে তিনি কঙ্গো থেকে আইভরি রপ্তানি করে তার মুনাফা ঘরে তোলা শুরু করেন। তখন বিশ্বে রাবারের দাম এবং চাহিদা আকস্মিকভাবে বৃদ্ধি পায়। আর লিওপোল্ড রাবার থেকে অধিক মুনাফা অর্জনের জন্য বার্লিন কনফারেন্সে শর্ত ভাঙতে শুরু করেন।

এভাবেই কঙ্গো ফ্রি স্টেটের দাসদের শেকল পরিয়ে কাজ করানো হতো; ছবিঃ thejewishwars.blogspot.com

প্রথমেই লিওপোল্ড কঙ্গো ফ্রি স্টেটে বিদেশিদের বিনিয়োগ বন্ধ করে দেন যা বার্লিন কনফারেন্সের প্রথম শর্তের বিরুদ্ধে। এরপর তিনি কঙ্গোর শ্রমিকদের দিয়ে জোরপূর্বক রাবার চাষ করানো শুরু করেন। অথচ বার্লিন কনফারেন্সে স্পষ্ট করে বলা হয়েছিল যে লিওপোল্ড কোনো প্রজার উপর জোর খাটাতে পারবেন না। এই রাবার শিল্প কঙ্গোর শ্রমিকদের জন্য এক দুঃস্বপ্ন হয়ে দেখা দেয়। লিওপোল্ডের চাহিদা অনুযায়ী রাবার উৎপাদিত না হলেই শ্রমিকদের উপর নানা অত্যাচার করা হতো এবং সামান্যতম কারণে হত্যার ঘটনা ঘটতো অহরহ। পাঠক, ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রজাদের উপর নীলকরদের অত্যাচারের সাথে মিল খুঁজে পাচ্ছেন কি?

একদিকে কঙ্গোর প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ ও জনসম্পদ কাজে লাগিয়ে বেলজিয়ামের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটাচ্ছিলেন, অন্যদিকে লিওপোল্ড যেন কঙ্গোর জনসংখ্যা হ্রাসের এক পৈশাচিক মিশনে নেমেছিলেন। ‘পান থেকে চুন খসা’র মতো ভুলও তার বাহিনীর সহ্যের সীমার মধ্যে ছিল না। লিওপোল্ডের আদেশ ছিল একরকম ‘জিরো টলারেন্স’। বিশ শতকের অন্যতম কুখ্যাত নরহন্তারক লিওপোল্ড তার বাহিনীর লাগাম টেনে ধরার বদলে তাদেরকে আরো অধিক রক্তপিপাসু হতে আদেশ দিতেন। তারই প্রমাণ পাওয়া যায় তার অত্যাচারের ধরণ থেকে। অপরাধের শাস্তি হিসেবে প্রজাদের হাত, পা কেটে ফেলা হতো। বাবা-মায়ের সামনে তাদের সন্তানদের মুন্ডুচ্ছেদ করা হতো। গ্রামের পর গ্রাম, জনপদের পর জনপদ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় লিওপোল্ডের অত্যাচারে। তার আক্রোশের স্বীকার মানুষের সংখ্যা, বিভিন্ন ঐতিহাসিকের মতে ৫০ লক্ষ থেকে দেড় কোটি পর্যন্ত! তবে সবেচেয়ে গ্রহণযোগ্য সংখ্যাটি (অধিকাংশ ইতিহাসবিদের মত) ১ কোটি! লিওপোল্ড কঙ্গোর ক্ষমতা গ্রহণের সময় জনসংখ্যা ছিল ২.২ কোটির মতো। অর্থাৎ ক্ষমতা ছাড়ার সময় তিনি একটি জাতির অর্ধেক জনসংখ্যার ধ্বংস করে দিয়ে গেছেন! তার এই বর্বরতার জন্য তাকে বলা হয় ‘বুচার অব কঙ্গো’ বা কঙ্গোর কসাই।

প্রকাশ্যে অঙ্গচ্ছেদ করে হত্যা করা হচ্ছে; ছবিঃ thejewishwars.blogspot.com

লিওপোল্ডের অকল্পনীয় বর্বরতার কথা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় ওঠে। ব্রিটিশরা রজার কেসমেন্টের অধীনে কঙ্গোতে তদন্তের দল পাঠায়। তদন্তে কঙ্গোর জনগণের উপর লিওপোল্ডের অমানবিক নিষ্ঠুরতার বর্ণনা উঠে আসে। এই রিপোর্টের পর লিওপোল্ডের সমালোচনায় যোগ দেন বিখ্যাত আমেরিকান লেখক মার্ক টোয়েন এবং ব্রিটিশ ফিকশন লেখক স্যার আর্থার কোনান ডয়েল। আর্থার কোনান ডয়েলের ‘দ্য ক্রাইম অব কঙ্গো’ এবং মার্ক টোয়েনের ব্যাঙ্গাত্মক ‘কিং লিওপোল্ড’স সলিলকি’ পুরো ইউরোপজুড়ে জনমনে সাড়া ফেলে। লিওপোল্ডের উপর আন্তর্জাতিক চাপ চরমে ওঠে। অন্যদিকে নিজে দেশের পার্লামেন্টে লেবার পার্টি এবং ক্যাথলিক পার্টি, উভয় শক্তিশালী দলই লিওপোল্ডের বিপরীতে অবস্থান নেয়। অবশেষে সকল চাপের কাছে নতি স্বীকার করে ‘কঙ্গো ফ্রি স্টেট’ ভেঙে দেয়া হয় এবং কঙ্গো তখন সরাসরি বেলজিয়ামের কলোনি ‘বেলজিয়ান কঙ্গো’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তখন লিওপোল্ড নিজের সকল অত্যাচারের তথ্য গোপন করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালান। তিনি সম্পূর্ণ ‘কঙ্গো ফ্রি স্টেট আর্কাইভ’ আগুনে পুড়িয়ে দেন। প্রথমে স্বীকার না করলেও পরে অবশ্য স্বীকার করেন যে আর্কাইভ তিনিই পুড়িয়েছেন। কেন পুড়িয়েছেন সে প্রশ্নের উত্তরে লিওপোল্ড বলেছিলেন, “আমার স্টেটে আমি কি করেছি তা অন্যদের জানার কোনো অধিকার নেই!

১৯০৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর লায়েকেনে রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ড মৃত্যুবরণ করেন। তাকে ‘লেডি লায়েকেন’ চার্চে সমাধিস্থ করা হয়। তার প্রতি জনমনে জমে থাকা ক্রোধ প্রকাশ পায় তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অবজ্ঞাসূচক শব্দ করার মাধ্যমে। বেলজিয়ামের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সময় ধরে শাসন করা এই রাজার মৃত্যু পর অনেক দিন মানুষ কেবল তাকে ঘৃণাই করেছে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে ১৯৩০ এর পর থেকেই বেলজিয়ামের নতুন প্রজন্মগুলো যেন বেমালুম ভুলে যায় লিওপোল্ডের বর্বরতার কথা। বেলজিয়ামের ইতিহাসে লিওপোল্ডকে একজন মহান রাজা হিসেবে অধিষ্টিত করা হয়। তার স্মরণে অসংখ্য সৌধ ও ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়। বিশেষ করে কিছু ভাস্কর্যে দেখানো হয় কঙ্গোর জনগণ তার প্রতি কৃতজ্ঞ! এমনকি বেলজিয়ামের ইতিহাসে লেখা হয় লিওপোল্ড কঙ্গোবাসীকে আরবদের দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছেন! যিনি একটি জাতির অর্ধেক জনসংখ্যা নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছেন, তাকে করা হলো কিনা মুক্তির দূত! ৪৪ বছরের শাসনামলে তিনি বেলজিয়ামের জন্য অনেক কিছু করলেও তার নিষ্ঠুরতা কোনোকিছু দিয়েই ঢাকা সম্ভব নয়। বেলজিয়ানদের ইতিহাস চেপে যাবার অপ্রত্যাশিত চেষ্টার কারণে আজ বেলজিয়ামের অধিকাংশ মানুষই লিওপোল্ড সম্পর্কে অন্ধকারে বাস করছে।

ফিচার ছবিঃ The New York Times

(ফিচার ছবিটি একটি প্রতিকী ছবি। রবারের জন্য লিওপোল্ডের বর্বরতা দেখাতে তাকে একটি রবারের সাপ কল্পনা করা হয়েছে।)

Related Articles

Exit mobile version