Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

শিবরাম চক্রবর্তী: রম্য সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র

বাংলা সাহিত্যের রম্যশাখার এক অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব শিবরাম চক্রবর্তী। বাংলা রম্যসাহিত্যিকের খুব ক্ষুদ্র তালিকা করলেও সেখানে নিঃসন্দেহে ঠাঁই পাবেন শিবরাম। তার সাহিত্যের হাস্যরস ছিল সম্পূর্ণই স্বভাবজাত। কোথাও জোর করে হাসানোর প্রবণতা ছিল না, পাঠক নিজ মনেই পড়তে পড়তে হাসির রাজ্যে হারিয়ে যাবেন। একটি শব্দের পিঠে আরেকটি শব্দ চালিয়ে, অর্থাৎ ইংরেজিতে যেটিকে আমরা ‘PUN’ বলে থাকি, বাংলা সাহিত্যে এটির প্রবর্তন করেছিলেন মূলত শিবরাম। এটি শিবরামীয় স্টাইল নামেও পরিচিত। 

শিবরামের জন্ম নিয়ে শিবরামের পিতা শিবপ্রসাদের একটি দলিল সংরক্ষিত আছে মালদহ জেলার কালীগ্রামের ভারতী ভবনের পাঠাগারে। তাতে লেখা,

বঙ্গাব্দ তেরোশো দশ প্রাতে রবিবার

সাতাশে অগ্রহায়ণ শিবের কুমার

শিবরাম জনমিল

লীলাশংখ বাজাইল

শিব হ্রদে উপজিল আনন্দ অপার।

এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, শিবরামের জন্ম ১৩১০ বঙ্গাব্দের ২৭শে অগ্রহায়ণ; অর্থাৎ ১৯০৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর। জন্মসূত্রে তিনি ছিলেন মালদহের চাঁচল রাজপরিবারের ঘনিষ্ঠ। তার পিতার নাম শিবপ্রসাদ চক্রবর্তী এবং মাতা শিবরানী দেবী। শিবপ্রসাদ ছিলেন আধ্যাত্মিক মনোভাবের মানুষ। ফলে সংসারের মায়ায় কখনো বন্দী থাকেননি। ফলে, মায়ের তত্ত্বাবধানেই কেটেছিল শিবরামের শৈশব ও কৈশোর। ছোটবেলা থেকেই দুরন্ত ছিলেন শিবরাম, ছিলেন স্বাধীনচেতা। ছোটবেলায় একবার বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন কলকাতায়। পরে সেই অভিজ্ঞতা থেকেই লেখেন তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’।

পড়তেন মালদহের সিদ্ধেশ্বরী ইনস্টিটিউশনে। ১৯১৯ এ সেখান থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষার জন্য নির্বাচনী পরীক্ষা দেওয়া হলেও চূড়ান্ত পরীক্ষা আর দেওয়া হয়নি। সেসময় ভারতবর্ষে চলছিল আন্দোলনের হাওয়া। অসহযোগ আন্দোলনের এক প্রচারসভায় মালদহে এসেছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন ও বাসন্তী দেবী। কলকাতা ফিরে যাওয়ার সময় তাদের যাত্রাসঙ্গী হন স্বয়ং শিবরাম। কলকাতা গিয়ে ভর্তি হন গৌড়ীয় সর্ববিদ্যায়তনে, যে প্রতিষ্ঠানের প্রধান ছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস। পরে সেখান থেকেই পাশ করেন ম্যাট্রিক। স্বাধীনচেতা শিবরাম স্বদেশী আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে কারাবরণও করেন। ম্যাট্রিকের পর পড়ালেখাটা আর চালাননি। সামান্য কিছুকাল চাকরি করলেও পরবর্তীতে সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করেন সাহিত্যে।

ছোটবেলায় পালিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন
ছোটবেলায় পালিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’; Image Source: Rokomari

ব্যক্তি শিবরাম ছিলেন প্রচণ্ড রকমের খেয়ালী এবং রসিক একজন মানুষ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, শিবরামের এক ভক্ত তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, সারা দিন তিনি কীভাবে কাটান। শিবরাম যে জবাব দেন, তা সরাসরি বিষ্ণু বসু ও অশোককুমার মিত্র সংকলিত ও সম্পাদিত ‘শ্রেষ্ঠ শিবরাম’ বইয়ের প্রসঙ্গ শিবরাম হতেই বলি,

সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে শুয়ে শুয়ে তিনি একটু বিশ্রাম নেন। তারপর হাতমুখ ধুয়ে চা-জলখাবার খেয়ে আবার শুয়ে পড়েন। দুপুরবেলা কষ্টেসৃষ্টে উঠে টানটান করে খাওয়া সারেন। দ্বিপ্রাহরিক আহারের পর ভাতঘুম তো বাঙালির ন্যায্য পাওনা। দুপুরে তাই ভাতঘুমে থাকেন। বিকেলে চা জলখাবারের পর ভাবেন কোথায়ই বা যাবেন, ‘বরং শুয়েই থাকি’। রাতের বেলার খাওয়া সেরে আবার ঘুমিয়ে পড়েন। এভাবেই কাটে তাঁর দিনগুলো রাতগুলো। প্রশ্নকর্তা তখন বিস্মিত হয়ে জানতে চান, “তাহলে লিখেন কখন!”

নির্বিকার ভঙ্গিতে শিবরাম উত্তর দেন, “কেন, পরের দিন!”

শিবরামের বাস্তব জীবনে এমন খেয়ালী রসিকতার উদাহরণ অসংখ্য। এবং সেখানেও যথারীতি পাওয়া যায় শিবরামীয় স্টাইলের ‘পান’। প্রেমেন্দ্র মিত্রের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক নিয়ে বলেছিলেন “প্রেমেণের মতো মিত্র হয় না”। আবার শিশিরকুমার ভাদুড়ীর মাদকাসক্তিকে ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন, “শিশি-র ভাদুড়ী নহ, তুমি বোতলের”। নিজেকে নিয়ে মজা করতেও ছাড়তেন না তিনি। নিজের নামকে নিজেই বিকৃত করে লিখতেন ‘শিব্রাম চকরবরতী’; লিখেছিলেন ‘শিবরাম বনাম শিব্রাম’।

যৌবনের শুরুতে ছিলেন নিতান্তই বোহেমিয়ান এক যুবক। পত্রিকায় প্রকাশিত হতো কিছু কিছু লেখা। তা থেকে যা আয় হতো, তাতেই চলছিল জীবন। একসময় পরিচয় হয় ১৩৪ নং, মুক্তারামবাবু স্ট্রিটের নির্মীয়মাণ আনন্দভবনের মালিক আনন্দবাবুর সাথে। তিনি তাকে সেই মেসের কেয়ারটেকারের দায়িত্ব দেন। সারাজীবন আর ঠিকানা বদলাননি শিবরাম। তার ভাষায়,

“এই মেসবাড়ির আদি বাসিন্দা আমি। বাড়ি তৈরির আগে থেকেই আছি।”

সেখানে আসবাব বলতে ছিল একটিমাত্র তক্তপোশ এবং একটি পায়াভাঙা চেয়ার। চারপাশে চুনকামহীন বিবর্ণ দেওয়ালে ছিল নানারঙ্গের পেন্সিলে লেখা পরিচিতদের নাম-ঠিকানা-টেলিফোন নাম্বার। সেখানেই লিখে রাখতেন দেনাপাওনার হিসাব। কার কাছ থেকে কত পাবেন অথবা কাকে কত শোধ করতে হবে। যদিও পাওয়ার হিসাবটা খুব একটা পরিবর্তন করতে হয়নি কখনো তাকে। তার বিশ্বাসপ্রবণতার সুযোগ নিয়ে অনেকেই ঠকিয়ে গেছেন তাকে। তবুও তিনি খুব একটা হতাশা দেখাতেন না। বলতেন, 

“মুক্তোরামের তক্তারামে শুক্তোরাম খেয়ে বেশ আরামে আছি।”   

মুক্তারাম স্ট্রিটের মেস হাউস যেখানে শিবরাম থাকতেন
মুক্তারাম স্ট্রিটের মেস হাউস, যেখানে শিবরাম থাকতেন; Image Credit: Subhadip Mukherjee

শিবরামের জীবনের একটি ঘটনা থেকে তার রসিক এবং খেয়ালী ব্যক্তিত্ব আরো ভালোভাবেই বোঝা যায়। শিবরাম ছিলেন চাঁচলের রাজবাড়ির উত্তরসূরী। যদিও পৈত্রিক সম্পত্তিতে আগ্রহ ছিল না তার, তবুও একবার বন্ধুদের জোরাজুরিতে সম্পত্তির দাবিতে মামলা ঠোকেন তিনি। এবং রীতিমতো শিবরামীয় কায়দায়। নিজের পক্ষে কোনো উকিল নেই। তিনি নিজেই উকিল। আছেন কেবল এক সাক্ষী। আর সাক্ষীটি কে? যার বিরুদ্ধে মামলা ঠুকেছেন, স্বয়ং তিনিই। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন, সাক্ষী মিথ্যা বলবেন না। কিন্তু যথারীতি সাক্ষী নিজের পক্ষেই বলল এবং মামলার সেখানেই নিষ্পত্তি। এরকম আরো অসংখ্য খেয়ালীপনায় গড়া তার জীবন।

সামান্য কিছুকাল চাকরি করেছিলেন শিবরাম চক্রবর্তী। দেশবন্ধুর পত্রিকা ‘আত্মশক্তি’র সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। কিন্তু স্বভাবসুলভ অবহেলার কারণে চাকরি হারান তিনি। পরবর্তী সময়ে ‘যুগান্তর’ নামে নিজেই একটি পত্রিকা চালু করলেও ব্রিটিশ পুলিশের ভুল বোঝাবুঝিতে পুনরায় গ্রেফতার হন। এরপর আর চাকরিজীবনে যাননি শিবরাম। লেখালেখি নিয়েই কাটিয়ে দিয়েছেন বাকি জীবন।

সারাজীবন একাই কাটিয়েছেন শিবরাম, বিয়ে-থা করেননি। কথিত আছে, কৈশোরের বিচ্ছেদের ব্যথা থেকেই পরবর্তী জীবনে সংসারে জড়াননি তিনি। চাঁচলের রাজবাটিতে তিনি যখন বসবাস করছেন, তখন সেখানে এক এস্টেটের ডাক্তার সপরিবারে থাকতেন। সেই ডাক্তারের মেয়ে রিনি ছিলেন শিবরামের সমবয়সী। রিনিই ছিলেন শিবরামের প্রথম এবং একমাত্র প্রেম। পরবর্তী সময়ে কিশোরী রিনি বাবার সঙ্গে চাঁচল ছেড়ে কলকাতা চলে যায়। সেই বিচ্ছেদ থেকে নাকি আর কখনো সম্পর্কে জড়ানোর কথা ভাবেননি শিবরাম । রিনিকে বলেছিলেন, “আমার জীবনে তুই একমাত্র মেয়ে। তুই প্রথম আর তুই-ই শেষ”। কথা রেখেছিলেন শিবরাম।

আজীবন একাই থেকে গেলেন শিবরাম চক্রবর্তী
আজীবন একাই ছিলেন শিবরাম চক্রবর্তী; Image Source: Get Bengal

মূলত রম্যসাহিত্যিক হলেও সাহিত্যজগতে প্রবেশ করেছিলেন কবিতা দিয়েই। তৎকালীন সাহিত্য পত্রিকা ‘ভারতী’তে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কবিতা। পরে বেশ কিছু রাশভারি লেখা লিখলেও ধীরে ধীরে সমস্ত মনোযোগ দেন রম্যসাহিত্যেই। এছাড়াও লিখেছিলেন বেশ কিছু উপন্যাস, নাটক এবং প্রবন্ধ। এভাবেই তিনি গড়ে তোলেন এক বিশাল সাহিত্যের ভাণ্ডার। তবে ব্যক্তিজীবনের খেয়ালের প্রভাব পড়েছিল তার সাহিত্যকর্মেও। নিজের অনেক লেখাই সংরক্ষণ করে যাননি। ১৯২৯ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘মানুষ’ প্রকাশিত হয়। একই বছরে প্রকাশিত হয় আরেকটি কাব্যগ্রন্থ- ‘চুম্বন’। লিখেছেন ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ এবং ‘হাতির সাথে হাতাহাতি’-এর মতো অসাধারণ কিছু উপন্যাস। ‘ঈশ্বর পৃথিবী ভালোবাসা’ নামের স্মৃতিকথা গ্রন্থে তিনি লিখে গেছেন নিজের কথা। সৃষ্টি করেছেন হর্ষবর্ধন-গোবর্ধন, বিনি, ইতুর মতো স্মরণীয় কিছু চরিত্র। জীবনে সাহিত্য পুরস্কার ছিল হাতেগোনা কয়েকটি- মৌচাক পুরস্কার, আনন্দ পুরস্কার এবং মরণোত্তর বিদ্যাসাগর পুরস্কার। তবে এর চেয়েও বেশি যেটা পেয়েছেন, তা হলো ভক্তের ভালোবাসা।

শ্রেষ্ঠ শিবরাম -১ প্রচ্ছদ
শ্রেষ্ঠ শিবরাম; Image Source: Rokomari

এই খেয়ালী লোকটার শেষকাল কেটেছিল নিদারুণ কষ্টে। দেনা-পাওয়ার হিসাবে গরমিল থাকায় অর্থকষ্টে ভুগেছেন সারা জীবন। তবে প্রবীণ অবস্থায় তা প্রকট হয়ে ওঠে। নিজেই নিজের অবস্থা নিয়ে বলতেন,

“জিনিসপত্র সব বাঁধা হয়ে গেছে। এবার একটা ট্যাক্সি পেলেই চলে যাব।”

একসময় পশ্চিমবঙ্গ সরকার তার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নেয়। এ কষ্টেও নিজের জাত ভুলে যাননি তিনি। সর্বদা ছিলেন হাস্যমুখর। হঠাৎ একদিন প্রবল জ্বরে দুর্বল হয়ে বাথরুমেই সংজ্ঞা হারান তিনি। সারারাত পড়ে ছিলেন সেখানেই। পরদিন জানাজানি হলে তাকে ভর্তি করানো হয় হাসপাতালে। সেদিন ছিল ২৮ আগস্ট, ১৯৮০। এক পর্যায়ে ডাক্তার তাকে জিজ্ঞেস করেন,

“শিবরামবাবু, এখন কেমন লাগছে শরীর?”

জড়ানো গলায় উত্তর দেন,

“ফার্স্টক্লাস।”

তার পাঁচ মিনিট পরেই ‘ট্যাক্সি’ চেপে মৃত্যুলোকে রওনা হন শিবরাম চক্রবর্তী। এক অজানা রাজ্যে হারিয়ে যান হাসির রাজা শিবরাম।

বাংলা সাহিত্যের রম্যশাখার সাথে যদি কেউ পরিচিত হতে চায়, তবে তার সর্বপ্রথম উচিত শিবরাম পড়া। এত সহজেই আমাদের জীবনের খুব সাধারণ বিষয়গুলোকে নিয়ে হাস্যরস সৃষ্টি করতেন তিনি, তা সত্যিই অবিশ্বাস্য। শিবরাম চক্রবর্তী নিজে হয়তো ট্যাক্সিতে চেপে চলে গেছেন পরপারে, তবে তার জিনিসপত্র, সাহিত্যকর্ম ছড়িয়ে গেছেন আমাদের মাঝেই। এসবই তাকে বাঁচিয়ে রাখবে পাঠকদের অমলিন স্মৃতিতে।

Related Articles