অভিনেতা পল ওয়াকারের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে? মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান এই হলিউড অভিনেতা। মৃত্যুর পর তার নামে দাতব্য সংস্থা চালু হয়েছে। সেই সংস্থার অন্যতম সদস্য হচ্ছেন আরেক অভিনেতা ভিন ডিজেল। ফাস্ট অ্যান্ড ফিউরিয়াস সিনেমার চলচ্চিত্র সিরিজের সুবাদে তাদের দুজনের মধ্যে দারুণ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। সেই সম্পর্কের জেরেই পল ওয়াকারের মৃত্যুর পর তার নামে দাতব্য সংস্থাটি চালিয়ে নিচ্ছেন ভিন ডিজেল। এমন অনেক সুপারস্টারকে পাওয়া যাবে, যারা তাদের অভিনয় এবং বিলাসী জীবনের পাশাপাশি কাজ করে যাচ্ছেন সমাজের সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য। সমাজসেবক হিসেবে উজাড় করে দিচ্ছেন নিজেদের আয় করা অর্থ।
আমাদের বাংলাদেশেও এমন একজন অভিনেতা আছেন, যিনি বছরের পর বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছেন নিরাপদ সড়কের জন্য। যিনি প্রায় চার দশক ধরে উজ্জ্বল করে রেখেছিলেন বাংলা সিনেমার রূপালী পর্দা। অন্যদিকে পর্দার আড়ালে কিছুটা নিভৃতে কাজ করে গেছেন নিরাপদ সড়কের মতো একটি জনগুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যু নিয়ে। তিনি ইলিয়াস কাঞ্চন।
টিভি বা সিনেমা হলে যার অভিনয় দেখে মুহুর্মুহু করতালি বেজে উঠতো, বাস্তব জীবনে তিনিই দুই যুগের বেশি সময় ধরে মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন কোনোপ্রকার করতালির আশা না করেই। ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন নিয়ে গত ২৫ বছর ধরে পড়ে আছেন কেবল একটি স্লোগান, একটি স্বপ্নকে সামনে রেখে-
পথ যেন হয় শান্তির, মৃত্যুর নয়।
সংক্ষিপ্ত জীবনী
ইলিয়াস কাঞ্চনের জন্ম কিশোরগঞ্জ জেলায়; ১৯৫৬ সালের ২৪ ডিসেম্বর। কবি নজরুল কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু টম হ্যাংকস, ব্র্যাড পিটদের মতো তিনিও ইউনিভার্সিটি ড্রপ-আউট সুপারস্টারদের তালিকায় নাম লেখান। বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষে থাকার সময় ১৯৭৭ সালে সর্বপ্রথম চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। সুভাষ দত্ত পরিচালিত বসুন্ধরা চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে রূপালী পর্দায় তার অভিষেক ঘটে।
২য় বর্ষেই পড়াশোনার ইতি টেনে বাংলা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিকে দিয়ে গেছেন একের পর এক ব্যবসাসফল সিনেমা। তার অভিনীত বেদের মেয়ে জোসনা বাংলা চলচ্চিত্র ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যবসাসফল সিনেমা। তার বিপরীতে অভিনয় করেছেন চার দশক আগের নায়িকা ববিতা থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর নায়িকা পপি পর্যন্ত। বাংলা সিনেমা যখন অশ্লীলতার দায়ে মুখ থুবড়ে পড়তে শুরু করে, তখন তিনি ধীরে ধীরে সিনেমা জগত থেকে সরে আসেন। মনোনিবেশ করেন সমাজসেবা এবং রাজনীতিতে।
নিরাপদ সড়কের আন্দোলন
ইলিয়াস কাঞ্চন বিয়ে করেন ১৯৭৯ সালে; স্ত্রীর নাম জাহানারা কাঞ্চন। বিয়ের ১৪ বছর পার করে ফেলেছেন। ১৯৯৩ সালের ২২ অক্টোবর, বান্দরবনে সিনেমার শ্যুটিংয়ে ব্যস্ত ছিলেন ইলিয়াস কাঞ্চন। স্বামীর সিনেমার শ্যুট দেখতে ছেলে-মেয়ে জয় ও ইমাকে নিয়ে শ্যুটিং লোকশনের দিকে রওনা হন স্ত্রী জাহানারা। কিন্তু পথে পটিয়ার কাছাকাছি গিয়ে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি। তাদের দুই সন্তান বাবাকে দেখতে গিয়ে হারায় তাদের মাকে।
স্ত্রী হারানোর শোকে মুহ্যমান ইলিয়াস তখনই ঠিক করেন নিরাপদ সড়কের জন্য তাকে কিছু করে যেতে হবে। স্ত্রী হারানোর শোককে শক্তিতে পরিণত করে সে বছরের ১ ডিসেম্বর এফডিসি থেকে প্রেসক্লাব পর্যন্ত ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ স্লোগান নিয়ে পদযাত্রা করেন। সড়ক দুর্ঘটনা যেন আর কোনো সন্তানকে মায়ের বুক থেকে কেড়ে নিতে না পারে, সেজন্য নিরাপদ সড়কের দাবিতে শুরু হয় তার আন্দোলন। এই যাত্রায় সর্বস্তরের মানুষ ও নানা সামাজিক সংগঠনের অংশগ্রহণ তাকে অনুপ্রেরণা দেয় সামনে এগিয়ে যাবার। যায়যায় দিন পত্রিকার সম্পাদক শফিক রেহমানের পরামর্শে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনকে সাংগঠনিক রূপ দেবার কথা ভাবেন। পাশাপাশি ২২ দফা দাবিও উত্থাপন করেন।
শুধু ঢাকাতেই নয়, এরপর থেকে তিনি ঢাকার বাইরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নিরাপদ সড়ক চাই শীর্ষক পদযাত্রার আয়োজন করতে থাকেন। পাশাপাশি স্ত্রীর মৃত্যু দিবস ২২ অক্টোবরকে নিরাপদ সড়ক দিবস হিসেবে পালনের পক্ষে জনমত গঠন করতে থাকেন। ২০১১ সালে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে ২২ অক্টোবর নিরাপদ সড়ক দিবস পালনের সুপারিশ করা হয় এবং প্রধানমন্ত্রী এতে সম্মতিও দান করেন। কিন্তু মন্ত্রীসভায় বিল পাশ হবার পরও প্রজ্ঞাপন জারি হতে সময় নেয় কয়েক বছর। অবশেষে ২০১৭ সালের ১৪ জুন, মন্ত্রীপরিষদ বিভাগ কর্তৃক পরিপত্র প্রকাশের মাধ্যমে ২২ অক্টোবরকে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
রোহিঙ্গাদের পাশে
গত ২০১৭ সালে রাখাইন সম্প্রদায়ের নির্যাতনে মায়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পাশে ত্রাণ নিয়ে দাঁড়িয়েছেন এই মহানায়ক। শরণার্থী শিবিরে নিজে উপস্থিত থেকে দুই দফায় ত্রাণ বিতরণ করে দুঃস্থ এই মানুষগুলোর পাশে থেকেছেন। রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধের দাবি জানিয়ে জাতিসংঘে এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবর চিঠিও পাঠিয়েছিলেন তিনি।
সময়ানুবর্তীতা
যারা টিভি, সিনেমা বা মিডিয়াতে কাজ করেন তাদের প্রতি মানুষের ধারণা- তারা বুঝি সময়জ্ঞান খুব একটা মেনে চলেন না। কিন্তু ইলিয়াস কাঞ্চনের সহ-অভিনেতারা এবং তার সিনেমার পরিচালকেরা বলে থাকেন, তিনি বাস্তব জীবনে এবং শ্যুটিংয়েও সময়ানুবর্তী। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক কাজী হায়াত বলেন,
ইলিয়াস কাঞ্চন সেই নাম যার বিকল্প আজও খুঁজে পায়নি ইন্ডাস্ট্রি। তার মতো সময়জ্ঞান, নিয়ামুবর্তিতা আমি আমার চার দশকের ক্যারিয়ারে আর কোনো নায়কের মধ্যে দেখিনি।
একুশে পদক
গত ৪৩ বছরে যতজন নাট্য বা চলচ্চিত্র কুশীলব রাষ্ট্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সম্মাননা- একুশে পদক পেয়েছেন, তাদের মধ্যে সকলেই নাট্যকলা বা অভিনয় শিল্পী হিসেবে পদকটি পেয়েছেন। ব্যতিক্রম কেবল ইলিয়াস কাঞ্চন। দীর্ঘ চার যুগের সমৃদ্ধ চলচ্চিত্রে ক্যারিয়ার থাকার পরেও তিনি একুশে পদক পেয়েছেন সমাজসেবায়।
সম্প্রতি বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় দুই কলেজ শিক্ষার্থী মৃত্যুবরণ করলে সারা দেশের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে। হাতে হাত রেখে দাবি করে নিরাপদ সড়কের। পঁচিশ বছর আগে স্ত্রীকে হারিয়ে নিরাপদ সড়কের দাবিতে যে আন্দোলনের শুরু করেছিলেন ইলিয়াস কাঞ্চন, সেই একই দাবিতে এবার রাস্তায় নেমেছিল স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। এই আন্দোলনে ইলিয়াস কাঞ্চনের সমর্থন ছিল শতভাগ। পঁচিশ বছর আগে তিনি রাস্তায় নেমেছিলেন একার উদ্যোগে, এবার হাজার হাজার সাধারণ ছাত্র মেনেছে এই কাজে। এই স্কুল কলেজগামী ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন দেখে ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন,
আমি দীর্ঘদিন ধরে বলেছি, এক ইলিয়াস কাঞ্চনে হবে না, হাজার হাজার ইলিয়াস কাঞ্চন হতে হবে। আজকে লাখ লাখ ইলিয়াস কাঞ্চন রাস্তায়।
Feature Image- IMDB