২০১৮ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি ছিল বলিউডের এক শোকের দিন। হাজারো হৃদয়ের রানী, সবচেয়ে দীর্ঘ সময় জুড়ে পর্দায় রাজত্ব করা শ্রীদেবী সেদিন দুবাইতে শেষবারের মতো চোখ মুদলেন। তার আকস্মিক মৃত্যু বলিউডের ঝলমলে জগতকে শুধু হতবাকই করে দেয়নি, বরং তাঁর হাজারো ভক্তের হৃদয়ে বয়ে আনে মৃত্যুর অন্ধকার মেঘ, বিশেষত যারা আশি ও নব্বইয়ের দশকে হিন্দি সিনেমার ভক্ত ছিলেন। বর্তমান প্রজন্মের এই প্রতিভাবান ও প্রভাবশালী অভিনেত্রীর সাথে যতটা না পরিচয় আছে, তার চেয়ে অনেক বেশি শ্রীদেবীর নাম ও প্রতিভার সাথে পরিচয় এর আগের প্রজন্মের, নাগিন আর মি. ইন্ডিয়া দেখে যারা বড় হয়েছেন তাদের। নায়কের প্রাধান্যভিত্তিক ভারতের সিনেমার জগতে নায়িকার জয়জয়কারের এক নতুন পরম্পরা শুরু হয় এই অসামান্য সুন্দরীর হাত ধরে। তার মৃগনয়না মুখের চঞ্চল হাসি আর পোশাকের দারুণ নির্বাচন নব্বইয়ের দর্শকের হৃদয়ে যেন মি. ইন্ডিয়ার গানের মতো আসলেই বিজলি হয়ে পড়তো। আর এই দুটোর সাথে যখন যোগ হয় অভিনয়ের আজন্ম প্রভিভা, তখন রাজত্ব তো এই রানীর হবেই, নয় কি?
বলিউডের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘসময় পর্দায় নায়িকা হয়ে বাজিমাত করতে থাকা এই নায়িকার অভিনয়ের জীবন কিন্তু শুরু হয় একদম ছোট্টবেলা থেকেই। তারপর থেকে জীবনের মোড়গুলোও কিন্তু তাঁর জন্য সিনেমার জগতের চেয়ে কম ঝলমলে আর রোমাঞ্চকর ছিলো না। সুবিশাল সাফল্য, পর্দার জগতে সেই সময় একজন নায়িকার জন্য সম্ভবত সর্বোচ্চ নামডাক ও জনপ্রিয়তা, একের পর এক সর্বোচ্চ পুরস্কার, আলোচনা-সমালোচনায় ভরপুর ব্যক্তিগত জীবন ও প্রেম, প্রণয় শেষে পরিণয়, দীর্ঘ এক দশকের বিরতির পরেও প্রথম কোনো নায়িকার আবার পর্দায় প্রধান চরিত্রে সবচেয়ে জমকালোভাবে ফিরে আসা আর সবশেষে নিজের সমস্ত গরিমা নিয়ে আকস্মিক বিদায়- রোমাঞ্চকর কোনো সিনেমার কী নেই তার জীবনে? চলুন কিংবদন্তি এই নায়িকার জীবনের অলিগলি থেকে ঘুরে আসি।
আজীবন নিরামিষাশী শ্রীদেবীর জন্ম ভারতের মাদ্রাজে ১৯৬৩ সালের ১৩ আগস্ট। শ্রীদেবী নামেই জগতে পরিচিত হলেও জন্মগতভাবে তার প্রকৃত নাম শ্রী আম্মা ইয়াগার আইয়াপ্পা। বাবা ছিলেন তামিলনাড়ুর বাসিন্দা আইয়্যিপা আর তেলেগু মায়ের নাম রাজেশ্বরী। দুই সৎ ভাই আর নিজের এক বোনের সাথে কাটে এই নায়িকার শৈশব। ছেলেবেলায় যে বয়সে আর দশটা শিশু স্কুলের ব্যাগ নিয়ে ছোটাছুটি করে, সেই বয়স থেকেই শ্রীদেবী জুড়ে যান অভিনয়ের জগতের সাথে। স্কুলে আসা-যাওয়ার চেয়ে অভিনয়ের মঞ্চে আসা-যাওয়াতেই তার শৈশবের বেশিরভাগ কাটে। সেই থেকেই শুরু এই নক্ষত্রের পথচলা।
মাত্র চার বছর বয়সে ১৯৬৯ সালে অভিনয় করেন তামিল সিনেমা ‘থুনায়ভান’তে। এরপরে শিশু শিল্পী হিসাবে আরো অনেক তামিল, তেলেগু, মালায়ালাম আর কান্নাডা সিনেমায়। বলিউডে তাঁর অভিষেক ঘটে শিশুশিল্পী হিসাবে ‘রানী মেরা নাম’ সিনেমাতে। মাত্র তেরো বছর বয়সে তিনি প্রথম অভিনয় করেন প্রথম সারির চরিত্রে, এই ত্রিকোণ প্রেমের গল্পে কলেজ পড়ুয়া মেয়ে হিসাবে। তামিল ও তেলেগু সিনেমাতে নায়িকা হিসাবে ব্যাপক জনপ্রিয়তার পরে ১৯৭৯ সালে ‘সোলভা সায়ান’ সিনেমার মাধ্যমে নায়িকা হিসাবে তার যাত্রা শুরু হয় এবং ১৯৮৯ সালে ‘হিম্মতওয়ালা’ সিনেমার মাধ্যমে সবার নজরে আসেন। এরপর তার গল্পটা কেবল সফলতার এবং একের পর এক সিনেমার পর্দা কাপানো গল্প। তার ব্যবসাসফল সিনেমার তালিকায় যোগ হতে থাকে একের পর এক নাম- ‘মাওয়ালি’, ‘তোহফা’, ‘নায়া কাদম’, ‘মাকসাদ’, ‘মাস্টারজি’, ‘নাজরানা’, ‘মি.ইন্ডিয়া’, ‘ওয়াক্ত কি আওয়াজ’, ‘চাঁদনী’ আরো কত কী! ‘চাঁদনী’ আর ‘মি. ইন্ডিয়া’ সিনেমাতে শ্রীদেবীর লাবণ্যময়ী উপস্থাপনা সে সময়ের দর্শকের মনে এক স্থায়ী মোহনীয়তার সৃষ্টি করে।
এরপরের গল্পটা আরো বেশি উজ্জ্বল, আরো বড়ো সফলতার গল্প। ‘নাগিনা’, ‘সাদমা’, ‘চালবাজ’, ‘খুদা গাভাহ’, ‘লামহে’, ‘গুমরাহ’, ‘লাডলে’ আর ‘জুদাই’য়ের মতো সিনেমাগুলো শ্রীদেবীর নাম ভারতের চলচ্চিত্র জগতে যেন রূপালী অক্ষরে লিখে দেয়। শ্রীদেবীই প্রথম নায়িকা হিসাবে এই জগতে এতো দীর্ঘস্থায়ী স্থান দখল করে রাখেন। সেই সাথে তিনি নিজের ঝুলিতে নিয়ে আসেন প্রচুর স্বীকৃতি, সম্মান আর জনপ্রিয়তা। আফগানিস্তানে শুটিং হওয়া এক আফগানি মেয়ের প্রেমের গল্প নিয়ে নির্মিত ‘খুদা গাভাহ’ এখনো আফগানিস্তানে সবচেয়ে জনপ্রিয় সিনেমাগুলোর একটি। ‘জুদাই’ সিনেমাতে তাঁর অসাধারণ অভিনয় নিয়ে চলচ্চিত্র পত্রিকা ‘বলি স্পাইস’ মন্তব্য করে, “তার ঝাঁঝালো অভিনয় প্রতিভা চরিত্রটির সবটুকু লোভ আর চারিত্রিক গুণাবলি সম্পূর্ণভাবে বের করে এনেছে”। এই সিনেমাটিই শ্রীদেবীকে তার অষ্টম ফিল্মফেয়ার পুরষ্কার এনে দেয়। এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০০টিরও অধিক সিনেমায় অভিনয় করেন শ্রীদেবী।
অভিনয় জগতে তার এই দৃঢ় পদচারণা তাকে এনে দিয়েছে আটটি ফিল্মফেয়ার পুরষ্কার সহ অসংখ্য পুরষ্কার। ২০১৩ সালে ভারত সরকারের কাছ থেকে পান দেশটির চতুর্থ সর্বোচ্চ নাগরিক পুরষ্কার ‘পদ্মশ্রী’। আরো আটবার ফিল্মফেয়ার পুরষ্কারের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। তামিলনাড়ু রাজ্যের সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র পুরষ্কারসহ তিনি ভূষিত হয়েছেন আরো প্রায় একুশটি পুরষ্কার ও সম্মাননাতে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখ্যযোগ্য ২০১৩ সালে কেরালা সরকার ও ভারতের রাষ্ট্রপতির কাছে থেকে পাওয়া পৃথক দুটি সম্মাননা। ২০১৩ সালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন,
“স্কুলে বা কলেজে যাওয়ার পরিবর্তে একসময় শুটিং স্থানে আমার আসা- যাওয়া নিয়মিত হয়ে গেলো। শিশুশিল্পী থেকে সরাসরি নায়িকা হিসাবে অভিনয় করতে শুরু করলাম আর আমি অন্য কিছু চিন্তা করার সুযোগও পেলাম না। আমার অবশ্য এগুলোর জন্য কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত।”
তার এই উঠে আসার পেছনে তার পরিবারের অবদানও কিন্তু কম নয়। জানা যায়, ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত শ্রীদেবীর মা বা বড় বোন কেউ একজন সব সময় তার সাথে শুটিংয়ের স্থানে আসতেন। অবশ্য এই ঘটনা থেকে আরো একটি কথা বোঝা যায় যে, রক্ষণশীল মায়ের যথেষ্ট প্রভাবের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তাকে।
সিনেমার মতোই তার ব্যক্তিগত জীবন দারুণ ঘটনাবহুল আর তা একসময় পত্রিকার পাতায় আর আলোচনায় ভালোই স্থান দখন করে। তখনো তিনি তামিল আর তেলেগু সিনেমাগুলোরই নিয়মিত নায়িকা। প্রযোজক বনি কাপুর এক তামিল সিনেমায় শ্রীদেবীকে দেখে মুগ্ধ হয়ে যান। তিনি চেন্নাইতে নায়িকার বাসা পর্যন্ত ছুটে যান কিন্তু শ্রীদেবী সিংগাপুরে থাকায় ভগ্নহৃদয় নিয়ে ফিরে আসেন। ১৯৭৯ সালে ‘সোলা সায়ান’ দেখার পর বনি সরাসরি শ্রীদেবীর সাথে দেখা করতে তার শুটিংয়ের স্থানে ছুটে যান। অন্তর্মুখী নায়িকা তখন বনিকে তার মায়ের সাথে কথা বলতে বলেন, যিনি অভিনয়ের জন্য বনির কাছে সেসময় প্রায় দশ লাখ রুপি দাবি করেন। সবাইকে অবাক করে দিয়ে বনি ১১ লাখ রুপি পারিশ্রমিক দিতে রাজি হন। শ্রীদেবীর মা কিন্তু এতে বনির প্রতি বেশ ভালো মনোভাবই পোষণ করেন। পরবর্তীতে বনি স্বীকার করেছেন যে, এই সবই তিনি করেছেন শ্রীদেবীর কাছাকাছি থাকার জন্য। বনি কাপুর প্রথম দর্শনেই শ্রীদেবীর প্রেমে পড়ে গেলেও শ্রীদেবী কিন্তু বেশ সময় নেন তার সিদ্ধান্ত নিতে। বনি কাপুর তখন বিবাহিত আর দুই সন্তানের জনক। বলতেই হবে, শ্রীদেবীর জন্য এই পদক্ষেপ নেওয়াটা মোটেও সহজ ছিলো না।
মি.ইন্ডিয়া সিনেমার শুটিং চলাকালীন শ্রীদেবী বনি কাপুরের প্রতি আস্তে আস্তে আকৃষ্ট হতে শুরু করেন। বনি নিজে নায়িকার সকল প্রয়োজন আর সুবিধার দিকে নজর রাখতেন। এমনকি ওই সময়েই নায়িকার জন্য আলাদা মেকআপ রুম গঠন করা হয়। পরবর্তী সিনেমা ‘চাঁদনী’ শুটিংয়ের সময় বনি নায়িকার সাথে সুইজারল্যান্ড ভ্রমণ করেন এবং ফিরে এসে নিজেই স্ত্রী মোনা কাপুরকে এই ব্যপারে বলেন। শ্রীদেবীকে সেই সময় অন্যের ঘর ভেঙে দেওয়া এক নারী হিসাবে দেখা হতো, আলোচনা-সমালোচনা হতো। শ্রীদেবী নিজেই বলেন,
“আমিও একসময় তাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম, যদিও তা মেনে নেওয়া ছিলো আমার জন্য কঠিন এবং যন্ত্রণাদায়ক। তাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিতে আমার কয়েক বছর সময় লাগে। কিন্তু একসময় আমি বুঝলাম তিনিই আমার জীবনের স্বপ্নের পুরুষ আর আমি আসলেই সুখী তার সাথে। আমি আনন্দিত যে আমি তা বুঝতে পেরেছিলাম।”
১৯৯৬ সালে তারা গাঁটছড়া বাঁধেন। তাদের দুই কন্যা আছে- খুশি আর জাহ্নবী।
বিয়ের পরপরই বলিউডের এই রানী প্রায় ১৫ বছর অভিনয় জগত থেকে বিরতি নেন। কিন্তু এরপর ‘ইংলিশ ভিংলিশ’ সিনেমার মাধ্যমে আবার যখন ফিরে আসেন, তা যেন আসলেই রানীর মতোই হয়। ব্যবসায়িকভাবে সফল ২০১২ সালের এই সিনেমার পর তিনি আসেন ‘মম’ সিনেমাতে, প্রমাণ করেন যে সময় তার প্রতিভাকে একটুও ম্লান করতে পারেনি।
এই কিংবদন্তির জীবনের গল্প বলতে গেলে বলতে হয় আরো দুটি দুঃখজনক ঘটনার কথা। ১৯৯৫ সালে ব্রেইন টিউমারের অস্ত্রোপচার পরবর্তী জটিলতায় তার মা মারা যান। চিকিৎসক ভুল করে যেদিকে টিউমার তার বিপরীত দিকে অস্ত্রোপচার করে মস্তিষ্কের দৃষ্টি ও স্মৃতির অংশ নষ্ট করে ফেলেন। আমেরিকার গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে এই ঘটনা আলোচিত হয় এবং পরবর্তীতে এক সফল আইনি লড়াইয়ের পরে রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটন হাসপাতালের চিকিৎসা আর অস্ত্রোপচারের ভুলত্রুটি সবার সামনে প্রকাশিত করার আইন পাস করতে বাধ্য হয়। ২০১২ সালে শ্রীদেবী আমির খানের সামাজিক কল্যাণমূলক অনুষ্ঠান ‘সত্যমেব জয়তে’তে আসেন শিশু যৌন নিপীড়নের ভুক্তভোগী হিসাবে। তার যোগদান প্রমাণ করে, সমাজের সর্বক্ষেত্রে এই ব্যাধি কতটা ছড়িয়ে পড়েছে।
এই বর্ণাঢ্য জীবনের অবসান ঘটিয়ে কয়েকদিন আগে তিনি পারাপারে পাড়ি জমান। প্রথমে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছেন বলে ধারণা করা হলেও ময়নাতদন্তের পর জানা যায়, হোটেলের বাথটাবে ডুবে আকস্মিক মৃত্যু হয়েছে তার। শরীরে অ্যালকোহলের উপস্থিতিও পাওয়া গেছে বলে জানা যায়। এক আত্মীয়ের বিয়েতে যোগ দিতেই তিনি স্বামী ও কন্যাসহ দুবাই যান। বিয়ে শেষে সবাই ফিরে আসলেও তিনি পরিবারসহ আরো কিছুদিন থেকে যেতে চান। তার মৃত্যুর এই ঘটনার কথা বিভিন্ন গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার হলেও পুরো ব্যাপারটা নিয়ে এখন সন্দেহের কুন্ডলীও কম নয়।
শ্রীদেবী চলে যাওয়ার সাথে তার জীবন সম্পর্কিত আরো অনেক প্রশ্নই কিন্তু এখন মাথা নাড়া দিয়ে উঠছে। সত্যিই কি এই অত্যন্ত জনপ্রিয় নায়িকা ব্যক্তিজীবনে ততটাই সুখী ছিলেন, যতটা বাইরে থেকে দেখা যেতো? তার পেশাগত ও ব্যক্তিজীবনে মায়ের নেওয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্তের জন্য কি অভিমান জমেনি কখনো তার মনে? হাজারো পুরুষের কামনার এই নারীর কি তার ভালোবাসা আর বিয়ের অসঙ্গতি নিয়ে কোন ক্ষোভ জমে ছিলো মনে শেষ পর্যন্ত? এই সকল প্রশ্নের উত্তর অসম্পূর্ণ রেখে তিনি চলে গেছেন পার্থিব জীবনের অনেক উর্ধ্বে। কিন্তু চলে গেলেও তার প্রতিভা আর ব্যক্তিত্বের সাক্ষর থেকে যাবে বিনোদনের ঝলমলে জগতে আর লাখো ভক্তের হৃদয়ে।
ফিচার ইমেজ: funniestindia.com