FBI এজেন্ট ক্লারিস স্টার্লিং মনিটরের দিকে ঝুঁকে আছেন। তার সময়টা তেমন ভালো যাচ্ছে না। একাডেমির অন্য এজেন্টদের তুলনায় তার রেজাল্ট ছিল ঈর্ষণীয়। অনেক স্বপ্ন নিয়ে তিনি FBI-তে নিজের নাম লিখিয়েছেন। ক্যারিয়ারের শুরুটাও হয়েছিলো দারুণ। কিন্তু এরপরেই ঘটে বিপত্তি। একের পর এক অভিযানে ব্যর্থ হতে থাকেন তিনি। ঘটনাস্থলে অপরাধীকে গুলি করে হত্যা করার রেকর্ডে সবার আগে উঠে এসেছে তার নাম। ব্যাপারটা মোটেও সুখকর নয়। তাই এবার তিনি যথেষ্ট সতর্ক।
কয়েক সেকেন্ড পর মনিটরের পর্দা নীল হয়ে গেলো। সেখানে যান্ত্রিক ফন্টে লেখা একটি ইংরেজি বাক্য ভেসে উঠলো- Baltimore State Forensic Hospital। এরপর দেখা গেলো হাসপাতালের একটি কক্ষ। সেখানে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ড. হ্যানিবল লেক্টারকে বেঁধে রাখা হয়েছে। নিষ্পাপ শিশুর মতো শান্ত হয়ে আছেন তিনি। একটু পর দৃশ্যপটে একজন নার্সের আগমন ঘটলো। তিনি খুব মনোযোগ সহকারে রোগীকে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চলছিলো। নার্স তার পর্যবেক্ষণ শেষে মাথা নিচু করে রিপোর্ট লেখা শুরু করলেন। ঠিক তখন হঠাৎ করে আবদ্ধ হ্যানিবল হিংস্র পশুর মতো সামনে ঝুঁকে খপ করে নার্সের গাল কামড়ে ধরলেন। মনিটরের সামনে বসা ক্লারিসের মুখ সামান্য হাঁ হয়ে গেলো। এরপর সেখানে আরো কয়েকজন নিরাপত্তা কর্মীর আগমন ঘটে। সবাই টেনেহিঁচড়ে হ্যানিবলকে আলাদা করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু হ্যানিবল কিছুতেই নার্সকে ছাড়ছেন না। একজন কর্মী হ্যানিবলের মাথায় জোরে আঘাত করলেন। জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন নরখাদক হ্যানিবল।
উপরের ঘটনাটুকু ২০০১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত হ্যানিবল সিরিজের দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ‘Hannibal’-এর একটি বিখ্যাত দৃশ্য। এখানে উন্মাদ নরখাদক ড. হ্যানবল লেক্টার চরিত্রে অভিনয় করেছেন কিংবদন্তি অভিনেতা অ্যান্থনি হপকিন্স। এই সিরিজের প্রথম চলচ্চিত্র ‘The Silence of the Lambs’-এ একই চরিত্রে অসাধারণ অভিনয়ের মাধ্যমে পুরো পৃথিবীকে এক অনবদ্য ভিলেন উপহার দিয়েছেন তিনি। মুভিপাড়া যখন হ্যানিবলের প্রশংসায় পঞ্চমুখ, তখন অস্কার কমিটিও তাকে হতাশ করেননি। ১৯৯২ সালের অস্কারের আসরে সেরা অভিনেতা হিসেবে সম্মানজনক অ্যাওয়ার্ডটি নিজের করে নেন তিনি।
জন্ম এবং শৈশবকাল
১৯৩৭ সাল একদম শেষের দিকে। আর কিছুক্ষণ পরেই ওয়েলসের আকাশ আতশবাজির আলোতে রঙিন হয়ে যাবে। শুরু হবে নতুন একটি বছর। ঠিক এরকম একটা সময়ে রিচার্ড হপকিন্স ও অ্যানি মুরিয়েলের ঘর আলো করে জন্ম নেয় একটি শিশু। তার নাম রাখা হয় ফিলিপ অ্যান্থনি হপকিন্স। এরপর মা-বাবার আদরে ধীরে ধীরে বড় হতে থাকেন শিশু অ্যান্থনি। একটা সময় তাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়া হয়। ২০০২ সালে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস আয়োজিত একটি টকশোতে যখন অ্যান্থনিকে তার স্কুল জীবন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়, তিনি তখন মুচকি হাসি দিয়ে বললেন,
“আমি ছাত্র হিসেবে খুব খারাপ ছিলাম। একটা সময় আমি বুঝতে পারলাম যে আমি একটা নির্বোধ। তবে আমি একটা কাজ খুব দারুণভাবে পারতাম। সেটা হচ্ছে দোয়াতের কালি পান করে ফেলা”।
পড়াশোনায় মন বসতো না কিশোর অ্যান্থনির। তাই তিনি সারাদিন রঙিন ছবি আঁকতেন। কিন্তু একটা সময় তিনি পিয়ানোর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। তখন অ্যান্থনি স্বপ্নে দেখতেন, তিনি বিশাল জনতার সামনে বসে কনসার্টে পিয়ানো বাজাচ্ছেন। ১৫ বছর বয়সে তার পরিচয় হয় রিচার্ড বার্টন নামক এক অভিনেতার সাথে। বার্টনের সান্নিধ্যে এসে অ্যান্থনির চিন্তাধারা বদলে যায়। কিছুদিন পর তিনি অভিনেতা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। ভর্তিও হয়ে যান Royal Welsh College of Music and Drama-তে। সেখানে যত্নের সাথে তিনি অভিনয় শিখতে থাকেন। তার স্কুল জীবনের বিষণ্ণতার অনেকটাই এখানে দূর হয়ে যায়।
এরপর ১৯৬০ সালে অভিনয় ছেড়ে দু’বছরের সাময়িক বিরতিতে যোগ দেন সামরিক বাহিনীতে। সেখান থেকে ফিরে এসে Royal Academy of Dramatic Art in London-এ যোগদান করেন। এর মাধ্যমেই অভিনেতা হওয়ার পথে যাত্রা শুরু হয় তার।
অভিনয়ে হাতেখড়ি
অ্যান্থনি হপকিন্সের অভিনয়ে হাতেখড়ি হয় ১৯৬০ সালের দিকে। ইংল্যান্ডের সোয়ানসি প্যালেস থিয়েটার আয়োজিত ‘Have a Cigarette’ নামক মঞ্চনাটকে তিনি অভিনয় করেন। তারপর সামরিক বাহিনী থেকে ফেরত আসার পরে ১৯৬৫ সালের দিকে তিনি Royal National Theatre-এ লরেন্স অলিভিয়ার নামক এক বিখ্যাত অভিনেতার সহকারী হিসেবে যোগদান করেন। লরেন্স অলিভিয়ার ১৯৪৯ সালে কালজয়ী সিনেমা ‘Hamlet’-এ অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেতা হিসেবে অস্কার লাভ করেছিলেন। অলিভিয়ারের দীক্ষায় তিনি অভিজ্ঞ অভিনেতা হয়ে উঠেন। কিন্তু তখনও তাকে মঞ্চে অভিনয়ের কোনো সুযোগ দেয়া হয়নি।
১৯৬৭ সালের কথা। ন্যাশনাল থিয়েটারে ‘The Dance of Death‘ নামক একটি নাটকের জন্য অলিভিয়ারকে প্রস্তাব দেয়া হলো। নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার দিন সকালে অলিভিয়ার অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রোডাকশন হাউজের মাথায় হাত! এখন কী উপায়?
অসুস্থ অলিভিয়ার নিরুপায় হয়ে তার সহকারী অ্যান্থনিকে ডেকে পাঠালেন। তারপর সরাসরি বলে দিলেন যে, আজকের নাটকে তার অংশটুকু অ্যান্থনি অভিনয় করবে। এই প্রস্তাবে অ্যান্থনি হতবাক হয়ে গেলেন। শত শত গণ্যমান্য দর্শকের সামনে এত কম প্রস্তুতি নিয়ে অভিনয় করা চাট্টিখানি কথা নয়। তিনি অনেক অনুনয় বিনয় করতে লাগলেন। কিন্তু অলিভিয়ার তার কোনো কথা শুনলেন না। তাকে কাছে ডেকে বললেন,
“ভয় হচ্ছে করুণার মতো। তুমি হয়তো ভাবছো লোকে কী বলবে! কিন্তু সেটাতে কি আদৌ তোমার কিছু আসে যায়? উত্তরটা ‘না’ হলে আজকে বাজিমাত করে দিয়ে আসো”।
অ্যান্থনি তখন রাজি হয়ে গেলেন। এরপর যেভাবে অভিনয় করলেন, তা এক কথায় বলা যায়, ‘এলেন, দেখলেন, জয় করলেন’। লরেন্স অলিভিয়ারের ব্যক্তিগত ডায়েরিতে লেখা ছিল,
“একটি বিড়াল যেভাবে মুখে করে ইঁদুর নিয়ে হেঁটে চলে যায়, সেভাবেই এডগার চরিত্রটি নিজের করে নিয়ে গেলেন অ্যান্থনি হপকিন্স”।
ডেইলি টেলিগ্রাফের এক সাক্ষাৎকারে তিনি সেদিন সম্পর্কে মন্তব্য করেন,
“অভিনয় করতে গিয়ে জীবনে একবারই ভয় পেয়েছিলাম। এরপর আর কখনো ভয় লাগেনি”।
এরপর নিয়মিত মঞ্চে নাটক করতে থাকেন তিনি। দেখতে দেখতে ইউরোপের বুকে টেলিভিশনের চল শুরু হলো। অ্যান্থনি হপকিন্স প্রস্তাব পেলেন টেলিভিশনের নাটকে অভিনয় করার। ১৯৬৭ সালে তিনি ‘A Flea in Her Ear‘-এ অভিনয় করেন। পরের বছর তিনি কালজয়ী অভিনেত্রী ক্যাথেরিন হেপবার্নের সাথে ‘The Lion in Winter‘ নামক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। এর মাধ্যমে সিনেমা জগতে অভিষেক হয় অ্যান্থনি হপকিন্সের। অ্যান্থনি হপকিন্স এ ব্যাপারে স্মৃতিচারণ করে বলেন,
“তিনি একজন শক্তিমান অভিনেত্রী। তার প্রতি আমার যথেষ্ট শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে। আমি তখন প্রচুর মদ্যপান করতাম। তিনি সবসময় আমাকে দেখলেই বিরক্ত হয়ে বলতেন যে, আমার মদ্যপান করা উচিত নয়। আমি আমাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছি যা তার মোটেও পছন্দ হচ্ছে না”।
এরপর তিনি বিবিসি প্রযোজিত ‘War and Peace‘ মিনি সিরিজেও অভিনয় করেন।
১৯৭৫ সাল অ্যান্থনি হপকিন্সের জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সে বছর তিনি মদ্যপান করা ছেড়ে দেন। নতুন একজন অ্যান্থনির জন্ম হয়। যদিও অ্যান্থনি হপকিন্স টিভি নাটকে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন, কিন্তু তিনি এতে সন্তুষ্ট থাকতে পারলেন না। তার চোখে তখন বিশ্ববিখ্যাত হওয়ার স্বপ্ন। শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়।
The Elephant Man এবং একটি নতুন সূচনা
১৯৭৭ সালে অ্যান্থনি হপকিন্স তার সাবেক নিয়োগকর্তা লরেন্স অলিভিয়ারের সাথে ‘A Bridge Too Far‘ নামক সিনেমায় অভিনয় করেন। তার অসাধারণ অভিনয়শৈলী বড় বড় পরিচালকদের নজর কাড়ে। পরিচালক ডেভিড লিঞ্চ তার পরবর্তী সিনেমা ‘The Elephant Man‘-এ অভিনয়ের জন্য অ্যান্থনিকে প্রস্তাব দেন। অ্যান্থনি হপকিন্স সেই সিনেমায় ‘ফ্রেডেরিক ট্রেভেস’ চরিত্রে অভিনয় করেন। সিনেমায় মূল চরিত্রে অভিনয় করেন কিংবদন্তি অভিনেতা জন হার্ট। এই সিনেমার অভিজ্ঞতা অ্যান্থনির অভিনয় জীবনে অনেক বড় ভূমিকা পালন করেছিলো। সিনেমার একটি দৃশ্যে অ্যান্থনির কান্নার অভিনয় করার কথা ছিল। তিনি সেই দৃশ্যে তার অসুস্থ পিতার কথা স্মরণ করে কেঁদেছিলেন। তার এক চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রু পুরো দৃশ্যটি অনেকটাই বাস্তবসম্মত করে তুলেছিলো। পরবর্তীতে সিনেমাটি বিশ্বজুড়ে সমাদৃত হয়।
তারপর ১৯৮৪ সালে মেল গিবসনের সাথে ‘The Bounty‘ সিনেমায় অভিনয় করেন। ‘Othello‘,’The Hunchback of Notre Dame‘ সহ বিভিন্ন নাটকে অভিনয় করে তিনি তখন অনেকটাই পরিচিত মুখ। ‘The Elephant Man’ এর বন্ধুসুলভ ডাক্তারকে দেখলেই সবাই মুচকি হাসি দিয়ে অভিবাদন জানাতো। কিন্তু তার সেই ভদ্ররূপ আর বেশিদিন টিকতে পারলো না। পরিচালক জোনাথান ডেমে তাকে ডেকে পাঠালেন। পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, এবার তার ভদ্রতার মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা নরখাদকের বের হবার পালা। সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন অ্যান্থনি। শুরু হলো আরেক নতুন অধ্যায়।
নরখাদক ডক্টর হ্যানিবল লেক্টার
ইতোমধ্যেই থমাস হ্যারিস রচিত উপন্যাস ‘The Silence of the Lambs’ বইপোকাদের কাছে সমাদৃত হয়েছে। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র উন্মাদ নরখাদক ডক্টর হ্যানিবল চরিত্রটি হররপ্রেমীদের নিকট জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলো। তাই পরিচালক জোনাথান ডেমে কিছুটা চিন্তায় পড়ে যান। পাঠকদের চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য রেখে হ্যানিবলকে চিত্রায়িত করতে না পারলে পুরো প্রজেক্টটাই ভেস্তে যাবে। তাই অনেক চিন্তা-ভাবনার পর তিনি অ্যান্থনি হপকিন্সকেই পছন্দ করলেন হ্যানিবল হিসেবে।
নির্দিষ্ট সময়ে সিনেমার শুটিং শেষ হলো। ১৯৯১ সালে মুক্তির পর দর্শকসারিতে বসা অ্যান্থনির সহকর্মীরাও অবাক হয়ে গেলেন। এ কোন অ্যান্থনি! নিতান্ত ভদ্রমানুষ অ্যান্থনি অত্যন্ত সাবলীলভাবে অভিনয় করলেন হ্যানিবল চরিত্রে। দেখে মনে হচ্ছিল যেন হপকিন্স বাস্তব জীবনেও উন্মাদ হ্যানিবল। এই হ্যানিবল চরিত্রটি অ্যান্থনি হপকিন্সের জীবনের সেরা অর্জন। কিছুদিনের মধ্যেই হ্যানিবল চরিত্রটি চলচ্চিত্রের ইতিহাসের অন্যতম আলোচিত খলচরিত্র হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। দর্শক, সমালোচক সবার নিকট ভূয়সী প্রশংসা পান তিনি। ১৯৯২ সালের অস্কারের মঞ্চেও তখন হ্যানিবলের জয়জয়কার। অ্যান্থনি হপকিন্স জিতে নেন সেরা অভিনেতার পুরষ্কার। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার পুরষ্কার পান পরিচালক জোনাথান ডেমে। তিনি সেরা পরিচালকের পুরষ্কার জিতে নেন। পরবর্তীতে জোনাথান ডেমে এবং অ্যান্থনি হপকিন্সের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে এই সিনেমার অভিনয় নিয়ে অনেক রোমাঞ্চকর তথ্য বেরিয়ে আসে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু মজার তথ্য তুলে ধরা হলো-
- সিনেমার এক দৃশ্যে অ্যান্থনি হপকিন্স জুডি ফস্টারকে তার উচ্চারণ নিয়ে কটাক্ষ করেন যা স্ক্রিপ্টে উল্লেখ করা ছিল না। তখন জুডি রেগে গিয়ে উল্টো কটাক্ষ করেন হ্যানিবলকে। পুরো দৃশ্যটি পরিচালকের খুব পছন্দ হয়ে যাওয়ায় সেটি আর বাদ দেয়া হয়নি।
- প্রথমবার ক্লারিসের আগমনের পর হ্যানিবল নাক দিয়ে অদ্ভুত শব্দ করেছিলেন। দর্শকদের নিকট জনপ্রিয়তা পাওয়া এই পুরো অংশটি ছিল অ্যান্থনি হপকিন্সের নিজস্ব উদ্ভাবন।
- সিনেমা মুক্তির পর ভক্তরা তাকে দেখলেই অনুরোধ করতো একবার হ্যানিবলের মতো ঠাণ্ডা গলায় “হ্যালো ক্লারিস” বলার জন্য। তবে অ্যান্থনি এই অনুরোধ হেসে উড়িয়ে দিতেন।
- অ্যান্থনি শৈশবে এক ডেন্টিস্টকে মারাত্মক ভয় পেতেন। তার সাদা পোশাক দেখলেই তার ভয়ে রক্ত হিম হয়ে যেত। সেই ভয়াল স্মৃতি থেকেই তিনি পরিচালক জোনাথানকে অনুরোধ করেন যেন তাকে বাল্টিমোর হাসপাতালের দৃশ্যে কয়েদি হিসেবে কমলার বদলে সাদা রঙের পোশাক দেয়া হয়।
- একমাত্র হরর সিনেমা হিসেবে অস্কারজয়ী সিনেমা ‘The Silence of the Lambs’.
- অ্যান্থনি হপকিন্স পুরো সিনেমায় মাত্র ২৪ মিনিট ৫২ সেকেন্ড অভিনয় করেছিলেন। এর চেয়ে কম সময় অভিনয় করে এর আগে মাত্র একজন অস্কার লাভ করেছিলেন।
- জুডি ফস্টার সিনেমায় অভিনয়ের আগে প্রায় দু’মাস FBI এজেন্ট ম্যারি ক্রাউসের সাথে চলাফেরা করেছিলেন।
- পুরো সিনেমায় সংলাপ বলার সময় অ্যান্থনি হপকিন্স একবারের জন্যও চোখের পাতা ফেলেননি।
পরবর্তীতে তিনি ‘হ্যানিবল লেক্টার’ চরিত্রে আরো দুটি সিনেমায় অভিনয় করেন। প্রতিবার তার কণ্ঠে “হ্যালো ক্লারিস” শোনার আকাঙ্ক্ষায় আজও ভক্তরা সিনেমাগুলো উপভোগ করে। ২০০৫ সালে তিনি ‘The World’s Fastest Indian‘ সিনেমায় বার্ট মুনরোর চরিত্রে অভিনয় করেন। তার অভিনয় এত নিঁখুত আর স্বাভাবিক ছিল যে এক হৃদয়স্পর্শী দৃশ্যে হলের দর্শকসারিতে কান্নার রোল পড়ে যায়।
পরবর্তীতে তিনি ‘The Edge (1997)‘, ‘The Mask of Zoroo (1998)‘, ‘Proof (2005)‘, ‘Beowulf (2007)‘, ‘Thor (2011)‘, ‘Noah (2014)‘ ইত্যাদি বিখ্যাত সিনেমায় অভিনয় করেন। ১৯৯৮ সালে এক জরিপ অনুযায়ী তিনি যুক্তরাজ্যের সর্বোচ্চ আয় করা অভিনেতা হিসেবে চিহ্নিত হন। তিনি বর্তমানে ‘Westworld‘ নামক সায়েন্স ফিকশন টিভি সিরিজে ড. রবার্ট ফ্রড চরিত্রে অভিনয় করছেন। বয়স বেড়ে গেলেও, তার অভিনয়ের দীপ্তিতে একদমই ভাটা পড়েনি।
এছাড়া তিনি বেশ কয়েকটি সিনেমা পরিচালনাও করেন। তার পরিচালিত ‘August (1996)‘ সিনেমাটি ১৯৯৭ সালে বাফটা অ্যাওয়ার্ডে সেরা নাট্য বিভাগে পুরষ্কৃত হয়। তিনি টুকটাক গানও করতে জানেন। ২০১১ সালে তিনি ‘Hopkins’s piece’ নামক অ্যালবামও বের করেন।
অদ্ভুত অভিনয় ধরন এবং সম্মাননা
অ্যান্থনি হপকিন্স বাল্যকাল থেকে Dyslexia রোগে ভুগতেন। তাই তার কোনোকিছু বুঝতে একটু সময় লাগতো। তবে তার স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর। তিনি স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে প্রতি সপ্তাহে নতুন করে একটি কবিতা মুখস্ত করতেন। ক্যামেরার সামনে আসার আগে তিনি নিজের সংলাপ প্রায় ২০০ বারের মতো চর্চা করেন। তাকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তরে জানান,
“আমি বারবার একই সংলাপ আওড়াতে থাকি। একটা সময় সেটা আমার মস্তিষ্কের অংশ হয়ে যায়। তখন আমি অভিনয়ের ভেতরে ঢুকে যাই। যখন সংলাপ স্বাভাবিকভাবে বলতে পারি, তখন আমি ক্যামেরার সামনে যাই”।
‘জুরাসিক পার্ক‘ সিনেমার অভিনেতা রিচার্ড অ্যাটেনবোরো অ্যান্থনি হপকিন্স সম্পর্কে বলেন,
“যেকোনো দৃশ্যে অভিনয় করতে যেখানে অনেকের একাধিকবার শট নিতে হতো, সেখানে হপকিন্সের কখনই একবারের বেশি শট নেয়ার দরকার পড়েনি। তারপরও ওর অভিনয় অনেক নিখুঁত হতো”।
তার কঠোর পরিশ্রমের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি অসংখ্য পুরষ্কার এবং সম্মাননা লাভ করেন। প্রায় চারবার অস্কারের জন্য মনোনীত হন হপকিন্স এবং একবার সেরা অভিনেতা হিসেবে অস্কার জিতে নেন। এছাড়া প্রায় সাতবার গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনীত হন এবং ২০০৬ সালে তিনি সম্মানজনক Cecil B. DeMille Award পুরষ্কার লাভ করেন। বাফটা অ্যাওয়ার্ডে আটবার মনোনীত হন এবং এর মধ্যে চারবারই জয়ী হন। সিনেমা ছাড়াও নাটকে অভিনয়ের জন্য তিনি দু’বার অ্যামি অ্যাওয়ার্ডে সেরা অভিনেতা হিসেবে পুরষ্কৃত হন।
এর আগে ১৯৮৭ সালে তাকে Commander of the Order of the British Empire সম্মানে ভূষিত করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৩ সালে তিনি ব্রিটিশ নাইটহুড সম্মাননা অর্জন করেন। তার নামের আগে সম্মানসূচক ‘স্যার’ পদবী ব্যবহার করা হয়।
অভিনয়ের বাইরের জীবন
ব্যক্তিগত জীবনে অ্যান্থনি হপকিন্স নিজেকে একা হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি নিজের সম্পর্কে বলেন,
“আমার বন্ধুদের সংখ্যা খুব কম। আমার বন্ধুদের কেউই আবার অভিনয় পছন্দ করে না”।
অভিনয়ের শুরুর দিকে সহকর্মীদের সাথে আয়োজিত নৈশভোজেও অংশ নিতেন না তিনি। এ ব্যাপারে তিনি মন্তব্য করেন,
“কেন? আমার তো তেমন ক্ষুধা নেই। আমি সবাইকে চিনি না এবং চিনতে আগ্রহীও নই। খাবারের সামনে বসে সবার সাথে সামাজিক হওয়ার অভিনয় করা আমার কাছে বিরক্তিকর ঠেকে”।
তিনি অবসর সময়ে ছবি আঁকেন। মাঝে মাঝে পিয়ানো বাজান। এছাড়াও সময় পেলেই হরর সিনেমা নিয়ে বসে পড়েন। তার প্রিয় সিনেমার নাম ‘Rosemary’s Baby (1968)‘.
একা থাকতে ভালোবাসালেও তিনি খুব অমায়িক ব্যবহার করেন সবার সাথে। তিনবার বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন হপকিন্স। প্রথম স্ত্রীর গর্ভে একটি কন্যাসন্তান জন্ম নেয়। কন্যা অ্যাবিগাইল হপকিন্স যুক্তরাজ্যে একজন প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। সম্প্রতি অ্যান্থনি হপকিন্স স্টেলা আরোইয়েভেকে বিয়ে করেন। তার মোট সম্পদের পরিমাণ প্রায় ১৬০ মিলিয়ন ডলার।
সিনেমাজগতের ইতিহাসে স্যার অ্যান্থনি হপকিন্স একজন অন্যতম শক্তিমান অভিনেতা। যতবার তিনি ক্যামেরার সামনে হাজির হয়েছেন, ততবারই দর্শকদের মুগ্ধ করতে সক্ষম হয়েছেন। শান্ত দৃষ্টি মেলে তরল গলায় সংলাপের মাধ্যমে প্রতিটি দৃশ্যকে জীবন্ত করে তুলেছেন তিনি।
যতদিন পৃথিবীর বুকে সিনেমা বেঁচে থাকবে, ততদিন স্যার অ্যান্থনি হপকিন্সের নাম সম্মানের সাথে উচ্চারিত হবে।
ফিচার ইমেজঃ Edited by Jakaria Hasan.