স্টেজে নানা রঙের আলোর সাথে আঁধারের খেলা। টিকালো নাকের, লম্বা গড়নের এক মেয়ে মাইক্রোফোন হাতে মধ্যমণি হয়ে গান গাইছে। কোমর ছাড়িয়ে যাওয়া লম্বা চুল লাগামছাড়া খোলা হাওয়ার মতোই ঢেউ তুলেছে পরনের জিন্স আর শার্টে। কাজল মাখা চোখ, চিবুকে আলোর ঝলকানি, সবুজ রঙা মিঠে আলোয় তার খোলা চুলগুলোও সবুজাভ হয়ে উঠেছে। কেমন এক স্বপ্নিল দৃশ্য! মেয়েটি গেয়ে চলেছে, পারফর্ম্যান্সের জবাব নেই। দৃষ্টি শ্রোতাদের উপর নিবদ্ধ, কিন্তু ভেতরে যেন ডুবে আছে সুরের মোহনায়। এক অদ্ভুত রসধারায় সিক্ত প্রাণ। ভাবছেন রূপের বর্ণনা দিতে বসেছি নাকি গানের? এ প্রশ্নের জবাব দেয়া মুশকিল। তাই হয়তো রবীন্দ্রনাথের নাম নিয়ে সে প্রশ্নের জবাব গায়িকা নিজেই দিয়েছেন- “আমি রূপে তোমায় ভোলাবো না…গান দিয়ে দ্বার খোলাবো” (অ্যালবাম: মোর ভাবনারে- ২০১৬)। তিনি যখন গান করেন, তখন তার জাদুকরী কন্ঠের আবেশে অবশ হতে বাধ্য হয় দূরের বা কাছের যেকোনো প্রান্তের শ্রোতা। সোমলতার সোমরসে সিক্ত হতে বাধ্য হয় সকল সঙ্গীতপ্রেমীর মন।
সোমলতা আচার্য্য চৌধুরী, ওপার বাংলার গান যারা নিয়মিত শোনেন, তাদের নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। ‘তুমি আসবে বলে তাই’, ‘অন্ধকারের পরে’, ‘আমি বৃষ্টি দেখেছি’, ‘জাগরণে যায় বিভাবরী’- ‘রঞ্জনা আমি আর আসবো না’ ছবিতে গাওয়া এই গানগুলোই তাকে রাতারাতি করে দেয় বিখ্যাত করে তোলে এবং জায়গা করে দেয় সঙ্গীতপ্রেমীদের মনে। ভারতীয় বাংলা ছবিতে নির্মাতাদের পছন্দের প্লেব্যাক সিংগারদের মধ্যে অন্যতম এখন সোমলতা। কন্ঠই তার পরিচয়। কী করে সঙ্গীত জগৎ পেলো সোমলতাকে? চলুন শোনা যাক তার উঠে আসার গল্পটা।
ছোটবেলায় বর্ণপরিচয় শেখার আগেই তার গানে হাতেখড়ি হয়। পরিবারের অধিকাংশ সদস্যই ছিলেন সঙ্গীতের সাথে যুক্ত। গানটা তাকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন ঠাকুরমা। সঙ্গীতের সাথে সোমলতার সখ্য হতে সময় লেগেছিল অবশ্য। তার ভাষ্যমতে, তিনি প্রথম প্রথম সঙ্গীতের জ্ঞান আয়ত্ব করার উপর বেশি জোর দিতেন, যদিও জরুরি ছিল মন আর আত্মার সংযোগ। কিন্তু এই সঙ্গীত যেন তিনি পেয়েছিলেন উত্তরাধিকার সূত্রে। তার সাথে যোগ হয়েছিল তার মাধুর্যময়ী কন্ঠ। তাই বেশিদিন লাগেনি সুরের লাগাম ধরে ফেলতে। বাড়িতে যখনই কোনো অতিথি আসতো, তাদের বিশেষ অনুরোধে গাইতেই হতো সোমলতাকে। এটা এমনি এক অভ্যেসের মতো হয়ে গিয়েছিল যে, একবারের এক অতিথি তাকে গান গাওয়ার অনুরোধ না করলে তিনি বেশ চিন্তায় পড়ে যান। মাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “উনি আমায় গাইতে বললেন না যে?”
সোমলতার শেকড় কিন্তু ছড়িয়ে আছে বাংলাদেশে। তার বাবা শ্যামল আচার্য্য চৌধুরী ময়মনসিংহের মানুষ, আর মা নোয়াখালীর। মুক্তাগাছার এক বনেদী জমিদার বংশে তার জন্ম। ১১ বছর বয়সে পন্ডিত বীরেশ রায় এর কাছে ক্ল্যাসিকাল মিউজিকের তালিম নিতে শুরু করেন সোমলতা। গুরু হিসেবে বীরেশ রায় ছিলেন যথেষ্ট আধুনিকমনা। সব ধরনের গান গাইতেই তিনি উৎসাহ যোগাতেন সোমলতাকে। বাড়িতে ক্রিস ডি বার্গ আর মাইকেল জ্যাকসন নিয়মিত শুনতেন তিনি। ’৯০ এর দশকের চার্টবাস্টার অ্যাকুয়ার ‘আই অ্যাম এ বার্বি গার্ল’ গানটি তার আগ্রহ জাগিয়ে তোলে ওয়েস্টার্ন পপ মিউজিকে। এরপরে শুরু করলেন নিজে নিজে পপ মিউজিক শোনা, সুরভঙ্গিমা অনুসরণ করার চেষ্টা, আর নতুন গায়কীর উদ্ভাবনা। ধীরে ধীরে আবিষ্কার করলেন ইয়োডেলিং (yodeling, দ্রুত স্বর ওঠানামা করানোর একরকম পদ্ধতি) এর মতো ভয়েস মড্যুলেশন টেকনিকগুলোতে তিনি বেশ পারদর্শী। ক্ল্যাসিকাল আর ওয়েস্টার্ন ঘরানা দুটোর উপরই এক অভূতপূর্ব দক্ষতা নিয়ে গানের জগতে আবির্ভূত হয়েছেন সোমলতা। তাই তার ফিউশন করা গানগুলোই (যেমন- রক ধাঁচে রবীন্দ্রসঙ্গীত) বড় বেশি শ্রুতিমধুর হয়ে ওঠে শ্রোতার কাছে।
সোমলতা পড়াশোনা শেষ করে আশুতোষ কলেজে সাইকোলজির গেস্ট লেকচারার হিসেবে যোগ দেন (এখনও কর্মরত)। পাশাপাশি চলতে থাকে তার সঙ্গীতচর্চা। পেশাদার ভোকালিস্ট হিসেবে তার যাত্রা শুরু হয় বিভিন্ন মিউজিক প্রোডাকশনে ব্যাকিং ভোকাল হিসেবে অংশ নিয়ে। ব্যাকিং ভোকাল হিসেবে তার কন্ঠ লীড ভোকালিস্টদের পরিবেশিত গানে এক আলাদা আস্বাদন যোগ করতো। এক পারিবারিক বন্ধু তাকে একটি মিউজিক স্টুডিওর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। ধীরে ধীরে নজরে আসতে থাকেন সোমলতা। ২০০৫-এ সুনামি রিলিফ ফান্ড প্রোগ্রামে তিনি প্রথম ব্রেক পান। সেখানে ঊষা উত্থুপের মতো নামকরা শিল্পীদের পাশাপাশি তিনি স্টেজ মাতান। এরপরে ‘তারা’ মিউজিক চ্যানেলে পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের উপস্থাপনায় ‘টেক এ ব্রেক’ নামে একটি মিউজিক্যাল শোতে অংশ নেন তিনি।
পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। ২০০৭ সালে প্রথম ‘দ্য পারফেক্ট ওম্যান’ নামে একটি ফিচার ফিল্মে ‘মেক লাভ টু মি’ শিরোনামের একটি ইংরেজি গানে কন্ঠ দেন তিনি। তবে প্লেব্যাক সিঙ্গার হিসেবে তার প্রথম সাফল্য নীল দত্তের ‘ক্রস কানেকশন’(২০০৯) ছবিতে ‘ইচ্ছেগুলো যে দিচ্ছে ইশারা’ গান দিয়ে। এরপরে ২০১১-তে অঞ্জন দত্তের ‘রঞ্জনা আমি আর আসবোনা’ ছবিতে ৬টি গানে কন্ঠ দিয়ে তার বাজিমাৎ। এই ছবির গানগুলোতে সোমলতা একইসাথে দেখিয়েছেন ওয়েস্টার্ন ঘরানার উপর তার পারদর্শিতা আর রবীন্দ্র সঙ্গীতে ফিউশনের জাদু; দেখিয়েছেন শিরিশিরে হাওয়ার মতো ঠান্ডা সুর কিংবা উদ্দাম ঝড়ো হাওয়ার মতো দুরন্ত সুর, দুটোর উপরই কী অদ্ভুত নিয়ন্ত্রণ তার। সুরের জগতে যেন কোনো দেবীর মূর্ত রূপ তিনি।
ক্যাজুয়াল জিন্স আর শার্টে ব্যান্ড গার্ল অবতারে রক স্টাইলে রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে প্রথাগত রবীন্দ্রসঙ্গীতপ্রেমী ও শিল্পীদের সমালোচনার শিকার হয়েছেন সোমলতা। কিন্তু তিনি জানতেন তিনি কী করছেন, আর তা থেকে তিনি পিছপা হননি। কেন রবীন্দ্রসঙ্গীত শুধু প্রথাগতভাবেই গাইতে হবে, এই প্রশ্ন তার তরুণ বয়স থেকেই ছিল। রবীন্দ্রসঙ্গীতকে ভালোবেসে, তরুণ প্রজন্মের পছন্দনীয় করে, যুগোপযোগী নতুন ধারায় নিয়ে এসেছেন তিনি। আর তাই ‘মায়াবন বিহারিনী’, ‘তোমায় গান শোনাবো’, ‘তোমার খোলা হাওয়া’, ‘মোর ভাবনারে’ এমন ক্ল্যাসিকাল রবীন্দ্র সঙ্গীতগুলোর আকর্ষণ হারিয়ে যায়নি তরুণ প্রজন্মের মাঝ থেকে। পপ মিউজিকের সাথে সমান তালে মনের আনন্দে গলায় রবীন্দ্রনাথও চালিয়ে যাওয়ার আগ্রহ পাচ্ছে তরুণরা। রবীন্দ্র অঙ্গনে একজন সোমলতার প্রয়োজন ছিল বৈকি।
আগেই বলা হয়েছে, ওয়েস্টার্ন আর ক্ল্যাসিকাল দুটোতেই সোমলতা সিদ্ধহস্ত। তিনি পারেন একটি গানের প্রতিটি লাইনের, প্রতিটি কথার, প্রতিটি শব্দের অন্তর্নিহিত আবেদন তার কন্ঠের আশ্চর্য কারুকার্যে ফুটিয়ে তুলতে। সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া ‘The Bongs Again’ ছবিতে তার আধুনিক ধাঁচে গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘তোমায় গান শোনাবো’র কথাই ধরা যাক। সুরের সাথে হারাতে পারা যেকোনো শ্রোতামাত্রই উপলব্ধি করতে বাধ্য- শুরুতে যখন সোমলতা গেয়ে ওঠেন, “এলো আঁধার ঘিরে…”, যেন হঠাৎ করেই চারপাশ স্তব্ধ হয়ে যায়। যেন সত্যিই এক অন্তহীন অন্ধকারে মূর্ছিত হয়ে আসছে চারদিক। এরপর যখন শোনা যায়, “শুধু আমার হিয়া বিরাম পায় নাকো”, শ্রোতার মনে হবে সে স্বয়ং যেন আসলেই কতদিনের অবসাদক্লিষ্ট, শ্রান্ত। আবার যখন শেষের দিকে বেজে ওঠে, “আমার কাজের মাঝে মাঝে, কান্না ধারার দোলা তুমি থামতে দিলে না যে”, মনে হবে যেন অজ্ঞাত কোনো অভিমান দলা পাকিয়ে গলা ছাড়িয়ে চোখের দুয়ার ছাপিয়ে দেবে এখনই। এই অনুভূতিগুলো সোমলতা তার শ্রোতার ভেতর অনায়াসে জাগিয়ে দিতে পারেন তার কন্ঠের অনন্য কারিগরিতে, স্বরের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ওঠানামায়।
সোমলতার উল্লেখযোগ্য গান অনেক। এখন এমন অবস্থা দাঁড়িয়ে গেছে যে, সোমলতা গান গাইলে তা উল্লেখযোগ্য হতে বাধ্য। সোমলতার প্লেব্যাক করা আর সব ছবিগুলোর মধ্যে আছে ‘ক্রস কানেকশন’, ‘বেডরুম’, ‘ইউ-টার্ন’, ‘দত্ত ভার্সাস দত্ত’, ‘হাফ-সিরিয়াস’, ‘মাছ মিষ্টি অ্যান্ড মোর’, ‘আমার আমি’, ‘বেলা শেষে’, ‘উনিশে এপ্রিল’, ‘চতুষ্কোণ’ ইত্যাদি। এছাড়া তার একক অ্যালবামের তালিকায় আছে ‘চুপকথা’(২০০৯), ‘আমি আছি এর মাঝে’(২০১৪), ‘মোর ভাবনারে’(২০১৬)। নিজের তৈরি একটা ব্যান্ডও আছে তার, ‘সোমলতা অ্যান্ড দ্য এসেস’।
বেশ আছেন তিনি। গাইছেন নিজের মনে, সিনেমায় একের পর এক হৃদয় কাঁপানো প্লেব্যাক দিয়ে যাচ্ছেন, নিজের ব্যান্ড নিয়ে কনসার্ট করে বেড়াচ্ছেন, একটু গোছানো সময় পেলেই নিয়ে আসছেন নিজের সলো অ্যালবাম। এখনও অনেকটা পথ যাবার আছে তার, অর্থাৎ আরও অনেক অনেক সুরে শ্রোতাদের মন মাতানোর আছে। বেঁচে থাকুন সোমলতা। তার সুরের সোমরস ধারা আকুল ভক্তপ্রাণে এসে ঠাঁই পেতে থাক, ঠিক যেমনটা রবিবাবুর কথায় তিনি গেয়েছেন, “আমার সকল রসের ধারা, তোমাতে আজ হোক না হারা…”।
ফিচার ইমেজ: youtube.com