স্পাইডার-ম্যান হাতে গোনা কয়েকটি কাল্পনিক চরিত্রের মধ্যে একটি, যার পরিচিতি এবং জনপ্রিয়তা পুরো বিশ্বজুড়ে। কমিকের পাতা ছাড়িয়ে, লাইভ একশন মুভিতে বক্স অফিস থেকে বিলিয়ন ডলার আয় অথবা অ্যানিমেশনে অস্কার জয়, সবকিছুর পেছনে মূল কৃতিত্ব দুজন মানুষের, যারা ১৯৬২ সালে এই চরিত্রটি সৃষ্টি করেছিলেন। কিন্তু অবাক করা বিষয়, তাদের মধ্যে একজন আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা পেলেও অপরজন সবসময় আড়ালেই ছিলেন। মুভি থেকে বিলিয়ন ডলার আয়ের কিছুই তিনি গ্রহণ করেননি। ১৯৬৮ সালের পর কোনো ইন্টারভিউ দেননি, এমনকি তার সৃষ্টি নিয়েও কখনো কথা বলেননি। তিনি নিউ ইয়র্কে খুবই সাদামাটা জীবনযাপন করতেন। মেধাবী আর্টিস্ট হওয়া স্বত্ত্বেও সমসাময়িক স্ট্যান লি কিংবা জ্যাক কিরবির মতো বিখ্যাত হয়ে উঠতে পারেননি, অথবা তিনি বিখ্যাত হতে চাননি। তিনি স্টিভ ডিটকো।
স্টিভ ডিটকো কখনোই নিজেকে নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করতেন না। তাই আমরা তার জীবন সম্পর্কে খুব কমই জানি। কিন্তু কমিকে তার অবদান তার সম্পর্কে বলেছে আমাদের। কারণ, তিনি বিশ্বাস করতেন, তার কাজের মাধ্যমেই তাকে চেনা যাবে।
কমিককে ভালোবেসে বেড়ে ওঠা
১৯২৭ সালে পেনসিলভেনিয়ার জনসটাউনে এক স্লোভাকিয়ান-আমেরিকান পরিবারে জন্ম ডিটকোর। মোট চার ভাই-বোনের মধ্যে ডিটকো ছিলেন দ্বিতীয়। তাকে নিয়ে লেখা ব্লেইক বেলের বই ‘স্ট্রেঞ্জ এন্ড স্ট্রেঞ্জার: দ্য ওয়ার্ল্ড অভ স্টিভ ডিটকো’ থেকে আমরা জানতে পারি, তার বাবা স্টিফেন ডিটকো কমিকের বিশাল বড় ভক্ত ছিলেন, বিশেষ করে স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত ‘প্রিন্স ভ্যালিয়েন্ট’ এর। তিনি স্থানীয় একটি স্টিল মিলে ছুতার হিসেবে কাজ করতেন। আঁকাআঁকিতে তার বেশ ভাল দক্ষতা ছিল, কিন্তু কাজের চাপে সেদিকে আর মনোযোগ দিতে পারেননি।
স্টিভ ডিটকোও বেড়ে উঠেছিলেন তার বাবার মতোই কমিকের পাতার কাল্পনিক জগতটাকে ভালোবেসে। সেই ভালোবাসা যেন পরিপূর্ণতা পায় ১২ বছর বয়সে ব্যাটম্যানের কমিক হাতে পেয়ে। তখন তিনি আর তার বন্ধু মাইক জনসটাউনের রাস্তায় ব্যাটম্যান-রবিন সেজে নিজেদের কাল্পনিক এডভেঞ্চার করতেন। এছাড়াও উইল উইসনারের ‘দ্য স্পিরিট’ কমিকেরও ভক্ত হয়ে উঠেন তিনি। মূলত দ্য স্পিরিট এবং ব্যাটম্যান কমিকই ছিল তার অনুপ্রেরণা- একজন পেশাদার কমিক বুক আর্টিস্ট হয়ে ওঠার।
নিঃসন্দেহে তিনি তার ক্লাসের সেরা আর্টিস্ট ছিলেন। যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল তখন তিনি মিত্রবাহিনীদের সাহায্য করতে চেয়েছিলেন। তাই তিনি একটি ক্লাবে যোগ দেন যারা জার্মান বিমানের কাঠের মডেল তৈরি করত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শত্রুপক্ষের বিমান শনাক্তে সহায়তা করার জন্য। ১৯৪৫ সালে হাই স্কুল শেষ করার পর তিনি মিলিটারিতে যোগ দেন এবং যুদ্ধপরবর্তী জার্মানিতে সেনাবাহিনীর জন্য পত্রিকায় কমিক আঁকতেন, যা তার স্বপ্ন বাস্তবায়নকে এক ধাপ এগিয়ে দেয়।
১৯৫০ সালে সেনাবাহিনী থেকে ফেরার পর তিনি জানতে পারেন যার আঁকা কমিক তাকে এত অনুপ্রাণিত করেছিল, সেই জেরি রবিনসন নিউ ইয়র্কে একটি আর্ট স্কুলে পড়াচ্ছেন। তাই ডিটকো দেরি না করে ব্যাগপত্র গুছিয়ে রওনা দেন স্বপ্নের শহর নিউ ইয়র্কে, নিজের স্বপ্ন সত্যি করতে।
স্বপ্নের পথে যাত্রা
১৯৩০ সাল থেকেই নিউ ইয়র্ক ছিল সকল কমিক বুক ইন্ডাস্ট্রির কেন্দ্রবিন্দু। সেখানেই ডিটকো ভর্তি হলেন দ্য কার্টুনিস্ট এন্ড ইলাস্ট্রেটর স্কুলে (যেটা বর্তমানে পরিচিত দ্য স্কুল অভ ভিজুয়াল আর্টস নামে)। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি তার মেধা এবং অধ্যবসায়ের মাধ্যমে শিক্ষক জেরি রবিনসনের মন জয় করে নেন।
রবিনসন ডিটকো সম্পর্কে বলেছিলেন,
স্টিভ খুবই শান্তশিষ্ট এবং চাপা স্বভাবের ছিল। তবে সে তার কাজে বেশ মনোযোগী এবং কঠোর পরিশ্রমী ছিল।
স্টিভ ডিটকোর আঁকা প্রথম কমিকটি ছিল একটু রোমান্টিক ধাঁচের, যেটি একটি অখ্যাত প্রকাশনী থেকে ছাপানো হয়েছিল ১৯৫৩ সালে। এছাড়াও তিনি তিনমাস কাজ করেছিলেন ক্যাপ্টেন আমেরিকার ক্রিয়েটর জো সাইমন এবং জ্যাক কারবির সাথে। এরপর তিনি চার্লটন কমিকে কাজ করেন বেশ কিছুদিন। তারা যদিও আর্টিস্টদের অতটা ভাল বেতন দিতে পারত না, তবে সে প্রকাশনীতে শিল্পীরা স্বাধীনতা পেতেন। তাই ডিটকো তার কর্মজীবনে বেশ কয়েকবারই চার্লটন কমিকে ফিরে যান। তবে তার জীবনে বড় পরিবর্তন আসে ১৯৫৫ সালে যখন রবিনসন তাকে পরিচয় করিয়ে দেন স্ট্যান লির সাথে।
স্ট্যান লি তখন অ্যাটলাস কমিকসের (যেটা পরবর্তীতে মার্ভেল কমিকস হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে) রাইটার-এডিটর ছিলেন। লি ডিটকোর মেধা, দক্ষতা এবং কাজের প্রতি একনিষ্ঠতা দেখে মুগ্ধ হয়ে এটলাস কমিকসের একজন আর্টিস্ট হিসেবে নিযুক্ত করেন। সেখানেই ডিটকোর অসাধারণ এবং ব্যতিক্রমী কৌশলটির বিকাশ ঘটে।
স্পাইডার-ম্যান সৃষ্টি
জনপ্রিয় চরিত্র স্পাইডার-ম্যান কে সৃষ্টি করেছিল এর সঠিক গল্পটা অনেক বিতর্কিত। স্পাইডার-ম্যান দেখতে কেমন হবে সেই ধারণা অবশ্য প্রথমে এসেছিল জ্যাক কিরবির কাছ থেকে। কিরবি সেই স্পাইডারম্যানের (মাঝের হাইফেন পরবর্তীতে স্ট্যান লি যোগ করেন) অরিজিনের প্রথম পাঁচ পৃষ্ঠা আঁকেন। জ্যাক কিরবির কল্পনায় সেই স্পাইডারম্যান ছিল এক কিশোর, যে একটি জাদুর আংটির মাধ্যমে সুপারহিরোতে পরিণত হয়। তার আংকেল ছিলেন একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার, যে তাকে মোটেই পছন্দ করত না।
স্ট্যান লি তখন কিরবির আঁকা সেই প্রথম পাঁচ পৃষ্ঠায় রঙ করতে নিযুক্ত করেন স্টিভ ডিটকোকে। কিন্তু ডিটকো বুঝতে পারেন কিরবির সেই স্পাইডারম্যান মিলে যাচ্ছে, জো সাইমনের দ্য ফ্লাইয়ের সাথে, যেটা আর্চি কমিকস আরো তিন বছর আগেই প্রকাশ করেছিল (এমনকি জ্যাক কিরবি দ্য ফ্লাইয়ের প্রথম দুই ইস্যু এঁকেছিলেন)।
এ বিষয় যখন ডিটকো স্ট্যান লিকে জানান, স্ট্যান লি কিরবির সাথে কথা বলেন এবং তার আঁকা সেই পাঁচ পৃষ্ঠা বাতিল করেন। এরপর স্ট্যান লি নিজেই স্পাইডারম্যানের মূল চরিত্রটিকে সাজান। তারপর তিনি সেটা স্টিভ ডিটকোকে দেন আঁকার জন্য। ডিটকো সেখানেই নিজের অসাধারণ দূরদর্শিতা এবং স্বকীয়তার প্রমাণ দিয়ে যান, যা স্পাইডার-ম্যানকে করে তোলে অন্যতম জনপ্রিয় কাল্পনিক চরিত্র।
স্পাইডার-ম্যানের কস্টিউম ছিল তখনকার সময়ের প্রেক্ষিতে অদ্ভুত এবং অন্য সবার চাইতে ব্যতিক্রম, যা আগে কেউ দেখেনি। বেশিরভাগ সুপারহিরো যারা মুখোশ পড়তো, সেই মুখোশ তাদের সম্পূর্ণ চেহারা ঢাকতো না। কিন্তু স্টিভ ডিটকোর স্পাইডার-ম্যানের পুরো মুখই ঢাকা ছিল। স্টিভ ডিটকো বলেছিলেন,
আমি নিশ্চিত ছিলাম না যে আসলেই স্ট্যান পুরো মুখ ঢাকার বিষয়টি পছন্দ করবে কি না, তবে আমি এটা করেছি চরিত্রটির বালকসুলভ চেহারাটি ঢাকতে। এটা আবার চরিত্রটিকে বেশ রহস্যময় করে তুলবে।
লাল কস্টিউমে সাদা জালের রেখাগুলো এতটাই বিস্তৃত ছিল যেটা আকাঁই কষ্টসাধ্য ছিল। ডিটকো চলে যাওয়ার পরে অন্য আর্টিস্টরা সেই কস্টিউমটি আর সহজভাবে আঁকার চেষ্টা করেনি, যেটা বলে দিচ্ছে সেটি আসলেই কতটা সুন্দর এবং আইকনিক ছিল। এছাড়াও ডিটকো যে ভঙ্গিতে স্পাইডার-ম্যানের ইস্যুগুলো এঁকেছিলেন, যেভাবে স্পাইডার-ম্যান দেয়াল বেয়ে উপরে উঠত, যেভাবে স্পাইডার-ম্যান জাল ছুড়ে মারত বা যেভাবে সে শত্রুর মোকাবেলা করত, সবই চরিত্রটির জনপ্রিয়তা এবং শ্রেষ্ঠত্বের জন্য দায়ী।
শুধু স্পাইডার-ম্যানই কেন? একগাদা ভিলেনের পাশাপাশি জনপ্রিয় সব পার্শ্চরিত্রেরও কো-ক্রিয়েটর ছিলেন তিনি। স্যান্ডম্যান, গ্রিন গবলিন, ইলেক্ট্রো, মিস্টিরিও, জে জোনাহ জেমসন, আন্ট মে (আন্ট মের চুলের খোঁপাটা তার মায়ের অনুকরণেই করেছিলেন তিনি), মেরি জেইনসহ প্রিয় সব চরিত্র প্রথম ফুটে উঠছিল তার পেন্সিল থেকেই।
স্পাইডার-ম্যানের প্রথম কয়েক ইস্যুতে কাজ করার সময় স্ট্যান লি স্টিভ ডিটকোকে সে গল্পের কিছুটা ধারণা দিতেন, তবে কখনোই পুরো স্ক্রিপ্ট দিতেন না। লি চাইতেন যাতে আর্টিস্ট নিজেই নিজের মতো ছবির সাথে গল্প সাজাতে পারে। পরে তিনি তাতে নিজের মতো করে সংলাপ এবং চরিত্রগুলোর ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করতেন। কিন্তু একটা সময় স্ট্যান লি বুঝতে পারেন, স্টিভ ডিটকো নিজেই খুব ভাল গল্প এবং প্লট দাঁড় করাতে পারেন। এরপর আস্তে আস্তে লি গল্পের ধারণা দেয়াই বন্ধ করে দেন। তখন ডিটকো নিজেই পুরো গল্প নিজের মতো করে সাজিয়ে, সেভাবে প্রতিটি চরিত্র এবং ঘটনা পাতায় ফুটে তুলে তা স্ট্যান লিকে দিতেন। লি তখন সেখানে প্রয়োজনীয় সংলাপ বসাতেন। এই পদ্ধতিটি এখন পরিচিত মার্ভেল মেথড হিসেবে।
স্টিভ ডিটকোর তেমনই একটি গল্প ছিল এমেজিং স্পাইডার-ম্যানের ৩৩তম ইস্যু, দ্য ফাইনাল চ্যাপ্টার। সে গল্পে স্পাইডার-ম্যান অনেক ভারী জঞ্জালের চাপা পড়ে এবং সে অনেক চেষ্টা করেও তা থেকে নিজেকে বের করে আনতে পারছিল না। কিন্তু তাকে বের হয়ে আসতেই হবে, তা না হলে সে আন্ট মেকে বাঁচাতে পারবে না। এখানেই ছিল ডিটকোর কৃতিত্ব। তিনি সেই গল্পে স্পাইডির শক্তি কিংবা একগাদা মারামারির দৃশ্য তুলে ধরেননি, বরং স্পাইডার-ম্যানের সংগ্রাম এবং দৃঢ়তা তুলেন ধরছেন। নেইল গেইম্যানের মতো অনেকেই মনে করেন, এটা কমিকবুক ইতিহাসের সেরা একটি মুহুর্ত। এই মুহুর্তটিকে রুপালি পর্দায় তুলে ধরা হয়েছিল ২০১৭ সালের স্পাইডার-ম্যান: হোমকামিং মুভিটিতে।
ডক্টর স্ট্রেঞ্জের সৃষ্টি
যদিও স্টিভ ডিটকোকে ডক্টর স্ট্রেঞ্জের কো-ক্রিয়েটর হিসেবে উল্লেখ করা হয়, কিন্তু অনেকেই মনে করেন এই চরিত্রটি একান্তই ডিটকোর সৃষ্টি। স্ট্রেঞ্জার টেইলসের ১১০ তম ইস্যুতে ডক্টর স্ট্রেঞ্জের প্রথম আবির্ভাবের পর ব্যতিক্রমী এই সুপারহিরোকে দেখে সবাই অবাক হয়। ডিটকোর অনন্য চিন্তাভাবনা এবং সেইভাবেই ডক্টর স্ট্রেঞ্জকে ফুটিয়ে তোলার কারণেই স্ট্রেঞ্জও ভালই জনপ্রিয়তা পায়। স্ট্রেঞ্জার টেলস যতই নতুন ইস্যু প্রকাশিত হচ্ছিল, সেই অদ্ভুত ডক্টরের যাত্রা দূর থেকে দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছিল। পৃথিবীর বাইরে তো বটেই, এমন এক জগতে স্ট্রেঞ্জকে ডিটকো নিয়ে গিয়েছিল, যা কমিকের পাতায় আগে কেউ দেখেনি।
এসব কমিক খুব বেশিই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল কলেজপড়ুয়াদের মধ্যে, যারা একসময় মনে করত, ডিটকো হয়তো বা কোনো সাইকেলেডিক ড্রাগস নিত। কিন্তু ডিটকো কখনই এসব গ্রহণ করেননি। অর্থাৎ কমিকের পাতায় যেসব অদ্ভুত দৃশ্য দেখা যেত সব এসেছে ডিটকোর ব্যতিক্রমী কল্পনার মাধ্যমে।
মার্ভেলের অন্যান্য চরিত্রে স্টিভ ডিটকোর ভূমিকা
ডিটকোর কাজ শুধু স্পাইডার-ম্যান কিংবা ডক্টর স্ট্রেঞ্জের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তিনি মার্ভেলের অন্যান্য সুপারহিরো নিয়েও কাজ করেছিলেন। যেমন- আগের গল্পগুলোতে ব্রুস হাল্কে পরিণত হত ভিন্ন কারণে, প্রথমদিকে সকালে কিংবা সন্ধায়, পরবর্তীতে একটি মেশিনের কারণে। ডিটকোই নির্ধারণ করেছিলেন, যখন ব্রুস রেগে যাবে কিংবা মানসিক হতাশায় থাকবে তখনই সে হাল্কে পরিণত হবে। তিনি ব্রুস ব্যানার চরিত্রটিতেও পরিবর্তন আনেন।
কিরবির গল্পে ব্রুস সরকারের হয়ে কাজ করত এবং বিভিন্ন অস্ত্র বানাত। অপরদিকে ডিটকোর ব্রুস ব্যানার সরকার থেকে পালিয়ে বেড়াত, কারণ সরকার বুঝতে পেরেছিল হাল্ক খুবই বিপদজনক। প্রথম দিকের আয়রন ম্যানের স্যুটের ডিজাইন করেছিলেন ডন হেক এবং জ্যাক কিরবি। তবে আমরা আয়রনম্যানকে এখন যে লাল-হলুদ স্যুটে দেখে থাকি, সেটা স্টিভ ডিটকোর আঁকা। আগে আয়রনম্যান ছিল ধূসর আর্মরে, মাথায় বালতির মতো এক হেলম্যাট ছিল তার। ডিটকো সেই স্যুট পরিবর্তন করে লাল হেলমেট, লাল শরীর এবং লাল গ্লাভস-বুটের পাশাপাশি হলুদ মুখোশ, হলুদ হাত-পা দিয়ে সাজিয়ে তোলেন আয়রন ম্যানকে। যদিও পরবর্তীতে আয়রন ম্যানের স্যুটে বেশ পরিবর্তন করা হয়, কিন্তু এখনো যে স্যুটে আমরা আয়রন ম্যানকে চিনে থাকি সেটা ডিটকো থেকেই অনুপ্রাণিত।
মার্ভেল কমিকস ছেড়ে চলে যাওয়া
বিভিন্ন কারণে স্ট্যান লি এবং স্টিভ ডিটকোর মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়। ১৯৬৬ সালের নিউ ইয়র্ক হ্যারাল্ড ট্রাইবিউন ম্যাগাজিনে স্ট্যান লি বলেছিলেন
আমি এখন আর স্পাইডার-ম্যানের গল্প লিখছি না। স্টিভ ডিটকো, সে নিজেই গল্পের বিষয়টি সামলাচ্ছে। আমি বিষয়টি তার হাতেই ছেড়ে দিলাম যতদিন না পর্যন্ত স্পাইডার-ম্যানের বিক্রি কমে না যায়। যখন থেকেই স্পাইডার-ম্যানের জনপ্রিয়তা বেড়ে গেছে, সে নিজেকে পৃথিবীর একমাত্র মেধাবী ভেবে বসে আছে। আমাদের মধ্যে প্লট নিয়ে এত বেশি ঝগড়া হচ্ছিল যে, আমি গল্পের পুরো বিষয়টাই তার হাতে তুলে দিয়েছি।
অনেক ইতিহাসবিদই বলেন, গ্রিন গবলিনের আসল পরিচয় নিয়েই লি আর ডিটকোর মধ্যে মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়৷ ডিটকো চেয়েছিলেন সম্পূর্ণ অপরিচিত কেউ হবে গ্রিন গবলিন, যেটা বেশিরভাগ স্পাইডার-ম্যানের ভিলেনের ক্ষেত্রেই হয়েছিল। কিন্তু লি চেয়েছিলেন স্পাইডার-ম্যানের প্রিয় বন্ধু হ্যারি অসবর্নের বাবাই হবেই গ্রিন গবলিন। অনেকের বিশ্বাস, এ কারণেই স্টিভ ডিটকো মার্ভেল ছেড়ে চলে যান। তবে ২০১৫ সালে স্টিভ ডিটকো তার এবং রবিন স্নাইডারের ফোর-পেজ পাবলিকেশনের মাধ্যমে জানান, মূলত তিনি স্ট্যান লির আচরণে আঘাত পেয়েই মার্ভেল ছেড়ে চলে যান। আগে দুজনেই গল্প এবং প্লট নিয়ে আলোচনা করতেন, কোনো কিছু পরিবর্তনের প্রয়োজন হলে সেটা করতেন। কিন্তু একসময় স্ট্যান লি ডিটকোর সাথে কথা বলাই বন্ধ করে দেন।
কেন আমি মাসিক ইস্যুগুলোর জন্য কাজ করব, কেন গল্প নিয়ে কাজ করব এমন এক মানুষের জন্য, যে কোনো এক কারণে ভয়ে বা রেগে আছে যে আমার সাথে দেখা বা কথাই বলতেই পারছে না। তাই একসময় আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি মার্ভেল ছেড়ে চলে যাব।
এমেজিং স্পাইডার-ম্যানের ৩৮তম ইস্যুটিই স্টিভ ডিটকোর আঁকা শেষ স্পাইডার-ম্যান কমিক।
ডিটকোর সৃষ্ট অন্যান্য চরিত্র
স্টিভ ডিটকো আবার যোগ দেন চার্লটন কমিকে, যেখানে তিনি আর রাইটার জো গিল মিলে সৃষ্টি করেছিলেন ক্যাপ্টেন এটম চরিত্রটি। ডিটকো এরপর এই চরিত্রটির বেশ কিছু বিষয় পরিবর্তন করেন। তার সাইডকিক হিসেবে নিয়ে আসেন সুপার স্পাই নাইটশেডকে। এছাড়াও তিনি ব্লু বিটলের নতুন ভার্সন টেড কর্ডকে সৃষ্টি করেন। প্রথম ব্লু বিটল ড্যান গেরেট তার সুপার পাওয়ার পেয়েছিল রহস্যময় প্রাচীন মিশরীয় এক গুবরেপোকা থেকে। কিন্ত টেড ছিল প্রযুক্তিনির্ভর সুপারহিরো।
চার্লটন কমিকসে স্টিভ ডিটকোর গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টি ছিল দ্য কোয়েশ্চেন। দ্য কোয়েশ্চেন ছিল না কোনো সুপারহিরো কস্টিউম, শুধু একটি স্যুট, একটি হ্যাট আর মুখোশ, যার কারণে মনে হত তার কোনো চেহারা নেই। তার আসল নাম ছিল ভিক্টর সেইজ। সে একজন মেধাবী ডিটেকটিভ যে নিজেকে ন্যায়ের পথে উৎসর্গ করেছিল। চরিত্রটিতে ডিটকো যে দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন অর্থাৎ এইন র্যান্ডের অবজেকটিভিজম বেশ ভাল ভাবেই ফুটে উঠেছে।
এলান মুর তার বিখ্যাত সিরিজ ‘ওয়াচম্যান’ নিয়ে কাজ করার সময় ডিটকোর কাজকে অনুপ্রেরণা হিসেবে নিয়েছিলেন। ততদিনে অর্থাৎ ১৯৮৬ সালে চার্লটন কমিকস তার সব চরিত্রের স্বত্তাধিকার ডিসি কমিকসের কাছে বিক্রি করে দিয়ে নিজেদের ব্যবসা গুটিয়ে নেয়। মুর নিজেও স্টিভ ডিটকো এবং তার কাজের বেশ বড় ভক্ত ছিলেন। তাই ডিটকোর সৃষ্টির সেই চরিত্রগুলোকেই ওয়াচম্যানে ভিন্ন আংগিকে তুলে ধরেন। দ্য কোয়েশ্চেন পরিণত হলো রোরশ্যাকে, ব্লু বিটল পরিণত হলো নাইট আউলে এবং ক্যাপ্টেন এটম পরিণত হলো ডক্টর ম্যানহাটনে। এলান মুর এখনো তার কাজে স্টিভ ডিটকোকে স্মরণ করেন। যেটা বুঝিয়ে দেয়, যদি দ্য কুয়েশ্চন না থাকতো, সেখানে কোনো রোরশ্যাক থাকতো না। অর্থাৎ ডিটকো না থাকলে, কোনো ওয়াচম্যানও থাকতো না।
স্টিভ ডিটকো তার ব্যতিক্রমী এই কর্মজীবনে বেশ কয়েকবার ডিসি কমিকেও কাজ করেছিলেন। যদিও চার্লটন কিংবা মার্ভেল কমিকসের মতো অতটা ছাপ ফেলতে পারেন নি, কিন্তু সেখানেও তার কিছু চরিত্র সৃষ্টি করেন, কিছু ব্যতিক্রমী ধারণার জন্ম দেন। ডিসিতে তার উল্লেখযোগ্য সৃষ্টির মধ্যে আছে দ্য ক্রিপার নামের এক অদ্ভুত সুপারহিরো। এছাড়াও আছে অরজিনাল হক এন্ড ডাভ (যারা প্রথমে ছিল দুই ভাই, কিন্তু তাদের পরিচয় পরে বেশ কয়েকবার পরিবর্তন করা হয়), দ্য চেইঞ্জিং ম্যান, স্টকার ও স্টারম্যান।
অন্যান্য প্রকাশনীতে কাজ করার পাশাপাশি ডিটকো নিজস্ব কমিকও ছাপাতে শুরু করেন, যেটা তাকে আরো বেশি স্বাধীনতা দেয় তার চিন্তার জগতটিকে কমিকের পাতায় ফুটিয়ে তুলতে। সেই কমিকে তার সবচাইতে উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি ছিল মিস্টার এ (Mr. A), যে ছিল ধবধবে সাদা এক স্যুটে এবং মুখে একটি সাদা মুখোশে। মিস্টার এ ছিলেন বেশ কঠোর এবং তার নীতি ছিল অনেকটাই ব্যাটম্যানের উল্টো। এই চরিত্রটিতেও বস্তুমুখিতার ভালই ছোয়া আছে। ১৯৬৭ সাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত স্টিভ ডিটকো চরিত্রটি নিয়ে কাজ করে গেছেন।
স্টিভ ডিটকো একসময় আবার মার্ভেল কমিকসে যোগ দেন যখন স্ট্যান লি আর কমিক লেখায় যুক্ত ছিলেন না। ১৯৯১ সালে স্টিভ ডিটকো আর রাইটার উইল মারে একসাথে সৃষ্টি করেন স্কুইরাল গার্লকে। কেউ কখনোই ভাবেনি সৃষ্টির ২৩ বছর পর এই চরিত্রটি জনপ্রিয়তা পাবে।
স্পাইডার-ম্যান আসলে কার সৃষ্টি?
স্পাইডার-ম্যান চরিত্রটির সাথে মিশে আছে স্ট্যান লি এবং স্টিভ ডিটকোর নাম। কিন্তু বেশ কয়েকবছরই স্পাইডার-ম্যানের স্রষ্টা হিসেবে কেবল স্ট্যান লির নামই উচ্চারিত হত। স্ট্যান লি নিজেকেই সবসময় স্পাইডার-ম্যানের একমাত্র স্রষ্টা বলে দাবি করতেন। বিভিন্ন পত্রিকা-ম্যাগাজিনেও একমাত্র স্ট্যান লিকেই স্পাইডির ক্রিয়েটর বলা হত। যেটা একসময় অনেক ব্যথিত করলে স্টিভ ডিটকোকে।
স্ট্যান লি ২০০৭ সালের বিবিসির এক ডকুমেন্টারি ইন সার্চ অফ স্টিভ ডিটকোতে জনাথন রস যখন তাকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করেন, স্ট্যান লি বলেছিলেন,
আমি মনে করি, যেকোনো চরিত্রকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে সেই সে চরিত্রটির স্রষ্টা। আপনি কোনো চরিত্র নিয়ে ভেবেছেন, তারপর সেটা যে কাউকেই আঁকতে দিতে পারেন।
তবে স্ট্যান লির সেই যুক্তিকে মেনে নেননি স্টিভ ডিটকো। ১৯৯৯ সালে ৩২ পৃষ্ঠার এক ছোট প্রকাশনায় সে ক্ষোভ তুলে ধরেছিলেন।
তবে স্ট্যান লি সবসময় ডিটকোর কাজের প্রশংসা করতেন। তাই তিনি এটা ভাবতেন, কেউ যদি স্টিভ ডিটকোকে কো-ক্রিয়েটর হিসেবে ডাকতে চায়, ডিটকো অবশ্যই সেটার উপযুক্ত। পরবর্তিতে লি একটি চিঠিও পাঠিয়েছিলেন তাকে।
কিন্তু ‘consider’ শব্দটির কারণে সন্তুষ্ট হননি স্টিভ ডিটকো। এরপর আর কখনোই স্ট্যান লি ও স্টিভ ডিটকোর মধ্যে কোনো কথা হয়নি।
তবে এখন স্পাইডার-ম্যানের ক্রিয়েটর হিসেবে সব জায়গাতেই স্ট্যান লির পাশাপাশি স্টিভ ডিটকোর নাম আমরা দেখতে পাই।
শেষজীবন
স্টিভ ডিটকো কখনোই আঁকাআঁকি থেকে অবসর নেননি। ২০০০ সালের পর থেকে বেশ কিছু কমিক লিখেছিলেন। ম্যানহাটনে তার স্টুডিও ছিল। তিনি এই সময়টাতে তার বন্ধু রবিন স্নাইডার বাদে কারো সাথেই কাজ করেননি। ২০১৭ এর শুরুর দিকে তারা নতুনভাবে মিস্টার এ কমিক প্রকাশ করেন। তবে যতই দিন যাচ্ছিল তিনি ততই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। তিনি কোনো ইন্টারভিউ দিতে রাজি হতেন না, স্নাইডার বাদে কারো সাথে কাজ করতেন না, এবং তিনি যোগাযোগ করতেন খুবই কম মানুষের সাথে। এ কারণে তাকে বলা হতো কমিকের জে. ডি. সালিঙ্গার । এসব কারণে তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে খুব কম মানুষই জানতো। তবে এটুকু আমরা জানি, ভাই এবং ভাইপোর সাথে যোগাযোগ ছিল তার। তিনি কখনো বিয়ে করেননি।
মেধাবী এই আর্টিস্ট ৯০ বছর বয়সে ২০১৮ সা্লের ২৯ জুন নিউ ইয়র্কে নিজের বাসাতেই মৃত্যুবরণ করেন।
ডিটকোর আজও অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছেন অনেক কমিকবুক আর্টিস্টকে। কিন্তু যে জগত ডিটকো সৃষ্টি করেছেন, তা কেউ আবার নতুন করে সৃষ্টি করতে পারবে না। ডিটকোর কাজ তাকে বাঁচিয়ে রাখবে আজীবন। যতদিন স্পাইডার-ম্যান নিউ ইয়র্কে ঝুলে ঝুলে শত্রুদের সাথে লড়াই করবে, ততদিনই আমরা স্মরণ করব এই মানুষটিকে।
স্পাইডার-ম্যান সম্পর্কে আরও জানতে পড়ুন এই বইটি