“আমাদের যুগে আমরা যখন খেলেছি পুতুল খেলা
তোমরা এ যুগে সেই বয়সেই লেখাপড়া কর মেলা।
আমরা যখন আকাশের তলে ওড়ায়েছি শুধু ঘুড়ি
তোমরা এখন কলের জাহাজ চালাও গগন জুড়ি।”
(‘আজিকার শিশু’ কবিতার অংশবিশেষ)
কবি সুফিয়া কামাল, নামটির সাথে মিশে আছে অসংখ্য আবেগ, অনুভূতি, ভালো লাগা ও ভালোবাসার সরলতা ও নারীর আত্মবিশ্বাস দৃঢ় করার মনোবল। শুধুমাত্র কবিই নন, তিনি ছিলেন একাধারে সাহিত্যিক, দার্শনিক, সমাজ সেবক, শিক্ষক ও সংগ্রামী নেতৃত্ব । তার কবিতার স্তবকে মিশে আছে প্রেম, প্রকৃতি, ব্যক্তিগত অনুভূতি, বেদনাময় স্মৃতি, স্বদেশের প্রতি মমতা, মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা এবং ধর্মীয় আবেগ।
সহজ কিন্তু আবেগী ভাষার প্রয়োগ ও মননশীল শব্দচয়ন তার প্রতিটি কবিতায় অন্য মাত্রা যুক্ত করে। তার লেখার ঝুলিতে কবিতা ছাড়াও আরও আছে ভ্রমণ কাহিনী, ডায়েরি, ছোট গল্প, উপন্যাস ও শিশুতোষ গ্রন্থ। সব মিলিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ২০টিরও বেশি। সেসবের মধ্যে কেয়ার কাঁটা, মায়া কাজল, মন ও জীবন, উদাত্ত পৃথিবী, অভিযাত্রিক, ভ্রমণ কাহিনী ‘সোভিয়েত দিনগুলি’, স্মৃতিকথা ‘একাত্তরের ডায়েরি’ ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
অনন্ত সূর্যাস্ত-অন্তে আজিকার সূর্যাস্তের কালে
সুন্দর দক্ষিণ হস্তে পশ্চিমের দিকপ্রান্ত-ভালে
দক্ষিণা দানিয়া গেল, বিচিত্র রঙের তুলি তার
বুঝি আজি দিনশেষে নিঃশেষে সে করিয়া উজাড়
দানের আনন্দ গেল শেষ করি মহাসমারোহে।
(‘সাঁঝের মায়া’ কবিতার অংশবিশেষ)
বরিশালের আড়িয়াল খাঁ নদীর পাড়ে শায়স্তাবাদে জন্ম এই মহিয়সী নারীর। ক্যালেন্ডারের পাতায় সেদিন ছিল ১৯১১ সালের ২০ জুন। পিতা সৈয়দ আবদুল বারী ছিলেন সেই সময়কার একজন খুব নামকরা উকিল। কিন্তু পিতার স্নেহ খুব বেশি বছর দীর্ঘায়িত হয়নি সুফিয়া কামালের জন্য। সুফিয়ার সাত বছর বয়সেই বাবা গৃহত্যাগী হন। ফলে পিতার অনুপস্থিতিতে মা সৈয়দা সাবেরা খাতুন অসম্ভব স্নেহ-ভালোবাসায় লালন পালন করতে থাকেন শিশু সুফিয়াকে।
জীবনের শুরুটা কবি সুফিয়ার জন্যে মোটেও আনন্দদায়ক ছিল না। নারীরা তখন সমাজে অনেকটাই পশ্চাৎপদ ছিল। চার দেয়ালের বদ্ধ ঘরে জীবন কাটানোর জন্য প্রস্তুত হতে চাননি তিনি, সমাজের সাথে ঠিকভাবে খাপ খাইয়ে নিতে পারছিল না তার মন। প্রেরণা ছিলেন শুধুই কবির মা সৈয়দা খাতুন। রক্ষণশীল পরিবার বলে, ঘরে মেয়েদের পড়ালেখা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল। মায়ের হাত ধরে হাতে প্রথম বই পাওয়ার আনন্দ পান তিনি। বাড়িতে উর্দুর চল থাকলেও নিজের চেষ্টায় বাংলায় লিখতে পড়তে শিখেন তিনি। গৃহবন্দী জীবনে নিজেকে ধীরে ধীরে স্বশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে থাকেন কবি সুফিয়া।
অন্তর তৃষা মিটাতে এনেছে মমতার মধু-সুধা?
রিক্তের প্রাণ ভরিবে কি আজ পুণ্যের আশ্বাসে?
অবহেলিতেরে ডেকে নেবে ঘরে, তাদের দীর্ঘশ্বাসে।
ব্যথিত মনের সম বেদনায় দূর করি দিয়ে প্রাণজুড়াবে,
শুনাবে ভরসায় ভরা আগামী দিনের গান?
(‘মিটাতে জঠর ক্ষুধা’ কবিতার প্রথম স্তবক)
সুফিয়া কামালের জীবনের দিক পরিবর্তনের সূচনা হয় আরেক মহিয়সী নারী বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সাথে সাক্ষাতের মাধ্যমে। ১৯১৮ সালে মায়ের সাথে যখন প্রথম কলকাতায় যান তিনি, তখন তার পরিচয় হয় বেগম রোকেয়ার সাথে। বেগম রোকেয়ার দর্শন, নারী জাগরণের মনোভাব এবং সাহিত্যানুরাগ ভীষণভাবে নাড়া দেয় শৈশবের সুফিয়াকে।
শৈশবের গণ্ডি না পেরোতেই রক্ষণশীল পরিবারের নিয়মানুযায়ী মাত্র ১৩ বছর বয়সে মামাতো ভাই সৈয়দ নেহাল হোসেনের সঙ্গে সুফিয়ার বিয়ে হয়। স্বামী নেহাল হোসেন যেন সুফিয়ার জীবনে এক অপ্রত্যাশিত আশীর্বাদ হয়ে এসেছিলেন। নেহাল হোসেন নিজে লেখক, সাহিত্যিক ও সমাজসেবী ছিলেন। স্ত্রীর এসব বিষয়ে আগ্রহ দেখে নেহাল হোসেন বিভিন্নভাবে সুফিয়াকে উৎসাহ দিতে লাগলেন। সাধারণ এক গৃহিণী থেকে সাহিত্যের আলোয় নিজেকে মেলে ধরার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ১৯২৩ সালে তিনি রচনা করেন তার প্রথম গল্প ‘সৈনিক বধূ’, যা বরিশালের সেসময়কার জনপ্রিয় ‘তরুণ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯২৫ সালের দিকে মহাত্মা গান্ধী যখন বরিশাল আসেন তখন সুফিয়ার সাথে দেখা হয়ে যায়। মহাত্মা গান্ধীর জীবনদর্শন এবং অহিংসা আন্দোলন অল্প বয়সী সুফিয়াকে এতোটাই নাড়া দিয়ে যায় যে তিনি কিছুদিন চরকায় সুতা কাটতে শুরু করেন। এর পাশাপাশি তিনি নারী কল্যাণমূলক সংগঠন ‘মাতৃমঙ্গল’-এ যোগ দেন।
স্বামীর প্রেরণায় সুফিয়া কামাল ধীরে ধীরে কবিতা লেখায় মনোনিবেশ করেন। কলকাতায় তার আরেকজন বিশেষ ব্যক্তির সাথে পরিচিতি ঘটে যিনি সুফিয়া কামালের কবি জীবন পরবর্তীকালে অনেকটাই পরিবর্তন করে দিয়েছিলেন। তিনি হলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি সুফিয়া কামালের কবিতা পড়ে বিশেষভাবে মুগ্ধ হন। ১৯২৬ সালে ‘সওগাত’ পত্রিকায় ‘বাসন্তী’ কবিতাটি প্রকাশের মাধ্যমে বাংলার সাহিত্যাঙ্গনে সুফিয়া কামাল প্রথম কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
“আমার এ বনের পথে
কাননে ফুল ফোটাতে
ভুলে কেউ করত না গো
কোনদিন আসা-যাওয়া।
সেদিন ফাগুন-প্রাতে
অরুণের উদয়-সাথে
সহসা দিল দেখা
উদাসী দখিন হাওয়া।”
(‘বাসন্তী’ কবিতার অংশবিশেষ)
১৯২৯ সালের দিকে বেগম রোকেয়ার একটি মুসলিম মহিলা সংগঠন যার নাম ছিল ‘আঞ্জুমান-ই-খাওয়াতিন-ই-ইসলাম’-এ কবি সুফিয়া কামাল যোগদান করেন। এখানে নারীদের উন্নতি, শিক্ষা এবং সংস্কারের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হতো। সুফিয়ার জীবনে বেগম রোকেয়ার এমনই প্রভাব ছিল যে বেগম রোকেয়ার সামাজিক আন্দোলনে সবসময় তার পথ অনুসরণ করে গেছেন। এছাড়াও তিনি রোকেয়ার উপর অনেক কবিতা রচনা করেন এবং পরবর্তীতে ‘মৃত্তিকার ঘ্রাণ’ নামে একটি কাব্য সঙ্কলনও উৎসর্গ করেন। ১৯৩৭ সালে সুফিয়া কামালের গল্পের সংকলন ‘কেয়ার কাঁটা’ প্রকাশিত হয়। এর ঠিক পরের বছর তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সাঁঝের মায়া’ প্রকাশিত হয়, যার প্রস্তাবনা লেখেন স্বয়ং কাজী নজরুল ইসলাম। বইটি পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুফিয়া কামালের ভূয়সী প্রশংসা করেন। এর পর থেকেই মূলত সুফিয়া কামালের কবি হিসেবে সুখ্যাতি চারপাশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
তবে কবি সুফিয়া কামালের জীবনেও ছিল অনেক চড়াই উৎরাই। জীবনের এমন কিছু সময় তাকে অতিবাহিত করতে হয়েছে, যখন তাকে নিরন্তর যুদ্ধ করতে হয়েছে পশ্চাৎপদ সমাজ এবং ঘুণে ধরা সংস্কৃতির সাথে। জীবনের সবচাইতে কঠিন পরীক্ষাটি কবির জীবনে আসে ১৯৩২ সালে, যখন তার স্বামী আকস্মিক মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। স্বামীকে হারিয়ে একেবারে একা হয়ে পড়েন কবি। সেই সময়কার প্রেক্ষিতে ছোট্ট একটা মেয়েকে নিয়ে একা একা বাস করা মোটেও সহজসাধ্য ছিল না। আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন করতে কলকাতা কর্পোরেশন প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতার পেশা বেছে নেন। ১৯৪১ সালের শেষ পর্যন্ত তিনি এই পেশায় নিযুক্ত ছিলেন। এই স্কুলেই সৌভাগ্যবশত তার পরিচয় হয় খ্যাতনামা প্রাবন্ধিক আবদুল কাদির এবং পল্লীকবি জসীমউদ্দিনের সাথে।
১৯৩৯ সালের দিকে কবি চট্টগ্রামের লেখক ও অনুবাদক কামালউদ্দীন আহমদকে বিয়ে করেন। সেই থেকে তিনি ‘সুফিয়া কামাল’ নামে সকলের কাছে পরিচিতি লাভ করেন। কবির সংগ্রামী জীবনের পথে স্বামী কামালউদ্দীনকেও নিরন্তর কাছে পেয়েছেন।
সুফিয়া কামালের সারাটি জীবন কেটেছে নারীদের স্বাধীনতা এবং নারীদের শোষণ বঞ্চনার হাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টায়। ১৯৪৬ সালে কলকাতায় যখন ধর্মীয় দাঙ্গা বাধে তখন তিনি কলকাতার সোহরাওয়ার্দী এভিনিউ এলাকাই লেডি ব্র্যাবোর্ন কলেজে একটি আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করার ব্যাপারে যথেষ্ট সাহায্য করেন। ১৯৪৯ সালে বেগম রোকেয়ার সুলতানার স্বপ্ন গ্রন্থের প্রধান চরিত্র সুলতানার নামানুসারে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়।
১৯৪৮ সালে সমাজসেবা ও রাজনীতি হয়ে ওঠে সুফিয়া কামালের ধ্যান-জ্ঞান। হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি রক্ষা করার উদ্দেশ্যে গঠিত শান্তি কমিটিতে যোগ দেন তিনি। ঐ একই বছরই তাকে সভানেত্রী করে ‘পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সমিতি’ গঠিত হয়।
বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধে সুফিয়া কামালের অবদান ছিল অবিস্মরণীয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির ওপর আগ্রাসনের কারণে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। কবি সুফিয়া কামাল এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধেও তীব্র প্রতিবাদ জানান। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষে তিনি ‘সাংস্কৃতিক স্বাধিকার আন্দোলন’ নামে একটি আন্দোলন পরিচালনা করেন। ১৯৬৯ সালে ‘মহিলা সংগ্রাম পরিষদ’ যা বর্তমানে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ নামে পরিচিত, তার হাত ধরেই গঠিত হয়। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশ মহিলা পুনর্বাসন বোর্ড, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন কমিটি এবং দুস্থ পুনর্বাসন সংস্থা, ছায়ানট, বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন এবং নারী কল্যাণ সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৬ সালে শিশুদের সংগঠন কচিকাঁচার মেলা প্রতিষ্ঠার সাথেও সরাসরি জড়িত ছিলেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা হোস্টেলকে ‘রোকেয়া হল’ নামকরণের দাবিও তোলেন কবি সুফিয়া কামাল।
সুফিয়া কামাল ৫০টিরও অধিক পুরস্কার লাভ করেছেন। এর মধ্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, বেগম রোকেয়া পদক, জাতীয় কবিতা পুরস্কার ও স্বাধীনতা দিবস পদক উল্লেখযোগ্য। সুফিয়া কামালের কবিতা চীনা, ইংরেজি, জার্মান, ইতালিয়ান, পোলিশ, রুশ, ভিয়েতনামিজ, হিন্দি ও উর্দু ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর ৮৯ বছর বয়সে ঢাকায় কবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বাংলাদেশী নারীদের মধ্যে তাকেই প্রথম পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়।
কবিদের মৃত্যু নেই; তাই তো তিনি এখনো পাঠকদের সাথে মিশে আছেন তার লেখা কবিতার প্রতিটি চরণে।
“হোক, তবু বসন্তের প্রতি কেন এই তব তীব্র বিমুখতা?”
কহিলাম “উপেক্ষায় ঋতুরাজে কেন কবি দাও তুমি ব্যথা?”
কহিল সে কাছে সরি আসি-
“কুহেলী উত্তরী তলে মাঘের সন্ন্যাসী-
গিয়াছে চলিয়া ধীরে পুষ্পশূন্য দিগন্তের পথে
রিক্ত হস্তে। তাহারেই পড়ে মনে, ভুলিতে পারি না কোন মতে।”
(তাহারেই মনে পড়ে কবিতার শেষ কিছু পঙক্তি)