বয়স সত্তরের কোঠায়। লাল হয়ে গেছে স্বাভাবিক ফর্সা মুখ। কিছুটা পরিশ্রমে, কিছুটা রাগে। তারপরেও থেমে যাননি একটুর জন্যও। বরং বয়সের সাথে সাথে জেদটাও বুঝি বেড়ে গেছে জ্যামিতিক হারে। বাড়বে না-ই বা কেন? এ নিয়ে সাতটা অভিযান হলো খোদ হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে। এবার একটা উচিত শিক্ষা তাদের প্রয়োজন।
প্রতিপক্ষের সৃষ্ট প্রতিকূলতা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যেই তাই মোকাবেলা হলো। অধিকারে এলো হাঙ্গেরির সর্বশেষ দুর্গ সিগেত। দুর্গ পতনের আগের রাতেই আকস্মিকভাবে মৃত্যুবরণ করলেন বৃদ্ধ। সময়টা ১৫৬৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর।
সৈন্যদের মনোবল যেন ভেঙে না পড়ে, সেজন্য গোপন রাখা হয়েছিল মৃত্যুসংবাদ। এমনকি হত্যা করা হয় ব্যক্তিগত হেকিমকেও। সৈন্যদের উপর তার প্রভাব ছিল এতটাই প্রবল। সাম্রাজ্যের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছিল তার শক্তি ও সক্ষমতার গল্প। ভেতরে সমাদৃত হতেন ‘কানুনি’ বা আইনপ্রণেতা নামে। আর ইউরোপ দিয়েছিল Magnificent উপাধি।
সুলতান সুলাইমান। অটোম্যান স্বর্ণযুগে সাম্রাজ্যের নায়ক। পিতা সেলিম দ্য গ্রিম এশিয়া ও আফ্রিকায় একচ্ছত্র অধিপতি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন অটোম্যানদের। পুত্র সুলাইমান ইউরোপে নিজেদের শক্তিশালী ও উন্নত করে অটোমান মহাকাব্যের বাকি অংশ সমাপ্ত করলেন। খুব অল্প কথায় Encyclopedia Britannica তাকে পরিচয় করিয়ে দেয় এভাবে-
সাম্রাজ্যের পরিধি বৃদ্ধি করার জন্য কেবল সামরিক অভিযান নিয়েই ব্যস্ত থাকেননি। আইন, সাহিত্য, শিল্প এবং স্থাপত্যের যেগুলো পরবর্তীতে অটোম্যান বৈশিষ্ট্য বলে স্বীকৃত হয়েছে, তার বিকাশ ঘটেছে মূলত তার আমলে।
বিস্তারিত জানতে হলে ইতিহাসের পাতায় আরেকটু পেছনে যেতে হবে। যেখান থেকে একজন মহান শাসকের গল্পের শুরু। যেখানে শুরু, অটোম্যান সাম্রাজ্যের সবচেয়ে গর্বের আখ্যান।
সুলতান সুলাইমান
সুলাইমানের জন্ম ১৪৯৪ সালের ৪ নভেম্বর ট্রাবজোনে। অটোম্যান সাম্রাজ্যের নবম সুলতান সেলিমের একমাত্র জীবিত পুত্র তিনি। মা আয়েশা হাফসা সুলতান ছিলেন ক্রিমিয়ার ধর্মান্তরিত মুসলিম। হাতেখড়ি হয়েছিল দাদি গুলবাহার খাতুনের কাছে। তারপর, মাত্র সাত বছর বয়সেই ইস্তাম্বুলের তোপকাপি প্রাসাদের রাজকীয় পাঠশালায়।
মেধার পরিচয় পাওয়া যায় দ্রুতই। খায়রুদ্দীন খিজির এফেন্দির তত্ত্বাবধানে ঘুরে আসেন বিজ্ঞান, ইতিহাস, সাহিত্য, যুদ্ধবিদ্যা ও ধর্মতত্ত্বের চৌহদ্দি। বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান লাভের পাশাপাশি ছয়টি ভাষায় দক্ষতাও অর্জিত হয়- অটোম্যান তুর্কি, আরবি, সার্বিয়ান, চাগতাই তুর্কি, ফারসি এবং উর্দু।
মাত্র পনেরো বছর বয়সে প্রাদেশিক শাসনকর্তার পদে আসীন হন সুলাইমান। পিতা এবং চাচাদের মধ্যে উত্তরাধিকার নিয়ে গৃহবিবাদ শুরু হয় ইতোমধ্যে। পিতার পক্ষে বিশ্বস্ত সেনাপতির ন্যায় যুদ্ধ করেন এশিয়া মাইনরে, প্রবল বিক্রমে।
সিংহাসনে আরোহন করলেন সেলিম, পুত্রকে দিলেন ইস্তাম্বুলের ভার। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। নিজের যোগ্যতায় সুলাইমান অর্জন করলেন আনাতোলিয়া ও মিশরের শাসনকর্তার পদ।
সিংহাসনে বসার আগে থেকেই ঈর্ষনীয় রকমের জনপ্রিয় ছিলেন সুলাইমান। অবশিষ্ট দিন কেমন যাবে, তা নাকি সকাল দেখেই বোঝা যায়। সুলাইমানের ক্ষেত্রেও তা শতভাগ সত্যি। দীর্ঘ ৪৬ বছর দোর্দণ্ড প্রতাপে এক বিশাল সাম্রাজ্য শাসন শেষে যখন মৃত্যুবরণ করেন তিনি, ততদিনে তার জনপ্রিয়তা অটোম্যান-সীমানা ছাড়িয়ে, ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়।
সিংহাসনে প্রাথমিক দিনগুলো
সুলেমান সিংহাসনে আরোহন করেন ১৫২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। মা থাকেন পরামর্শক হিসেবে। মৃত্যুর আগে সেলিম অটোম্যান সাম্রাজ্যকে স্থিতিশীল একটা ভিতের উপর দাঁড় করিয়ে যান। ভূমধ্যসাগরীয় অর্থনীতি, এশিয়া ও আফ্রিকার রাজনীতি, এমনকি ধর্মের ক্ষেত্রেও প্রাধান্য নিশ্চিত হয়।
কিন্তু অনেক কাজ যেন তখনো বাকি। সুলাইমান পিতার সাথেই ছিলেন পুরো সময়। তাই হয়তো বুঝতে ভুল করেননি পরবর্তী কর্মপরিকল্পনা ঠিক করতে। মনোযোগ দিলেন সাম্রাজ্যের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত ইউরোপীয় অঞ্চলের দিকে। বলা হয়- খুব বিপজ্জনক গতিতে সুলাইমান তার রাজত্ব শুরু করেন। বেলগ্রেড, রোডস এবং হাঙ্গেরি- একে একে অনুগত করেন নিজের। (The Cambridge History of Turkey, Vol-2, Page-32)
প্রথম জীবনের বন্ধু ইবরাহীম পারগালিকে প্রধানমন্ত্রী করে সাথে রাখা হয়। যদিও প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে শিকার হয়ে জীবন দিতে হয়েছিল তাকে। বন্ধুত্বের অত্যন্ত নির্মম প্রতিদান!
বেলগ্রেড অধিকার
হাঙ্গেরির রাজা লুইয়ের তুর্কি-দূত হত্যাই মূলত সংঘর্ষের প্রধান কারণ হিসাবে পরিগণিত হয়। সুলাইমান তাই রাজধানী বেলগ্রেড দখলের প্রস্তুতি নিলেন।
ঠিক এই সময়টাতে অস্ট্রিয়ার রাজা পঞ্চম চার্লস এবং ফ্রান্সের রাজা প্রথম ফ্রান্সিসের মধ্যে যুদ্ধ চলছিল। মার্টিন লুথারের প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলন ও অন্যান্য কারণে ভেতরে ভেতরেই টানাপোড়েনে ব্যস্ত ইউরোপ। কে কার হয়ে কিংবা কার বিরুদ্ধে লড়ছে, ঠিক নেই। সে যা-ই হোক, দূত হত্যার মতো অপমানে জবাব না দিলে সম্ভ্রম থাকে না!
সুতরাং তিন হাজার সমরাস্ত্রবাহী, দশ হাজার রসদবাহী উট এবং সেই সাথে তিনশো কামানধারী গোলন্দাজ নিয়ে অগ্রসর হলেন সুলতান। সপ্তাহ তিনেক অবরুদ্ধ থাকার পর প্রাণপণ প্রচেষ্টাতেও টিকতে পারলো না শত্রুপক্ষ। ১৫২১ সালের ৩১ আগস্ট পতন ঘটলো বেলগ্রেডের। সুলতান একে পরিণত করলেন হাঙ্গেরির অন্যান্য অংশ অভিযানের ঘাঁটি হিসাবে।
রোডস্ দ্বীপ বিজয়
দ্বিতীয় মুহম্মদ রোডস্ দ্বীপ অধিকার করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। রোডসকে আশ্রয় করে জলদস্যুরা ইস্তাম্বুল ও মিশরে চলাচলকারী তুর্কি বাণিজ্য জাহাজ লুট করতো। উপযুক্ত ব্যবস্থা না নিলে, মুখ থুবড়ে পড়বে ভূমধ্যসাগরে অটোম্যানদের বাণিজ্য। তাই আট হাজার জেনিসারিসহ তিন হাজার রণতরীসমৃদ্ধ শক্তিশালী নৌবহর রোডস্ অভিমুখে প্রেরণ করলেন সুলতান।
নিজে প্রায় এক লাখ সৈন্য নিয়ে এশিয়া মাইনর হয়ে রওনা হলেন। সেন্ট জন-এর নাইটদের বীরত্বপূর্ণ প্রচেষ্টায় ছয়মাস অবরোধেই অতিবাহিত হলো। সে প্রতিরোধ অবশ্য এর বেশি টিকলো না। সুকঠিন প্রতিরোধ-প্রাচীরে একসময় ফাটল ধরলো, আর নাইটরাও আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলো। সময়টা ১৫২২ সালের ২৫ ডিসেম্বর।
রোডস্-বাসীর বীরত্বে মুগ্ধ হয়েছিলেন সুলেমান। সম্মানসূচক সন্ধি স্থাপিত হলো উভয়পক্ষে। ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে পূর্ণ স্বাধীনতা পেলো নাগরিকেরা। কর থেকে অব্যাহতি দেয়া হলো পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য। এর মধ্য দিয়ে ভূমধ্যসাগরের বুকে অটোম্যানদের শক্তিশালী ঘাঁটি হিসাবে স্থাপিত হলো রোডস্।
হাঙ্গেরি অধিকার
রোডস্ বিজয়ের পর বিরতি ছিল বেশ কিছুদিন। অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা- কথাটা যেন আগেকার সেনাবাহিনীর জন্য আরো বেশি করে সত্য। সবসময় যুদ্ধ-বিগ্রহে ব্যস্ত রাখতে হয়। কিন্তু সামনে যদি শত্রু না থাকে, তবে নিজেদের মধ্যেই গোল বাঁধিয়ে মরবে। সুলাইমানের সেনাবাহিনীর সাথেও তা-ই ঘটেছিল। জেনিসারি বাহিনীতে অসন্তোষ দেখা দিলো তুচ্ছ কিছু বিষয়কে কেন্দ্র করে। সুলতান দক্ষতার সাথে দমন করলেন।
ইতোমধ্যে ফ্রান্সের সম্রাট প্রথম ফ্রান্সিস ১৫২৫ সালে পাভিয়ার যুদ্ধে পরাজিত হন অস্ট্রিয়ার পঞ্চম চার্লসের কাছে। যেহেতু হাঙ্গেরির সম্রাট লুই অস্ট্রিয়ার সম্রাটের আত্মীয়, সেহেতু ফ্রান্সিস সুযোগ নিলেন। সুলাইমানকে প্ররোচনা দেন শত্রুকে জব্দ করার জন্য। প্রধানমন্ত্রী ইবরাহিমও পরামর্শ দেন সুযোগটা কাজে লাগাতে।
আবার বাজলো যুদ্ধের দামামা। ১৫২৬ সালে এক লাখ সৈন্য ও তিনশো কামান নিয়ে অভিযান শুরু হলো। পথিমধ্যে পেট্রোভারদিন অধিকার করে মোহাকস্ নামক স্থানে মুখোমুখি হলো দুই বাহিনী। ২৭শে আগস্ট শুরু হয় মোহাকস্-এর যুদ্ধ। সংখ্যা ও যোগ্যতায় তুর্কিরা এগিয়ে থাকায় জয়মাল্য তাদের গলাতেই আসলো। লুই নিহত হলেন। তুর্কি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে এলো গোটা হাঙ্গেরি। ১৪০ বছরের জন্য সেটি পরিণত হলো অটোম্যান সাম্রাজ্যের প্রদেশে।
কাউন্ট জেপোলিয়াকে দায়িত্ব দিয়ে সুলতান ইস্তাম্বুল ফিরলেন। ফ্রান্সের সম্রাট জেপোলিয়াকে সমর্থন দিলেও হাঙ্গেরির বিরাট অংশ বিষয়টা মেনে নিতে পারেনি। ফলে গৃহযুদ্ধের সূচনা ঘটলো। সেই আগুনে ঘি ঢাললো অস্ট্রিয়ার সম্রাট চার্লসের ভাই ফার্ডিনান্ড। আত্মীয়তার সূত্রে দাবি করে বসলো হাঙ্গেরির সিংহাসন।
১৫২৭ সালে টারকাল এর যুদ্ধে জেপোলিয়াকে হটিয়ে মসনদে বসলেন ফার্ডিনান্ড। পালিয়ে এলেন জেপোলিয়া। সাহায্যের আবেদন জানাতে শরণ নিলেন সুলতান সুলাইমানের।
রাগে ফেটে পড়লেন সুলতান। কালবিলম্ব না করে আবার সজ্জিত হলেন অভিযানের উদ্দেশ্যে। ১৫২৯ সালের প্রায় আড়াই লাখ সৈন্য ও সাতশো কামান নিয়ে আক্রমণ করা হলো। যথারীতি পতন ঘটলো হাঙ্গেরির। পরাজিত ফার্ডিনান্ড পালিয়ে আত্মরক্ষা করলো। জেপোলিয়াকে সিংহাসনে বসালেন সুলতান। তারপর রওয়ানা হলেন অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনার পথে। শত্রুর বীজ রাখতে নেই!
ভিয়েনা অবরোধ
অস্ট্রিয়ার সম্রাট চার্লসকে শিক্ষা দেবার জন্যই ১৫২৯ সালে সুলতান পূর্ণ শক্তি নিয়ে ভিয়েনাতে আক্রমণ চালালেন। সমগ্র ইউরোপে তখন তুর্কিভীতি। সংস্কার আন্দোলনকারী মার্টিন লুথার নিজে তুর্কিদের ‘ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ শত্রু’ বলে আখ্যা দিলেন। দুই সপ্তাহ অবরোধ ও গোলন্দাজ বাহিনীর প্রবল আক্রমণে ভিয়েনা নগরীর পতন অত্যাসন্ন হয়ে উঠলো।
কিন্তু আকস্মিকভাবেই সুলতান অবরোধ প্রত্যাহার করে নিলেন। প্রত্যাহারের প্রধান কারণ ছিল মূলত প্রতিকূল পরিবেশ এবং প্রয়োজনীয় রসদের অভাব। তাছাড়া সৈন্য ও জেনিসারিরাও শীতের আগে ইস্তাম্বুল ফিরতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল।
কারো কারো মতে, সুলতান জয়ের জন্য না, বরং ভিয়েনা অবরোধ করেছিলেন ‘শিক্ষা’ দেবার জন্য। আর তাতে তিনি সফল। এর ফলে অস্ট্রিয়ার সম্রাট ও তার ভাই ফার্ডিনান্ড হাঙ্গেরি ও ট্রানসিলভানিয়ার উপর সুলতানের অধিকার মেনে নিয়ে সন্ধি করে।
সাফাভিদের সাথে সম্পর্ক
পারস্যের মসনদে তখন শাহ তামাস্প। পূর্ব শত্রুতাই মূলত এখানে বড় প্রভাবক ছিল। উপরন্তু অস্ট্রিয়ার সম্রাটের দূতকে সম্মানের সাথে গ্রহণ করেছিলেন শাহ। শরীফ খান নামে জনৈক তুর্কি বিদ্রোহীকে দিয়েছিলেন আশ্রয়।
১৫৩৪ সালে ক্ষুব্ধ সুলতান সুলাইমান, প্রধানমন্ত্রী ইবরাহিমকে নিয়ে নামেন পারস্য অভিযানে। প্রায় বিনা প্রতিরোধে অধিকার করেন বাগদাদ ও তাবরিজ। বাগদাদে অবস্থান করে ১৫৩৬ সালের দিকে ইস্তাম্বুল ফিরে যান। আরেকবার অভিযান চালান ১৫৪৮ সালে।
সুলতান যখন ইউরোপ নিয়ে ব্যস্ত, এই সুযোগে ১৫৫৩ সালে শাহ তামাস্প এরজুরাম দখল করে নেন। সময় বের করে তৃতীয়বারের মতো পারস্য অভিযান চালান সুলতান। লণ্ডভণ্ড হলো ফোরাতের পূর্ব তীর। দুই পক্ষের মধ্যে স্থাপিত হলো সন্ধি। সমগ্র ইরাকসহ জিলান ও শেরওয়ান সুলতানের দখলে আসে। বাগদাদে দুই হাজার জেনিসারি রেখে ইস্তাম্বুল ফিরে যান তিনি। ১৫৬৬ সালের দিকে বসরাতে বিদ্রোহ দেখা দিলে তাও সাম্রাজ্যভুক্ত করা হয়।
মাল্টা অভিযান
১৫৬৫ সালে প্রধানমন্ত্রী মোস্তফার নেতৃত্বে মাল্টায় অভিযান প্রেরিত হয়। রোডস্-এ পরাজিত নাইটরা মাল্টায় অবস্থান করে তুর্কি বাণিজ্যতরী ও উপকূলভাগে অতর্কিত আক্রমণ করছিল। তাছাড়া পরবর্তীতে ইতালি বিজয়ের জন্য মাল্টা অধিকারের প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন সুলতান। তুর্কি নৌ-সেনাপতি পিয়ালি পাশা এবং ত্রিপোলির নৌ-সেনাপতি দ্রাগুত পাশা, মোস্তফাকে এই অভিযানে সহযোগিতা করেন।
হঠাৎ তিন সেনাপতির মধ্যে মতানৈক্যের সূচনা ঘটে। সে সুযোগে শত্রুপক্ষ ইতালি ও সিসিলি থেকে রসদ সংগ্রহ করে প্রতিরোধ সুদৃঢ় করে ফেলে। পরিণামে সেন্ট আলামো দুর্গ জয় করতে পারলেও সেন্ট মাইকেল দুর্গ জয় করতে ব্যর্থ হয় তুর্কিরা। বাধ্য হয়ে মোস্তফা অবরোধ প্রত্যাহার করে নেন। ব্যর্থ হয় মাল্টা অভিযান।
সুলাইমানের নৌশক্তি
উৎকর্ষের বিচারে, সুলতান সুলাইমানের নৌশক্তি ছিল স্থলবাহিনীর মতোই প্রতাপশালী। খায়রুদ্দিন বারবারোসা, দ্রাগুত পাশা, ওলুজ পাশা, পিরি পাশা, পিয়ালি পাশা নামের সুদক্ষ কয়েকজন নৌ-সেনাপতি ছিলেন এই সময়। যাদের মাধ্যমে ভূমধ্যসাগরে, লোহিত সাগর এবং আরব সাগরে তুর্কি নৌ-বাহিনীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। অধিকারে আসে তিউনিশিয়া, ত্রিপোলির মতো শহর এবং এডেন উপসাগর, ভূমধ্যসাগরের অনেকগুলো দ্বীপ।
সুলাইমানের সময়ে অটোম্যান বাণিজ্যতরীগুলো মোঘল-ভারতের বন্দরগুলোতে এসেও নোঙর করতো। আকবরের সাথে সুলতানের পত্র বিনিময় হবার প্রমাণও পাওয়া যায়।
কানুনি বা আইনপ্রণেতা
স্বীয় সাম্রাজ্যে কানুনি বা আইনপ্রণেতা হিসেবে খ্যাত হন সুলেমান। প্রধান কারণ, আইন ব্যবস্থায় আমূল সংস্কার। তুর্কি-সাফাভি ব্যবসায় নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে দেন তিনি। অটোম্যান সৈন্যদের খাদ্য ও সম্পত্তি ক্রয়ের আইন জারি হয়। এমনকি শত্রু অঞ্চলে অভিযানে গেলেও বলবৎ থাকবে সেই আইন।
কর ব্যবস্থা সংশোধন ও অতিরিক্ত কর বাতিল করা হয়। রাষ্ট্রীয় নিয়োগে আত্মীয় বা পরিবারের চেয়ে মেধাকে মূল্যায়ন করার জন্য দেওয়া হয় তাগিদ। উঁচু ও নিচু- সমাজের সব তলার সকলের জন্যই, আইন ছিল সমান।
প্রশাসনব্যবস্থা ও সামরিক শক্তিকে ঢেলে সাজান সুলতান। সমগ্র সাম্রাজ্যকে ২১টি প্রদেশে এবং ২৫০টি সানজাক বা জেলায় বিভক্ত করেন। সানজাককে ভাগ করা হয় কাজাস-এ। কাজাসের শাসনকর্তা ছিলেন কাজ, সানজাকের পাশা এবং প্রদেশের গভর্নর। ইহুদি ও খ্রিস্টানদের অধিকার নিশ্চিত করার জন্যও তার পদক্ষেপ প্রশংসার দাবিদার।
পরবর্তী দিনগুলো
১৫৬১ সালের চুক্তি অনুযায়ী সুলতানের অনুগত জেপোলিয়া, ট্রানসিলভানিয়া ও হাঙ্গেরির পূর্ব অংশের কর্তৃত্ব পান। পশ্চিম অংশ যায় ফার্ডিনান্ডের দখলে। উভয়েই সুলতানকে কর দিতে রাজি হয়।
১৫৬৪ সালে ফার্ডিনান্ডের মৃত্যু হলে পুত্র ম্যাক্সিমিলিয়ান ক্ষমতায় আসেন। তিনি পিতার নীতি পরিহার করে কর প্রদানে অস্বীকৃতি জানান। সেই সাথে আক্রমণ চালান অটোম্যান অঞ্চলে। ক্ষুব্ধ সুলতানের বয়স তখন সত্তরের ঘরে। তারপরেও ১৫৬৬ সালে অভিযান চালানো হয়। জীবনের শেষ অভিযান!
সুলতান সুলাইমানের সময়টি অটোম্যান ইতিহাসের স্বর্ণযুগ হিসাবে স্বীকৃত। সামরিক ও প্রশাসনিক যোগ্যতা দিয়েই শুধু না, বিজ্ঞান, সাহিত্য, চিত্রকলা, স্থাপত্যের অনন্য উচ্চতায় আসীন হয় সাম্রাজ্য। নির্মাণের অনেক নিদর্শন আজ পর্যন্ত টিকে আছে।
যে কথা বলা হয়নি
অসংখ্য দাসীর বাইরে আনুষ্ঠানিকভাবে সুলতানের স্ত্রী ছিল দুই জন। প্রথমজন মাহিদেভরান। তার গর্ভে জন্ম নেন বুদ্ধিমান ও যোগ্যতম পুত্র মোস্তফা। দ্বিতীয়জন ইউক্রেনীয় দাসী থেকে স্ত্রী-তে পরিণত হওয়া হুররাম সুলতান; সুলাইমানের প্রিয়তম-পত্নী ও ছয় পুত্রের জননী।
হুররাম জানতেন, যদি হারেমের নিয়ম অনুযায়ী মোস্তফা ক্ষমতায় আসে, তাহলে তার সকল সন্তানকে হত্যা করা হবে। আগেও এমনটিই হয়ে এসেছে। তাই প্রচার করলেন, মোস্তফা তার পিতাকে সিংহাসনচ্যুত করতে চায়।
এই প্রোপাগান্ডার ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। ১৫৫৩ সালে সুলতান তার যোগ্যতম পুত্রকে মৃত্যুদণ্ড দেন। ক্ষমতায় আসেন হুররামের বড় পুত্র সেলিম। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, মোস্তফার কোনো গুণই তার মধ্যে ছিল না। ইতিহাসে তিনি ‘মদ্যপ সেলিম’ নামে পরিচিত।
হেরেমের বাইরে সুলেমান যতটা যোগ্যতম হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, হেরেমের ভেতরে ছিলেন ততটাই দুর্বল। এজন্যই প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে বলি হতে হয়েছে ইবরাহিমের মতো প্রধানমন্ত্রী এবং মোস্তফার মতো যোগ্য উত্তরাধিকারীকে। তার মৃত্যুর পর থেকেই অবক্ষয়ের সূচনা ঘটে অটোম্যান সাম্রাজ্যে। ঐতিহাসিকরা মনে করেন, দুইজন রাজপুত্রের সিংহাসন লাভে ব্যর্থতার পরিণাম, অভিশাপ হিসাবে সাম্রাজ্যের উপর পড়েছে- মোঘল ইতিহাসে দারাশিকোহ আর অটোম্যান ইতিহাসে মোস্তফা।