জ্যাকবের তখন মাত্র ৪ বছর বয়স। তার বাবা মারা গেলে, একমার্ক নামক এক ধর্মযাজককে বিয়ে করেন তার মা। সৎবাবার সাথে মোটামুটি ভালোই সম্পর্ক ছিল জ্যাকবের। কিন্তু সম্পর্ক তার ভালো ছিল না নিয়তির সাথে। তাই ৯ বছরের মাথায় মারা গেলেন তার মা, আর রেখে গেলেন দুই সংসারের মোট ৭টি শিশু, যাদের মধ্যে কেবল জ্যাকবই প্রথম সংসারের। মধ্য আয়ের যাজক একমার্ক সংসার দেখাশোনার জন্য কয়েক মাসের মাথায়ই পুনর্বিবাহ করলেন। আর সৎবাবার কল্যাণে তার জীবনে আসা ‘ডাবল’ সৎমার চোখে প্রথম দিন থেকেই বিষ হয়ে ওঠেন তিনি। একমাসের মাথায়ই তাই বাড়ি ছেড়ে পালালেন, ছুটলেন চাচার কাছে। কিন্তু নিয়তি যেন আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল, তার কৈশোর সুখময় হতে দেবে না!
জ্যাকবের চাচা ম্যাগনাসেরও ছিল গুণে গুণে সাত সন্তান! তাদের নিয়ে দিনাতিপাত করতেই ম্যাগনাসের নাভিশ্বাস অবস্থা। এর মাঝে ‘উটকো ঝামেলা’ হয়ে এলেন জ্যাকব! তবে, জ্যাকবকে তাড়াতে তার কিছুই করতে হয়নি। তার বদমেজাজি নেশাগ্রস্ত স্ত্রীর বকুনি খেয়ে এক হপ্তায় বাড়ি ছেড়ে পালালেন জ্যাকব! কিন্তু, “জন্ম হোক যথাতথা, কর্ম হোক ভালো”, এই উক্তির জন্য তার চেয়ে ভালো উদাহরণ খুব কমই আছে! শোক আর দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করা এই জ্যাকবের পুরো নাম এখনো বলা হয় নি কিন্তু। তিনি জনস জ্যাকব বার্জেলিয়াস, তিনটি মৌলের আবিষ্কারক, পারমাণবিক ভরের আবিষ্কারক, বিক্রিয়ায় প্রভাবকের আবিষ্কারক, সর্বোপরি আধুনিক রসায়নের অন্যতম একজন পুরোধা ব্যক্তি!
জ্যাকব বার্জেলিয়াসের জন্ম ১৭৭৯ সালের ২০ আগস্ট, সুইডেনের গোটল্যান্ড প্রদেশের এক নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে। তার বাবা স্যামুয়েল বার্জেলিয়াস ছিলেন একজন হাই স্কুল শিক্ষক, আর মা এলিজাবেথ ডরোথি ছিলেন গৃহিণী। জন্মের পর থেকেই অভাব অনটন আর অভিভাবকহীনতার জন্য তার প্রাথমিক শিক্ষাটা হয় নড়বড়ে। ১৭৯৩ সালে, মাত্র ১৩ বছর বয়সেই তিনি চমৎকার গৃহশিক্ষক হিসেবে সুনাম অর্জন করেন এবং পেয়ে যান বেশ কিছু ধনী পরিবারের শিক্ষার্থী। এই উপার্জনের উপর নির্ভর করেই তিনি ভর্তি হন লিনকোপিঙ্গের ক্যাথেড্রাল স্কুলে। বিস্ময়কর তাই না? জীবনের প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিজের পয়সায় শুরু করা বিস্ময়করই বটে!
জ্যাকব বার্জেলিয়াসের শৈশব-কৈশোর সিনেমাকেও হার মানায়। গৃহপাঠদান করে স্কুলের ফি তো যোগানো যেত, কিন্তু ঘর ভাড়া আর খাবার দেবে কে? খাবারের সমস্যাও অবশ্য ঘুচেছিল তার অস্বাভাবিক পরিশ্রম করবার ক্ষমতার জন্য। সপ্তাহান্তে কিংবা যেকোনো উৎসবে, অবসর যাপনের কথা কখনো মাথায় আসেনি পরিশ্রমী বালক জ্যাকবের। এ সময় তিনি গৃহশিক্ষার পাশাপাশি কৃষিকাজ ও নানাবিধ কায়িক পরিশ্রমের কাজ করতেন! আর দিনভর হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে রাতে ঘুমাতেন গুদামে! কোনো নির্দিষ্ট গুদাম নয়, যেদিন যে গুদামে জায়গা হয় সেখানেই! এতে করে বেঁচে যেত সামান্য কিছু অর্থ।
স্কুলজীবনে সচরাচর বিজ্ঞানীদের মতো ‘মেধাবী’ তকমাটা গায়ে মাখাতে পারেননি বার্জেলিয়াস। কায়ক্লেশে কাটা দিনগুলোতে পড়ালেখা চালিয়ে গিয়েছিলেন, সেটাই তো অনেক কিছু। তবে একটি বিষয়ে তিনি বরাবরই দুর্দান্ত ছিলেন, তা হলো জীববিজ্ঞান। আর জীববিজ্ঞান নিয়ে বালক বার্জেলিয়াসের মধ্যে অসীম সম্ভাবনা দেখেছিলেন তার স্কুলের বিশপ। তাই ফলাফল ভালো না হওয়া সত্ত্বেও তিনি বার্জেলিয়াসকে ভর্তির জন্য আপসালা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জ্যাকবকে ভর্তি করাতে রাজি হয়ে গেল। জীববিজ্ঞানের প্রতি নিজের আকর্ষণ এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তার কথা ভেবে জ্যাকব ডাক্তারি পড়াকেই বেছে নিলেন।
১৭৯৭ সালে আপসালায় পড়ালেখা শুরু করেন জ্যাকব বার্জেলিয়াস। মাসখানেক যেতেই অনুধাবন করলেন অর্থ ফুরিয়ে আসছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের মতো ব্যয়বহুল পড়ালেখা চালানো তার পক্ষে সম্ভব না বুঝতে পেরে ছেড়ে দেন বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু এবার নিয়তি যেচে পড়েই এলো বার্জেলিয়াসের সাথে সম্পর্ক ভালো করতে। ১৭৯৮ সালে তিনি পেয়ে গেলেন ৩ বছরের স্কলারশিপ! শুরু হলো আপসালায় তার দ্বিতীয় অধ্যায়। আপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ, সমকালীন বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বলে পরিচিত ছিল। আর এখানে রসায়ন পড়ে, রসায়নের ভিতটা ভীষণ মজবুত হয়ে যায় তার। ক্লাস শেষে প্রায়শই তাকে দেখা যেত রসায়ন গবেষণাগারে। এভাবেই চললো তার চিকিৎসাবিজ্ঞান পড়া। ১৮০২ সালে তিনি ডাক্তারির ছাড়পত্র নিয়ে বেরিয়ে যান আপসালা থেকে।
জীববিজ্ঞানের প্রতি ঝোঁক, কিংবা ডাক্তার হয়ে অর্থাভাব দূর করার ইচ্ছা, দুটোই যেন হঠাৎ উবে গেল বার্জেলিয়াসের! তার মন তখন শুধুই রসায়ন গবেষণাগারে পড়ে থাকে। পড়ালেখা শেষ করেও, তাই তার পড়ালেখা শুরু হয় নতুন করে! তবে এবার চিকিৎসাবিজ্ঞান নয়, এবার রসায়ন। ‘পার্টটাইম’ চিকিৎসক, আর ‘ফুলটাইম’ গবেষক হয়ে ওঠেন বার্জেলিয়াস। যে গবেষণাগারেই ডাক আসে, সেখানেই তিনি চলে যান এবং সর্বোচ্চ সহায়তা করেন। তথাপি এই কাজের জন্য গ্রহণ করেন না একটি পয়সাও। বরং, তার মনোভাব এমনই ছিল যে, প্রয়োজনে পকেটের অর্থ ব্যয় করে এই কাজ তিনি করে যাবেন!
১৮০৩-০৫ সাল পর্যন্ত সময়টা ছিল জ্যাকব বার্জেলিয়াসের উত্থানকাল। এ সময় তিনি উইলহেলম হিসিংগার নামক এক খনি মালিকের সহায়তায় কিছু চমৎকার রাসায়নিক পরীক্ষা চালান। এগুলোর মধ্যে একটি পরীক্ষায় তিনি বিস্ময়ের সাথে আবিষ্কার করলেন যে, অ্যাসিড, দ্রবণের যে তড়িৎ মেরুতে অবস্থান নেয়, ক্ষার তার বিপরীত মেরুতে যায়। এ কাজে তিনি নিজের তৈরি ব্যাটারি ব্যবহার করেছিলেন, যা দ্রবণে লবণের আয়ন সরবরাহ করে। পরের বছর রসায়নবিদ হামফ্রে ডেভি প্রায় সমরূপ প্রক্রিয়া ব্যবহার করে পটাসিয়াম এবং সোডিয়াম নামক দুটি মৌলিক পদার্থ আবিষ্কার করেন। ডেভির এই আবিষ্কার অভিভূত করে জ্যাকবকে।
অবশ্য ডেভির সোডিয়াম এবং পটাশিয়াম আবিষ্কারের পূর্বেই, হিসিঙ্গারের সাথে একটি বিশেষ মৌল আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন জ্যাকব বার্জেলিয়াস। ১৮০৩ সালে আবিষ্কৃত এই মৌলের নাম রাখা হয় ‘সিরিয়াম’। এর আবিষ্কারের দু’বছর পূর্বে, ইতালিয়ান বিজ্ঞানী পিয়াজ্জি একটি বামন গ্রহ আবিষ্কার করেছিলেন যার নাম রাখা হয় ‘সেরেস’। এই বামন গ্রহের নামেই মৌলটির নাম সিরিয়াম রাখা হয়। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে, এতকিছুর পরও তার আর্থিক অবস্থা ছিল শোচনীয়। ‘দিন আনি দিন খাই’ করেও চলছিল না। গবেষণায় অধিক সময় ব্যয় করার কারণে মনোযোগ দিয়ে ডাক্তারি করতে পারছিলেন না তিনি। ফলে ডাক্তারি থেকেও আয় ছিল সামান্যই। এই সংকট সমাধানে আরো একবার হাত বাড়ায় নিয়তি! অপ্রত্যাশিতভাবে, ১৮০৭ সালে স্টকহোমের ক্যারোলিন্সকা মেডিক্যাল ইনস্টিটিউটে রসায়ন অধ্যাপকের পদে চাকরি পান বার্জেলিয়াস।
১৮০৮ সালে প্রকাশিত হয় জন ডাল্টনের বিখ্যাত বই ‘আ নিউ সিস্টেম ইন কেমিক্যাল ফিলসফি’। এই বইয়ে তিনি তার বিখ্যাত তত্ত্ব প্রকাশ করেন যা ‘ডাল্টনের সূত্র’ নামে সমধিক পরিচিত। “পদার্থের ক্ষুদ্রতম একক পরমাণু যা দ্বারা প্রতিটি পদার্থ গঠিত” কিংবা, “ভিন্ন ভিন্ন মৌলের পরমাণু ভিন্ন ভিন্ন”, এরকম বৈপ্লবিক তত্ত্ব দাঁড় করালেও ডাল্টন যথার্থ প্রমাণ দিতে পারছিলেন না। ফলে কিছুটা হলেও ম্লান হয়ে যায় তার বৈপ্লবিক আবিষ্কার। এর পেছনে প্রধান কারণ হচ্ছে, ডাল্টনের সঠিকভাবে পারমাণবিক ভর নির্ণয় করতে না পারা। এই সমস্যা সমাধানে কে এগিয়ে এসেছিলেন জানেন? অবশ্যই জনস জ্যাকব বার্জেলিয়াস!
মৌলের পারমাণবিক ভর নির্ণয়ের জন্য বার্জেলিয়াস ডুব দেন অনন্ত রাসায়নিক পরীক্ষানিরীক্ষার মাঝে। উল্লেখ্য, তখনো পরমাণুর অস্তিত্বই প্রমাণিত নয়। যার অস্তিত্বই প্রমাণ হয়নি, তার ভর নির্ণয় কতটা দুরূহ একবার ভাবুন! তিনি তাই বুদ্ধি করে অক্সিজেনকে আদর্শ ধরে নিলেন, অন্য মৌলগুলোর সাথে তুলনার সুবিধার জন্য। প্রথমে তিনি বায়বীয় বিক্রিয়া নিয়ে কাজ শুরু করলেন এবং ১৮১৮ সালের মধ্যেই তখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সকল গ্যাসীয় মৌলের পারমাণবিক ভর নির্ণয় করে ফেললেন।
১৮১৮ থেকেই বার্জেলিয়াস ধাতব মৌলের পারমাণবিক ভর নির্ণয়ের কাজ শুরু করেন। তিনি অক্সিজেনের সাথে বিভিন্ন মৌলের বিক্রিয়া সেগুলোর পারমাণবিক ভর নির্ণয় করেন। তবে, এই প্রক্রিয়ায় ভুল হবার সম্ভাবনা ছিল শতভাগ। কারণ, কোনো মৌল অক্সিজেনের এক পরমাণুর সাথে বিক্রিয়া করে, তো কোনোটি দুই পরমাণুর সাথে (যা আমরা আধুনিককালে জানতে পেরেছি)। এগুলো ছাড়াও তিনি নিজস্ব প্রক্রিয়ায় নানা গবেষণার মাধ্যমে সে সময়ে আবিষ্কৃত ধাতুগুলোরও পারমাণবিক ভর নির্ণয় করেন। তার আবিষ্কৃত পারমাণবিক ভরের উপর নির্ভর করেই ১৮৬৯ সালে দিমিত্রি মেন্ডেলিভ পর্যায় সারণী তৈরি করেন, যা সূচনা করে আধুনিক রসায়নের। অন্যদিকে, পারমাণবিক ভর আবিষ্কারই ডাল্টনের সূত্রকে গ্রহণযোগ্যতা এনে দিয়েছিল।
১৮১৫ সালে জ্যাকব বার্জেলিয়াস আরো একটি মৌল আবিষ্কার করেছিলেন সম্পূর্ণ একক প্রচেষ্টায়। ‘থোরিয়াম’ নামক মৌলটি আবিষ্কার করেই তিনি কাজ শুরু করেন জোহান ঘানের সাথে, যার সাথে একত্রে কাজ করে আবিষ্কার করেন ‘সেলেনিয়াম’। ১৮২৪ সালে তিনি ল্যাবরেটরিতে প্রথম সিলিকন সংশ্লেষণ করেন। কিন্তু মৌলগুলোর নামকরণ করতে গিয়ে বিস্তর সমস্যা হতো। কারণ, তখনো মৌলের নাম লেখার নির্দিষ্ট পদ্ধতি সংকলিত হয়নি। ফলে একেক দেশে একেক নামে পরিচিত হতো মৌলগুলো। বার্জেলিয়াসই প্রথম, মৌলের ল্যাটিন নামের অক্ষর দ্বারা মৌলের নামকরণের পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। যেমন, লোহা ইংরেজিতে ‘আয়রন’ কিংবা জার্মান ভাষায় ‘আইজেন’ নামে পরিচিত। বার্জেলিয়াস, এর ল্যাটিন নাম ‘Ferrum’ থেকে Fe সংকেত দ্বারা আয়রনকে চিহ্নিত করেন। এই পদ্ধতিই এখনো বিশ্বজুড়ে চলছে।
রাসায়নিক বিক্রিয়ায় যে পদার্থের প্রভাবে বিক্রিয়ার গতি বৃদ্ধি পায় বা হ্রাস পায়, তাকে বিক্রিয়ার প্রভাবক বলে। ১৮৩৫ সালে বার্জেলিয়াস প্রভাবক আবিষ্কার করেন এবং নামকরণ করেন। অন্যদিকে, চার প্রকার রাসায়নিক বন্ধনের মধ্যে অন্যতম একটি বন্ধন হচ্ছে আয়নিক বন্ধন। যদিও আয়নিক বন্ধনের আবিষ্কর্তা হিসেবে বার্জেলিয়াসের কথা শোনা যায় না, তথাপি এই বন্ধনের মূল ধারণাটা তার মাথা থেকেই এসেছিল প্রথমে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, একটি ধনাত্মক এবং ঋণাত্মক চার্জিত আয়নের মধ্যে স্থিরবৈদ্যুতিক আকর্ষণের মাধ্যমে রাসায়নিক (আয়নিক) বন্ধন সৃষ্টি হয়।
১৮১৮ সালে সুইডেনের রাজা কার্ল, বার্জেলিয়াসকে ‘সুইডিশ নোবিলিটি’ প্রদান করেন। ‘বার্জেলিয়াস’স টেক্সটবুক অব কেমিস্ট্রি’ আক্ষরিক অর্থেই বিশ্বজুড়ে রসায়নবিদদের কাছে রসায়নের পাঠ্যবইয়ে পরিণত হয়। ১৮৩৫ সাল, ৫৬ বছর বয়সে নিজের চিরকুমার থাকবার পণ ভঙ্গ করেন বার্জেলিয়াস। বিয়ে করেন ২৪ বছর বয়সী এলিজাবেথ পপিয়াসকে। এই দম্পতির ঘরে কোনো সন্তান জন্ম নেয়নি। ১৮৪৮ সালের ৭ই আগস্ট স্টকহোমের মৃত্যুবরণ করেন জ্যাকব বার্জেলিয়াস। তাকে সোলনা সমাধিস্থলে সমাহিত করা হয়।
ফিচার ছবি: commons.wikimedia.org