মেরিল স্ট্রিপ: দশকের পর দশক ধরে যিনি হলিউড রাজ্যের রানী

হলিউডে এত এত অভিনয়শিল্পীর ভিড়ে এমন অনেক অভিনয়শিল্পী আছেন যারা কাল, প্রজন্ম ও বয়সের সীমানায় নিজেদেরকে গণ্ডিবদ্ধ রাখেননি। যে দীপ্তিময় আভা নিয়ে তারা প্রবেশ করেছিলেন সময়ের সাথে সাথে সেটিকে আরো উদ্ভাসিত করে দিগ-দিগন্তে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। এই সারির শিল্পীদের আখ্যায়িত করা যেতে পারে ‘চিরসবুজ’ তারকা বলে। এদের মধ্যে একজনের নাম যেন আলাদাভাবে জ্বলজ্বল করে। সেই একজনকে নিয়েই আজকের আলোচনা।

ছোটকাল থেকে আত্মকেন্দ্রিক ও কিছুটা অলস প্রকৃতির এই অভিনেত্রীকে তার মা একবার বলেছিলেন, “মেরিল, তুমি সম্ভাবনাময়ী। তুমি অসাধারণ। তুমি একবার কোনোকিছুতে মন বসিয়ে ফেললে সেটা করেই ছাড়বে। কিন্তু তুমি আলসেমি করলে সেটা সম্ভব নয়। তবে তোমার দ্বারা কোনোকিছুই করা অসাধ্য নয়।” নিজের জন্মদাত্রীকে নিজের জীবনের চলার পথের গুরু মনে করতেন। ছোট্ট মেয়েটি মায়ের কথাগুলোকে পরম যত্নে বুকে ধারণ করে নিয়েছিল। সেই থেকে শুরু করে নিজের প্রাপ্ত বয়সকালেও মাকে সবসময় নিজের একমাত্র উপদেষ্টা হিসেবে গণ্য করে এসেছিলেন।

মেরিল নামটি উচ্চারণ করার পরে তাকে নতুন করে আর পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। হলিউড, হলিউডের সিনেমা ও হলিউডের অভিনেতা-অভিনেত্রী নিয়ে যাদের মোটামুটি ভালো ধারণা আছে, তাদের জন্য মেরিল স্ট্রিপ নামটির সাথে পরিচিত না থাকাটা প্রায় অসম্ভব। তার অভাবনীয় খ্যাতি ও অর্জনের দিকে তাকালে উঠতি ও সাফল্য অন্বেষণকারী অভিনয়শিল্পীরা একইসাথে অনুপ্রাণিত ও ঈর্ষান্বিত হতে বাধ্য। হবেই বা না কেন? প্রজন্মের সেরা অভিনেত্রী মেরিল তার অভিনয় জীবনে ২১টি অ্যাকাডেমি এওয়ার্ড ও ৩১টি গোল্ডেন গ্লোব এওয়ার্ডের জন্য মনোনীত হয়েছেন। হলিউডের ইতিহাসে এটি এক বিরল ঘটনা। একমাত্র তিনিই এই কৃতিত্বের অধিকারি।

আজকের হলিউড থেকে পুরো বিশ্ব যাকে মেরিল স্ট্রিপ হিসেবে একনামে চেনে, তিনি খ্যাতি, প্রাপ্তি, মর্যাদা ও সাফল্যে নামক উপাদানগুলো নিজের হাতের মুঠোতে নিয়ে জন্মাননি। তিনিও একসময়ে একজন সাধারণ বালিকা রূপে পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন। সে সময় থেকে শুরু করে আজ অবধি তার জীবনের প্রতিটি স্তরের উপর আলোকপাত করা হবে এখানে।

তরুণী মেরিল স্ট্রিপ; Source: citaty.net

জগতে এক জগদ্বিখ্যাতের আগমনী

১৯৪৯ সালের ২২ জুন মেরি লুইস স্ট্রিপ জন্মগ্রহণ করেছিলেন। জন্মস্থান যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির সামিট শহর। বাবা হ্যারি উইলিয়াম স্ট্রিপ জুনিয়র পেশায় একটি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী ও তার মা মেরি উইলকিনসন স্ট্রিপ একজন কমার্শিয়াল আর্টিস্ট ও আর্ট এডিটর হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

মেরিলের অভিনয়জীবনের শুরুটা কিন্তু রূপালি পর্দায় অভিষেকের মাধ্যমে হয়নি। তিনি যখন বারো বছরের কিশোরী, তখন স্কুলের সংগীত পরিবেশনায় তাকে কণ্ঠশিল্পী হিসেবে বাছাই করা হয়। সেই সূত্র ধরে পরবর্তীতে তিনি এস্টেল লিবলিংয়ের কাছে অপেরা চর্চা করার সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু মেরিলকে সংগীতচর্চা তেমন একটা টানতে পারেনি। তার নিজের ভাষ্যমতে,

“আমি এমন কিছু গাইছিলাম যা আমি নিজেও বুঝে উঠতে কিংবা অনুভব করতে পারছিলাম না। তাই সেটা ছেড়ে দেওয়া অত্যাবশ্যক ছিল। পাশাপাশি অত্যাবশ্যক ছিল এমন কিছু খুঁজে নেওয়া, যা আমি অনুভব করতে পারবো।”

চার বছর সংগীতের পেছনে শ্রম দেওয়ার পর, তিনি সংগীতকে চিরতরে বিদায় জানিয়েছিলেন।

চিয়ারলিডারের বেশে কিশোরী মেরিল; Source: wypr.org

উন্মুক্ত মঞ্চে মেরিলের মোহাচ্ছন্ন অভিনয়

হাই স্কুলে পড়াকালীন সময়ে মেরিল স্কুলের অনেকগুলো নাটকে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১৯৬৯ সালে ভাসার কলেজের নাটক মিস জুলিতে অভিনয় করার আগ পর্যন্ত তিনি নিজেও জানতেন না তার ভেতর একজন প্রতিভাবান অভিনেত্রী লুকিয়ে আছে। ভাসার কলেজের ড্রামা প্রফেসর ক্লিনটন জে. অ্যাটকিনসন তরুণ মেরিলের প্রশংসা করতে গিয়ে বলেছিলেন “আমার মনে হয় না, মেরিলকে কেউ কখনো অভিনয় শিখিয়েছিল। সে নিজেই এটা রপ্ত করে নিয়েছিল।”

ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় তিনি প্রথম বছরেই ডজনখানেক মঞ্চ নাটকে অভিনয় করেছিলেন। কিন্তু অতিরিক্ত কাজের চাপ ও প্রাতিষ্ঠানিক চাপের ফলে নিজের প্রতি এতটাই উদাসীন হয়ে উঠেন যে, আলসারে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। তাই সে সময়ে অভিনয় ছেড়ে, আইনের ওপর পড়াশোনার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু নিয়তির খেল কিংবা অভিনয়ের প্রতি অশেষ টান যেটাই কারণ হয়ে থাকুক না কেন, টানা চার বছর ওয়েট্রেস ও টাইপরাইটিংয়ের কাজ করে পড়াশোনার খরচ চালিয়ে শেষমেশ চারুকলায় মাস্টার্স ডিগ্রি নিয়ে বের হন।

একই বছর ইউজিন ও’নিল থিয়েটার সেন্টারে আয়োজিত জাতীয় নাট্যকার সম্মেলনে পাঁচ-ছয়টি মঞ্চ নাটকে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে তিনি পেশাগতভাবে অভিনয় জগতে পদার্পণ করেছিলেন। এরপর নিউইয়র্কে গিয়ে বসবাস শুরু করলে, সেখানের একটি পাবলিক থিয়েটারে মঞ্চনাটক নির্দেশক জোসেফ প্যাপের দলের সদস্য হয়ে ট্রেলনি অব দ্য ওয়েলস নাটকে অভিনয় করেন। পাশাপাশি নিউইয়র্কে পা দেওয়ার পর প্রথম বছরেই আরো পাঁচটি মঞ্চ নাটকে অভিনয়ের সুযোগ পান। এর মধ্যে প্যাপের নিউইয়র্ক শেক্সপিয়র ফেস্টিভ্যাল প্রডাকশনের হেনরি ভি, দ্য ট্যামিং অব দ্য শ্রিউ ও মেজার অর মেজারও অন্তর্ভুক্ত ছিল।

ক্যামেরার সামনে আসার পেছনের গল্প

১৯৭৬ সালে প্রথমবারের মতো সিনেমার নায়িকার হবার স্বপ্ন বুকে লালন করে মেরিল ইতালীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা ডিনো ডি লরেনটিসের সামনে কিং কং সিনেমার জন্য অডিশন দিতে আসেন। লরেনটিসের তাকে তো পছন্দ হওয়া দূরের কথা, তিনি মেরিলের সামনেই নিজের ছেলেকে বলেছিলেন, “এই মেয়ে দেখতে কেমন কুৎসিত। কাকে ধরলে আনলে তুমি?” মেরিল ইতালীয় ভাষা জানতেন বলে সাথে সাথে লরেনটিসের মুখের ওপর সেদিন উত্তর দিয়েছিলেন, “আমি আপনার প্রত্যাশানুযায়ী সুন্দরি নই বলে মাফ করবেন। কিন্তু জেনে রাখবেন- এটাই আমি। আর আমি এমনই ঠিক আছি।”

সে বছর বাকিটা সময় নিজেকে পুরোপুরিভাবে মঞ্চনাটকে ডুবিয়ে রেখেছিলেন। সে সময়ে টিনেসি উইলিয়ামের টোয়েন্টি সেভেন ওয়াগনস ফুল অব কটন-এর জন্য মঞ্চনাটকের সেরা অভিনেত্রী হিসেবে টনি এওয়ার্ডের জন্য মনোনয়ন প্রাপ্ত হন । এছাড়া আর্থার মিলারের অ্যা মেমোরি অব টু মানডেস-এ অভিনয় করেও দারুণ সুনাম অর্জন করেছিলেন। তাছাড়া চেলসি থিয়েটার সেন্টারের ছোট পরিসরে অ্যান্টন চেকভের দ্য চেরি অর্চ্যার্ড ও বার্টোল্ট ব্রেশট- কার্ট ওয়েইল-এর মিউজিকাল ড্রামা হ্যাপি এন্ড-এ অভিনয়ের জন্য দুটো ড্রামা ডেস্ক এওয়ার্ডের জন্যও মনোনীত হয়েছিলেন।

প্রথমবার রূপালি পর্দায় আগমন ঘটে ১৯৭৭ সালে। জুলিয়া নামক সেই সিনেমাতে খুব স্বল্প সময়ের একটি ফ্ল্যাশব্যাকের দৃশ্যে তাকে দেখানো হয়েছিল। সিনেমায় তার অনেকগুলো দৃশ্য ও সংলাপ কাঁটাছেড়া প্রসঙ্গ নিয়ে তার বক্তব্য ছিল,

“আমাকে একটা বিদঘুটে পরচুলা পরানো হয়েছিল। আর আমি জেনের সাথে যে দৃশ্যগুলোতে অভিনয় করেছিলাম, সেগুলো থেকে আমার সংলাপগুলো কেটে অন্য দৃশ্যে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি ভেবেছিলাম, আমি কোনো মারাত্মক ভুল করে ফেলেছি। আর কোনো সিনেমা নয়। আমি এই ধান্দাটাকেই অপছন্দ করতে শুরু করেছি।”

ভাগ্যিস, সেদিনের কথাটি একদম মন থেকে শতভাগ নিশ্চয়তার সাথে বলেননি তিনি। তাহলে, আজকের মেরিল স্ট্রিপকে কীভাবে পেতাম আমরা?

রূপালি পর্দায় ঝলমলে মেরিল

মেরিল স্ট্রিপের ভাগ্যের চাকা ঘুরানোর পেছনে মূলত আরেক কিংবদন্তী অভিনেতা রবার্ট ডি নিরোর ভূমিকা অনস্বীকার্য। মেরিলকে দ্য চেরি অর্চ্যার্ড মঞ্চনাটকে অসাধারণ অভিনয় করতে দেখে তিনি নিজের অভিনীত পরবর্তী সিনেমা দ্য ডিয়ার হান্টার-এ নিজের প্রেমিকার চরিত্রে অভিনয়ের জন্য তাকে প্রস্তাব করেন। বিখ্যাত সিনেমা সমালোচক পলিন কায়েল সেই সিনেমাতে মেরিলকে দেখে তাকে ‘সত্যিকার অর্থেই সুন্দরী’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। যদিও পরবর্তীকালে তিনি মেরিলের অন্যতম সমালোচক হিসেবে তার অভিনয় জীবনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন।

প্রথম সিনেমা দিয়েই বাজিমাত করেছিলেন মেরিল। তার সাক্ষাৎ প্রমাণ দ্য ডিয়ার হান্টার সিনেমার জন্য তার অস্কারে সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রী শাখায় মনোনয়ন লাভ। তাছাড়া সিনেমাটি বেস্ট ফিচার ফিল্ম ক্যাটাগরিতে অ্যাকাডেমি এওয়ার্ডও অর্জন করে। দ্য ডিয়ার হান্টার ছাড়াও ১৯৭৮ সালে তাকে মিনি সিরিজ হলোকাস্ট-এ দেখা গিয়েছিল। সেই সিরিজে তিনি একজন জার্মান মহিলার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, যিনি হিটলারের শাসন আমলে একজন ইহুদি আর্টিস্টকে বিয়ে করেছিল। সিরিজটি শুধু যে ব্যবসায়িকভাবেই দারুণ সফল হয়েছিল তা-ই নয়, এমনকি জনপ্রিয়তার দিকেও দারুণ সাড়া ফেলেছিল। সিরিজটি মেরিলকে সমগ্র দেশব্যাপী পরিচিত করে তোলে। এছাড়া প্রাইম টাইম অ্যামি অ্যাওয়ার্ডের সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কারও তার ঝুলিতে এনে দেয়। এত সাফল্যের পরেও, মেরিলকে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি মঞ্চনাটকের মতো তেমনটা উদ্যমী করতে পারছিল না।

প্রেমিক ক্যাজেলের মৃত্যুর শোককে কাটিয়ে উঠতে, তিনি ১৯৭৯ সালে ‘দ্য সিডাকশন অব জো টাইনান’ মুভিতে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। একই বছর উডি অ্যালেনের পরিচালিত ও অভিনীত ‘ম্যানহাটন’-এও পার্শ্ব অভিনেত্রী হিসেবে অভিনয়ের সুযোগ মেলে তার। যদিওবা তিনি পরে অভিযোগ করেছিলেন, অ্যালেন তাকে পরিপূর্ণ কোনো স্ক্রিপ্ট দেওয়া তো দূরের কথা, তাকে নিজের সংলাপগুলো নিজের মতো গুছিয়ে বলার সুযোগও দেয়নি। তবে সে বছরের ‘ক্রেমার ভার্সেস ক্রেমার‘, মেরিলের অভিনয় জীবনের প্রথম মাইলফলক ছিল। ডাস্টিন হফম্যানের বিপরীতে এই মুভিতে তিনি এমন একজন বিবাহিত নারীর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এই চরিত্র নিজের স্বামী ও সন্তানকে ফেলে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়।

এই মুভির গল্প নিয়ে প্রথমদিকে মেরিলের কিছুটা আপত্তি থাকলেও, পরে মায়ের সাথে এ ব্যাপারে খোলামেলা আলোচনা করে মুভিটিতে কাজ করার ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। মুভির পরিচালক রবার্ট বেন্টন অভিনেতা হফম্যানের ঘোর আপত্তি থাকা সত্ত্বেও, মুভির দুটি গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যে মেরিলকে নিজের সংলাপ নিজের মতো করে লেখার সুযোগও দিয়েছিলেন। পরবর্তী মেরিল সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে হফম্যান বলেছিলেন, “সে অস্বাভাবিক রকমের পরিশ্রমী, একদম অত্যধিক যাকে বলে। আমার মতে, যখন সে কোনো কাজে নিয়োজিত থাকে, তখন সেটি ছাড়া তার মাথায় আর কোনো কিছুই থাকে না।”

‘ক্রেমার ভার্সেস ক্রেমার’ মুভিটিতে চমৎকার অভিনয় দক্ষতা প্রদর্শনের ফলে গোল্ডেন গ্লোব ও অ্যাকাডেমি এওয়ার্ডে সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রী ক্যাটাগরিতে পুরস্কার অর্জন করেছিলেন। এছাড়া মুভিটি সেরা চলচ্চিত্র শাখাতেও অস্কার জিতে নিয়েছিল।

‘দ্য ডিয়ার হান্টার’ সিনেমার শুটিং চলাকালীন মেরিল ও ক্যাজেল; Source: The Quint

সাধারণ দর্শক থেকে কঠোর সমালোচকের মুখে

তখনো মেরিল মঞ্চনাটকের সাথে নিজের আত্মিক টানকে পুরোপুরিভাবে বিচ্ছিন্ন করতে পারছিলেন না। তাই নিউইয়র্ক পাবলিক থিয়েটারে অনুষ্ঠিত জোসেফ পাপের ‘এলিস ইন কনসার্ট’ মিউজিকাল ড্রামাতে অংশগ্রহণ করেন। নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদক ফ্রাঙ্ক রিচ মেরিলকে সেই প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের, ‘একমাত্র বিস্ময়’ বলে উল্লেখ করলেও অবাক হয়েছিলেন, এই ভেবে যে, “কেন সে তবুও মঞ্চনাটকে এতটা খাটুনি দিচ্ছে?”

১৯৮০ সালের দিকে মেরিল সিনেমার মূল চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব পেতে শুরু করলেন। সে বছর নিউজউইক-এর মূল প্রচ্ছদে তার ছবিসহ হেডলাইন এসেছিল, ‘আশির দশকের তারকা’।

১৯৮১ সালে ব্রিটিশ রোমান্টিক ড্রামা ফিল্ম ‘দ্য ফ্রেঞ্চ লেফটেন্যান্ট’স উইমেন’ এর মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো মেরিল মূল চরিত্র হিসেবে পর্দার সামনে আসেন। মেরিলকে সেই ফিল্মের জন্য ব্রিটিশ উচ্চারণে কথা বলতে হয়েছিল ও চরিত্রটি অত্যন্ত রূপবতী একজন নারীর ছিল বলে, সে সময়ে তিনি “আমি কেন আরও রূপবতী হলাম না?” বলে আক্ষেপও করেছিলেন। এটি তাকে সেরা অভিনেত্রী হিসেবে একটি বাফটা এওয়ার্ড এনে দিয়েছিল। তার অভিনয়শৈলী দেখে নিউইয়র্কের একটি সাময়িকী তৎকালীন সময়ে লিখেছিল,

“যেখানে অন্যান্য অভিনেত্রীরা তাদের সিনেমাগুলোতে একই ধরনের চরিত্রের পুনরাবৃত্তি ঘটান, সেখানে মেরিল ‘বহুরূপী’ বলা যেতে পারে। তিনি যেকোনো চরিত্রে নিজের মানিয়ে নিতে পারেন।”

একই বছর তিনি দ্বিতীয়বারের মতো পরিচালক রবার্ট বেন্টনের সাথে জুটি বেঁধে সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার মুভি ‘স্টিল অব দ্য নাইট’-এ রয় শাইডারের সহশিল্পীর হিসেবে অভিনয় করেছিলেন। তবে এটি বেশ সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিল। কিন্তু মেরিলের জন্য এর পরের বছরটি চমক নিয়ে অপেক্ষা করছিল। ‘সোফি’স চয়েস’ নামক ত্রিভুজ গল্পের ওপর নির্মিত সেই সিনেমাতে তিনি একজন পোলিশ ধ্বংসযজ্ঞ থেকে টিকে থাকা নারীর চরিত্র চিত্রায়িত করেছিলেন। তার পোলিশ উচ্চারণ ও আবেগপূর্ণ নাটকীয়তা বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিল। সিনেমার চিত্রনাট্যকার অন্য একজন অভিনেত্রীকে কল্পনা করে সিনেমার গল্পটি সাজিয়েছিলেন। কিন্তু ঘটনাক্রমে চরিত্রটি মেরিলের হাতে এসে পড়েছিল। সিনেমাটিতে অবিস্মরণীয় অভিনয় প্রতিভা দেখানোর জন্য মেরিল সেরা অভিনেত্রী হিসেবে অস্কার জিতে নিয়েছিলেন। আর অন্যান্য পুরষ্কার তো পেয়েছিলেনই। তবে এই সিনেমার ক্ষেত্রে তার সবথেকে বড় অর্জনটি ছিল, প্রিমিয়ার ম্যাগাজিন কর্তৃক সর্বকালের সেরা ‘মুভি পারফরমেন্স’-এর তালিকায় তৃতীয় স্থান লাভ করা। জগদ্বিখ্যাত সিনেমা সমালোচক রজার এবার্ট মেরিলের অভিনয়ের প্রশংসা করতে গিয়ে বলেছিলেন,

“এটি আমার দেখা অন্যতম অভূতপূর্ব অভিনয়। এর চেয়ে অকৃত্রিম ও স্বাভাবিকভাবে কোনো চরিত্রকে উপস্থাপন করা যাবে বলে আমি কল্পনাও করতে পারি না।”

তবে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, সিনে ক্রিটিক কায়েল এই মুভির ক্ষেত্রে মেরিলের অভিনয়শৈলীকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিলেন।

১৯৮৩ সালে প্রথমবারের মতো মেরিল একটি সত্য কাহিনী অবলম্বনে নির্মিত বায়োগ্রাফিক্যাল ফিল্মে অভিনয় করেন। ‘সিল্কউড’ নামের সেই সিনেমায় নিউক্লিয়ার আন্দোলন ও শ্রমিক সংগঠনের হোতা ক্যারেন সিল্কউডের রহস্যজনকভাবে আকস্মিক গাড়ি দুর্ঘটনায় মৃত্যু ও তার মৃত্যু পূর্ববর্তী কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়। ক্যারেন চরিত্র মেরিলের হৃদয়কে এত গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল যে, তিনি ক্যারেনের পরিচিত ও কাছের মানুষজনের সাথে সামনাসামনি গিয়ে কথা বলতে উদ্যোগী হোন। তার ভাষ্যমতে,

“আমি নিজেকে ক্যারেনে পরিণত করিনি। আমি শুধু তাকে উপলব্ধি করতে চেয়েছি। তার সম্পর্কে খুঁজে পাওয়া প্রতিটি তথ্য একসাথে জোড়াতালি লাগিয়ে তার জীবনের প্রতিটি ঘটনাকে পর্যবেক্ষণ করেছি। আর তার ভেতরে লুকিয়ে থাকা সত্তাকে বুঝতে চেষ্টা করেছি।”

এতকিছুর পরেও এই ফিল্মের ক্ষেত্রেও কায়েল তার সমালোচনা করতে ছাড়েননি। তার মতে, মেরিল ক্যারেনের চরিত্রের অবমূল্যায়ন করেছিলেন। অন্যদিকে, নিউজউইকের জ্যাক ক্রল মেরিলের অভিনয়কে দুর্দান্ত বলে আখ্যায়িত করেন।

এরপর মেরিল দ্বিতীয়বারের মতো দুনিয়া কাঁপানো অভিনেতা রবার্ট ডি নিরোর সাথে জুটি বেঁধে অভিনয় করেন। কিন্তু ১৯৮৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সেই সিনেমা ‘ফলিং ইন লাভ‘ অত্যন্ত বাজেভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছিল। পরের বছর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে কেন্দ্র করে নির্মিত ব্রিটিশ সিনেমা ‘প্ল্যান্টি’তে একজন যোদ্ধার চরিত্রে পর্দায় নিজেকে উপস্থাপন করেছিলেন। সেবার রজার এবার্টের মেরিলের চরিত্র সম্পর্কে বক্তব্য ছিল যে, “একজন ভারসাম্যহীন, স্নায়ুরোগে আক্রান্ত ও আত্ম-বিধ্বংসী নারীর চরিত্রে এতটা আকর্ষণীয় ও সুন্দরভাবে ফুটিতে তোলাটা আসলেই দুরূহ ব্যাপার।”

‘সিল্কউড’ সিনেমার দৃশ্যে মেরিল; Source: hollywoodreporter.com

মেরিলের জাদুতে বশ

মেরিল হলিউড সুপারস্টার খেতাবপ্রাপ্ত হওয়ার পেছনে মূলত তার পরবর্তী মুভি ‘আউট অব আফ্রিকা’ ভূমিকা রেখেছিল। মুভিটিতে তিনি ক্যারেন ব্লিক্সেন নামের একজন ড্যানিশ লেখিকার চরিত্রায়ন করেছিলেন। যদিওবা মুভির নির্মাতা সিডনি পোলাকের যথেষ্ট সন্দেহ ছিল তাকে নিয়ে, কারণ পোলাকের মতে, মেরিল তেমন আবেদনময়ী ছিলেন না। তবে মুভির শুটিং চলাকালীন মেরিল পোলাককে নিজের অন্যান্য প্রতিভা দ্বারা বেশ ভালোভাবেই আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছিলেন। পোলাক এক সাক্ষাতকারে বলেন, “সে ছিল অত্যন্ত সরল, সৎ ও একদম কৃত্রিমতা বর্জিত অভিনেত্রী।”

মুভিটি ব্যবসায়িকভাবে ও সমালোচকদের দৃষ্টিতে দারুণ সাফল্য অর্জন করেছিল। তাছাড়া সেরা ফিচার ফিল্ম ক্যাটাগরিতে অস্কারও জিতেছিল। মেরিল নিজেও এতে সেরা অভিনেত্রী হিসেবে মনোনয়ন লাভ করেছিলেন।

সে সময় মেরিলের জনপ্রিয়তা একদম তুঙ্গে উঠে যাওয়া সত্ত্বেও তার পরবর্তী দুই সিনেমা তেমন সাড়া ফেলতে পারেনি। ১৯৮৬ সালের ‘হার্টবার্ন’ ও ১৯৮৭ সালের ‘আয়রন উইড’ উভয় মুভিতে তার সহ অভিনেতা হিসেবে ছিলেন জ্যাক নিকলসন। ১৯৮৮ সালে ‘এভিল অ্যাঞ্জেলস’ মুভিতে নিজের কন্যাকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত একজন অস্ট্রেলিয়ান মহিলার চরিত্রে দেখা যায় তাকে। মুভিতে অসাধারণ অভিনয়ের পাশাপাশি সাবলীলভাবে অস্ট্রেলীয় উচ্চারণে কথা বলার জন্য তিনি সে বছর সেরা অভিনেত্রী হিসেবে অস্ট্রেলিয়ান ফিল্ম ইন্সটিটিউশন এওয়ার্ড, কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল এওয়ার্ড ও নিউইয়র্ক ক্রিটিকস সার্কেল এওয়ার্ড নিজের শোকেসে তুলে নেন। পরের বছর মেরিল ‘সি-ডেভিল’ চলচ্চিত্রে একজন অপরূপা লেখিকার চরিত্র নিয়ে দর্শকদের সামনে আসেন। যদিওবা সিনেমাটি তেমন দর্শকনন্দিত হতে পারেনি, তবুও টাইম সাময়িকীর সাংবাদিক লিখেছিলেন, “শুধু মেরিলের জন্য হলেও সিনেমাটি দেখা উচিত।”

‘আউট অব আফ্রিকা’ সিনেমার দৃশ্যে মেরিল ও রেডফোর্ড; Source: Stars of Africa

অভিনয় জীবনের চড়াই-উতরাই

নব্বই দশকের শুরুর দিকে হঠাৎ করে তার মুভিগুলোর জনপ্রিয়তা কমতে শুরু করে। চল্লিশের কোঠায় পৌঁছে যাওয়া এই অভিনেত্রীকে তখন দর্শকরা ঠিক আগের মতো মেনে নিতে পারছিল না। একের পর এক সিনেমা ফ্লপের খাতায় নাম লেখাচ্ছিল। এমনকি কমেডি সিনেমাতে অভিনয় করেও দর্শকদের গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছিলেন না তিনি। ১৯৯০ সালের কমেডি- ড্রামা ফিল্ম ‘পোস্টকার্ড ফ্রম দ্য এজ’, ১৯৯১ সালের কমেডি- ফ্যান্টাসি ফিল্ম ‘ডিফেন্ডিং ইয়োর লাইফ’, ১৯৯২ সালের ব্ল্যাক কমেডি ফিল্ম ‘ডেথ বিকামস হার’, ১৯৯৩ সালের পিরিয়ড ড্রামা ফিল্ম ‘দ্য হাউজ অব দ্য স্পিরিটস’ সবকটিই মেরিলের অভিনয় জীবনকে ধ্বসে নামাতে শুরু করেছিল।

কিন্তু তিনি যেন এত সহজে কালের অতল গহ্বরে হারিয়ে যেতে চাননি। তাই ১৯৯৫ সালে ওয়েস্টার্ন হার্টথ্রব হিরো ক্লিন্ট ইস্টউড নিজের পরিচালিত ও অভিনীত রোমান্টিক মুভি ‘ দ্য ব্রিজেস অব মেডিসন কাউন্টি’-তে মেরিলকে চুক্তিবদ্ধ করেন। এই মুভি মেরিলকে আবারো হলিউডে পাকাপোক্তভাবে ফিরে আসতে সুযোগ করে দেয়। সমালোচকদের মতে, মেরিল প্রথম মধ্য বয়স্ক অভিনেত্রী যিনি এমন নিখুঁতভাবে রোমান্টিক হিরোইন হিসেবে নিজেকে মেলে ধরেছিলেন।

১৯৯৬ সালে ‘মারভিন’স রুম’ মুভিতে লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিওর মায়ের চরিত্রে তাকে দেখা গিয়েছিল। এতে অভিনয়ের জন্য মেরিল আরো একবার গোল্ডেন গ্লোবে মনোনয়ন তালিকায় নিজের নাম উঠিয়েছিলেন। এক বছর বিরতির পর, ১৯৯৮ সালে ‘ড্যান্সিং এট লুওনাসা’-তে একজন আইরিশ মহিলার চরিত্রে অভিনয় করেন। এই চরিত্রটিকে তার অভিনয় জীবনের অন্যতম সেরা চরিত্র বলে বিবেচনা করা হয়। একই বছর ‘ওয়ান ট্রু থিংক’ মুভিতে তিনি একজন ক্যান্সার আক্রান্ত মহিলার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। সিনেমাটি বেশ ভালো রিভিউ পেয়েছিল। লস এঞ্জেলস টাইমসের ফিল্ম ক্রিটিক কেনেথ টুরান মুভিটিতে মেরিলের অভিনয় দেখার পর বলেছিলেন, “তার ক্যারিয়ারের অন্যতম কম নাটকীয়তাসম্পন্ন চরিত্র। খানিকটা সততা ও বাস্তবতার সাথে তিনি চরিত্রটিকে দারুণভাবে এগিয়ে নিয়ে গেছেন।”

১৯৯৯ সালে ‘মিউজিক অব দ্য হার্ট’ নামক মিউজিকাল ড্রামা ধাঁচের মুভিতে মেরিল একজন ভায়োলিন শিক্ষকের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। চরিত্রটির জন্য তিনি প্রায় পাঁচ-ছয় মাস ভায়োলিনের ওপর প্রশিক্ষণও গ্রহণ করেছিলে। এর জন্য তিনি অস্কার, গোল্ডেন গ্লোব ও স্ক্রিন অ্যাক্টরস গিল্ড এওয়ার্ডে ভূষিত হয়েছিলেন। রজার এবার্ট এই মুভিটির জন্য মেরিলের ভূয়সী প্রশংসা করছিলেন।

‘দ্য ব্রিজেস অব মেডিসন কাউন্টি’ সিনেমার দৃশ্যে মেরিল; Source: Pinterest

নতুন শতাব্দীর আশীর্বাদ রূপে

নতুন শতাব্দীর শুরুটা তিনি করেছিলেন স্টিভেন স্পিলবার্গের ‘এ.আই. আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ সিনেমাতে একটি চরিত্রে কণ্ঠ দেওয়ার মধ্যদিয়ে। ২০০১ সালে তিনি অ্যাকশন হিরো লিয়াম নিসনের সাথে সম্মিলিতভাবে ‘নোবেল পিস প্রাইজ কনসার্ট’-এ উপস্থাপিকা হিসেবে ছিলেন। একই বছর প্রায় দুই দশক পর তিনি আবারো মঞ্চে পা রাখেন। অ্যান্টন চেকোভের নির্দেশনায় ‘দ্য সিগাল’ নামের মঞ্চনাটকে মেরিল ছাড়াও আরও অনেক তারকা অভিনয় করেছিলেন। ২০০২ সালে স্পাইক জোঞ্জ এর পরিচালনায় ‘অ্যাডাপ্টেশন’ মুভিতে তিনি সুজান অরলিন নামের একজন বাস্তব জীবনের সাংবাদিকের চরিত্রকে রূপায়িত করেছিলেন। এই সিনেমা শুধু দর্শকদের হৃদয়কেই নয়, গোল্ডেন গ্লোব কমিটির মনও জিতে নিয়েছিলেন তিনি। তাই চতুর্থ গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কারও বাগিয়ে নেন তিনি।

একই বছর ‘দ্য আওয়ারস’ সিনেমাতে তাকে নিকোল কিডম্যান ও জুলিয়ান মুরের সাথে দেখা গিয়েছিল। তিনজন নারীর জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই সিনেমার জন্য তারা তিনজনই সেরা অভিনেত্রী হিসেবে ‘সিলভার বিয়ার’ পুরস্কার জিতেছিলেন।

২০০৩ সালে ‘স্টাক অন ইউ’ সিনেমাতে তাকে নিজের ক্যামিও হিসেবে দেখা যায়। সেই বছর ‘অ্যাঞ্জেলস ইন আমেরিকা’ নামের এইচবিও’র ড্রামাতে তিনি মাইক নিকোলাস, আল পাচিনোর সাথে অভিনয় করেছিলেন। এই মিনি সিরিজের জন্য তিনি নিজের পঞ্চম গোল্ডেন গ্লোব ও দ্বিতীয় অ্যামি এওয়ার্ড জিতে নেন। এর পরের বছর ড্যানজেল ওয়াশিংটন এর সহশিল্পী হিসেবে তাকে ‘দ্য ম্যানচুরিয়ান ক্যান্ডিডেট’ সিনেমাতে একজন নির্দয়া ইউ.এস সিনেটরের চরিত্রে দেখা গিয়েছিল। একই বছর জিম ক্যারির সাথে তিনি ‘আ সিরিজ অব আনফরচুনেট ইভেন্টস’-এ জোসেফিন চরিত্রে অভিনয় করেন। এছাড়া সেই বছর ‘মনেটস প্যালেট’ সিনেমাতে তিনি ধারাভাষ্যকার হিসেবেও কণ্ঠ দিয়েছিলেন। ২০০৫ সালে ‘প্রাইম’ নামের রোমান্টিক- কমেডি ধাঁচের সিনেমাতে তিনি একজন মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেন। বরাবরের মতো এবার্ট এই সিনেমার ক্ষেত্রেও মেরিলের চরিত্রটিকে বাহবা দিয়েছিলেন।

২০০৬ সালে ‘দ্য ডেভিলস ওয়েরস প্রাডা’ সিনেমায় তাকে একজন ক্ষমতাবান ও অভিলাষী ফ্যাশন ম্যাগাজিন এডিটর মিরান্ডার চরিত্রে দেখা যায়। মুভিটি মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করলেও, রজার এবার্ট মেরিলের চরিত্রটিকে, ‘সুস্থির ও দাম্ভিক’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। তাছাড়া সিনেমাটি তাকে ১৪তম বারের মতো অস্কারে মনোনয়ন লাভ করার সম্মান এনে দেয়। তখন পর্যন্ত সেটিই ছিল মেরিলের সবচেয়ে বেশি আয় করা সিনেমা।

একই বছর চাইনিজ পরিচালক চেনের মুভি ‘ডার্ক ম্যাটার’-এ একজন বিত্তশালী ইউনিভার্সিটির পৃষ্ঠপোষকের চরিত্রে অভিনয় করেন। তবে এই মুভিটি বেশ খারাপ প্রতিক্রিয়ার স্বীকার হয়েছিল। ‘রেন্ডিশন’ নামের ২০০৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত পলিটিকাল থ্রিলারে তাকে একজন মার্কিন সরকারের কর্মকর্তা হিসেবে দেখা গিয়েছিল। সেই বছর তিনি আরো কয়েকটি মুভিতে স্বল্প দৈর্ঘ্যের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন।

‘দ্য ডেভিলস ওয়েরস প্রাডা’ সিনেমাতে মেরিল; Sourc: Hollywood.com

২০০৮ সালের মিউজিকাল রোমান্টিক ড্রামা মুভি ‘মামা মিয়া!’ মেরিলের অভিনয় জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। মুভিটি বক্স অফিসে তুমুল ঝড় উঠানোর পাশাপাশি মেরিলকে আরো একটি গোল্ডেন গ্লোব নমিনেশন এনে দিয়েছিল। একজন স্বামীসঙ্গ ছাড়া এক সন্তানের মায়ের চরিত্রে চমৎকার অভিনয়শৈলী দেখানোর ফলে মার্কিন দৈনিক পত্রিকা ‘দ্য বোস্টন গ্লোব’-এর প্রতিবেদক ওয়েসলি মরিস তাকে নিয়ে লিখেছিলেন, “আমেরিকান চলচ্চিত্রের সর্বসেরা অভিনেত্রী অবশেষে মুভি স্টারে পরিণত হলেন।”

একই বছর ‘ডাউট’ নামের ১৯৬৪ সালের প্রেক্ষাপটে নির্মিত আরো একটি সিনেমায় ক্যাথলিক স্কুলের পাদ্রি প্রিন্সিপ্যাল চরিত্র নিয়ে তিনি পর্দার সামনে আসেন। এই সিনেমাটি পাঁচটি অ্যাকাডেমি এওয়ার্ডের জন্য মনোনীত হয়েছিল যার মধ্যে তার সেরা অভিনেত্রীর শাখায় একটি। এবার্ট থেকে শুরু করে বাকি সমালোচকেরা মেরিলের এই চরিত্রের বেশ গুণগান গেয়েছিলেন। ২০০৯ সালে ‘জুলি অ্যান্ড জুলিয়া’ সিনেমায় তিনি শেফ জুলিয়ার চরিত্র রূপে দর্শকদের সামনে হাজির হন। সে বছর ‘ইটস কমপ্লিকেটেড’ নামের রোমান্টিক কমেডি ধাঁচের মুভিতেও তাকে দেখা যায়। সেই বছর এই দুই মুভির জন্যই তিনি গোল্ডেন গ্লোবে নমিনেশন পান  প্রথমটির জন্য পুরস্কারও জিতে নেন। এমনকি এই মুভির জন্য সেই বছর অস্কারেও মনোনয়ন পেয়েছিলেন তিনি। এছাড়া সে বছর ‘ফ্যান্টাস্টিক মি. ফক্স’ নামের স্টপ- মোশন ফিল্মে ফেলিসিটি ফক্স চরিত্রে নিজের কণ্ঠও দিয়েছিলেন।

২০১১ সালে ‘মামা মিয়া!’ সিনেমার পরিচালক ফিলিডা লয়েডের সাথে ফের জুটিবদ্ধ হয়ে মেরিল ‘দ্য আয়রন লেডি’ নামক ব্রিটিশ বায়োগ্রাফিকাল ফিল্মে কাজ করেন। যুক্তরাজ্যের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারকে নিয়ে নির্মিত এই সিনেমাটি মেরিলকে তার তৃতীয় অস্কারসহ গোল্ডেন গ্লোব, বাফটা এওয়ার্ড লাভের সুযোগ করে দেয়। যদিওবা সিনেমাটিকে থ্যাচারের পরিবার-পরিজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা ভালোভাবে মেনে নিতে পারেনি। এর পরের বছর কমেডি-ড্রামা ধাঁচের ফিল্ম ‘হোপ স্প্রিংস’ তিনি টমি লি জোনস এর সাথে জুটি বেঁধে বিবাহিত দম্পতির চরিত্রে অভিনয় করেন। ২০১৩ সালে জুলিয়া রবার্ট ও ইয়ান ম্যাকগ্রেগরের ব্ল্যাক কমেডি মুভি ‘অগাস্ট: ওস্যাজ কাউন্টি‘তে একজন ক্যান্সারে আক্রান্ত নারীর চরিত্রে অভিনয় করে আরো একবার অস্কার ও গোল্ডেন গ্লোবের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন। ২০১৪ সালে মেরিল ‘দ্য গিভার’ নামক সিনেমাতে কমিউনিটি লিডার চরিত্রে, ‘দ্য হোমসম্যান’ সিনেমাতে ছোট একটি চরিত্রে ও ডিজনির ‘ইন টু দ্য উডস’ সিনেমাতে ডাইনি চরিত্রে অভিনয় করেন।

২০১৫ সালে জোনাথন ড্যামির ‘রিকি অ্যান্ড দ্য ফ্ল্যাশ’-এ একজন মুদি দোকানির চরিত্রে অভিনয় করেন। এ চরিত্রটি রাতে বেলা রক মিউজিশিয়ান হিসেবে চাকরি করে। একই বছর সারাহ্ গ্যাভরোনের ‘সাফরাজেট’ মুভিতে তাকে ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ হিসেবে দেখা গিয়েছিল। পরের বছর ২০১৬ সালে জীবনী মুভি ‘ফ্লোরেন্স ফস্টার জেনকিন্স‘-এ তিনি একজন অপেরা গায়িকা রূপে আবির্ভাব ঘটান। মুভিটি অস্কার, গোল্ডেন গ্লোব, বাফটা এওয়ার্ডের জন্য মনোনয়ন লাভ করেছিলেন। গত বছর স্টিভেন স্পিলবার্গের ‘দ্য পোস্ট’ নামক বায়োগ্রাফিকাল ড্রামা সিনেমাতে টম হ্যাঙ্কসের সহশিল্পী হিসেবে তাকে মার্কিন প্রথম মহিলা দৈনিক পত্রিকার সম্পাদককে গ্রাহামের চরিত্রে তাকে দেখা গিয়েছিল। সিনেমাটির জন্য তিনি ৩১তম বারের মতো গোল্ডেন গ্লোবের ও ২১তম বারের মতো অ্যাকাডেমি এওয়ার্ডে মনোনয়ন লাভের অবিস্মরণীয় রেকর্ড গড়েন। এই বছর তার অভিনীত ‘মামা মিয়া! হিয়ার উই গো’ ও ‘ম্যারি পোপিন্স রিটার্ন’ সিনেমা দুটি মুক্তি পাবার কথা।

‘দ্য পোস্ট’ মুভির দৃশ্যে টম হ্যাঙ্কসের সাথে মেরিল; Source: gazeta.ru

বিচিত্রমুখিতা যখন তার পরিচয়

মেরিলের অন্যান্য কর্মকাণ্ডের কথা বলতে গেলে আগেই বলে নিতে হয়, তিনি নানা উচ্চারণে কথা বলতে পারদর্শী এবং তার কণ্ঠস্বর দারুণ হওয়াতে গান থেকে শুরু করে ধারাভাষ্যকার হিসেবে তার জুড়ি মেলা ভার। ‘মামা মিয়া!’ সিনেমাতে তার গাওয়া সাউন্ডট্রেকে গান জনপ্রিয়তার একদম শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিল। এছাড়া তিনি বেশ কয়েকটি সিনেমাতে ধারাভাষ্যকার হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি বহু অডিও বইয়েও কণ্ঠ দিয়েছেন। ‘ন্যাশনাল উইমেন’স হিস্ট্রি মিউজিয়াম’-এর স্পোক্সপার্সন হওয়ার সম্মান অর্জনের পাশাপাশি তিনি সেখানে প্রচুর অর্থও দান করেছেন। বন্ধু ও গুরু জোসেফ প্যাপের সম্মানার্থে মেরিল পাবলিক থিয়েটারের তহবিলে ১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দান করেছিলেন।

নারীর ক্ষমতায়নের পক্ষে জোরালো ভূমিকা রাখতে তিনি নিউইয়র্ক উইমেন ইন ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন সংস্থায় চল্লিশোর্ধ্ব চিত্রনাট্যকার মহিলাদের জন্য ‘রাইটার ল্যাব’ খোলার উদ্দেশ্যে আর্থিক সহায়তা করেছিলেন। ম্যাসাচুসেটস ইউনিভার্সিটির গণিত ও ইংরেজিতে মেজর করা শিক্ষার্থীদের জন্য তিনি দুটি বৃত্তিরও ব্যবস্থা করেছিলেন। এছাড়া আরো ছোট ছোট অনেক জনহিতকর কাজের সাথেও তিনি জড়িত।

তিনটি ভিন্ন যুগে তিনটি অস্কার হাতে মেরিল; Source: GoldDerby

দুই রাজ্যের সম্রাজ্ঞী মেরিল

হলিউড থেকে শুরু করে পুরো দুনিয়াব্যাপী নিজের অভিনয় প্রতিভা দিয়ে কাঁপিয়ে বেড়ানো এই অভিনেত্রী কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনেও দারুণ গোছালো ও কর্তব্যপরায়ণ। সত্তর ছুঁইছুঁই এই চিরযৌবনা জীবনে প্রেমে পড়েছেন দুবার। আর দুটো সম্পর্কেই একদম মন থেকে ভালোবেসে নিষ্ঠা ও দায়িত্বের সাথে পালন করে এসেছেন। হাই স্কুলে থাকাকালীন চিয়ারলিডার ও হোমকামিং কুইন খ্যাত এই অভিনেত্রীর জীবনের প্রথম ভালোবাসার পুরুষ ছিলেন অভিনেতা জন ক্যাজেল। ১৯৭৫ সালে মঞ্চনাটকে অভিনয় করতে গিয়ে দুজনের পরিচয়, তারপর একসাথে তারা তিনটি বছর একই ছাদের নিচে কাটিয়েছিলেন। ১৯৭৮ ক্যান্সারে ক্যাজেল মৃত্যুবরণ করেছিলেন। ক্যাজেলের জীবনের শেষ কটা দিনে তাকে সেবাশুশ্রূষা করেই কাটিয়েছিলেন মেরিল। ক্যাজেল সম্পর্কে এক সাক্ষাতকারে মেরিল বলেন যে,

“আমি ওর মৃত্যুশোক কাটিয়ে উঠিনি। আমি কাটিয়ে উঠতেও চাই না। আপনি যা-ই করুন না কেন, কিছু কিছু বেদনা সবসময় হৃদয়ের কোনো না কোনো কোনায় বয়ে নিয়ে চলতে হয়।”

ক্যাজেলের মৃত্যুর ছয় মাস পর মেরিল ডন গামার নামের একজন প্রসিদ্ধ স্থাপত্যবিদকে বিয়ে করে সংসারে মন দেন। চল্লিশ বছরের বিবাহিত জীবনে তাদের সংসার আলো করে আসে চারজন ছেলেমেয়ে। বর্তমানে তিনি লস এঞ্জেলসে স্বামীর কেনা বিলাসবহুল ম্যানশনে স্বামী গামারের সাথে সুখে-শান্তিতে বসবাস করছেন।

তারা একসাথে চলেছেন দীর্ঘ চল্লিশটি বছর; Source: mamamia.com.au

‘মেরিল স্ট্রিপ’ শুধু দুই শতাব্দীর অন্যতম সেরা অভিনেত্রীই নন, তিনি যেকোনো দেশ, জাতি, ধর্ম, পেশা ও বয়সের নারীর জন্য একজন পথিকৃৎও বটে। একদম মাটিতে হাঁটতে শিখে কীভাবে আকাশে উড়ার মতো পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়া যায়, তা মেরিলের জীবনবৃত্তান্তে চোখ বোলালেই বাস্তব দৃষ্টান্ত হিসেবে পরিলক্ষিত হয়। সামনে এই হলিউডের মহারানীর উনসত্তরতম জন্মদিন। আমরা সিনেমাপ্রেমীরা শুধু তার শততম জন্মবার্ষিকী উদযাপনের ঘটনার সাক্ষী হবার জন্য প্রার্থনাই করতে পারি। সামনের দিনগুলো এই অভিনেত্রীর আরো ভালো কাটুক এবং আরো কয়েকটি অস্কার ও গোল্ডেন গ্লোব তার বাড়ির শোকেসে জায়গা পাক, সেই কামনা করে আজকের মতো ‘মেরিল স্ট্রিপ গাঁথা’র সমাপ্তি টানছি।

তথ্যসূত্র

  1. https://www.biography.com/people/meryl-streep-9497266
  2. https://www.britannica.com/biography/Meryl-Streep
  3. https://www.thefamouspeople.com/profiles/mary-louise-streep-2342.php
  4. https://www.fandango.com/people/meryl-streep-652463/biography
  5. https://www.empireonline.com/people/meryl-streep/6/

ফিচার ইমেজ: SheSimply

Related Articles

Exit mobile version