ক্লাসের শেষ মাথায় বসা ছেলেটাকে ঘিরে ছোটখাট একটা জটলা দেখা যাচ্ছে। প্রতিদিন টিফিনের ঘণ্টা বাজার পরপরই এই ঘটনা ঘটছে। আর জটলা পাকানো ছাত্রদের সবার হাতেই ২৫ সেন্টের সিকি শোভা পাচ্ছে। ঘটনা কী, সেটা জানার জন্য উঁকি দিলেই দেখা যাবে কিছুটা গোলগাল মুখায়বের এক কিশোর বেশ কয়েক বাণ্ডিল কাগজ নিয়ে মিনি বইয়ের দোকান খুলে বসেছে। কিশোরের নাম জর্জ। অনেকে তাকে ‘জর্জি’ বলে ডাকে। বাণ্ডিল করা কাগজগুলো প্রতি কপি সে ২৫ সেন্টের বিনিময়ে বিক্রি করেছে। আগ্রহবশত যদি আপনি তার থেকে এক বাণ্ডিল কিনে ফেলেন, তাহলে বুঝতে পারবেন সেগুলো কোনো সাদামাটা কাগজের বাণ্ডিল নয়, বরং হাতে লেখা ছোটগল্পের বই। প্রচ্ছদপৃষ্ঠা উল্টালেই দেখতে পাবেন কোনো চেনা পরিচিত সুপারহিরো কমিকের নাম। কিন্তু লেখকের স্থলে বেশ কায়দা করে লেখা আছে‘জর্জ রেমন্ড!
ঘটনা কী, জানতে চাইলে এক আগ্রহী ক্রেতা জানালো, জর্জের লেখার হাত খুব ভালো। সে সুপারহিরো কমিকগুলো নিজের মতো করে লিখতে ভালোবাসে। মাঝে মাঝে সেগুলো আসল কমিক থেকেও ভালো মনে হয়। তবে কমিক লেখালেখিতেই সীমাবদ্ধ নয় জর্জি। সে বেশ কিছু দৈত্য-দানো নিয়ে মৌলিক গল্পও লিখেছে। কিন্তু সেগুলো কেনা যাবে না।“কেন, কেন?” গম্ভীর গলায় মুরুব্বি গোছের জর্জি জানালো,“সেগুলো আপাতত স্টক আউট হয়ে গেছে।” একথা শুনে যাদের মন খারাপ হয়ে আছে, তাদের বলছি, একদমই মন খারাপ করবেন না। কারণ, স্কুলের ক্লাসে যাত্রা শুরু করা এই খুদে লেখক এখানে আটকে থাকবেন না। সামনে সে আরো বড় লেখার কাজে হাত দেবে। সে গল্প, উপন্যাসগুলোর মোহনীয় গাথায় তখন আপনি-আমি সবাই গেঁথে থাকবো। শুধু নামটা মনে রাখবেন- ‘জর্জ রেমন্ড রিচার্ড মার্টিন’।
কিছুটা কল্পনার আশ্রয় নিয়ে চিত্রায়িত করা সেদিনের কিশোর জর্জকে নিশ্চয়ই চিনতে পেরেছেন। ‘গেম অফ থ্রোন্স’ নামক নেশা জাগানো টিভি সিরিজের উন্মাদনায় যখন পুরো পৃথিবী মত্ত, তখন এই কাহিনীর রূপকার জর্জকে নিয়ে কিছু আলোচনা না করলেই নয়। তাই আমাদের আজকের আয়োজনে থাকছে সেই জর্জ আর আর মার্টিনের গল্প।
জর্জ রেমণ্ড মার্টিন
টলকিন পরবর্তী যুগে ইংরেজি সাহিত্যে রূপকথাভিত্তিক লেখালেখিতে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ লেখক জর্জ আর আর মার্টিন। তার জন্ম ১৯৪৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সিতে। এখানে বেয়োন নামের মফস্বলে তিনি বড় হন। পুরো শৈশব এখানেই কাটান। তার পিতা রেমন্ড কলিন্স মার্টিন সমুদ্র বন্দরে কাজ করতেন। জর্জ ছাড়াও পরিবারে আরো দুটি কন্যাসন্তান ছিল। জর্জের যখন পাঁচ বছর বয়স, তখন তাকে বাসার নিকটে প্রপিতামহের নিকট পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এখানে বলতে গেলে চার দেয়ালের মাঝে বন্দী হয়ে পড়েন তিনি। কিন্তু ছোট থেকেই বেশ ছটফটে ছিলেন তিনি। তাই তিনি সুযোগ খুঁজতেন এই চার দেয়াল ভেঙে বাইরের পৃথিবীকে উপভোগ করার। তার সেই সুযোগ পরোক্ষভাবে মিলে যায় প্রপিতামহের সংগ্রহে থাকা বইয়ের মাধ্যমে। এখান থেকেই সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ জন্মাতে থাকে তার।
এসময়ে তাকে মেরি জেন স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়। স্কুলে থাকা বন্ধুদের বদৌলতে তিনি কমিক বইয়ের জগতে ঢুকে পড়েন। কমিকের গল্পগুলো যেন তার সাহিত্যপ্রতিভাকে জাগিয়ে তুললো। তিনি চিন্তা করলেন, এমন গল্প আমিও দু’-চারখানা লিখতে পারি! যে-ই ভাবা, সে-ই কাজ। তিনি কাগজ-কলম নিয়ে শুরু করলেন গল্প লেখা। প্রথমদিকে দৈত্য-দানো নিয়ে ছোটগল্প লিখতেন। সেগুলো পাড়ার শ্রমিক পরিবারের কিশোররা কয়েক সেন্টের বিনিময়ে কিনে নিতো। মাধ্যমিকে ভর্তি হওয়ার আগপর্যন্ত এধরনের লেখাই লিখতেন। মাধ্যমিকে শুরু করলেন সুপারহিরো কমিকের ফ্যান-ফিকশন লেখা। স্কুল ছাত্রদের মাঝে খুব অল্প সময়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠলো তার লেখা। মাঝে মাঝে তিনি নিজে থেকেই সুপারহিরো আর ভিলেন বানাতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে পরিচিতি পেতে থাকে জর্জের সাহিত্য ক্ষুধা। ভক্তরাও বুঝতে পারলো, এই ধারা বজায় রাখলে সামনে বেশ বড় চমক উপহার দিতে পারবেন তিনি। লেখালেখি ছাড়াও তার আরেকটি পরিচয় ছিল। তিনি বেশ ভালো দাবা খেলতে পারতেন। তিনি স্কুলে দাবা দলের বেশ গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে কাজ করতেন।
পেশাদার সংগ্রাম
দেখতে দেখতে স্কুলের জীবন শেষ হয়ে এলো। স্কুল শিক্ষা শেষ করে জর্জ তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে নজর দেন। ১৯৬৬ সালে তিনি ভর্তি হন নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যস্ত রুটিন জর্জকে লেখালেখি থেকে দূরে সরাতে পারেনি। কিন্তু তখনও তিনি লেখক হওয়ার সিদ্ধান্ত নেননি। ১৯৭০ সালে তিনি সাংবাদিকতায় স্নাতক এবং পরে একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষে তিনি কুক কাউন্টির একটি আইন সংস্থার অধীনে কর্মরত ছিলেন। ‘৭৬ সালে তিনি সংস্থার কাজ ছেড়ে দিয়ে ক্লার্ক কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এখানে কেটে যায় দুটি বছর। এরই মধ্যে তিনি গেইল বার্নিক নামক এক বান্ধবীকে বিয়ে করেন। কিন্তু তার দাম্পত্যজীবন খুব একটা ভালো কাটেনি। চার বছর পরেই তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়ে যায়।
এতসব পরিবর্তনের মাঝেও তিনি দাবা এবং সাহিত্য থেকে দূরে সরে যাননি। ১৯৭২ সালে তার প্রিয় ববি ফিশার যখন দাবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের খেতাব অর্জন করেন, তখন তিনি নতুন উদ্যমে দাবার পেছনে লেগে যান। সংস্থার কাজের পাশাপাশি তিনি মহাদেশীয় দাবার টুর্নামেন্ট আয়োজক হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। কিন্তু কাজের চাপে পড়ে ধীরে ধীরে তার দাবা উৎসাহে ভাঁটা পড়ে।
লেখালেখি যখন পেশা
কাগজের বাণ্ডিল থেকে ছাপাখানার মেশিনের নিচে যাওয়া প্রথম মার্টিন রচনা ছিল ‘দ্য হিরো’। ১৯৭০ সালে গ্যালাক্সি নামক একটি ম্যাগাজিন থেকে প্রকাশিত হয় ছোট গল্পটি। এরপর থেকে তিনি নিয়মিত ছোট গল্প রচনা করতে থাকেন। এভাবে ৬ বছরে তিনি বহু ছোট গল্প লিখে ফেলেন, যেগুলো ‘আ সং ফর লিয়া অ্যান্ড আদার্স’ নামক একটি বইয়ে একত্র করে প্রকাশ করা হয় ১৯৭৬ সালে। ছোট গল্প থেকে তিনি পরবর্তীতে উপন্যাস লেখায় মন দেন। তার প্রথম উপন্যাস ছিল ‘ডাইয়িং অফ দ্য লাইট’। এটি ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত হয়। তার উপন্যাস এবং ছোটগল্প রচনার সময়কাল বিবেচনা করে এটা বোঝা যায় যে, তিনি ক্লার্ক কলেজে কর্মরত অবস্থায় মূলত বড় লেখার কাজে হাত দিয়েছেন। এই সময়ে তিনি পেশাদার লেখক হিসেবে বিভিন্ন বইয়ের প্রকল্পে নিজের নাম লেখান।
তার বইগুলো স্থানীয়ভাবে বেশ সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়। এ কান ও কান ঘুরে ঘুরে তার নাম শেষপর্যন্ত সিনেমার স্বর্গরাজ্য হলিউডের দ্বারপ্রান্তে গিয়ে পৌঁছে। ছোটবেলা তিনি ‘দ্য টোয়াইলাইট জোন’ নামক একটি টিভি সিরিজের প্রতি আসক্ত ছিলেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তিনি এই সিরিজের একেকটি এপিসোডের পেছনে ব্যয় করতেন। তার সেই শৈশব স্মৃতি তাকে পুনরায় টোয়াইলাইট জোনের কাছে নিয়ে আসে। ১৯৮৬ সালে এই সিরিজের রিমেক প্রকল্পে একজন পুরোদস্তুর লেখক হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। তার লেখনীর সাহায্যে দর্শকরা নতুনভাবে ফিরে পেতে থাকে সেই পুরাতন আমেজের চমৎকার সিরিজ টোয়াইলাইট জোনকে। এরপর তিনি ‘বিউটি অ্যাণ্ড দ্য বিস্ট’-এর একটি প্রকল্পেও লেখক হিসেবে কাজ করেন। কিন্তু ধীরে ধীরে টেলিভিশন সিরিজে কাজ করা কিছুটা কঠিন হয়ে উঠতে থাকে। এর কারণ হিসেবে জর্জ বলেন,
যখনই কোনো পাণ্ডুলিপি লিখে জমা দিতাম, প্রযোজক আমাকে ডেকে পাঠাতেন। এরপর শুরু হতো রাজ্যের ফিরিস্তি। তারা জানাতো, আমি যা লিখছি, তা নিঃসন্দেহে চমৎকার। কিন্তু আমার পাণ্ডুলিপি থেকে ক্যামেরায় রূপান্তরিত করতে তাদের প্রায় ৫ গুণ বেশি বাজেট দরকার পড়বে।
বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ঘরানার নাটক থেকে বের হয়ে এরপর জর্জ লেখা শুরু করেন রূপকথাভিত্তিক নাটক। মধ্যযুগীয় যুদ্ধের ঝনঝনানির সাথে কল্পনার জগতের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে বিভিন্ন পাণ্ডুলিপি লেখতে থাকেন তিনি। ১৯৯০ সালে তিনি ‘ওয়ার্স অফ রোজেস’ নামক এ ধরনের নাটকের পাণ্ডুলিপি লেখার কাজ শুরু করেন। লেখার কাজে থিতু হয়ে যাওয়া জর্জ অবশ্য তখনও তার শ্রেষ্ঠ কাজ ‘গেম অফ থ্রোন্স’ লেখা শুরু করেননি।
গানটি তুষার এবং অগ্নির
ছোট থেকে জর্জ আর আর মার্টিন টলকিনের মিডল-আর্থ সিরিজের বেশ বড় ভক্ত ছিলেন। জে আর আর টলকিনের ম্যাগনাম অপাস ‘লর্ড অফ দ্য রিংস’ পড়া অবস্থায় তিনি নিজের ভেতর এক অদ্ভুত তাড়না অনুভব করতেন। তাকে ভেতর থেকে বিলবো ব্যাগিন্স, গ্যাণ্ডালফ, আরাগন আর এক ঝাঁক কাল্পনিক ওর্ক অনুপ্রেরণা দিতো নিজের মিডল-আর্থ সৃষ্টির জন্য। কিন্তু কেন যেন লেখি লেখি করেও এ ধরনের কিছু লেখা হচ্ছিলো না। যেন এক অদৃশ্য বেড়ি তার কল্পনার মিডল-আর্থকে বন্দী করে রেখেছে। জর্জ এই বেড়ি ভাঙতে সময় নিলেন ১৯৯১ সাল পর্যন্ত। লেখক বিজনেস ইনসাইডারে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন,
১৯৯১ সালের গ্রীষ্মকালের দিকের কথা। তখন হলিউডে কাজ করতাম। তখন বছরে দু’মাস আমাকে ছুটি দেওয়া হতো- মে এবং জুন। বলতে গেলে একদম অলস হয়ে পড়েছিলাম সেবার। তাছাড়া বহুদিন হয়েছিলো কোনো উপন্যাস লিখিনি। হলিউডের নাটকের পাণ্ডুলিপি লিখতে লিখতে আমি বিরক্ত হয়ে পড়েছিলাম। তখন ভাবলাম, একটি সায়েন্স ফিকশন লেখা যাক। ‘আভালন’ নামের সেই ফিকশন লিখতে লিখতে এমন একটি দৃশ্যে গিয়ে আটকে যাই, যেখানে একটি মানুষকে তরবারি দিয়ে শিরোচ্ছেদ করার কথা লিখছিলাম। তখন আমার কী হলো জানি না, কিন্তু সেই দৃশ্য আমার মনে গেঁথে গেলো। সেখান থেকে মাথায় আসলো ডায়ার উলফগুলোর কথা। বিচ্ছিন্ন দৃশ্যগুলোকে জোড়া লাগিয়ে আমি লেখা শুরু করলাম। এমনভাবে তিনদিন সময় দিলাম এর পেছনে, ব্যস! এরপর থেকে আমি লিখেই চললাম।
ঠিক এভাবে শুরু হওয়া কাহিনী একসময় গানে রূপান্তরিত হলো। প্রায় ৪ বছর ধরে লেখা সেই গানের নাম দেওয়া হলো ‘আ সং অফ আইস এণ্ড ফায়ার’ অর্থাৎ তুষার ও অগ্নির গান। ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত হয় এই নামে গেম অফ থ্রোন্স সিরিজের সর্বপ্রথম উপন্যাস। জর্জ ভেবেছিলেন, তিন পর্বে শেষ করবেন তার গল্প, আর এটিই হবে সে টলকিন প্রভাবিত রূপকথা। কিন্তু মাঝপথে তার মতবদল হলো। তিনি ৭ খণ্ডে কাহিনী শেষ করার চিন্তা-ভাবনা করলেন। পরবর্তীতে এই সিরিজের পাঁচটি বই প্রকাশিত হয়। এক লৌহ মসনদ এবং তাকে অধিকার করার এক রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের ফলশ্রুতিতে ঘটা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের প্রেক্ষিতে রচিত হয় জর্জের ম্যাগনাম অপাস ‘গেম অফ থ্রোন্স’ সিরিজ। টলকিনের মিডল-আর্থের বিপরীতে তিনি সৃষ্টি করলেন ওয়েস্টেরসের গাথা। তার উপন্যাসে ভ্যালিরিয়ান ইস্পাত, হোয়াইট ওয়াকার, ডায়ার উলফ, ড্রাগন গ্লাস, আয়রন থ্রোন, চিলড্রেন অফ ফরেস্ট, ড্রাগন, ওয়াইল্ড ফায়ার প্রভৃতি কাল্পনিক বিষয়ের সমাগম ঘটে। বেশ কয়েক বছর পূর্বে এই সিরিজের ষষ্ঠ বই প্রকাশ পাওয়ার কথা থাকলেও লেখা শেষ করতে না পারায় এর প্রকাশ পিছিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, কীভাবে যেন লেখক এরই মাঝে সিরিজের প্রিক্যুয়েল উপন্যাস ‘ফায়ার এণ্ড ব্লাড’-এর কাজ শেষ করে ফেলেন। ভক্তদের মাঝে এই নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া থাকলেও এখন অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই।
সাহিত্য দর্শন
জর্জ আর আর মার্টিনের লেখায় টলকিনের প্রভাব থাকলেও সমালোচকদের দৃষ্টিতে দুজনের সৃষ্টিতে কিছু পার্থক্য রয়েছে। যেমন টলকিনের গল্পে কাল্পনিক প্রাণী এবং সম্প্রদায়ের মুখ্য আনাগোনা লক্ষ করা যায়। কিন্তু জর্জের উপন্যাস অনেকটাই মানুষ নির্ভর। ওয়েস্টেরস মূলত মানুষ দ্বারা পরিপূর্ণ একটি মহাদেশ। টলকিনের কাহিনীতে জাদু এবং অতিপ্রাকৃত শক্তির প্রভাব চোখে পড়ার মতো। এদিকে জর্জ মানুষের ক্ষমতার লোভ এবং স্বার্থপরতার সাথে জটিল কূটনৈতিক চালের সমন্বয়ে রচনা করেছেন গেম অফ থ্রোন্স। তার উপন্যাসগুলো পড়লে মনে হয়, পাঠকের সাথে তিনি প্রতিটি পৃষ্ঠায় দাবা খেলছেন। একটু পর পর যেখানে পাঠকেরা জর্জের জাদুতে ভুল চালের ফাঁদে পড়ছে। তাছাড়া তার গল্প বলার গতি বেশ ধীর, কিন্তু বেশ সুনিপুণ কায়দায় পুরো বর্ণনা জুড়ে পাঠকের মনোযোগ ধরে রাখতে সক্ষম তিনি।
তবে জর্জ মার্টিনের একটি বদভ্যাস রয়েছে। তিনি কোনো নোটিশ ব্যতিরেকে হঠাৎ করেই কাহিনীর মূল চরিত্রকে ‘ঘ্যাচাং’ করে দিতে উস্তাদ। এই নিয়ে তার ভক্তদের অভিযোগের শেষ নেই। কিন্তু জর্জ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে জানিয়েছেন,“বাস্তবে যেমন যুদ্ধে যে কেউ মারা পড়তে পারে, তেমনি তার উপন্যাসেও সেটা ঘটে থাকে। এখানে নায়ক বলে ছাড় পাওয়ার সুযোগ নেই।” তবে তার এই হত্যাযজ্ঞের পেছনে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন সেই টলকিনই। লর্ড অফ দ্য রিংসে গ্যান্ডালফের মৃত্যুর মাধ্যমে তিনি যেভাবে গল্পে নতুন করে উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে, সেটি তার বেশ মনে ধরেছে। যতই অভিযোগ থাকুক, তার এই কথার সাথে কারো দ্বিমত থাকার কথা না।
টিভির পর্দায় গেম অফ থ্রোন্স
জর্জ আর আর মার্টিনের সুদীর্ঘ উপন্যাস পড়তে যাদের অনীহা, তাদের জন্য রয়েছে এইচবিও চ্যানেলের বিশ্ব কাঁপানো টিভি সিরিজ গেম অফ থ্রোন্স। ২০০৭ সালে এইচবিও জর্জ মার্টিনের নিকট এই সিরিজ নির্মাণের অনুমতি লাভ করে। ২০১১ সালে তার উপন্যাসের ঘটনাকে পুঁজি করে নির্মিত এই সিরিজের সম্প্রচার শুরু হয়। প্রচারের প্রথম বছরে নাটকের জগতে সবচেয়ে বড় পুরস্কার ‘এমি’-র মঞ্চ কাঁপিয়ে ফেলে গেম অফ থ্রোন্স। সেবার মোট ১৩টি বিভাগে পুরস্কৃত হয় সিরিজটি। ২০১২ সাল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন বিভাগে প্রায় ৪১টি এমি পুরস্কার জিতে নিয়েছে এই সিরিজটি। দর্শকদের নিকট প্রচুর প্রশংসা পাওয়া এই সিরিজটি কিন্তু বর্তমানে কাহিনীর দিক দিয়ে বইয়ের সময়ের দৈর্ঘ্য অতিক্রম করে ফেলেছে। এই বছর (২০১৯ সাল) মে মাসের দিকে এই সিরিজের শেষ পর্ব প্রচারের মাধ্যমে এইচবিও গেম অফ থ্রোন্সের ইতি টানবে। আর এরই মাধ্যমে দর্শকদের দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটবে। তারা জানতে পারবেন লৌহ মসনদের সর্বশেষ পরিণতি।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, সিরিজ আর বইয়ের পরিণতি কী এক হবে নাকি? এই প্রশ্নের উত্তর হবে, সম্ভবত না। কারণ, ইতিমধ্যে বই আর সিরিজের কাহিনীতে বেশ বড় রকমের তফাৎ দেখা গিয়েছে। তাই পরিণতি এক না হওয়ারই কথা। এটি কিন্তু ভক্তদের জন্য বেশ ভালো খবর। এক ঢিলে দুই পাখির মতো তারা দু’টি গেম অফ থ্রোন্স উপহার পেতে যাচ্ছে বলে!
সম্মাননা এবং পুরস্কার
জর্জ আর আর মার্টিন তার অসাধারণ উপন্যাস এবং গল্পের জন্য অসংখ্য পুরস্কার জিতে নিয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে হুগো পুরস্কার। ১৯৭৫ সালে ‘আ সং ফর লিয়া’র জন্য তিনি প্রথম এই পুরস্কার জিতেছিলেন। ১৯৮০ সালে তিনি ‘স্যাণ্ড কিং’ নামক উপন্যাসিকার জন্য হুগো এবং নেবুলা পুরস্কার জিতে নেন। গেম অফ থ্রোন্স সিরিজের বইগুলোর জন্যেও তিনি হুগো, লুকাস, নেবুলাসহ বেশ কয়েকটি পুরস্কার অর্জন করেছেন।
গেম অফ থ্রোন্স সিরিজের প্রথম উপন্যাস তেমন সাড়া ফেলতে না পারলেও এর পরবর্তী কিস্তিগুলো নিউ ইয়র্ক বেস্ট সেলার তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। টিভি সিরিজ মুক্তির পর এই বইগুলোর বিক্রি বহুগুণে বেড়ে যায়। এখন পর্যন্ত এই সিরিজের প্রায় ৭০ মিলিয়ন বই বিক্রি হয়েছে বলে এক জরিপে জানা যায়। বিশ্বের প্রায় ৪৭টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে এই সিরিজের বইগুলো।
গেম অফ থ্রোন্সের ৫ম বই ‘ড্যান্স অফ ড্রাগন’ বের হয়েছে আজ আট বছর হতে চলেছে। ষষ্ঠ বই ‘দ্য উইণ্ডস অফ উইন্টার’ কবে বের হবে, সেটা নিয়ে জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। এদিকে সবাই যেমন অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত, তেমনি শান্তিতে নেই খোদ জর্জ। তার ভাষায়,
বেশ কয়েক বছর ধরে আমি যেন যুদ্ধ করছি। এই উপন্যাসটি সাধারণ কোনো কাহিনীর কাতারে ফেলার মতো নয়। আর আট দশটি গল্পের মতো লিখে ফেললেই হচ্ছে না। ষড়যন্ত্র, ভালোবাসা, শত্রু-মিত্র,-সবকিছু এক সুতোয় বাঁধা খুব সহজ লাগছে না আমার কাছে।
২০১১ সালে তার দীর্ঘদিনের প্রেমিকা প্যারিসকে বিয়ে করেন এই লেখক। নতুন স্ত্রীকে নিয়ে নিউ মেক্সিকোর সান্টা ফে’তে বসবাস করছেন তিনি। সাথে সাথে এগিয়ে যাচ্ছে বই লেখার কাজও। তার কলম থেকে রচিত হচ্ছে ওয়েস্টেরসের জটিল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের রোমাঞ্চকর সমাধান। হয়তো মে মাসের শেষের দিকে টেলিভিশনের বদৌলতে আপনারাও জেনে যাবেন সেই সমাধানের কথা। এরপর লৌহ মসনদ নিয়ে অনেকের কৌতূহল মিটে যাবে। কিন্তু একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না, এসব কিছুর স্রষ্টা ছিলেন একজন কাল্পনিক লেখক- যিনি আজীবন পাঠকের মসনদে আসীন থাকবেন। তিনি আমাদের প্রিয় জর্জ আর আর মার্টিন।