নিজের মেধা, পরিশ্রম আর আত্মোৎসর্গ দিয়ে বর্তমান ভারতীয় সিনেমার ঝলমলে সবচেয়ে দ্রুত আর খুবই উজ্জ্বলভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা এক নাম রাজকুমার রাও। খুব কম সময়ে এই জগতে নিজের তুলনা যেন তিনি নিজেই হয়ে উঠছেন। এ যেন নিজের রাজ্য চিনে নিয়ে হাজারো ভক্তের মন জয় করে নিজের ‘রাজকুমার’ নামকেই ষোলআনা সার্থক করে তোলা। আর পর্দার জমকালো রাজ্য জয়ের শুরুতেই যে দেশের চলচ্চিত্র জগতের সর্বোচ্চ পুরষ্কার দিয়ে এই রাজকুমারের অভিষেক ঘটেছে, সে কথাও তো না বললেই নয়। তাঁর প্রতিভা আর যোগ্যতা অভিনয় জীবনের শুরুতেই তাঁর ঘরে এনে দিয়েছে ভারতের অভিনয় জগতের আরেক অত্যন্ত সম্মানজনক পুরষ্কার ‘ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড’, তা-ও দু’বার। কোনো পারিবারিক নামের প্রভাবে নয়, অর্থের জোর বা সুপারিশও নয়, নিজের প্রতিভা আর কাজের প্রতি আত্মনিবেদনকে সাথে নিয়েই রাজকুমার দ্রুতই হয়ে উঠছেন রূপালি পর্দার সত্যিকারের রাজকুমার। রাজকুমারের নিজের কন্ঠেই অভিনয়ের প্রতি নিবেদন ফুটে ওঠে, যখন তাঁকে বলতে শোনা যায়-
“কখনো অন্য কোনো পরিকল্পনাই ছিলো না, অন্যকিছু করবো বলে কখনো ভাবিওনি। অভিনয়ই সবসময় জীবনের মানে ছিলো আমার।”
ভারতের এই উদীয়মান তারকা ১৯৮৪ সালের ৩১ আগস্ট ভারতের হরিয়ানা প্রদেশের গুরগাঁও নামক শহরে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। এই শহরেই তাঁর বেড়ে ওঠা। এখানকার ব্লু বেল মডেল স্কুলেই তাঁর শিক্ষাজীবনের হাতেখড়ি হয়। শৈশব আর কৈশোরের সময়টা থেকেই সিনেমার প্রতি তাঁর তীব্র আগ্রহ তৈরী হয়। গুরগাঁওয়ের সিনেমা হলগুলোতে কোনো নতুন সিনেমা এলেই সবার আগে তিনি টিকিটের লাইনে দাঁড়িয়ে যেতেন। স্কুল ফাঁকি দিয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়া তার ছিলো মোটামুটি নিত্যদিনের ব্যাপার। ভালো লাগলে একই সিনেমা দেখতেন একাধিকবার। সিনেমার প্রতি ভালোবাসাটা এভাবেই বাড়তে থাকে সময়ের সাথে। অবশ্য মধ্যবিত্ত ছেলেদের সিনেমা বা খেলাধুলাতে বেশি আগ্রহ দেখালে যেমন পারিবারিক অসন্তোষের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, রাজকুমারের বেলায় ঠিক তেমনটা হয়নি। বরং মায়ের কাছে সাহায্য আর অনুপ্রেরণা ভালোই পেয়েছিলেন বলা যায়। মধ্যবিত্ত মায়েদের মতো স্কুল ফাঁকি দিয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়া তাঁর মায়ের কাছে তেমন কোনো অপরাধ ছিলো না।
দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় মঞ্চে নাচ করে ব্যাপক প্রশংসা পান কিশোর রাজকুমার, স্কুলের নাটকে তাঁর অভিনয় দৃষ্টি কাড়ে দর্শকদের। তখন থেকেই তিনি ভাবতে শুরু করেন বিনোদন জগতে পা রাখার কথা, স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন অভিনয়কে আঁকড়ে ধরে। সেদিনকার কিশোর রাজকুমার ভুল স্বপ্ন দেখেননি। তাই বলে পড়াশোনা নিয়েও কিন্তু পিছিয়ে থাকেননি তিনি। স্কুলের গণ্ডি পার করে কলেজে পড়ার সময় তিনি দিল্লিতে একটা অভিনয়ের স্কুলে ভর্তি হোন, অন্যদিকে কলেজের মঞ্চে অভিনয় কিন্তু থেমে থাকেনি। ২০০৫ সালে তিনি ভারতে চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট (এফটিআইআই)-তে মাত্র ২০ জনের একজন হয়ে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পান। ঠিক তখন থেকেই তাঁর জীবন অন্য এক রাস্তা ধরে নিজের রাজত্বের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করে। প্রতিভা আগে থেকেই ছিলো, আরএফটিআইআই সেই প্রতিভাকে বিকাশের সম্পূর্ণ সুযোগ করে দেয় এসময়। দেশীয় গন্ডি পেরিয়ে রাজকুমার শুরু করেন আন্তর্জাতিক মানের অভিনেতাদের লক্ষ্য করা ও অভিনয়ের আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে শেখা। অভিনয়ের সবচেয়ে বড় পাঠ যে তিনি এখানেই পান, তা তিনি নিজেই পরবর্তী সময়ে স্বীকার করেন।
২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বলিউডের ঝলমলে জগতে নিজের ভাগ্যের অন্বেষণে তিনি মুম্বাই যান। ‘লাভ, সেক্স অর ধোঁকা’ বা ‘রাগিণী এমএমএস’ সিনেমাগুলোতেই তাঁর অভিনয় নজর কাড়ে অন্যদের। এরপর তিনি ‘গ্যাংস অব ওয়াসিপুর’, ‘তালাশ’, ‘কুইন’, ‘আলিগড়’ এর মতো সিনামাগুলোতে পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করলেও সেগুলো সিনেমাজগতে তাঁর অসাধারণ প্রতিভার জানান দেয়। এরপর থেকে তাঁর অভিনয়ের জমকালো যাত্রা আর থেমে থাকার নয়। অন্যরকম সব সিনেমায় অসাধারণ অভিনয় দর্শক, আলোচক- সমালোচক সবার মনেই খুব দ্রুতই দাগ কাটতে থাকে। ২০১৬ এবং ২০১৭ সাল তো বলা যায় ভারতের বিনোদনের জগত বলিউডের নামকরা সব তারকাদের থেকে মধ্যবিত্ত ঘরের এই রাজকুমারই জয় করেছে বেশি। আর করবেনই না কেন! রাজকুমার জেনেছেন তার মতো ভারতের সাধারণ দর্শকরাও সিনেমাতে জাঁকজমকের চেয়ে অর্থবহ গল্প আর যথার্থ অভিনয়ের আকাঙ্ক্ষী বেশি। আর নিজের প্রতিভার কথাও তার অজানা ছিলো না।
নিজের প্রতিভা আর আত্মনিবেদনের প্রতি শুরু থেকেই রাজকুমার বিশ্বাস রেখেছিলেন। দেখতে সচরাচর নায়কদের মতো আবেদনময় আর কমনীয় না হলেও তা নিয়ে আত্মবিশ্বাসের কমতি ছিলো না কখনোই। কর্মজীবনের শুরুর দিকে একবার তিনি ভালো একটা সিনেমার প্রস্তাব পান, শেষপর্যন্ত পরিচালক রাজকুমারকে নিতে অনেক আগ্রহ দেখালেও প্রযোজকের পক্ষ থেকে ত্বকের রঙ নিয়ে আপত্তি আসে। বিনোদনের জগতে যখন অন্য কেউ এরকম বিষয় নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগবে, তখন রাজকুমার অবাক হয়ে ভাবলেন- “গায়ের রঙ নিয়ে কেন সমস্যা হবে?” এই চরিত্রগুলোতে তো কাশ্মীরের মানুষদের চরিত্র নয়, তাহলে কেন এই ক্ষেত্রে গায়ের রঙ প্রতিবন্ধক হবে? তিনি হাসলেন আর পরের সিনেমার জন্য কাজ করা শুরু করলেন। সিনেমার গল্প বাছাই কিন্তু অভিনয়ের মতোই আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার রাজকুমারের জন্য। পরিচালক, সহকর্মী বা তাঁকে দেওয়া চরিত্র কিছুই বড় হয়ে ওঠে না তার জন্য, যদি গল্পটা মনমতো হয়।
পার্শ্বচরিত্র বা প্রধান চরিত্র- রাজকুমারের জন্য প্রত্যেক চরিত্রই সমান গুরুত্ব বহন করে। প্রত্যেকটা চরিত্রেই রাজকুমার নিজের প্রতিভার সবটুকু ঢেলে দেন। ‘নিউটন’ সিনেমায় একগুঁয়ে, জেদি আর কঠোর দায়িত্বশীল নায়ক রাজকুমার একদিকে যেমন দর্শকদের মন কাড়ে, আবার ‘বেহেন হোগি তেরি’ তে পাড়ার রোমান্টিক ছেলে প্রতিবেশী মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে দর্শকদেরও যেন নিজেদের প্রেমের কথা মনে কড়িয়ে দেয়। আবার একই সিনেমাতে পুরো বিপরীত দুটো চরিত্রও কিন্তু নিখুঁতভাবে তুলে ধরতে দেখা যায় তাঁকে। ‘শাদী মে জরুর আনা’ রাজকুমারের তেমনি একটা সিনেমা। এই সিনেমাতে প্রথম পর্বে যদিও অত্যন্ত সাদাসিধে মফস্বলের ছেলে হিসেবে তিনি বিয়ের দিন বাগদত্তার ধোঁকা দেওয়াতে অত্যন্ত ভেঙে পড়ে, বিরতির পরে দেখা যায় কিভাবে পরবর্তীতে সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে নিজেকে সমাজে মাথা তুলে দাঁড় করান। উভয় চরিত্রেই রাজকুমারের অভিনয় প্রশংসার দাবিদার। অবশ্য কর্মজীবনে রাজকুমারের শুরু তাঁর প্রতিভার অসামান্য স্বীকৃতি আর দর্শকদের হৃদয়ের জয়মাল্য দিয়েই হয়েছে বলা যায়। মানবাধিকারের পক্ষের উকিল শহীদ আজমীর জীবনের গল্প নিয়ে তৈরী ‘শহীদ’ সিনেমাতে প্রধান চরিত্রে অতুলনীয় অভিনয়ের জন্য পেয়েছেন ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার। এক অভিনেতার জন্য এরচেয়ে গর্বের বিষয় আর কি হতে পারে? ‘ট্র্যাপড’ সিনেমার জন্য পেয়েছেন ফিল্মফেয়ারে সমালোচকদের হিসাবে সেরা অভিনেতার খেতাব। ‘বারেলী কি বারফি’ তে আয়ুশমান আর কৃতি শ্যাননের সাথে কাজ করলেও রাজকুমারের অভিনয় পুরো সিনেমাটিকেই যেন রাজকুমারময় করে দেয়। এই সিনেমাতে অভিনয়ের জন্য পেয়েছেন দ্বিতীয় ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড। এ যেন ঠিক রাজকুমারের মতোই তাঁর জয়যাত্রার শুরু।
সাদাসিধে রাজকুমার শাস্ত্রে বিশ্বাসী। অভিনয়ের জগতে পা দেওয়ার আগে তাই মায়ের পরামর্শে নিজের নাম রাজকুমার যাদব থেকে পরিবর্তন করে রাখেন রাজকুমার রাও। ব্যক্তিত্বের জন্যই হয়তো অন্য তারকাদের মতো রাখঢাক না করে ‘সিটি লাইট’ সিনেমার সহকর্মী অভিনেত্রী পত্রলেখার সাথে সম্পর্কের কথা তিনি অকপটে স্বীকার করতে পারেন। শান্ত স্বভাবের হলেও রাজকুমার কিন্তু পঞ্চম শ্রেণিতে থাকতেই মার্শাল আর্টের প্রশিক্ষণ নেন এবং তাইকোয়ান্ডোতে জাতীয় পর্যায়ে সোনা বিজয়ী। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের রাজকুমার কিন্তু এভাবেই অনন্য করে তুলেছেন। তাঁর গল্পের এ তো কেবল শুরু, পুরো গল্প তো সামনের দিনগুলোই বলে দেবে। তবু নিজের জয় রাজ্যে রাজকুমারের ঝলমলে হাসি সামনের বৃহত্তর বিজয়েরই ইঙ্গিত দেয় যেন!
ফিচার ইমেজ- dinaindia.com