All our dreams can come true, if we have the courage to pursue them.
-Walt Disney
ভাবুন তো, ওয়াল্ট ডিজনিকে ছাড়া পৃথিবীটা কেমন হতো? কেমন কাটতো আপনার শৈশব ডিজনির মজার চরিত্রগুলো ছাড়া, যারা আপনার কল্পনার রূপকথার দুনিয়ায় এসে স্ফুলিঙ্গ ছড়ায়? ডিজনিল্যান্ড আর থিম পার্কগুলোর কি কোনো অস্তিত্ব থাকতো?
অ্যানিমেশন চলচিত্রের এই অগ্রদূত আমাদের শৈশবকে রাঙিয়ে তুলতে কালজয়ী সব চরিত্র আর রূপকথার জগৎ উপহার দিয়ে গেছেন। কিন্তু এর জন্য নাছোড়বান্দা এই উদ্যোক্তাকে পাড়ি দিতে হয়েছে বিশাল এক দুর্গম পথ। প্রতারিত হয়েছেন অনেকবার। মুখোমুখি হতে হয়েছে কঠোর বাস্তবতার। ইতিহাসের পাতায় যা তাকে কিংবদন্তীর আসন দিয়েছে। আবার ডিজনির চরিত্রগুলোর আড়ালে ঢাকা পড়েছে অনেক নির্মম বাস্তবতা। কেমন ছিল এই কিংবদন্তীর জীবনের চলার পথ? সত্যিই কি তিনি মিকি মাউসের স্রষ্টা?
১৯০১ সালের ০৫ ডিসেম্বর। ডিজনি পরিবারের মুখে হাসি ফুটিয়ে আগমন ঘটলো পরিবারের চতুর্থ অতিথির। নাম রাখা হলো তার ওয়াল্টার এলিয়াস। বাবা এলিয়াস ডিজনি এবং মা ফ্লোরা ডিজনির পরিবারের বাকি তিন সন্তান নিয়ে তখন সংসারে চলছে বেশ টানাপোড়ন। ওয়াল্টের জন্ম ইলিনয়ের শিকাগোতে। সেসময় শিকাগোর অপরাধ জগতের বেপরোয়াতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠায় এলিয়াস ডিজনি তার পরিবার নিয়ে পাড়ি জমান মিসৌরিতে। ওয়াল্টের বয়স তখন দুই বছর। জমানো টাকা দিয়ে মার্সেলাইন নামক এক ছোটখাটো মিডওয়েস্টার্ন শহরে কিনে ফেলেন ৪৫ একরের একটি ফার্ম। কাঠমিস্ত্রি পেশা ছেড়ে শুরু করেন কৃষিকাজ।
মার্সেলাইন ওয়াল্ট ডিজনির জীবনে বেশ বড় ধরনের একটা ভূমিকা পালন করেন। এখানে থাকাকালীনই কার্টুন আঁকানোর হাতেখড়ি হয় তার, তিনি আবিষ্কার করেন আর্টের প্রতি তার অদ্ভুত টান। এই শহরের প্রতিচ্ছবিই ফুটিয়ে তোলা হয় ডিজনিল্যান্ডে সহ বেশ কয়েকটি থিম পার্কের প্রবেশপথগুলোতে। এছাড়াও বেশ কিছু চলচ্চিত্র এবং কার্টুন যেমন “সো ডিয়ার টু মাই হার্ট”, “লেডি এন্ড দ্য ট্র্যাম্প” এ মার্সেলাইনের প্রভাব দেখা যায়।
ডিজনির বাবা ছিলেন বেশ কঠোর প্রকৃতির। অভাবের সংসারে তাই পাঁচ সন্তানকেই থাকতে হতো কড়া নিয়মকানুন এবং শাসনের মধ্যে। আর স্কুল শিক্ষিকা মা ফ্লোরা ছিলেন তার উলটো। বাবাকে ফার্মের কাজে সাহায্যের পাশাপাশি ফার্মের পশুপাখির ছবি আঁকতে থাকেন ডিজনি।
ফার্মে বেশ সুবিধা করতে না পেরে সেটিও বিক্রি করে দেন এলিয়াস ডিজনি। এবারে ক্যানসাস শহরে এসে শুরু করেন পত্রিকা বিক্রি। ওয়াল্ট ডিজনি তখন ৮ বছরের শিশু। ডিজনির বড় দুই ভাই পরিবারে নিয়মকানুনের সাথে মানিয়ে নিতে না পেরে পাড়ি জমান অন্য জায়গায়। বাবার কাজে সাহায্য করার জন্য এবার ডিজনির দায়িত্বটা বেড়ে যায় আরো।
বেনটন গ্রামার স্কুলে ভর্তি হয়ে পড়ালেখার পাশাপাশি বড় ভাই রয় ডিজনির সাথে শুরু করেন পত্রিকা বিলি করার কাজ। ওয়াল্ট ডিজনি তার বড় ভাই রয় ডিজনিকে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলোতে পাশে পেয়েছেন। ভাইয়ের প্রতি তার বিশ্বাস এবং শ্রদ্ধা দুটোই ছিল বেশ। ভোর ৪ টা কখনও বা ৩.৩০ এ উঠে বেরিয়ে পড়তেন পত্রিকা বিক্রি করতে। কাজ শেষে ছোট একটা ঘুমের পর আবার রওনা হতেন স্কুলে।
স্কুল থেকে ফিরে আবারো পেপার বিক্রির কাজ। টানা ছয় বছর এই ক্লান্তিকর কাজ করে যান তিনি। ক্লান্তির জন্য কখনো কখনো ক্লাসেই ঘুমিয়ে পড়তেন। কিন্তু আঁকাআঁকির প্রতি তার ভালোবাসা কমেনি কখনওই। আর্ট ক্লাসে চমৎকার সব স্কেচ করে অবাক করে দিতেন শিক্ষকদের। মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা স্বপ্নটাকে তিলে তিলে বড় করতে থাকেন চর্চার মাধ্যমে। নিউজপেপার বিক্রির সুবিধায় কার্টুন এঁকে পেপারেও ছাপাতেন মাঝেমাঝে। কিছু বাড়তি আয়ও হয়ে যেত।
এদিকে এলিয়াস ডিজনি যেন কোথাও তেমন সুবিধা করতে পারছেন না। নিউজপেপার বিক্রি ছেড়ে পরিবারসহ আবারো ফিরে এলেন শিকাগোতে। পার্টনারশিপে শুরু করলেন ও-জেল জেলি ফ্যাক্টোরিতে ব্যবসা। আর ১৬ বছর বয়সী কিশোর ওয়াল্ট ভর্তি হন ম্যাককিনলি হাই স্কুলে। দক্ষতার জোরে হয়ে যান স্কুলের নিউজপেপারের জুনিয়র আর্ট এডিটর। দিনে স্কুল আর রাতে শিকাগো একাডেমি অফ ফাইন আর্টসের আর্টক্লাসে চলতো প্রশিক্ষণ। আর্টক্লাসের খরচ যোগাতে কাজ নেন বাবার ফ্যাক্টোরিতে কাঁচের জার ধোয়ার। কিন্তু পড়ালেখায় মনোযোগের অভাবে হাইস্কুলে পড়ার সুযোগ হারালেন ডিজনি।
এদিকে ভাই রয় যোগ দিয়েছেন চলমান প্রথম বিশ্বযুদ্ধে। ভাইকে সঙ্গ দিতে যোগ দিতে চাইলেন আর্মিতে। কিন্তু ১৭ বছর পূর্ণ হয়নি তার। তাই সে আশা পূরণ না হলেও সুযোগ পান রেড ক্রস অ্যাম্বুলেন্স সেনাদলের অ্যাম্বুলেন্স চালক হিসেবে। আর তার জন্য ব্যবহার করেন জাল জন্ম নিবন্ধন। ডিজনিকে নিয়ে যাওয়া হয় ফ্রান্সে। যুদ্ধ তখন শেষ পর্যায়ে। সেই নৃশংসতা দৃশ্য চলাকালীন মুহূর্তেও ভবিষ্যতের আর্টিস্ট সত্ত্বাকে বাঁচিয়ে রাখতে অ্যাম্বুলেন্সের গায়েই চিত্রকর্ম তৈরি করে যান।
যুদ্ধ শেষে ইউরোপ থেকে ফিরে এলেন আবারো যুক্তরাষ্ট্রে। মনে এখন পূর্ণ বিশ্বাস, নিজ জীবনযুদ্ধে নামতে প্রস্তুত তিনি। ১৮ বছর বয়সী ডিজনি এবার চাকরির খোঁজে নেমে পড়লেন। কিছুদিন বাদেই যোগদান করলেন ক্যানসাস সিটির প্রেসম্যান-রুবিন স্টুডিওতে কমার্শিয়াল আর্টিস্ট হিসেবে। পরিচয় হলো সহকর্মী আব আইওয়ার্কসের সাথে, বড় ভাই রয়ের মতো আইওয়ার্কসকেও পাশে পেয়েছিলেন ডিজনি তার জীবনের জটিল মুহূর্তগুলোর সময়।
পরের বছর স্টুডিওটি থেকে বের হয়ে গেলেন তারা দুজনেই। দুই বন্ধু মিলে খুলে বসলেন নিজেদের স্টুডিও “ডিজনি-আইওয়ার্কস অ্যাড স্টুডিও”। কিন্তু ভাগ্য সহায় হলো না এবারও। যথাযথ ক্লায়েন্টকে আকৃষ্ট করতে পারলেন না তারা। এক মাসে বাদে ক্ষান্ত দিয়ে শুরু করলেন নতুন চাকরি। আবারো ক্যানসাসেই সিটি ফিল্ম অ্যাড কোম্পানিতে কার্টুনিস্ট হিসেবে যোগদান করলেন। আইওয়ার্কস আর ডিজনি মিলে তৈরি করতে থাকলেন মুভি থিয়েটারের জন্য অ্যাড।
সিটি ফিল্মে কাজ করার সময় ডিজনি একদিন ধার করে আনেন অব্যবহৃত একটি ক্যামেরা। শুরু করলেন নতুন আইডিয়ার পরীক্ষা, স্টপ অ্যাকশন ফিল্ম। তার আঁকা চিত্রগুলো দিয়ে একেরপর এক ফ্রেম সাজিয়ে তৈরি করার চেষ্টা করলেন অ্যানিমেশন। রাতের পর রাত জেগে পরিশ্রম কাজে আসলো। সফল হলেন, এর নাম দিলেন লাফ-ও-গ্রাম। মাথায় আসা আইডিয়া আরেকটু পরিবর্তন করে লাইভ অ্যাকশন ফিল্ম তৈরির কথা জানালেন স্টুডিওর মালিককে। কিন্তু তা প্রত্যাখ্যান করলেন মালিক।
পরের দু’বছর সেখানে কাজ করে আইওয়ার্কসকে নিয়ে আবারো ত্যাগ করলেন এই কোম্পানিও। খুলে বসলেন লাফ-ও-গ্রাম ফিল্মস। এবারে ভাগ্য কিছুটা সদয় হলো। পিক্টোরিয়াল ফিল্মসের কাছে একটি ফেয়ারি টেল সিরিজ বিক্রি করতে পারলেন তারা। কিন্তু পরের বছর পিক্টোরিয়াল ফিল্ম দেউলিয়া হয়ে গেলে ডিজনির আর কোনো উপায় খোলা ছিল না।
২২ বছর বয়সী ওয়াল্টের ভাগ্য সহায় না হলে কি হবে, হাল ছাড়বার পাত্র নন তিনি। হলিউডে এসে মেলা চেষ্টার পর মার্গারেট উইংক্লার নামের এক কার্টুন ডিস্ট্রিবিউটর কে চিঠি লিখে পাঠালেন। লাফ-ও-গ্রাম নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করলেন মার্গারেট। চুক্তিনামায় সই করে কাজে নেমে পড়লেন ডিজনি। সঙ্গে নিলেন ভাই রয়কে, দায়িত্ব নিলেন হিসাবরক্ষক এবং ক্যামেরাম্যানের। হলিউডে একটি রুম ভাড়া করলেন সাথে আরো কিছু অ্যানিমেটর এবং একটি বাচ্চা মেয়েকে, তৈরি হলো লাইভ অ্যাকশন ফিল্ম “অ্যালিস ইন কার্টুনল্যান্ড”।
থিয়েটারে দেখানোর পর বেশ প্রশংসিত হলো সেই চলচ্চিত্র। ডিজনি এবার ডেকে আনলেন আইওয়ার্কস সহ আরো দুজন আর্টিস্ট। ভাগ্য নতুনভাবে সঙ্গ দেয়া শুরু করেছে। ভাবছেন হয়তো এখানেই শেষ ভাগ্যের নির্মমতা, কিন্তু না। এক রুমের অফিস থেকে একতলার একটি বাসা ভাড়া করা হলো এবার। ডিজনি ব্রোস স্টুডিও নাম পালটে রাখা হলোওয়াল্ট ডিজনি স্টুডিও। এসময় স্টুডিওরই এক আর্টিস্ট লিলিয়ান বাউন্ডসের প্রেমে পড়ে বিয়ে করে ফেলেন তাকে।
সময়টা ১৯২৭ সাল। মার্গারেটের স্বামী চার্লস মিন্টজ ডেকে পাঠালেন ডিজনিকে। জানালেন সেসময়ের জনপ্রিয় কার্টুন সিরিজ ফেলিক্স দ্য ক্যাট কে পাল্লা দেয়ার মতো একটি কার্টুন সিরিজ বানানোর কথা। রাজি হলেন ডিজনি। টিম নিয়ে নেমে পড়লেন নতুন মিশনে। পরের বছরই তৈরি করলেন অসওয়াল্ড দ্য লাকি র্যাবিট সিরিজ।
রাতারাতি জনপ্রিয়তা পেল এই সিরিজ। এবার কিছুটা স্বস্তি, এতদিনের শ্রমের মূল্য পাওয়া শুরু হয়েছে। কিন্তু ভাগ্য বেঁকে বসলো আবারো। মিন্টজের চুক্তির টাকার পরিমাণটা বাড়াতে তার সাথে দেখা করতে নিউইয়র্ক গেলেন ডিজনি। যা শুনলেন তাতে পুরোপুরিভাবে মুষড়ে পড়লেন ডিজনি। বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন মিন্টজ আর মার্গারেট। অর্থ বৃদ্ধির পরিবর্তে প্রতিশ্রুত অর্থের আরো কম অফার করেন তারা। এছাড়াও জনপ্রিয় অসওয়াল্ডের কার্টুন চরিত্রগুলোর স্বত্বাধিকার চুরি করে নিজেদের নামে করে ফেলেছেন। ভাষা হারিয়ে কিছু না বলে ফিরে আসেন ডিজনি। কিন্তু তার মনে একটাই ভাবনা তখন হাল ছাড়া চলবে না।
ফিরে এসে আইওয়ার্কসকে জানালেন পুরো ঘটনা। নতুন এক কার্টুন চরিত্র তৈরি করতে হবে এবারে। ঘোড়া, বিড়াল, গরু, ব্যাঙের মতো একের পর এক চরিত্রের পরামর্শ দিয়ে গেলে আব আইওয়ার্কস। কিন্তু কোনোটাই মনে ধরলো না ডিজনির। অফিসে কাজ করার সময় একদিন ইঁদুর দেখেই বুঝে গেলেন ওয়াল্ট, কী চান তিনি। আইওয়ার্কস কথামতো শুরু করলেন ইঁদুরের একটি চরিত্র বানাতে।
অনেকেই হয়তো জানেন, ওয়াল্ট ডিজনি মিকি মাউসের স্রষ্টা। কিন্তু বাস্তবে এই চরিত্রটি ডিজাইন এবং অ্যানিমেট করেন আইওয়ার্কস, যেখানে ওয়াল্ট কেবল পরামর্শ দিয়েছিলেন তাদের। চরিত্রের নাম মর্টিমার মাউস রাখলেও লিলিয়ানের নামটি পছন্দ হয়নি। তিনি রাখলেন মিকি মাউস। স্ত্রীর দেয়া নামেই শুরু হলো নতুন কার্টুন সিরিজ তৈরি। জীবনের মোড় ঘোরানোর জন্য এটুকুই যথেষ্ট ছিল না।
এবারো ডিস্ট্রিবিউটর ছাড়া তা প্রচার করা সম্ভব নয়। পাশাপাশি দরকার আরেকটু বিশেষত্ব। সেসময়ের চলচ্চিত্র জগতে নতুন সংযোজন ছিল শব্দ। এতদিন সবই ছিল নির্বাক চলচ্চিত্র। সিনেফোনের প্যাট পাওয়ার স্টুডিওর সহায়তায় শুরু হলো লিপ সিংকের মাধ্যমে শব্দ দেওয়া। মিকি মাউসের ডিজাইন ওয়াল্ট নিজে না করলেও এইবার ওয়াল্টের কন্ঠেই রেকর্ড হলো মিকির ভয়েস। তবে এবারে স্বত্বাধিকারের দিকে বিশেষ নজর দিলেন ওয়াল্ট।
প্যাট পাওয়ারের সুনিপুণ দক্ষতায় আর আইওয়ার্কস-ডিজনি আর তাদের অ্যানিমেটরদের জাদুর ছোঁয়াই ১৯২৮ সালের ২৮ নভেম্বর প্রকাশিত হওয়া স্টিমবোট উইলি সবার মন জয় করলো। অসওয়াল্ডের থেকেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেলো স্টিমবোট উইলি। মিকি মাউস ক্লাব গঠনের পর তার সদস্য সংখ্যা দাঁড়ালো ১০ লক্ষের উপরে। পরের বছর সিলি সিম্ফোনি উন্মুক্ত করা হলে তাতে যোগ করা হয় গুফি, ডোনাল্ড ডাক, প্লুটোর মতো জনপ্রিয় কয়েকটি চরিত্র।
কোনোরকম হতাশা ছাড়া এবার ডিজনি তার জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছাতে শুরু করেন। যেমনি জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে, তেমনি লাভও আসতে থাকে সবদিক থেকে। কিন্তু এতদিন ছিল সবই কেবল সাদাকালো। টেকনিকালার আসার পর ১৯৩২ সালে প্রথম রঙিন অ্যানিমেশন ফ্লাওয়ারাস এন্ড ট্রিজ অ্যাকাডেমিক অ্যাওয়ার্ড জিতে নেয়। একের পর এক অসাধারণ চলচ্চিত্র উপহার দিতে থাকে ডিজনি স্টুডিও। দ্য গ্র্যাসহপার এন্ড দ্য অ্যান্টস (১৯৩৪), দ্য টরটয়েজ এন্ড দ্য হেয়ার (১৯৩৫) অন্যতম। এদিকে রয় কোম্পানির দেখভাল আর অর্থনৈতিক দিক সামলাতে থাকেন।
ডিজনি কখনোই থেমে থাকেননি। ১৯৩৪ সালে স্বল্পদৈর্ঘ্য থেকে পূর্ণদৈর্ঘ্য অ্যানিমেশন বানানোর সিদ্ধান্ত নেন। অসাধারণ কিছু আর্টিস্টের সাথে একটা দারূণ টিমের সমন্বয়ে ১৯৩৭ সালে প্রকাশ পায় ক্লাসিক রূপকথার উপর ভিত্তি করে তৈরি স্নো হোয়াইট অ্যান্ড দ্য সেভেন ডোয়ার্ফস। চলচ্চিত্রটি বানাতে খরচ হয়ে হয়েছিল ১.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। সেসময়ে টাকার অংকে এটা বিশাল পরিমাণ। সবাইকে অবাক করে দিয়ে বক্স অফিস মাতিয়ে আয় করে নেয় ৪১৬ মার্কিন ডলার।
শুধুমাত্র আর্টিস্ট এবং ডিজাইনার থেকে ডিজনি এবার দলের নেতৃত্ব দেয়া শুরু করেন, অসাধারণ সব কাজ নিয়ে এগিয়ে নিতে থাকেন ডিজনি স্টুডিওকে। কিন্তু পরের বছরের এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ওয়াল্টকে জীবনের বাকীটা সময় মানসিকভাবে বেদনাহত করে রাখে। পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে সফলতা পাবার পর বাবা মায়ের জন্য ক্যালিফোর্নিয়ার বারব্যাংকে বাসা কিনে দেন। বাসাটি তাদের খুব পছন্দ হলেও তার মা বাসার ফার্নেসের গ্যাস ছিদ্র থাকার অভিযোগ করেন।
ব্যস্ত ওয়াল্ট ব্যাপারটা খতিয়ে দেখার সময় পাননি। মিস্ত্রি এলেও তারা সারিয়ে তুলতে সক্ষম হননি। ২৬ নভেম্বর তাদের দুইজনকেই বাসার মধ্যে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া যায়। পরে হাসপাতালে নেয়া হলে ওয়াল্টের বাবাকে বাঁচানো গেলেও প্রাণ হারান তার মা। গ্যাসের কারণে শ্বাসরোধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। একেবারে মুষড়ে পড়েন ওয়াল্ট ডিজনি, বাকীটা জীবন নিজেকেই দোষারোপ করতে থাকেন এই দুর্ঘটনার জন্য।
কিন্তু জীবন তো থেমে থাকে না। একে একে প্রকাশ করেন ফ্যান্টাসিয়া (১৯৪০), ডাম্বো (১৯৪১), বাম্বি (১৯৪২) এর মতো জনপ্রিয় কিছু ফিচার ফিল্ম।
১৯৪১ সাল থেকে ডিজনি বড় ধরনের অবনতি ঘটে, কর্মরত শ্রমিকদের সঠিক বেতন না দেওয়াই কর্মীরা অবরোধ ঘোষণা করে। অনেক দক্ষতাসম্পন্ন আর্টিস্ট পদত্যাগ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ফেডারেল গভর্নমেন্টের হয়ে অ্যানিমেশন তৈরি করে ঘুরে দাঁড়ায় ডিজনি স্টুডিও। লাইভ-অ্যাকশন আর অ্যানিমেশনের মিশ্রণে তৈরি হয় দ্য রিল্যাক্ট্যান্ট ড্রাগন (১৯৪১), সালুদোস আমিগোস (১৯৪২), মেক মাইন মিউজিক (১৯৪৬) এবং সং অফ দ্য সাউথ (১৯৪৬)। ডিজনি ততদিনে বিশ্বে নাম কামিয়েছে বেশ বড় পরিসরে।
বেশ কিছু টিভি সিরিজ প্রকাশের পর তৈরি হয় সিন্ডারেলা (১৯৫৯), অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড (১৯৫১), পিটার প্যান (১৯৫৩) এর মতো জনপ্রিয় কিছু ফিচার-লেংগথ ফিল্ম। টেলিভিশনকে বিনোদন মাধ্যমের প্রধান উৎসে পরিণত করতে ডিজনি অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেছিলেন। মিকি মাউস ক্লাব সেসময় ছোটদের মাঝে বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। অ্যানিমেশন ফিল্মের এই জাদুকর তার ক্যারিয়ার অবসান ঘটান মোশন পিকচার মেরি পপিন্স (১৯৬৪) প্রকাশের মাধ্যমে, এটিও বিশ্বব্যাপী সাড়া ফেলে দেয়।
কিন্তু ডিজনির এই রূপকথার চরিত্রগুলোর আড়ালে লুকিয়ে আছে অনেক অজানা করূণ গল্প বা ইতিহাস। পড়ে আসতে সেসব গল্প রোর বাংলাতেই:
- ডিজনি বনাম মূল কাহিনী: রূপকথার আড়ালের করুণ গল্প
- ডিজনির আড়ালে পোকাহানতাসের নির্মম বাস্তবতা
- ডিজনি চরিত্রগুলোর কিছু অজানা দিক
- ওয়াল্ট ডিজনি কি কখনো কোনো কৃষ্ণাঙ্গ রাজকুমারীর চলচ্চিত্র বানিয়েছে?
৫০ এর দশকের শুরু থেকে ডিজনি একটি বিনোদনমূলক (Ammusement) পার্ক তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। অতীতের স্মৃতি, রূপকথার জগৎ সবমিলিয়ে ছোটবড় সকলের জন্য আনন্দঘন এক পরিবেশ তৈরির উদ্দেশ্যে ১৯৫৫ সালে উন্মুক্ত করা হয় ডিজনিল্যান্ড। দ্বিতীয় ডিজনি পার্কটির নির্মাণকাজ চলাকালীন তিনি মৃত্যুবরণ করেন, যেটি ১৯৭১ সালে উন্মুক্ত করা হয় এবং গড়ে তোলা হয় ফ্লোরিডার অরলান্ডোর কাছে।
অ্যানিমেশন জগতের এই কিংবদন্তী ছিলেন সবার থেকে আলাদা। শত বাধা অতিক্রম করে, প্রতারণা-অপমান, চাকরি না পেয়ে থাকার জ্বালা তাকে কম ভোগান্তি দেয়নি। কিন্তু সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত, ধৈর্যধারণ এবং নিজ লক্ষ্যে অটুট থাকা তাকে এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। বুকের মধ্যে স্বপ্নটাকে শুধু বড়ই করেননি এর জন্য ভালবাসা দিয়ে তাকে লালনপালনও করে গেছেন ডিজনি। কর্মজীবনে অর্জন করেছেন প্রচুর পুরস্কার।
কার্টুন জগতের এই কালজয়ী কারিগর ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন ১৯৬৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর। কিন্তু আজও তিনি বেঁচে আছেন কোটি শিশু কিশোরের হৃদয়ে, বড় হবার পরও ছোটবেলার সেই রঙ্গিন স্মৃতি পিছু ছাড়ে না কারোই।
ওয়াল্ট ডিজনির বই অনলাইনে কিনুন।