যুক্তরাষ্ট্রের কানেক্টিকাটের নিউ হ্যাভেনে বসবাস করতো উইলার্ড পরিবার। পুরো শহরে এ পরিবারের মতো উচ্চশিক্ষিত এবং বুদ্ধিজীবী গোছের পরিবার আর দ্বিতীয়টি ছিল না। জোশিয়া উইলার্ড গিবস নিজে ছিলেন ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক। তার স্ত্রী ছিলেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং বিখ্যাত পক্ষীবিদ। তার বাবা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নের অধ্যাপনা করেছেন দীর্ঘদিন। তার বড় ভাই এবং ছোট ভাইও যথাক্রমে প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার এবং লেখক ছিলেন। এমনই এক জ্ঞানপিপাসু পরিবারে ১৮৩৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন উইলার্ড গিবস। পৃথিবীর আলো দেখার সাথেই সাথেই তো তার নিয়তি ঠিক হয়ে গিয়েছিল। বিখ্যাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করে তিনি বিখ্যাত হবেন না, তা কি হতে পারে?
বাবার নামের অনুরূপ হওয়ায় তাকে ডাকা হতো গিবস জুনিয়র বলে। শৈশব থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তার জীবন পর্যবেক্ষণ করলে মনে হবে, গৎবাঁধা সিনেমার চিত্রনাট্যের মতো। সম্ভ্রান্ত পরিবার এবং উচ্চশিক্ষিত বাবা-মা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যগণ উইলার্ড পরিবারে সর্বদা জ্ঞানচর্চার পরিবেশ তৈরি করে রাখতেন। আর সে পরিবেশে বেড়ে উঠতে থাকা শিশু গিবস কথা বলতে শুরু করার সাথেই সাথেই জ্ঞান অন্বেষায় মননিবেশ করতে থাকেন। লিখতে শেখার আগেই মাত্র ৪ বছর বয়সে ৫০টির অধিক কবিতা অনর্গল বলে যেতে পারতেন! বর্ণমালা শিখতে সময় নিলেন মাত্র এক সপ্তাহ। অসাধারণ মেধা আর যথাযথ পারিবারিক পরিচর্যায় বড় হতে থাকা গিবস ১৫ বছর বয়সেই মাধ্যমিকে গণ্ডি পেরিয়ে যান। হপকিনস স্কুলের ইতিহাসের সবচেয়ে ভালো ফলাফল করেছিলেন তিনি।
মাধ্যমিকের গণ্ডি পার করেই অকূল সমুদ্রে পড়েন গিবস। সুখ-স্বাচ্ছন্দে ভরপুর জীবন হঠাৎই যেন দুঃখের সাথে চিরস্থায়ী সম্পর্ক গড়ে ফেলে। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কিছুদিন পূর্বে তার মা মারা যান। এ ঘটনা যতটা না দুঃখের, গিবসের জন্য তার চেয়ে বেশি কষ্টদায়ক ছিল সম্ভবত মায়ের মৃত্যুর ২ সপ্তাহের মাথায় বাবার দ্বিতীয় বিয়ে দেখা। শুধু তা-ই নয়, দ্বিতীয় স্ত্রীকে গিবস সিনিয়র আলাদা বসবাস করতে থাকেন এবং গিবস ও তার ছোট দুই বোনকে অঘোষিতভাবে ত্যাগ করেন। আত্মীয়স্বজন তাদের যথেষ্টই ছিল আর্থিক সহায়তার জন্য। তথাপি মাকে হারানোর অল্পকালেই বাবাকেও একপ্রকার হারিয়ে ফেলা তার জন্য ছিল বিশাল মানসিক ধাক্কা। সেই ধাক্কা সামলাতে না পেরেই হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবছর ব্যর্থ হন। রসায়নে এক বছরে একাধিক পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হন গিবস।
ঘুরে দাঁড়ানোর সামর্থ্য না থাকলে কেউ বিখ্যাত হতে পারে বলুন? ইয়েলে পরের বছর রসায়ন বাদ দিয়ে গণিত নিয়ে স্নাতক শুরু করলেন। স্বর্ণপদক সহ স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর শেষ করে তিনি আবারো কক্ষপথে ফিরে আসেন। গিবসের স্নাতকোত্তর শেষ করার বছর ইয়েলে তথা পুরো আমেরিকায় প্রথম প্রকৌশলবিদ্যার পিএইচডি ডিগ্রি চালু হয়। তিনি বিন্দুমাত্র কালক্ষেপণ না করে এই কোর্সে ভর্তি হয়ে যান। আর তাতেই আমেরিকার শিক্ষাব্যবস্থার ইতিহাসে নাম লেখান। উইলার্ড গিবসই ছিলেন মার্কিন কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকৌশলবিদ্যায় পিএইচডি-প্রাপ্ত প্রথম শিক্ষার্থী।
পিতামাতার পথ ধরে পড়ালেখা শেষ করে অধ্যাপনা শুরু করেন গিবস। ইয়েলে দু’বছর ল্যাটিন এবং তিন বছর পদার্থবিজ্ঞানে অধ্যাপনা করেন। এই পাঁচ বছরে তিনি বৈজ্ঞানিক পড়ালেখার পাশাপাশি ফরাসি এবং জার্মান ভাষা রপ্ত করেন। এর পরই দেশ ছেড়ে ৩ বছরের দীর্ঘ শিক্ষাসফরে বের হন। প্যারিসের সরবোন এবং জার্মানির বার্লিন ও হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে মোটামুটি ১ বছর করে গবেষণা করে সময় কাটান। দেশে ফিরে ইয়েলে গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানে অধ্যাপনা শুরু করেন। প্রাথমিকভাবে অবৈতনিক হলেও ধীরে ধীরে তিনি বেতন পেতে শুরু করেন। বিজ্ঞানী হিসেবে যখন খ্যাতি লাভ করেন গিবস, তখন ইউরোপের নামকরা সব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লোভনীয় সব প্রস্তাব আসতে থাকে তার কাছে। কিন্তু পিতা-মাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি তার ভালোবাসা এতটাই জোরালো ছিল যে তিনি আমৃত্যু এই বিশ্ববিদ্যালয়েই অধ্যাপনা করেন।
“গিবসের কাজের মহত্ব বুঝতে পেরেছিল মাত্র একজন ব্যক্তি, আর সে-ও শীঘ্রই মরতে চলেছে!”- মৃত্যুর কয়েকদিন আগে গিবসের সাথে রসিকতা করে এ কথা বলেন জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল
নিউটনের ‘প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা’ প্রকাশের পর তার নিজের ছাত্র এবং সহকর্মীরাই তাকে নিয়ে হাস্যরসাত্মক উক্তি করেছিল। গিবসের ক্ষেত্রেও অনেকটা এমনই ঘটেছিল। তার বৈজ্ঞানিক কর্মজীবনের শ্রেষ্ঠ গবেষণাটি প্রকাশের পর একমাত্র জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল ছাড়া আর কেউই সেটার প্রশংসা করেনি! তবে গিবস এসব নিয়ে থোরাই ভেবেছেন! তিনি তার মতো কাজ করে গেছেন আর লাভ করেছেন অমরত্ব।
তাপ, এনট্রপি আর শক্তির মধ্যে জটিল জটিল সব সম্পর্ক আর সমীকরণ নিয়ে আলোচনা করে পদার্থবিজ্ঞানের থার্মোডাইনামিক্স বা তাপগতিবিদ্যা নামক শাখাটি। উইলার্ড গিবস তার বৈজ্ঞানিক ক্যারিয়ার শুরু করেন পদার্থবিজ্ঞানের এ শাখাতেই। তাপগতিবিদ্যার উপর তার প্রথম গবেষণাপত্রটিই বিজ্ঞানের এ শাখাটিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পটভূমি তৈরি করে। তিনি সেখানে তাপগতিবিদ্যার মৌলিক দুটি সূত্রকে একত্রিত করে একটি নতুন সূত্র দাঁড় করান, যেটি ‘গিবস ইকুয়েশন অব স্টেট’ নামে পরিচিত। তিনি ত্রিমাত্রিক গ্রাফে তাপগতিবিদ্যায় পদার্থের অবস্থা বর্ণনা করেন। এই গবেষণাপত্রটি তিনি তৎকালীন ৭৫ জন প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানীর নিকট পাঠান। দুর্ভাগ্যক্রমে, ভবিষ্যতে প্রশংসিত হতে যাওয়া সে গবেষণা কাজটি সে ৭৫ জনের মধ্যে কেবল এক ম্যাক্সওয়েলের দ্বারাই প্রশংসিত হয়!
গিবস আর ম্যাক্সওয়েলের সম্পর্কে আরো কিছু কথা বলা প্রয়োজন। ম্যাক্সওয়েল গিবসের কাজের প্রশংসা করেছেন, এতটুকু বললে অবমূল্যায়নই করা হবে। ম্যাক্সওয়েল বলতে গেলে একরকম সহায় খুঁজে পেয়েছিলেন গিবসের কাজের মধ্যে। গিবসের গবেষণা প্রকাশের পূর্বে প্রায় দু’বছর চেষ্টা করেও পদার্থের অবস্থা সংক্রান্ত ব্যাপারগুলো নিয়ে স্পষ্ট ধারণা করে উঠতে পারছিলেন না। গিবসের গবেষণাই তার এ সমস্যার সমাধান ঘটায়। তিনি তাপগতিবিদ্যার আরো গভীর প্রবেশ করতে সক্ষম হন। গিবসের কাজে তিনি এতটাই উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন যে, গিবসের সাথে একত্রে গবেষণা করার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। ম্যাক্সওয়েল অকালে মারা না গেলে এই দুই বিজ্ঞানী একত্রে মানবজাতিকে আরো অনেক কিছুই দিয়ে যেতে পারতেন হয়তো।
১৮৭৮ সালে ‘অন দ্য ইকুইলিব্রিয়াম অব হেটেরোজেনাস সাবস্ট্যান্স পার্ট টু’ প্রকাশ করেন উইলার্ড গিবস। তার আগের গবেষণাগুলোই যেখানে সমকালীন বিজ্ঞানীগণ বুঝতে পারছিলেন না, সেসব বিষয় এই গবেষণায় আরো ধোয়াশাচ্ছন্ন হয়ে আসে। এটি ছিল আপাদমস্তক গাণিতিক, যে কারণে সমস্যাটা আরো বেশি হয়। তথাপি আধুনিক তাপগতিবিদ্যার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে গিবসের এই গবেষণাকর্মটি। তিনি অনেকাংশে পীথাগোরাসের মতো করে ভাবতেন পৃথিবীটাকে। যাবতীয় সমস্যাকে তিনি গণিত দিয়ে প্রকাশ করতে চাইতেন এবং করতেন। কেউ বুঝতে পারলো কী পারলো না, সেটা নিয়ে একদমই ভাবতেন না। সে জন্যই একবার মজা করে বলেছিলেন, “আমার ৩০ বছরের অধ্যাপনায় এখনো পর্যন্ত ক্লাসে আধ ডজন শিক্ষার্থীকেও মনোযোগ দিয়ে আমার বক্তৃতা শুনতে দেখিনি!”
জেমস ক্লার্কের কোয়ার্টারনিয়ন ক্যালকুলাসের নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই? এতে স্কেলার ও ভেক্টর নামক দুটি অংশ ছিল। এর কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল যা বর্তমানে আমরা জানি। তবে সে সময় সেগুলো জানা যায়নি। গিবস এর সীমাবদ্ধতা দূর করেন সেগুলো সম্বন্ধে না জেনেই! মূলত ম্যাক্সওয়েলের কোয়ার্টারনিয়ন ক্যালকুলাস শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থীদের বোঝাতে গিয়ে কিছুটা বিপাকে পড়েন তিনি। তার কাছে মনে হলো, এটি বেশ জটিল। তাই শিক্ষার্থীদের সহজে বোঝানোর জন্য তিনি ভিন্ন এক পদ্ধতি তৈরি করে ফেলেন, যা এখন গণিতের একটি স্বতন্ত্র শাখা ভেক্টর অ্যানালাইসিস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। অথচ তখন তিনি ম্যাক্সওয়েলের ক্যালকুলাসের সীমাবদ্ধতা কিংবা নিজের আবিষ্কার, কোনোটি সম্পর্কেই অবহিত ছিলেন না!
ডেনিয়েল বার্নোলি, জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল এবং লুডভিগ বোল্টজম্যান- এই তিনজনকে ধরা হয় স্ট্যাটিস্টিক্যাল মেকানিক্সের প্রতিষ্ঠাতা। কিন্তু যদি বলা হয় বিজ্ঞানের এই শাখার আধুনিকায়ন কে করেছেন, তাহলে যে নামটি সামনে আসবে সেটি অবশ্যই উইলার্ড গিবস। ২০ শতকের শুরুর দিকে তিনি প্রকাশ করেন তার বৈজ্ঞানিক কর্মজীবনের শেষ মাস্টারপিস ‘এলিমেন্টারি প্রিন্সিপ্যালস ইন স্ট্যাটিস্টিক্যাল মেকানিক্স’। মূলত বিজ্ঞানের এই শাখার নামকরণ হয় তার এই বইয়ের মাধ্যমেই। ক্ল্যাসিক্যাল এবং কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের মাঝে একপ্রকার সেতুবন্ধন তৈরি করে তার সৃষ্ট পরিসংখ্যানগত গাণিতিক কাঠামোগুলো। বিপুল পরিমাণ অণু/পরমাণুর একক বৈশিষ্ট্য হিসেব করে ভৌত ঘটনাকে আরো গভীরে গিয়ে অনুধাবন করার পথ উন্মুক্ত করে গিবসের পরিসংখ্যান।
বিজ্ঞান ও গণিতে ডুবে যাবার পর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ভাববার অবকাশ পাননি গিবস। কাজকে প্রাধান্য দিতে চিরকুমারই থেকে যান। যে কারণে শেষ জীবনটা কিছুটা নিঃসঙ্গতায় কেটেছিল। ১৯০৩ সালে যখন তিনি মৃত্যুবরণ করেন, তার পাশে ছিল না তার কোনো আত্মীয় স্বজন। নিউ হ্যাভেনেই তাকে সমাহিত করা হয়। পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন আর গণিতে অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য তাকে ‘কুপলি মেডাল’ প্রদান করে ব্রিটিশ রয়্যাল সোসাইটি। ২০০৫ সালে আমেরিকা থেকে তার স্মরণে তার ছবি সম্বলিত একটি বিশেষ স্ট্যাম্প প্রকাশ করা হয়। তাপগতিবিদ্যা ও স্ট্যাটিস্টিক্যাল মেকানিক্সকে আজকের অবস্থানে নিয়ে আসায় উলার্ড গিবসের অবদান চিরস্মরণীয়।
ফিচার ছবি: pinterest.com