উনিশশো একাত্তর সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের রূপকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আজীবন শোষণহীন এক গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়া এই মহান মানুষটিই যুদ্ধ শেষে কাঁধে নিয়েছিলেন বিধ্বস্ত রাষ্ট্র পুনর্গঠনের গুরুদায়িত্ব। কিন্তু মাত্র তিন বছর সাত মাস সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরেই সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তে একাত্তরের পরাজিত অপশক্তি নিজেদের জিঘাংসা চরিতার্থ করতে নির্মমভাবে হত্যা করে জাতির জনককে। শুধু বঙ্গবন্ধু নন, নরপিশাচদের হাতে প্রাণ হারান তার স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূ সহ উপস্থিত পরিবারের সদস্যরা। বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনা সপুত্রক জার্মানি থাকায় রক্ষা পান এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ থেকে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশ গভীর ষড়যন্ত্রের জালে আচ্ছাদিত হয়। সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থান চলতে থাকে। পরবর্তী শাসকেরা ক্ষমতায় এসে সমাজ-রাজনীতিতে স্বাধীনতা বিরোধীদের পুনর্বাসন করেন, ঘাতকদেরকে নিঃশর্ত দায়মুক্তি দিয়ে—বঙ্গবন্ধু শাসন আমলের চেতনা ছিন্নভিন্ন করে দেয়। এসময় শেখ হাসিনাকেও দেশে ফিরতে দেয়নি তৎকালীন সরকার। ভারতে অবস্থান করে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করেছেন তিনি। ১৯৮১ সালের ১৭ই মে তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন আকস্মিক হলেও তার নিহত জনকের শূন্যস্থান গ্রহণ ছিল যৌক্তিক পরিণতি। এই ঘটনা তদানীন্তন সামরিক স্বৈরাচারের নিশ্চয়ই অভিপ্রেত ছিল না।
কিন্তু ইতিহাসের গতি যে বড়ই বিচিত্র! যে নৃশংস প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্বংশ করতে চেয়েছিল, যে অন্ধশক্তি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সফল নেতৃত্বদানের অপরাধে চার জাতীয় নেতাকে কারাগারে পৈশাচিকভাবে হত্যা করেছিল, তারা কি স্বপ্নেও ভেবেছিল একদিন বঙ্গবন্ধু কন্যা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াতেই ক্ষমতাসীন হয়ে তাদের বিচার করবেন? পঁচাত্তরের ঘাতক-চক্রের জন্যে অবিশ্বাস্য হলেও তা ছিল ইতিহাসের বাস্তব সত্য!
স্বৈরাচারী সামরিক সরকারের শাসনের সেই অন্ধকার সময়ে শেখ হাসিনার লেখা দশটি প্রবন্ধ নিয়ে রচিত হয়েছে স্মৃতিকথামূলক আত্মজৈবনিক গ্রন্থ “শেখ মুজিব আমার পিতা”। কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা ১৯৯৯-তে সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় গ্রন্থটি। পরবর্তীকালে বাংলা একাডেমির গ্রন্থমেলা-২০১৫ উপলক্ষে ‘আগামী প্রকাশনী’ বইটির বাংলাদেশ সংস্করণ প্রকাশ করে। ২০১৮ সালে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় বইটির ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ১১১ পৃৃৃৃষ্ঠার নাতিদীর্ঘ বইটির ভূমিকা লিখেছেন জাতীয় অধ্যাপকের খেতাবপ্রাপ্ত বুদ্ধিজীবী ড. রফিকু্ল ইসলাম এবং প্রস্তাবনা রচনা করেছেন ওপার বাংলার খ্যাতনামা লেখক পার্থ ঘোষ। মোট চারটি পর্যায়ে প্রবন্ধগুলো সন্নিবেশিত হয়েছে- বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি, মুক্তিযুদ্ধ ও পারিবারিক কথা, স্মরণ-শ্রদ্ধার্ঘ্য এবং ছেঁড়া ছেঁড়া ছবি- এই নামে।
বইয়ের প্রবন্ধগুলো সবই ১৯৮৩ থেকে ১৯৯৪ সালের মধ্যে লেখা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের পরিক্রমায় যে বছরগুলো ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, আর যে বছরগুলোতে বারে বারে পরিবর্তনের ঢেউ অশান্ত করে তুলেছে বাংলাদেশকে- তা বইটিতে ফুটে উঠেছে। প্রবন্ধগুলোতে শেখ হাসিনার হৃদয়ের রক্তক্ষরণ, তার পিতার জীবন, নির্মম মৃত্যু, তদানীন্তন সমাজ-রাজনীতির ছবি এবং দিন বদলের আহবান দৃঢ়ভাবে উঠে এসেছে।
প্রথম পর্যায়ের তিনটি প্রবন্ধ ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’, ‘বঙ্গবন্ধু ও তার সেনাবাহিনী’ এবং ‘ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড’—এর মূল উপজীব্য বঙ্গবন্ধু স্বয়ং। শুধু মেয়ে হিসেবেই নন, পিতার রাজনৈতিক জীবনের ঘনিষ্ঠ সঙ্গী হিসেবে পিতার জীবনের নানা ঘটনার মালা গেঁথেছেন লেখিকা প্রবন্ধত্রয়ে। বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর ওঠা বিতর্ক নিয়ে শেখ হাসিনার এ পর্যায়ের শেষ দুটি প্রবন্ধ সচেতন পাঠকদের মনে আলোড়ন তুলবে। দ্বিতীয় পর্যায়ের তিনটি প্রবন্ধ— ‘স্মৃতির দখিন দুয়ার (এক এবং দুই)’ ‘স্মৃতি বড় মধুর’, ‘স্মৃতি বড় বেদনার’—এ ধরা পড়েছে লেখিকার স্মৃতিতে মুক্তিযুদ্ধ ও পারিবারিক কথা। প্রাণ হাতের মুঠোয় নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো কাটাতে হয়েছিল মুজিব পরিবারকে। সেই রুদ্ধশ্বাস অভিজ্ঞতার এক দীর্ঘ বর্ণনা আছে ‘স্মৃতির দখিন দুয়ার’ এ।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনসহ রাজনৈতিক জীবনের টুকরো ঘটনার উল্লেখও আছে এখানে। স্মরণ শ্রদ্ধার্ঘ্য শিরোনামে সংকলিত প্রবন্ধত্রয়ে ড.আবদুল মতিন, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম এবং শহীদ নূর হোসেনের স্মৃতি উঠে এসেছে। এই তিনজনের কথা বলতে গিয়ে শেখ হাসিনা সাল-তারিখের ছকবাঁধা পথে হাঁটেননি, বরং প্রত্যেকর সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রপাত থেকে কুশলতার সাথে আপন অভিজ্ঞতার আলোকে ধরা পড়া তাদের চরিত্র বৈশিষ্ট্য হৃদয়গ্রাহী করে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি।
বিশেষত জাহানারা ইমামকে নিয়ে লিখিত প্রবন্ধটিতে লেখিকা যেভাবে শহীদ জননীর সঙ্গে বেদনার অদ্ভুত সাযুজ্যের সন্ধান পেয়েছেন এবং তৎকালীন ঘটনাপ্রবাহের প্রেক্ষাপটে বর্ণনা করেছেন, তা সত্যিই অসাধারণ! উনিশশো একানব্বইয়ের কতগুলো স্মৃতি নিয়ে রচিত হয়েছে ‘ছেঁড়া ছেঁড়া ছবি’। একানব্বইয়ের সাইক্লোনের তাণ্ডবে যখন বহু মানুষের প্রাণ গেছে, বহু সম্পত্তির ক্ষতি হয়েছে- বিরোধী দলীয় নেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা তখন ছুটে গেছেন সেখানে, পিতার আদর্শ যে তাকে কতখানি প্রভাবিত করে তার অসাধারণ উপলব্ধি পাঠক পাবেন এই প্রবন্ধে। আবার প্রাকৃতিক তাণ্ডবের বীভৎসতা, বিভীষিকার মধ্যে দাঁড়িয়েও তার শিল্পীমন সজাগ হয়ে উঠেছে—অস্তমিত সূর্যের আলোয় চট্টগ্রামের সমুদ্রের ফেনিল জলে মুহূর্তের মধ্যে যে রঙের খেলা শুরু হয়ে যায়, তা-ও চোখ এড়ায়নি তার। অপরূপ বিবরণ তিনি দিয়েছেন সেই রসাস্বাদনের।
ব্যক্তিগতভাবে লেখিকা শেখ হাসিনার সাথে হয়তো অনেকেরই পূর্বপরিচয় ছিল না, তবে এই বইটির পর আশা করা যায় তার অন্যান্য বইগুলো পড়ার ইচ্ছাও জাগবে গভীরভাবে। রাজনীতির মাঠে দুর্মর নেত্রী—এই পরিচয়ের পাশাপাশি ‘সাহিত্যিক’ কিংবা ‘লেখিকা’ শেখ হাসিনাকেও খুঁজতে উৎসাহিত হবেন পাঠক। বইটির ভাষা অত্যন্ত প্রাঞ্জল এবং সুখপাঠ্য। এর সহজ সরল ভঙ্গিতে উচ্চারিত হৃদয়স্পর্শী বয়ান পাঠককে ইতিহাসলগ্ন হতে অনিঃশেষ প্রেরণা যোগায়। নিঃসন্দেহে রাজনীতি ও সমাজ সচেতন জ্ঞানপিপাসু পাঠককে জ্ঞানসমৃদ্ধ করবে এবং ইতিহাস নিয়ে চিন্তার খোরাক যোগাবে বইটি।
বইটি অনলাইনে কিনতে চাইলে ক্লিক করতে পারেন নিচের লিংকে-