হাল্লো কিশোর বন্ধুরা,
আমি কিশোর পাশা বলছি। আমেরিকার রকি বিচ থেকে। জায়গাটা লস অ্যাঞ্জেলসে, প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে। হলিউড থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে। যারা এখনও আমাদের পরিচয় জানো না তাদের বলছি, আমরা তিন বন্ধু একটা গোয়েন্দা সংস্থা খুলেছি। নাম তিন গোয়েন্দা।
আমি বাঙালি, থাকি চাচা-চাচীর কাছে। দুই বন্ধুর একজনের নাম মুসা আমান। ব্যায়ামবীর, আমেরিকান নিগ্রো। আরেকজন রবিন মিলফোর্ড। আইরিশ আমেরিকান, বইয়ের পোকা। একই ক্লাসে পড়ি আমরা। পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ডের লোহা-লক্কড়ের জঞ্জালের নিচে পুরনো এক মোবাইল হোমে আমাদের হেডকোয়ার্টার।
এভাবেই তিন গোয়েন্দা সিরিজের বইয়ের ব্যাক কভারে তিন গোয়েন্দার পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। যারা নিয়মিত বই পড়েন বা শৈশব-কৈশোর থেকেই যারা বইয়ের পাঠক তাদের কাছে তিন গোয়েন্দা হলো স্বপ্নের এক সিরিজ। শীর্ষ জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো একবার জরিপ চালিয়েছিল শিশু-কিশোর পঠিত সবচেয়ে প্রিয় গল্পের বইয়ের নাম জানতে চেয়ে। জরিপে সবার চেয়ে এগিয়ে ছিলো তিন গোয়েন্দা। সবচেয়ে প্রিয় চরিত্র নির্বাচিত হয়েছিলো কিশোর পাশা, মুসা আমান আর রবিন মিলফোর্ড অর্থাৎ তিন গোয়েন্দাই। তিন গোয়েন্দা পাঠকের কতটা প্রিয় এখান থেকেই অনুমান করা যায়।
শুরুটা হয়েছিলো ১৯৮৫ সালে, রকিব হাসান নামের এক তরুণ লেখকের হাত ধরে। সেবা প্রকাশনীতে তখন মাসুদ রানা, কুয়াশা ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলো। কুয়াশা সিরিজটি শেষ হয়ে যাওয়ায় কিশোরদের নিয়ে একটা গোয়েন্দা গল্প লেখার জন্য সেবা প্রকাশনীর কর্ণধার কাজী আনোয়ার হোসেনকে প্রস্তাব দেন রকিব হাসান। কাজীদাও অনুমতি দিয়ে দেন। রকিব হাসান শুরু করেন লেখা। ১৯৮৫ সালের আগস্ট মাসে প্রকাশ হয় তিন গোয়েন্দার প্রথম বইটি, যেটির নামও ছিলো তিন গোয়েন্দা। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক তিন গোয়েন্দা প্রকাশ হতে থাকে। শিশু, কিশোর, তরুণ এমনকি কিছু কিছু বয়স্করাও গোগ্রাসে গিলতে শুরু করেন বাংলা ভাষার সবচেয়ে জনপ্রিয় কিশোর থ্রিলার সিরিজটিকে। তিন কিশোরের একের পর এক রহস্য সমাধান আর দুঃসাহসিক অভিযানের বর্ণনা এত অসাধারণভাবে তুলে ধরেন রকিব হাসান, পড়তে শুরু করলে একদম নেশালাগা ঘোরে আবদ্ধ করে ফেলে পাঠককে। একসময় তিন গোয়েন্দার নেশায় পড়ে যান হাজার হাজার পাঠক। দ্রুতই জনপ্রিয়তার শীর্ষে আরোহণ করে পেপারব্যাক বাঁধাই করা অতি সাধারণ মানের প্রিন্টের এই অসাধারণ বইগুলো।
বিদেশী কাহিনী অবলম্বনে তিন গোয়েন্দা লিখতেন রকিব হাসান। সেক্ষেত্রে তিন গোয়েন্দাকে পুরোপুরি মৌলিক কাহিনী বলা যাবে না। মূলত ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন গোয়েন্দা সিরিজকে অনুকরণ করেই তিন গোয়েন্দার জন্ম হয়। এরমধ্যে প্রথম দিককার বইগুলো রবার্ট আর্থারের লেখা ইংরেজি সিরিজ ‘থ্রি ইনভেস্টিগেটরস’ অবলম্বনে রচিত। এনিড ব্লাইটনের লেখা ‘ফেমাস ফাইভ’ অবলম্বনেও লিখেছেন অনেক বইয়ের কাহিনী। যদিও সেসব কাহিনীর সাথে অনেক সংযোজন-বিয়োজন করে, বাংলা ভাষার পাঠকদের উপযোগী করে চরিত্রগুলো উপস্থাপন করেছেন, সৃষ্টি করেছেন নতুন সব চরিত্রও।
২০০৩ সাল পর্যন্ত টানা আঠারো বছরে মোট ১৬০টি বই লিখেছেন রকিব হাসান। সেবা প্রকাশনীর সাথে রয়্যালটি-সংক্রান্ত ঝামেলায় একসময় রকিব হাসান তিন গোয়েন্দা লেখা বন্ধ করে দেন। এরপর শামসুদ্দিন নওয়াব নামক ‘ঘোস্ট রাইটার’ এখনো তিন গোয়েন্দা সিরিজ চালিয়ে গেলেও সিরিজটি মূলত ২০০৩ সালেই শেষ হয়ে যায়। কারণ রকিব হাসানের লেখার স্টাইল, ধরন, কাহিনীর বিন্যাস, অসাধারণ বর্ণনা ও চরিত্রগুলোর গভীরতা ফুটিয়ে তোলার প্রখরতাকে কখনোই শামসুদ্দিন নওয়াবে খুঁজে পাননি পাঠক। ফলে পুরনো পাঠকদের বেশিরভাগই তিন গোয়েন্দা পড়া বন্ধ করে দেন। এখন অবশ্য তিন গোয়েন্দার পুরো সিরিজটিই তিনটা বই একত্রে করে ভলিউম আকারে পাওয়া যায়। সেক্ষেত্রেও রকিব হাসানের বইয়ের ভলিউম পাঠকের সর্বাধিক পছন্দ। সেগুলোই পড়েন বেশিরভাগ পাঠক
তিন গোয়েন্দায় তিন বন্ধুর মূল চরিত্র ও এর বাইরেও অনেক চরিত্র ওঠে এসেছে। গুরুত্ব অনুযায়ী তিন গোয়েন্দা ও তার পার্শ্ব-চরিত্রগুলো নিয়ে এবার একটু আলোচনা করা যাক।
প্রথমেই আসি তিন গোয়েন্দার প্রধান চরিত্র কিশোর পাশার কথায়। কিশোর পাশা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমেরিকান। তার বাবা-মা সাত বছর বয়সে এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। এরপর চাচা রাশেদ পাশা ও আমেরিকান চাচি মেরিয়ান পাশার (তিন গোয়েন্দা যাকে মেরিচাচি বলে সম্বোধন করে) কাছে থাকে। ইলেক্ট্রনিকসের ডিভাইস ও যন্ত্রপাতির ওপর দারুণ দখল ও তীক্ষ্ম বুদ্ধিসম্পন্ন গোয়েন্দাপ্রধান কিশোর পাশাকে ‘ইলেক্ট্রনিকসের যাদুকর’ও বলা হয়। একটু চাপা স্বভাবের, রোগা-পাতলা, কুঁকড়ানো কালো চুলের অধিকারী কিশোর যেকোনো সমস্যা সমাধানে যখন গভীর ভাবনায় মগ্ন হয়ে যায় তখন বারবার নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটে। কোনো রহস্যের সন্ধান পেলে সমাধান না করা পর্যন্ত কোনো নিস্তার নেই তার। কিশোর বয়সে রোগা হলেও শিশুকালে বেশ মোটা ছিলো সে। তখন একটা কমেডি টিভি প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করে তার নাম হয়েছিলো ‘মোটুরাম’।
গোয়েন্দা সহকারী মুসা আমান আফ্রো-আমেরিকান। বাবা রাফাত আমান হলিউডের বড় টেকনিশিয়ান, মা মিসেস আমান গৃহিণী। বয়সের তুলনায় অনেক লম্বা, স্বাস্থ্যবান সে। নিয়মিত ব্যায়াম করে। মা তাকে দিয়ে বাড়ির আঙিনার ঘাস কাটা থেকে শুরু করে আরও অনেক কাজ করিয়ে নেন। প্রচুর খেতে পারে সে। শরীরে প্রচুর শক্তিও থাকে সেজন্য। যে কোনো বিপদে সাহস বেড়ে যায় তরতর করে। শুধু একটা জিনিসকেই ভয় পায়। সেটা হলো ভূত। মুসার একটা মুদ্রাদোষও আছে। কথায় কথায় সে ‘খাইছে!’ শব্দটা বলে ওঠে। গাড়ি চালানোতে দারুণ দক্ষ এবং এই বয়সেই ভালো বৈমানিক হিসেবে পরিচিত।
তিন গোয়েন্দার নথি গবেষক হিসেবে পরিচিত আরেকজন গোয়েন্দা রবিন মিলফোর্ড। আইরিশ আমেরিকান রবিনের বাবা পেশায় সাংবাদিক। বই পড়া তার প্রধান কাজ। সারাদিন বইয়ে ডুবে থাকে। লাইব্রেরি তার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা। এমনই প্রিয় যে সে প্রায়ই স্বেচ্ছায়, বিনা পারিশ্রমিকে লাইব্রেরিয়ানের কাজ করে। তিন গোয়েন্দার সকল কেসের নথি ও রেকর্ড লিখে রাখে সে। ‘চলমান জ্ঞানকোষ’ হিসেবে খ্যাত রবিনের পাহাড়ে চড়ার নেশা আছে। কয়েকবার পা ভাঙলেও পাহাড়ে যেতে তাকে আটকাতে পারে না কেউই। সাথে মাঝে মাঝে গানবাজনাও করে থাকে। একটা ব্যান্ড দলেও কাজ করেছে সে।
তিন গোয়েন্দার আরেকজন বন্ধু আছে, যে তাদেরকে বিভিন্ন কেসে সহায়তা করে থাকে। তার নাম জরজিনা পার্কার, সংক্ষেপে জিনা বলেই ডাকে সবাই। বিখ্যাত বিজ্ঞানী জোনাথন পার্কারের মেয়ে জিনা রকি বিচে না থাকলেও শুধু তিন গোয়েন্দার জন্য রকি বিচে এসে তাদেরই স্কুলে ভর্তি হয়। জিনা ‘জর্জ গোবেল’ নামে উত্তরাধিকারসূত্রে একটা দ্বীপের মালিক। দ্বীপটিতে তিন গোয়েন্দাও জিনার সাথে প্রায়ই ছুটি কাটায় গিয়ে। মেয়ে হলেও জিনা ছেলেদের স্বভাব ধারণ করে থাকতে পছন্দ করে। পোষা প্রাণীর প্রতি তার গভীর মমত্ববোধ কাজ করে। রাফিয়ান নামের একটা কুকুর পোষে সে। যার ডাকনাম রাফি। তিন গোয়েন্দার অনেক কেসের সমাধানে রাফিকেও কাজে লাগানো হয়।
তিন গোয়েন্দার অসংখ্য বন্ধুর মধ্যে একটা ‘শত্রু’ও আছে। নাম টেরিয়ার ডয়েল। তিন গোয়েন্দার অনেক কাজে সে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তিন গোয়েন্দা তাকে ‘শুঁটকি টেরি’ বলে খ্যাপায়। মুসা তাকে দু’চোখেই দেখতে পারে না। জিনাকেও বিভিন্নভাবে, ছড়ার ছন্দে ছন্দে খ্যাপায় টেরি। ‘শুঁটকি টেরি’র একটা দল আছে। ওরাও তিন গোয়েন্দার সাথে নানা সময়ে ঝামেলা পাকায়। মোটকথা, বড়লোক বাবার বখে যাওয়া এক সন্তান এই টেরিয়ার ডয়েল ওরফে ‘শুঁটকি টেরি’। এই চরিত্রগুলো ছাড়াও আরও অনেক চরিত্র নানা সময়ে তিন গোয়েন্দায় এসেছে। তাদের মধ্যে আছেন রকি বিচ পুলিশ চিফ ক্যাপ্টেন ইয়ান ফ্লেচার, যিনি তিন গোয়েন্দার বিভিন্ন কেসের তদন্তের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করে থাকেন, নিজেও তাদের সহযোগিতা নেন। তিন গোয়েন্দা যাতে কাজ করতে সবার সহযোগিতা পায় সেজন্য তাদেরকে একটা সবুজ কার্ডে প্রত্যয়ন করেছেন। যেখানে লেখা থাকে“ প্রত্যয়ন করা যাচ্ছে যে, এই কার্ডের বাহক রকি বিচ পুলিশকে সহায়তাকারী একজন স্বেচ্ছাসেবক জুনিয়র সহকারী ডেপুটি। তাকে যেকোনো সহযোগিতা প্রদান করলে প্রশংসিত করা হবে।”
আরেকজন হলেন হলিউড পরিচালক ডেভিস ক্রিস্টোফার। যার মাধ্যমে তিন গোয়েন্দার গোয়েন্দাগিরি শুরু হয়। একটা ভূতুড়ে বাড়ি খুঁজতে গিয়ে তিন গোয়েন্দার সহায়তা নেন তিনি। এরপর তিনি তাদেরকে নানা কেস বিভিন্ন সময় ধরিয়ে দেন। তিন গোয়েন্দার বিভিন্ন রহস্যের সমাধানের কাহিনী নিয়ে শিশু-কিশোরদের জন্য চলচ্চিত্রও তৈরি করেন তিনি।
এছাড়াও দুর্ধর্ষ প্রাইভেট গোয়েন্দা ভিক্টর সাইমন, বিখ্যাত ফ্রেঞ্চ চিত্রচোর অ্যান্থনি শোঁপা, রাজকীয় রোলস রয়েসের চালক ইংলিশ শোফার হ্যানসন, গ্রামের পুলিশম্যান ফগর্যাম্পারকট ওরফে ‘ঝামেলা’, তারই ভাতিজা ববর্যাম্পারকট ও আরব বেদুইন ওমর শরিফ তিন গোয়েন্দায় এসেছে নানা সময়ে নানাভাবে। ওমর শরিফের কথা একটু আলাদাভাবে বলতে হয়। তিনি মূলত মিসরীয় বংশোদ্ভূত একজন দক্ষ বৈমানিক। তিন গোয়েন্দার সাথে বেশকিছু কেসে একসাথে কাজ করেন। তারা একসাথে ‘ওকিমুরো কর্পোরেশন’ গঠন করেন। তিন গোয়েন্দা আর ওমর শরিফের সম্মিলিতভাবে খোলা একটি ফ্লাইং ক্লাবের নাম ‘ওকিমুরো কর্পোরেশন’, যার ‘ও’ দ্বারা বোঝায় ওমর, ‘কি’ দ্বারা কিশোর, ‘মু’ দ্বারা মুসা আর ‘রো’ দ্বারা রবিনকে। বিভিন্ন কেসে কাজ করতে গিয়ে ওমর শরিফ তিন গোয়েন্দার পছন্দের ‘ওমর ভাই’য়ে পরিণত হয়ে যান।
তিন গোয়েন্দার একটি হেডকোয়ার্টার আছে। পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ডের লোহা-লক্কড়ের নিচে পুরনো একটা মোবাইল হোমে এর অবস্থান। হেডকোয়ার্টারে টেলিফোন, বিভিন্ন কেসের নথি রাখার জায়গা, ছবি ওয়াশ করার জন্য ডার্করুম, টেলিস্কোপসহ (কিশোর যেটার নাম দিয়েছে সর্বদর্শন) অনেক কিছুই আছে। হেডকোয়ার্টারে ঢোকার জন্য আছে গোপন সুড়ঙ্গপথ, যেগুলোর সাঙ্কেতিক নাম যথাক্রমে সবুজ ফটক এক, দুই সুড়ঙ্গ, সহজ তিন, লাল কুকুর চার ইত্যাদি।
তিন গোয়েন্দার একটি কার্ড আছে। কার্ডের ওপর শিরোনাম আকারে বড় করে ‘তিন গোয়েন্দা’ কথাটি লেখা আছে। তার ঠিক নিচেই থাকে তিনটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন (?)। তার নিচে প্রথম সারিতে ‘গোয়েন্দা প্রধান: কিশোর পাশা’, দ্বিতীয় সারিতে ‘গোয়েন্দা সহকারী: মুসা আমান’, তৃতীয় সারিতে ‘নথি গবেষক: রবিন মিলফোর্ড’ লেখা থাকে। প্রশ্নবোধক চিহ্নটির বিষয়ে অনেকেই তাদের প্রশ্ন করে। রহস্য বোঝানোর জন্য এটি ব্যবহার করা হয় মূলত। পরে অবশ্য প্রশ্নবোধকের জায়গায় বিস্ময়সূচক (!) চিহ্ন ব্যবহার শুরু করে তারা।
বিভিন্ন কেস তদন্তের ক্ষেত্রে কোনো তথ্য খুঁজে না পেলে দারুণ একটি কৌশল অবলম্বন করে তিন গোয়েন্দা। সেটা হলো ‘ভুত থেকে ভুত’। একেকজন তাদের পাঁচজন বন্ধুকে টেলিফোন করে তথ্যটা জানতে চায় এবং বলে দেয় তারাও যেন তাদের পাঁচজন বন্ধুকে ফোন করে তথ্যটা জানতে চায়। এভাবে বিভিন্ন সময় তথ্য উদ্ধার করে তিন গোয়েন্দা।
তিন গোয়েন্দা সিরিজের অজস্র বই প্রকাশিত হয়েছে এ পর্যন্ত। শুধু রকিব হাসান লিখেছেন ১৬০টি বই। সব বই সমান পাঠকপ্রিয়তা না পেলেও প্রথমদিককার লেখা বইগুলো ও রকিব হাসানের লেখা বেশিরভাগ বই-ই ছিলো জনপ্রিয়। এত বইয়ের ভিড়ে কিছু বইয়ের নাম আলাদা করে না বললেই নয়। তিন গোয়েন্দা, জলদস্যুর দ্বীপ ১ ও ২, ভীষণ অরণ্য ১ ও ২, গ্রেট কিশোরিয়োসো, গ্রেট রবিনিয়োসো, গ্রেট মুসাইয়োসো, দক্ষিণযাত্রা, দুর্গম কারাগার, অথৈ সাগর ১ ও ২, পোচার, ওকিমুরো কর্পোরেশন, মরুভূমির আতঙ্ক, চাঁদের পাহাড়, খ্যাপা কিশোর, কিশোর যাদুকর বইগুলো পাঠককে থ্রিলিংয়ের চরম স্বাদ দেবে দারুণভাবে।
তিন গোয়েন্দাকে নিয়ে আগেও সমালোচনা ছিলো, এখনও সমালোচনা আছে যে এটি একটি বিদেশী গল্পের অনুকরণে লেখা ‘নকল গল্প’। যদিও জনপ্রিয়তার জোরে এসব সমালোচনা বহু আগেই ভেসে গেছে, তবু এ সংক্রান্ত কয়েকটা কথা বলে নেয়া দরকার।
বাংলায় কিশোরদের নিয়ে গোয়েন্দা গল্প কিংবা উপন্যাসের সংখ্যা খুবই কম। মৌলিক গোয়েন্দা গল্প তো আরও কম। তিন গোয়েন্দার মতো মৌলিক কিশোর থ্রিলার লেখার মতো অনেক লেখক দেশে আছেন, রকিব হাসান নিজেও তাদের একজন। কিন্তু একটা গোয়েন্দা সিরিজ লিখতে গিয়ে যে তথ্য-উপাত্ত, বিভিন্ন জায়গা ও দেশ সরেজমিনে ভ্রমণ করে বাস্তব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা প্রয়োজন, সেটা আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে অনেক বেশি ব্যয়বহুল। নাটক-সিনেমার পরিচালকেরা চাইলেই ইউরোপ-আমেরিকা-এশিয়ার যেকোনো জায়গায় শ্যুট করতে পারেন, তাদের বাজেট ও আয়ের সাথে সেটা সঙ্গতিপূর্ণ। কিন্তু আমাদের দেশে লেখালেখি থেকে যে আয়টা হয় লেখকদের, তাতে হাতেগোনা দুয়েকজন বাদে বাকিরা কেউই বিদেশে গিয়ে লেখার তথ্য সংগ্রহ করার বিলাসিতা দেখাতে পারেন না। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এটা অনেকটাই অসম্ভব। এখানে জনসংখ্যার অনুপাতে বইয়ের ক্রেতার সংখ্যা খুবই শোচনীয়, নগণ্য।
জে কে রোলিং তুমুল জনপ্রিয় ‘হ্যারি পটার’ সিরিজ লিখে অনেক টাকা কামিয়েছেন, তার বই থেকে নির্মিত সিনেমা ব্লকবাস্টার ছিলো একেকটা। ‘থ্রি ইনভেস্টিগেটরস’, ‘শার্লক হোমস’, ‘এরকুল পোয়ারো’র লেখকেরা মৌলিক লিখতে পারেন, কারণ তাদের কাছে বিদেশ ভ্রমণ ব্যাপার ছিলো না। কিন্তু একজন কাজী আনোয়ার হোসেন, একজন রকিব হাসানরা যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও মৌলিক গোয়েন্দা সিরিজ লিখতে পারেননি শুধুমাত্র আর্থিক কারণেই। অনেকে বলবেন বর্তমানে ইন্টারনেটে সব তথ্য সহজলভ্য, এখন আর লিখতে হলে দেশ ঘুরতে হয় না। যদিও বাস্তবে ঘোরা আর ইন্টারনেটে ঘোরায় তফাৎ আছে, তবু মেনে নিলাম ঠিক। কিন্তু তিন গোয়েন্দা সিরিজ যখন (১৯৮৫) শুরু হয় তখন কিন্তু ইন্টারনেট ছিলো না। এমনকি টানা ১৬০টি বই লেখার পর রকিব হাসান যখন (২০০৩) ছেড়ে দেন তখনও ইন্টারনেট এভাবে বিস্তৃত ছিলো না। সুতরাং তখন মৌলিক কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ লেখা অসম্ভবের পর্যায়ে ছিলো। অবশ্য এখন অনেকেই চেষ্টা করছেন। হয়তো ভবিষ্যতে তিন গোয়েন্দার মতো না হলেও তার কাছাকাছি জনপ্রিয় কোনো মৌলিক কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ পেতে পারি আমরা।
আরেকটি সমালোচনা ছিলো যে, তিন গোয়েন্দা পড়ে অনেক কিশোররা গোয়েন্দা হওয়ার নেশায় বাড়ি ছেড়ে যাচ্ছে। অনেক ছেলেমেয়ে তিন গোয়েন্দা পড়তে গিয়ে পাঠ্যবই বিমুখ হয়ে যাচ্ছে। অভিভাবক, শিক্ষকরা এজন্যই তিন গোয়েন্দা পড়তে সন্তানদের মানা করতেন একসময়। কিন্তু তারা নিজেরা তিন গোয়েন্দা পড়লে তাদের ধারণাটা পাল্টে যেত। তারা দেখতেন তিন গোয়েন্দা পড়ে থ্রিলারের স্বাদ আর আনন্দ শুধু নয়, পৃথিবীর কত বিচিত্র সব তথ্যাবলী জানতে পারে একজন পাঠক। শিক্ষা মানে শুধু পাঠ্যবই পড়া নয়, শিক্ষা জ্ঞানের উন্মুক্ত দ্বারও। তিন গোয়েন্দার মত বই পড়ে যেমন আনন্দ পাওয়া যায় তেমনি দারুণ কিছু শেখাও যায়, জ্ঞানার্জনটাও হয় খুব ভালোভাবেই। আর যারা গোয়েন্দা হওয়ার নেশায় বিভোর হয়, কে বলবে তাদেরও কেউ কেউ হয়তো একদিন বাস্তবের গোয়েন্দাও হয়ে যান। একটা দেশের জন্য গোয়েন্দা যে কতটা প্রয়োজনীয়, তা রাষ্ট্রের নিরাপত্তার দায়িত্বে যারা থাকেন তারা বুঝতে পারেন। সিআইএ, মোসাদ, র’র মতো গোয়েন্দা সংস্থা গোটা পৃথিবীজুড়েই একেকটি পরিচিত নাম।
তিন গোয়েন্দা বিদেশী গল্পগুলো থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা দেশী স্বাদের কিশোর থ্রিলার। এটা যেমন কয়েকটা প্রজন্মকে বইপ্রেমী বানিয়েছে, আনন্দ-বেদনার সঙ্গী হয়েছে লাখো কিশোরের; তেমনি একদিন কেউ কিশোরদের জন্য মৌলিক থ্রিলার সিরিজ লিখবে, সেগুলো দেশে জনপ্রিয়তা পেয়ে বিদেশেও অনুকরণ করা হবে, এই স্বপ্ন দেখে তিন গোয়েন্দার প্রতিটি ভক্ত, পাঠক। হয়তো স্বপ্নটা একদিন পূরণ হবে। আশায় বাঁচে মানুষ, তাই আশা করতে দোষ কী!
রকিব হাসানের লেখা তিন গোয়েন্দা বইগুলো পড়তে ঘুরে আসতে পারেন এই লিংক থেকে।