রোগনির্ণয় ও চিকিৎসায় পদার্থবিজ্ঞানের অবদান

সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই রোগ-শোক আমাদের নিত্যসঙ্গী। সুস্থ থাকার তাগিদে মানুষের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়াও তাই নতুন কিছু নয়। মানব শারীরতত্ত্বের কোনো কিছু না জেনেই একসময় চিকিৎসাপদ্ধতির প্রয়োগ শুরু হয়। জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোয় ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে বিজ্ঞানের অন্যতম এক প্রায়োগিক শাখা- চিকিৎসাবিজ্ঞান। অন্যদিকে, প্রকৃতির রহস্য উন্মোচনে এগিয়ে আসে মৌলিক বিজ্ঞানের প্রধান শাখা পদার্থবিজ্ঞান। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ক্রমাগত উৎকর্ষ সাধন মূলত চিকিৎসাবিজ্ঞান-পদার্থবিজ্ঞান হাত ধরাধরি করে বেড়ে ওঠারই ইতিহাস!

রোগীর গায়ের ভেজা কাপড় শুকানোর দ্রুততা থেকে তাপমাত্রা পরিমাপের সূচনাই মূলত থার্মোমিটার আবিষ্কারে পূর্ণতা পায়। কাচ ঘষাঘষি থেকে যে প্রক্রিয়ার শুরু, তার শেষও যে হয় শক্তিশালী অণুবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কারের মাধ্যমে। এ সবকিছুতেই রয়েছে পদার্থবিজ্ঞানের দারুণ অবদান। রোগনির্ণয় ও চিকিৎসায় এমন সব প্রযুক্তির ব্যবহার চিকিৎসকদের কাজ অনেকটাই সহজ করে দিয়েছে। রোগনির্ণয় ও চিকিৎসায় ব্যবহৃত এমন কিছু প্রযুক্তি আবিষ্কারে পদার্থবিজ্ঞানের অবদান তুলে ধরা হয়েছে এই বইয়ে। পাশাপাশি, বইটিতে লেখক প্রদীপ দেব এসব প্রযুক্তি উদ্ভাবনের এক ইতিহাস-সচেতন আলোচনাও করেছেন, যা মুগ্ধ করবে পাঠককে। 

Image Source: bigganchinta.com

বর্তমানে স্টেথোস্কোপ গলায় মানব অবয়বই যেন একজন চিকিৎসকের প্রতিমূর্তি হয়ে উঠেছে। অথচ, তাদের একটা সময় রোগীর বুকে সরাসরি কান পেতেই শুনতে হতো হৃদয়ের স্পন্দন। পদার্থবিজ্ঞানের একদম সাধারণ এক সূত্রকে ঘিরে নিরেট কাঠের চোঙ দিয়ে প্রথম স্টেথোস্কোপটি তৈরি করেন রেন লাইনেক। ঘোড়ার ধমনিতে ছিদ্র করে রক্তের ঘনত্ব, অভিকর্ষ বল ও উচ্চতাকে হিসেব করে রক্তচাপ নির্ণয়ের শুরুই আজকে মানুষের রক্তচাপ মাপার যন্ত্র আবিষ্কারের পথিকৃৎ। কালের বিবর্তনে এর ক্রমাগত উন্নতি সাধন আজ চিকিৎসকদের হাতে তুলে দিয়েছে ডিজিটাল স্টেথোস্কোপ ও স্ফিগমোম্যানোমিটার। রোগজীবাণুর অনুসন্ধান সহজ করে দিয়েছে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের আবিষ্কার, যার সাহায্যে সদ্য আঘাত হানা করোনা মহামারির জীবাণুকেও দেখা সম্ভব হয়ে ওঠে। এই করোনাতেই তো ঘরে ঘরে আঙুলে সামান্য এক যন্ত্র লাগিয়েই দেহের অক্সিজেনের মাত্রা পরিমাপ করা সম্ভব হয়। এর পেছনেও রয়েছে পদার্থবিজ্ঞান।

Image Source: Istock

একসময় চিকিৎসার প্রয়োজনে শরীরের ভেতরের কলকব্জাগুলো পর্যবেক্ষণ করে দেখার চাহিদা অনুভব করেন চিকিৎসকরা। এমন সময়েই বিজ্ঞানীদের হাতে ধরা দেয় এক্সরে, ইলেকট্রন আর তেজস্ক্রিয়তা। চিকিৎসায় এক্সরে যেমন সাফল্যের সাথে ব্যবহার করা যায়, তেমনই আলোর পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলন কাজে লাগিয়ে দেহের ভেতরের ছবি তোলাও সম্ভব হয়ে ওঠে। ক্যান্সার চিকিৎসায় শুরু হয় তেজস্ক্রিয়তার ব্যবহার। ইসিজি, এমআরআই, সিটি স্ক্যানের মতো প্রযুক্তিগুলো চিকিৎসকদের কাছে সোনার হরিণ হিসেবে ধরা দেয়, যার আগা-গোড়া পুরোটাই পদার্থবিজ্ঞান। নবজাতকের ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগাম সংকেতসহ নানা রোগের কারণ নির্ণয়ে ভূমিকা রাখে আল্ট্রাসনোগ্রাফি।

Image Source: thehungryjpeg.com

রোগনির্ণয় ও চিকিৎসায় নিত্যদিনের এমন সব যন্ত্রপাতির পেছনের পদার্থবিজ্ঞানকে অত্যন্ত সহজভাবে তুলে ধরেছেন লেখক। পদার্থবিজ্ঞানকে যাদের একগাদা তত্ত্ব আর সূত্রের কচকচানি মনে হয়, তারাও নির্ভয়ে বইটি পড়তে পারবেন। কেননা, গণিতের তেমন জটিল কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই এসব যন্ত্রপাতির কার্যপদ্ধতি বেশ সাবলীলভাবে তুলে ধরেছেন লেখক। পাশাপাশি, পাঠক চিকিৎসাবিজ্ঞান ও পদার্থবিজ্ঞানের মধ্যকার নিগূঢ় বন্ধনও উপলব্ধি করবেন মুগ্ধ নয়নে। বিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান এই দুই শাখার হাত ধরাধরি করে বেড়ে ওঠার ইতিহাস বিজ্ঞান সম্পর্কে আরও জানতে আগ্রহী করে তুলবে পাঠককে। 

লেখক প্রদীপ দেব বর্তমানে মেলবোর্নের আরএমআইটি ইউনিভার্সিটির স্কুল অব হেলথ অ্যান্ড বায়োমেডিকেল সায়েন্সের শিক্ষক ও গবেষক। জনপ্রিয় বিজ্ঞান ম্যাগাজিন বিজ্ঞানচিন্তা ও ইন্টারনেটে নিজস্ব ব্লগে বিজ্ঞান বিষয়ে নিয়মিত লেখালেখি করেন তিনি। পাশাপাশি, আইনস্টাইনের কাল, সবার জন্য স্যাটেলাইট ,উপমহাদেশের এগারোজন পদার্থবিজ্ঞানীসহ বেশ কয়েকটি পাঠকপ্রিয় বইও রচনা করেছেন তিনি।

সংক্ষিপ্ত বই পরিচিতি

বই: রোগনির্ণয় ও চিকিৎসায় পদার্থবিজ্ঞান
লেখক: প্রদীপ দেব
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১৬০
মুদ্রিত মূল্য: ২৬০ টাকা
প্রথম প্রকাশ: অমর একুশে বই মেলা- ২০২২

Language: Bangla
Topic: This article is a book review on 'Rognirnoy O Chikitshay Podarthobiggan' which is authored by Pradip Deb.
Featured image: Md. Abdullah Abu Sayed

Related Articles

Exit mobile version