সিনেমায় ‘কুরোসাওয়া ইফেক্ট’ হচ্ছে এমন একটি অবস্থা যখন বিভিন্ন মানুষ একই ঘটনার উল্লেখযোগ্যভাবে ভিন্ন, কিন্তু সমানভাবে বিশ্বাসযোগ্য বিবরণ দেয়। এর মধ্যে কোনটা যে সত্য আর কোনটা যে মিথ্যা তা বের করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এটি ‘রশোমন ইফেক্ট’ নামেও পরিচিত। ১৯৫০ সালে জাপানি চলচ্চিত্রকার আকিরা কুরোসাওয়া ‘রশোমন’ সিনেমাটি তৈরি করেন। কিয়োটোর রশোমন গেটের নিচে দাঁড়িয়ে তিনজন পুরুষ; এর মধ্যে একজন কাঠুরিয়া, একজন পুরোহিত এবং একজন সাধারণ লোক। তারা ঝড় থেকে আশ্রয় নিতে সেখানে গেলে সিনেমার কাহিনী শুরু হয়। যেখানে পুরোহিত এবং কাঠুরিয়া দিন তিনেক আগে বনের মধ্যে কীভাবে একটি বাঁশের ঝোঁপে একজন সামুরাইয়ের লাশ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল সেই কাহিনী নিয়ে আলোচনা করছিল, সেখানে একে একে, অপরাধের সাথে পরিচিত সাক্ষীরা তাদের ঘটনাগুলোর সংস্করণ বর্ণনা করে। কিন্তু যখন তারা প্রত্যেকেই তাদের মতো করে বিবরণ দেয়, দেখা যায় প্রতিটি বিবরণই যুক্তিযুক্ত কিন্তু একটি অন্যটি থেকে আলাদা। আবার প্রতিটি সাক্ষী নিজেদের অবস্থানকে ওই অপরাধের সাথে জড়াচ্ছে। সব মিলিয়ে তৈরি হয় মানসিক অস্থিরতা এবং বিশ্বাসহীনতার। এবার বাংলা ওয়েব সিরিজে সেই ‘কুরোসাওয়া ইফেক্ট’ বা ‘রশোমন ইফেক্ট’ এরই খোঁজ মিলল ইয়াছির আল হকের পরিচালনায় ‘সাড়ে ষোলো‘-তে।
‘সাড়ে ষোলো’-তে পুলিশ অফিসার আলতাফ (ইমতিয়াজ বর্ষণ) যখন শ্রমিকনেতা গাফফারকে (শাহেদ আলী) বলছিলেন এনাম সাহেবের ছেলের বাঁচা-মরা কোনোটারই দরকার নেই, তখন দর্শকের সামনে একটা বিষয় চলে আসে, আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা যে রাজনীতি তার সফলতা কিংবা ব্যর্থতা, এমনকি আমাদের বেঁচে থাকা কিংবা মৃত্যু কোনো কিছুই আমাদের একার উপর নির্ভর করে না। এসবের সাথে আমাদের চারপাশের রাজনীতি, অর্থনীতি, ক্ষমতাসহ আরো অনেক কিছুরই সম্পর্ক বিদ্যমান। তেমনই এক বোঝাপড়ার গল্পকে ঘিরে একটি মৃত্যু এবং তার পরের পরিণতি নিয়েই তৈরি হয়েছে ওয়েব সিরিজ ‘সাড়ে ষোলো’। ওটিটি প্ল্যাটফর্ম হইচইয়ে এই ওয়েব সিরিজটি মুক্তি পেয়েছে গত ১৬ই আগস্ট, দুপুর ১২টায় (যাকে ‘সাড়ে ষোলো’ তারিখ বলা যায়)। প্রযোজক হিসেবে ছিলেন আলী আফজাল উজ্জ্বল।
রাজধানীর এক অভিজাত হোটেল ভায়োলেট ইন৷ সেখানটায় সবচেয়ে এক্সক্লুসিভ ফ্লোর হলো ‘সাড়ে ষোলো’ যেখানে সবচেয়ে ধনাঢ্য বা ভিআইপিরা আসেন, সময় কাটান, বিভিন্ন রকম ডিল করেন কিংবা কখনো কখনো এটি ব্যবহৃত হয় হানিট্র্যাপের জন্যও। এম্পায়ার সু ফ্যাক্টরির ভবন ধসে মারা যায় তিনশরও বেশি শ্রমিক, আহত হয় সাতশরও বেশি। সেই মামলার সর্বশেষ শুনানির আগের রাতে ভায়োলেট ইনের ‘সাড়ে ষোলো’-তে হালকা সময় কাটানোর জন্য বান্ধবী নাতাশাসহ হাজির হন কেপলার বিল্ডার্স গ্রুপের আইনজীবী আশফাক রেজা। হানিট্র্যাপে ফেলে আশফাক রেজাকে ফাঁসিয়ে পরের দিনের শুনানিতে যাওয়া আটকানোর জন্য ‘সাড়ে ষোলো’-তে হাজির হন সাংবাদিক রিনি, যার সাথে আশফাক রেজার বিরোধ রয়েছে আগ থেকেই। রাকিব, যিনি কেপলার গ্রুপের একজন হয়েও ওই গ্রুপের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছেন, তিনি হাজির হন হানিট্র্যাপের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে। আর এডিসি আলতাফ হাজির হন তারই পুরনো বান্ধবী রিনির ডাকে। কিন্তু, এইসব প্লট সাজানোর মাঝেই এক পর্যায়ে নাতাশার লাশ পাওয়া যায় ১৬৫২ নম্বর রুমে, যেখানে নাতাশা আর আশফাক রেজা উঠেছিলেন। নাতাশা কীভাবে মারা গেলেন? খুন কে করল? কীভাবেই বা করল? কেন করল? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আপনাকে দেখতে হবে গোটা সিরিজটি।
নানা কারণেই ‘সাড়ে ষোলো‘র ভিজ্যুয়ালাইজেশন নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত। এই সিরিজের চিত্রনাট্যকে দারুণ বলার সুযোগ নেই। কিন্তু তার ভেতরেও তারা নতুনত্ব আনার চেষ্টা করেছেন। বিভিন্ন সময়ের টিভির হেডলাইনগুলোকে দিয়ে সম্পর্ক তৈরি করা হচ্ছিল বর্তমান সময়ের সাথে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কথা, বাংলাদেশ ক্রিকেটের পঞ্চপাণ্ডবের কথা, তাপমাত্রা বাড়ার কথা- এসব কিছুকে তারা নিয়ে এসেছেন ফ্রেমের ভেতর। সাধারণত ওয়েব সিরিজগুলোয় একটি এপিসোডের ইন্ট্রোর আগে আনা হয় কোনো সাবপ্লটকে, যার সাথে ইন্ট্রোর পরের গল্পের যোগসূত্র রাখা হয়। ইয়াছির সে জায়গায় এনেছেন নতুনত্ব। তিনি ইন্ট্রোর আগের ওই এপিসোডের দৃশ্যগুলোর ছোট ছোট কাট নিয়ে তৈরি করছিলেন টিজার। তারপর ইন্ট্রো। ইন্ট্রোর ব্যাকগ্রাউন্ড ভিডিওটিও বেশ সুন্দর।
এই সিরিজটা দাঁড়িয়ে আছে যে প্রেক্ষাপটকে ঘিরে তা হলো, কেপলার বিল্ডার্স আর এম্পায়ার সুজের মামলা। এম্পায়ার সুজের ভবন ধসে মারা যান অসংখ্য মানুষ। ইয়াছির এই এলিট সোসাইটির একটা মার্ডার মিস্ট্রি বানালেও প্রত্যেক এপিসোডের শেষে আবার জুড়ে দিচ্ছিলেন ভবনধসে মারা যাওয়া বা আহত মানুষদের নিয়ে সাদাকালো কিছু ডকুমেন্টারি। জানি না, ডকুমেন্টারির মানুষগুলো কি অভিনয় করেছেন নাকি আসলেই বাস্তব কোনো ঘটনা দেখানো হয়েছে। কিন্তু এই ভিডিওর সাথে আমরা রানা প্লাজা ধস, ধসের পর একে অন্যকে দোষারোপ কিংবা তার সাথে ক্ষমতার বোঝাপড়াকে মেলাতে পারি। শেষ এপিসোডে যখন ব্যাকগ্রাউন্ডে একজন মানুষ বলছিলেন ভিডিও না করতে, এসব করে যারা ভিডিও বানান তাদের লাভ ছাড়া এই ভুক্তভোগীদের কোনো লাভ হয় না, তখন তা আমাদের হৃদয়ে গিয়ে লাগে। কিছুটা হলেও আমরা অনুতাপে ভুগি। ইয়াছির এই যে দর্শককে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন পুঁজিপতি সমাজের বিপরীতে, প্রথম কাজ হিসেবে এর জন্য তাকে অভিবাদন জানাতে হয়।
গল্পের বিচারে এই সিরিজটি অসাধারণ। সাসপেন্স তৈরি করতে এই গল্পটি অবশ্যই দারুণ। কিন্তু গল্পের তুলনায় চিত্রনাট্য কিংবা স্ক্রিপ্ট সে অর্থে বিশেষ কিছু দিতে পারেনি। বেশ কিছু সংলাপ আছে দারুণ। রিনির সাথে আলতাফের দীর্ঘদিন পরে সাক্ষাতের শুরুতেই তার পুরনো কমরেডের বুর্জোয়াদের ভেতর ঢুকে কেমন বিপ্লব করা হচ্ছে তা জানতে চাওয়া কিংবা আশফাক রেজার “সুন্দরী মেয়েদের আমার সবকিছুই পছন্দ, এক্সসেপ্ট বিশ্বাসঘাতকতা”, আশফাক রেজার স্ত্রীর অফিসে আলতাফের “পভার্টির তাহলে বিজনেস ভালোই” এধরনের সংলাপগুলো ভীষণ জোরালো। কিন্তু গল্পের ধারাবাহিকতার দিক থেকে দেখলে এই সিরিজের সংলাপগুলো খাপছাড়া। যেন সংলাপ দিতে হচ্ছে বলেই তারা দিচ্ছিলেন। মনে হচ্ছিল, চিত্রনাট্যের সংলাপ হুবহু বলতে গিয়ে তারা খেই হারিয়ে ফেলছিলেন, যেন সেগুলো দেওয়া শেষ করতে পারলেই বেঁচে যান। কোথাও কোথাও চলিত-আঞ্চলিক ভাষার মিশ্র রীতির অনুসরণ করতে গিয়েও খেই হারিয়ে ফেলছিলেন অভিনেতারা। তারপরও এই চিত্রনাট্যের যে দৃশ্যায়ন সেটাকে পাশ মার্ক দেওয়া যায় কিছুটা নতুনত্ব আর সাসপেন্সের একটা মনোরোম পরিবেশনা দেওয়ার জন্য। চিত্রনাট্য আর সংলাপ লিখেছেন আদনান হাবীব ও ইমতিয়াজ হোসাইন।
সিরিজের ট্রেলারে দেখানো হয়েছিল, আশফাক রেজা (আফরান নিশো) বলছিলেন খুনটা যে কেউই করতে পারেন। তিনি টুইস্ট যুক্ত করেছিলেন, রুমে যে আগে প্রবেশ করেছিলেন তার ওপরেই খুনের একটা দায় যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। পরিচালক ইয়াছির আল হক গল্পটা বলে গেছেন বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে। দেখানো হচ্ছিল, এডিসি আলতাফ যদি খুন করে থাকেন তবে কীভাবে করতে পারেন, রিনি যদি খুন করে থাকেন সেটাও কীভাবে হতে পারে, কিংবা রাকিব সাহেবও যদি খুন করেন তবে তা কীভাবে করতে পারেন, বা আশফাক রেজা নিজে করলেও তা কীভাবে হতে পারে। পরে আবার ওইসব অ্যাঙ্গেলের ‘প্লটহোল’ বা ফাঁকিটা কোথায় সেটাও আলোচনা হচ্ছিল। সব মিলিয়ে এখানে একটা সাসপেন্স তৈরি হচ্ছিল, যেখানে অ্যাঙ্গেলগুলোকে দেখানো হচ্ছিল কিছুটা হলিউডের ‘Vantage Point’ মুভির ধাঁচে। একটা সাসপেন্সও পাওয়া যাচ্ছিল ‘Frenzy’ চলচ্চিত্রের মতন। আর গল্প বলার ধরনের সাথে আপনি আমাদের উপমহাদেশেরই ‘Monsoon Shootout’ মুভির সাথে মিল পাবেন। শুধু পার্থক্য হলো, ইয়াছির এখানে খোলাসা করতে পারেননি, তিনি যে নানা অ্যাঙ্গেল থেকে দেখাচ্ছেন নাতাশার রুমে যাওয়াকে, সেসব অ্যাঙ্গেলের প্রয়োজনীয়তা কী? গল্পের সর্বশেষ যে পরিণতি, তার সাথে তো এগুলো প্রাসঙ্গিকতা তৈরি করতে পারেনি। গল্পের পরিণতি অনুসারে এই গল্পের দৈর্ঘ্য এক ঘণ্টা বা বড়জোর আশি মিনিটের বেশি হবার নয়। তার সাথে বাড়তি বিড়ম্বনা যোগ করেছে অন্তত ৮০ ভাগ দৃশ্যেই সিগারেটের ব্যবহার। প্রতিটি চরিত্রই সাসপেন্সের প্রয়োজনে হোক বা অপ্রয়োজনে, সিগারেট নিয়েই সবকিছু করছিলেন। প্রতিটি চরিত্রই এত বেশি সিগারেট সর্বস্ব হয়েছে, মনে হবে এ যেন কোনো সিগারেট কোম্পানির ‘প্রাত্যহিক জীবনে সিগারেট’ শীর্ষক ডকুফিকশন।ইয়াছির ইতিপূর্বে রেহানা মরিয়ম নূর কিংবা রিফিউজির মতো কাজগুলোয় সম্পৃক্ত ছিলেন৷ পরিচালক হিসেবে ‘সাড়ে ষোলো’ তার প্রথম কাজ। প্রথম কাজ বিবেচনায় ইয়াছিরের প্রচেষ্টাকে বাহবা দেওয়া যায়। কিন্তু এধরনের ভিজ্যুয়াল স্টোরি নতুন নয়, তাই আগেই প্রত্যাশার পারদ উঁচুতে থাকায় আরেকটু ভালো না হওয়ার খচখচানিটা থেকেই যায়!
আশফাক রেজা চরিত্রে আফরান নিশো হাজির হয়েছেন নতুনভাবে। মধ্যবয়সী এক আইনজীবী হিসেবে আফরান নিশো সাবলীল। নিশো তার সংলাপ দিয়ে সবসময়ই চমক তৈরি করে থাকেন। ‘সাড়ে ষোলো’-তে সে অর্থে খুব বিশেষ কিছু দেওয়ার ছিল না। সাসপেন্স তৈরির জন্য প্রয়োজন ছিল কিছু রহস্যময় অভিব্যক্তির। নিশো তার লুক আর এক্সপ্রেশন দিয়ে সে চাহিদা পূরণ করে দিয়েছেন।
অভিনয়ের দিক থেকে হোক বা গোটা ‘সাড়ে ষোলো’ সিরিজেই হোক, সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি এডিসি আলতাফ চরিত্রে ইমতিয়াজ বর্ষণ। দুর্নীতির সিস্টেমের মধ্য দিয়ে গিয়েও কিছুটা কম দুর্নীতিবাজ হওয়ার একটা অভিপ্রায় নিয়ে কাজ করা পুলিশ কর্মকর্তা এডিসি আলতাফ। অভিনয়, নিখুঁত চাহনি, পরিমিতিবোধ মিলিয়ে ইমতিয়াজ বর্ষণ যেন জমিয়ে দিয়েছেন। এধরনের একটা চরিত্র আর লম্বা সময়ের স্ক্রিনটাইমের জন্য তার ক্ষুধা যে কত দীর্ঘদিনের, সেটাই যেন পরিলক্ষিত হলো ‘সাড়ে ষোলো’-তে। চরিত্রের ভেতর ঢুকে একে ধারণ করার একটা শিল্পবোধ দেখা গেছে তার ভেতর। বর্ষণ তার ভাষায় একটা শহুরে টান ব্যবহার করেছেন; তিনি যখন ফরমাল হচ্ছেন তখন প্রমিত ভাষায় কথা বলছেন, বান্ধবী রিনির সাথে কথা বলছেন অন্য ধাঁচে, আবার শ্রমিক নেতা গাফফারের সাথে কথা বলছেন তারই ভাষায়। এই বৈচিত্র্যময় অভিব্যক্তিতে দর্শক আগ্রহী হয়ে ওঠে, উপভোগ করতে পারে অভিনয়।
সাংবাদিক রিনি চরিত্রে অভিনয় করেছেন জাকিয়া বারী মম। মম অভিজ্ঞতা আর দক্ষতার দিক থেকে সবসময়ই দর্শকের কাছে বিশেষ একটি নাম। সবমিলিয়ে তার কাছ থেকে প্রত্যাশাও ছিল বেশি। সেদিক থেকে রিনি চরিত্রে সেভাবে নিজের নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি তিনি। সংবাদ পাঠক কিংবা গ্রেফতারের আগ মুহুর্তের রিনি হিসেবে তিনি দারুণ। কর্পোরেট রিনি হিসেবে রিনি কিছুটা একঘেয়ে। অভিনয় বরাবরের মতো ভালো হলেও, এই চিত্রনাট্যের কারণেই তার দেওয়া সংলাপগুলো কিছুটা ক্লিশে মনে হচ্ছিল।
রাকিব চরিত্রে ইন্তেখাব দিনার, গল্প-কথক হিসেবে কাজী নওশাবা, নাতাশা চরিত্রে আফিয়া তাবাসসুম ভালো করেছেন। অল্প সময়ের পর্দার উপস্থিতিতে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে পেরেছেন শাহেদ আলী। নিজের আদর্শিক রাজনীতি ছাপিয়ে ক্ষমতা আর অর্থের কাছাকাছি থাকা শ্রেয় মনে করা শাহেদ আলীকে দেখে মনে হয় একেবারে বাস্তব কোনো চরিত্র। নবাগত হিসেবে শফিক চরিত্রে ইরফান রনি ছিলেন সাবলীল। তার অভিনয়ও ছিল দারুণ। লুক, বডি মুভমেন্ট, কিংবা কান্নার অভিনয় সবকিছুতেই ভারসাম্য ছিল তার।
সিনেমাটোগ্রাফিতে ছিলেন তুহিন তামিজুল। তুহিন এসময়ের বিখ্যাত সিনেমাটোগ্রাফার। ‘সাড়ে ষোলো’-তেও হতাশ করেননি তিনি। আগেই বলেছি, সিরিজের গল্পগুলোকে নানা সময়ে নানা অ্যাঙ্গেল থেকে বলা হচ্ছিল। তুহিনও শটগুলো নিয়েছেন ভিন্ন ভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে। ফ্রেমিং যথাযথ, ক্যামেরার কারসাজিও কম দেখাননি। ক্লোজ শট খুব একটা নেই এখানে। লং শটও খুব বেশি নেই। মিড ওয়াইডের কিছু শট নিয়েছেন। যখন নাতাশার লাশ দেখতে একে একে সবাই রুমে ঢুকছিলেন, সেসময়ের ফ্রেমিংটা খুবই উপভোগ্য ছিল।
সিনেমাটোগ্রাফি অনুসারে সম্পাদনা ভালো হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। একে তো একই শটের ফুটেজ একই অ্যাঙ্গেল থেকে বারবার দেখানো হচ্ছিল, তার উপর শটগুলোকে কেটে ফেলা হচ্ছিল অনেক দ্রুত। ফলে দৃশ্যের পর দৃশ্যের যে আসা-যাওয়া বা ‘ট্রানজিশন’ তা অনেকসময়ই বিব্রতকর লাগছিল। একদিকে চিত্রনাট্য বেশ ধীরগতির, গল্পে ঢুকতেই কেটে গেছে অনেকটা সময়, কথোপকথন আছে বেশি, তার ভেতর যদি ট্রানজিশনগুলো খাপছাড়া হয়ে যায় দর্শক মনোযোগ ধরে রাখবে কী করে!
কালার গ্রেডিংয়ের কাজ ছিল চমৎকার। সাসপেন্স তৈরি করার জন্য যা প্রয়োজন সবই ছিল। লাইটিংয়ের কাজও বেশ ভালো হয়েছে। একটা রহস্যময় আলো-আঁধারির ফ্লোর করা হয়েছে ‘সাড়ে ষোলো’-কে। আবার রুমের ভেতর রাখা হয়েছে ফটোজেনিক কালার। সব মিলিয়ে উপভোগ্য ছিল।
সাউন্ডের কাজ করেছেন শৈব তালুকদার। আমরা সাসপেন্সের কাজে যে ধরনের ঝাঁঝালো ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক দেখে থাকি সেটা এই সিরিজে নেই। সাসপেন্সের কাজে এধরনের একটা রিদমিক সাউন্ড, কন্টিনিওয়াজ বিটে আগে দেখা যায়নি বাংলাদেশি সিরিজগুলোয়। কিন্তু ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ছাড়াই সংলাপ সর্বস্ব কিছু দৃশ্য, তার সাথে ফলি আর নয়েজ মিলিয়ে কাজের আবেদনটা কমিয়ে দিয়েছে খানিকটা। এমনিতেই সংলাপগুলো ক্লিশে, তার সাথে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক না থাকলে সাসপেন্সটা জমে উঠতে বেগ পেতে হয়। এছাড়াও শুরুর দৃশ্যেই নাতাশার সংলাপের সাথে ঠোঁট মেলেনি। আরো কিছু জায়গায় এমনটা দেখা গেছে। আবার দ্বিতীয় এপিসোডে আলতাফ বলছেন, “কী হইসে?” এবং সেই একই দৃশ্য তৃতীয় এপিসোডে বলার সময় তিনি বলছেন, “কী হয়েছে?”। ডাবিংয়ে এমন কিছু ভুল চোখে পড়েছে।
‘সাড়ে ষোলো‘ কতটুকু দর্শকের মন ছুঁয়ে যাবে তা এখনই বলার সময় নয়। কিছু সীমাবদ্ধতা আর অসম্পূর্ণতাকে ছাপিয়ে ইয়াছির আল হক একটা সমসাময়িক গল্পকে হাজির করাতে চেয়েছেন আমাদের সামনে, সেটাই বা কম কীসের। ‘রানা প্লাজা’ ট্র্যাজেডির বিভীষিকার শিকার মানুষগুলো, সেজান গ্রুপের কারখানায় আগুনে পোড়া মানুষগুলো কিংবা আরো আরো অসংখ্য পুঁজিপতিদের অসাবধানতায় মৃত্যুবরণ করা মানুষগুলো ‘সাড়ে ষোলো’র কারণেও যদি একবার আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে, তবে তাকে কোনোভাবেই ছোট প্রাপ্তি বলা যায় না।