বন্দে আলী মিয়ার কবিতার মতো সবুজ-শ্যামলে মনোরম, শান্ত, ছায়াঘেরা এক গ্রাম সুন্দরপুর। বিলভরা পদ্মের বৈচিত্র্যের সাথে একসময় এই গ্রামে যুক্ত হয় নতুন বৈচিত্র্য, একটি রেস্টুরেন্ট; নাম- রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো খেতে আসেননি।
এই রেস্টুরেন্টের বাবুর্চির রান্নায় জাফরানির রঙের মাংসের ঝোল শ্রাবণের অঝোর বৃষ্টির মতো প্রশান্তি নিয়ে আসে ভোজনবিলাসীদের মনে, অকৃত্রিম আর অদ্বিতীয় স্বাদে যেন সত্য করে তোলে সভ্যতার সেই অপাংক্তেয় কথাটিই- সুস্বাদু খাবার সবসময়ই মানুষের যাপিত জীবনের কষ্ট ভুলে থাকার গোপন অস্ত্র, জীবনের প্রয়োজন আর অপ্রয়োজনের চিন্তা থেকে ক্ষণিকের নিষ্কৃতি অর্জনের মাধ্যম। এই অমোঘ সত্য আর রান্নার স্বাদ ভোজনবিলাসীদের বারবার নিয়ে এসেছে ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো খেতে আসেননি’ রেস্টুরেন্টে।
একসময় এই অপ্রচলিত আর অদ্ভুতুড়ে নামের রেস্টুরেন্টে নিয়মিত গ্রাহক হয়ে ওঠেন এক তরুণ, নিয়মিত যাতায়াতে ঘনিষ্ঠতা হয় রেস্টুরেন্টের মালিক ও বাবুর্চির দ্বৈত ভূমিকায় থাকা মুশকান জুবেরির সাথে। সময়ের সাথে ঘনিষ্ঠতার সূত্রে অন্তরঙ্গতা তৈরি হয়, ঘটনাপ্রবাহে নিখোঁজ হন সেই তরুণ।
সারাক্ষণ রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজতে থাকা অদ্ভুতুড়ে সেই রেস্টুরেন্টকে কেন্দ্র করে সেটাই প্রথম নিখোঁজের ঘটনা নয়। তবে এবারের নিখোঁজ তরুণ প্রধানমন্ত্রীর পিএসের ভাগিনা হওয়াতে অন্তর্ধান নিয়ে তোড়জোড় চলে বেশি, রহস্য উদঘাটনে নিয়োগ পান ডিবির গোয়েন্দা নুরে ছফা।
সুন্দরপুর গ্রামের এই ঘটনা নিয়েই আবর্তিত লেখক মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের বই ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো খেতে আসেন নি’।
রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো আসেননি
ডিবির সবচেয়ে মেধাবী গোয়েন্দাদের একজন হওয়া সত্ত্বেও মুশকান জুবেরিকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া সবগুলো রহস্যের সমাধান করতে পারেননি ইনভেস্টিগেটর নুরে ছফা। বরং তাকে বোকা বানিয়ে সুন্দরপুর থেকে পালিয়ে যান মুশকান জুবেরি। রবার্ট ব্রুস যেমন স্বদেশ রক্ষায় সাতবার যুদ্ধ করে সফল হন, জুবেরিকে আইনের অধীনে আনার বারবার চেষ্টায় দ্বিতীয় পর্ব ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো আসেননি‘।
সুন্দরপুর পর্বের পর কেটে গেছে তিনটি বছর, ফাইলের পিরামিডে চাপা পড়ে গিয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর পিএস আশেক মাহমুদের ভাগিনার অন্তর্ধান রহস্য। এর মধ্যে আশেক মাহমুদের বোন চলে যায় মৃত্যুশয্যায়, মৃত্যুর পূর্বে আত্মিক প্রশান্তির প্রয়োজনে নতুন করে শুরু হয় এই রহস্যজাল ভেদ করে মুশকান জুবেরিকে ধরার চেষ্টা।
তিন বছর পর ইনভেস্টিগেটর নুরে ছফা আবারও সুন্দরপুর থেকেই মুশকান জুবেরিকে ধরবার নতুন যাত্রা শুরু করেন। আগের পর্বের চরিত্রগুলো তিন বছরের মধ্যেই অনেকগুলো পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেছে, শিক্ষক রমাকান্ত কামার নতুন লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেছেন, স্থানীয় সংসদ সদস্যের পরিবর্তন হয়েছে, বদলে গেছে রাজনৈতিক কাঠামোও।
মুশকান জুবেরিকে ধরতে এবারও নুরে ছফা একের পর এক চেষ্টা করেছেন। ঘটনার সূত্র ধরে তিনি গিয়েছেন কলকাতাতে, আবিষ্কার করেছেন মুশকান জুবেরির কলকাতা জীবনের আরো কয়েকজন শিকারকে। কলকাতা পর্বে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সূত্র পেলেও, কলকাতা পর্বের সমাপ্তি ঘটে দ্রুতই, ছফাকে ফিরতে হয় এপার বাংলায়।
বাংলাদেশে ফেরার পর থ্রিলারে নতুন মোড় তৈরি করে সুস্মিতা সমাদ্দারের আগমনে। মুশকান জুবেরি প্লাস্টিক সার্জারি করে সুস্মিতা সমাদ্দার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন, এমন ধারণা থেকে ছফা গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসেন তাকে। আটকের পর ছফা আবিষ্কার করেন, সুস্মিতা আসলে মুশকান জুবেরির বন্ধু ডাক্তার আসকারের মেয়ে। ঘটনাপ্রবাহে সুস্মিতা সমাদ্দারকে ছেড়ে দিতে হয় পিএস মাহমুদকে। নুরে ছফার যুদ্ধ এখন তিনজনের বিপরীতে- মুশকান জুবেরি, সুস্মিতা সমাদ্দার আর ডাক্তার আসকার।
সুস্মিতা ছাড়া পাওয়ার পরও তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালিয়ে যান নুরের ছফা। পিএসের সূত্রে পুরো মেট্রোপলিটন পুলিশকে নিয়ে কাজ করার সুযোগ হয় তার। কিন্তু প্রথম পর্বে তাকে যেভাবে বোকা বানিয়ে পালান মুশকান জুবেরি, এবারও তাকে বোকা বানিয়ে পালান সুস্মিতা সমাদ্দারকে নিয়ে।
মুশকান জুবেরিকে ধরার চেষ্টা নুরে ছফার হয়তো এখানেই শেষ হবে না। আগামী চেষ্টাগুলো আর ঘটনাপ্রবাহের সন্ধানের জন্য অপেক্ষা করতে হবে এই সিরিজে লেখকের পরবর্তী বইগুলোর জন্য।
‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো আসেননি’র অনন্যতা
সময়ের জনপ্রিয় থ্রিলার লেখক মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের অনন্য সৃষ্টি ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো আসেননি’। ২০১৯ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের অমর একুশে বইমেলা আর কলকাতার বইমেলায় একসাথে প্রকাশিত এই বই এরই মধ্যে সমান জনপ্রিয়তা কুড়িয়েছে দুই বাংলায়। নানাবিধ কারণেই বইটি দ্রুত পাঠকদের কাছে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে যায়।
প্রথমত, গল্পের প্লট নির্মাণ শুরু হয় একটি অন্তর্ধান রহস্যকে কেন্দ্র করে। সেখান থেকে লেখক ধীরে ধীরে প্লটের পরিধি বাড়িয়েছেন, তুলে এনেছেন এক সিরিয়াল কিলারের যাপিত জীবনের গল্প। সময়ের সাথে ঘটনাপ্রবাহ এগিয়েছে, মুশকান জুবেরির বুদ্ধিমত্তা আর সৌন্দর্যের সৌরভ দোলা দিয়েছে পাঠকদের মনে, পাশাপাশি সিরিয়াল কিলিংয়ের ঘটনাগুলো পাঠককে দুর্বিষহ ঘটনাগুলোর মধ্যে দিয়ে নিয়ে গেছে। গল্প নির্মাণে লেখকের মুনশিয়ানা থ্রিলার সিরিজকে গ্রহণযোগ্য করেছে, গ্রহণযোগ্য করেছে লেখকের বাইরে থেকে কোনো ঘটনাপ্রবাহ গল্পে আরোপ না করার চেষ্টাও।
দ্বিতীয়ত, চরিত্র নির্মাণে যথেষ্ট সময় নিয়েছেন লেখক, প্রধান চরিত্রগুলোকে পাঠকের সামনে বাস্তব করে তুলতে লেখক কখনো ইতিহাসের ঘটনাবলীকে তুলে এনেছেন, কখনো তুলেছেন চরিত্রের সাথে সম্পর্কিত সমাজের বিচিত্র দিকগুলো। পাশাপাশি, মুশকান জুবেরিকে ছাড়া চরিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে ব্যতিক্রম কোনো উদাহরণ লেখক আনতে চাননি, থেকেছেন সাধারণ জীবনের মধ্যেই।
তৃতীয়ত, চরিত্রগুলোকে কেন্দ্র করে লেখক বাস্তবিক কিছু ক্ষমতার কাঠামো তুলে এনেছেন, সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার ধরন তুলে এনেছেন, দেখিয়েছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানিক পদের সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। সৃজনশীল কাজগুলো সময়ের প্রতিচ্ছবি তুলে আনে। ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো আসেননি’ বইয়ে লেখক সেই দায়িত্ব পালন করেছেন চরিত্র নির্মাণের তুলিতে।
সীমাবদ্ধতায় ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো আসেননি’
পাঠকদের মধ্যে জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা এই বইটিরও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যেগুলো চরিত্রের নির্মাণকে সীমাবদ্ধ করেছে, গল্পের প্রবাহে পাঠকের মনে খটকা তৈরি করবে।
প্রথমত, কিছু জায়গায় লেখক গল্পকে খুব দ্রুত এগিয়ে নিতে চেয়েছেন। যেমন- মুশকান জুবেরির সন্ধানে ছফা কলকাতায় গিয়ে দেখা করেন সেখানকার নগরপাল সুশোভন মিত্রের সাথে। তার সূত্র ধরে কলকাতায় গত তিন বছরে অন্তর্ধান হওয়া মানুষদের তালিকা আসে ছফার কাছে। কয়েক হাজার মানুষের বিশাল সেই তালিকা থেকে ছফা দুজন মানুষকে খুঁজে বের করেন এবং কাকতালীয়ভাবে মুশকান জুবেরির সাথে সেই দুজনের যোগাযোগের সূত্র তৈরি হয়। লেখক যুক্তি দিয়েছেন ছফার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের ব্যবহারের ব্যাপারে। কিন্তু গল্পে এভাবে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের ব্যবহার গল্পের প্রবাহকে সীমাবদ্ধ করে এবং ঘটনাপ্রবাহকে বাইরে থেকে আরোপিত মনে হয়।
দ্বিতীয়ত, থ্রিলারগুলোতে সাধারণভাবেই অপরাধী আর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত সংস্থাগুলোর মধ্যে চিরস্থায়ী প্রতিযোগিতা চলে। গল্পের প্রয়োজনে থ্রিলারগুলোতে কখনো অপরাধী চরিত্রগুলো অপরাধ নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত সংস্থাগুলোর হাতে ধরা পড়ে, কখনো লেখক গল্পের প্রয়োজনে অপরাধীদের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেন। একই থ্রিলারের মানের পরীক্ষা প্রকৃতার্থে ঠিক এখানেই হয়- লেখক কীভাবে অপরাধীকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিচ্ছেন।
‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো খেতে আসেননি’র মতো ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো আসেননি’ থ্রিলারটিতেও মুশকান জুবেরিকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছেন লেখক। থ্রিলারের শেষ প্লটে এসে মুশকান জুবেরিকে ডাক্তার আসকারের হাসপাতালের একটি বাড়িতে ঘিরে ফেলেন ছফা, শুরু করেন তল্লাশী। ঠিক সেই সময়েই বাড়ি থেকে তীব্রবেগে বেরিয়ে যায় একটি গাড়ি, ছফা তড়িৎ গতিতে পুরো ফোর্সসহ অনুসরণ শুরু করেন সেই গাড়িকে। ফলাফল, এই গাড়িকে অনুসরণ করতে গিয়ে মুশকান হাতের মুঠো থেকে পালিয়ে যায়। ছফার একবারের জন্যও মনে হয়নি, মুশকান জুবেরি এই গাড়িটি তার মনোযোগকে সরিয়ে দিতে ব্যবহার করতে পারে। কিংবা, ছফা তার নিয়ন্ত্রণে থাকা পুলিশদের দু’ভাগে ভাগ করে পরিস্থিতি মোকাবেলার কথাও ভাবেননি। একজন দক্ষ ইনভেস্টিগেটরের চরিত্রকে যুক্তির কাঠামোতে ভাবানো প্রয়োজন গল্পের খাতিরেই। ইনভেস্টিগেটর ছফা সবাইকে নিয়ে গাড়ি অনুসরণ শুরু করার সাথে সাথে অধিকাংশ পাঠকই ধরতে পারার কথা, ছফা আবারও বোকা হয়েছেন, বোকা বানিয়েছেন মুশকান জুবেরি।
তৃতীয়ত, লেখক অত্যন্ত মুনশিয়ানার সাথে সিরিজের দ্বিতীয় পর্বে এসে মুশকান জুবেরির দলে নতুন একটি চরিত্র যোগ করলেও চরিত্রগুলোকে রক্ষার ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত রক্ষণশীলতা দেখিয়েছেন। মুশকান জুবেরির গ্যাং থেকে একজন চরিত্রকে গল্পের প্রয়োজনে বিয়োগ করলে, পাঠক ভিন্নধর্মী আরেকটি অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেতেন।
থ্রিলার সিরিজের শুরু থেকে মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন চেষ্টা করেছেন একজন ব্রিলিয়ান্ট অফিসার হিসেবে ইনভেস্টিগেটর নুরে ছফার চরিত্র নির্মাণ করতে। সিরিজের প্রথম দুই পর্বে ঘটেছে ঠিক তার উল্টোটা, বারবার ভুল ডিরেকশনে গিয়েছেন ছফা, মুশকান জুবেরি বারবার তাকে বোকা বানিয়েছেন। সিরিজের আগামী পর্বগুলোতে নুরে ছফা প্রকৃত এক মেধাবী ইনভেস্টিগেটরের ভূমিকায় আবির্ভূত হবেন, পাঠক হিসেবে প্রত্যাশা সেটাই।