মনে করুন, কোথাও একটি বাস দুর্ঘটনা ঘটেছে। এ বিষয়ে হতাহতের খবর এসেছে সংবাদমাধ্যমে। নিয়মিত ঘটনাভিত্তিক এই ধরনের সংবাদগুলোর ক্ষেত্রে সংবাদ পাঠকরা ঘটনার মূল বিষয় ছাড়াও জানতে চান ঘটনার বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক দিক। সেটা হতে পারে ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর অসহায় পরিস্থিতির গল্প কিংবা ঘটানাটির ভিন্ন আঙ্গিকের বিশ্লেষণ। এই বিষয়টিই মূলত ফিচার। সাংবাদিক জাহিদ রেজা নূর তার লেখা ‘ভালো ফিচার লিখতে হলে‘ বইতে এ বিষয়ে উল্লেখ করতে গিয়ে কেস স্টাডি হিসেবে তারেক মাসুদ ও মিশুক মনিরের দুর্ঘটনার প্রসঙ্গ সামনে এনেছেন। একটি দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঠিক কত ধরন আর রকমের ফিচার হতে পারে আলোকপাত করেছেন সে বিষয়েও।
ফিচার নিয়ে লেখা বইটির বিষয়ে মূল আলোচনায় প্রবেশের আগে এর লেখক জাহিদ রেজা নূরের বিষয়ে কিছু তথ্য জানিয়ে রাখি। পেশায় সাংবাদিক জাহিদ রেজা নূর দেশের প্রথম সারির একাধিক পত্রিকার সম্পাদকীয় ও ফিচার বিভাগে কাজ করেছেন। টানা ১৭ বছর ফিচার বিভাগে কাজসহ সাংবাদিকতায় তার অভিজ্ঞতা প্রায় ২৫ বছরের। বর্তমানে জাতীয় দৈনিক ‘আজকের পত্রিকা’য় কাজ করছেন তিনি।
শুধু সাংবাদিকতায় পেশার গণ্ডিতেই জাহিদ নিজেকে আটকে রাখেননি। সাহিত্য ও সংস্কৃতির নানা ক্ষেত্রে বিচরণ করেছেন তিনি।
যা-ই হোক, তার বই প্রসঙ্গে ফিরে আসি। জাহিদ রেজা নূর তার লেখা আলোচিত বইটিতে মানবিক আবেদনভিত্তিক ফিচার, ঐতিহাসিক ফিচার, উৎসবভিত্তিক ফিচারসহ এর বিভিন্ন ধরন নিয়ে বলতে গিয়ে সেসব ধরনের সাথে নিজের অভিজ্ঞতা টেনেছেন। বলেছেন, ফিচার সময়নিরপেক্ষ হলেও কিছু ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক ফিচারও বেশ আগ্রহ নিয়েই পড়ে পাঠক। এই যেমন আমাদের এই লেখার শুরুতেই একটি দুর্ঘটনার পর সেই দুর্ঘটনাকেন্দ্রিক বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক ফিচারের বিষয়ে বলা হয়েছে।
বইটিতে ফিচার লেখার বিভিন্ন কৌশল দেখাতে গিয়ে ফিচারের মূল তিন অংশ সূচনা, অবয়ব এবং উপসংহারে আলোকপাত করেছেন তিনি। ফিচারকে গল্প হিসেবে উপস্থাপনের প্রসঙ্গটি বেশ কয়েক বছর ধরেই প্রাধান্য পেয়ে আসছে। রোর বাংলাতেও বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে দেখা হয়। জাহিদ রেজা নূরও একই মত দিয়েছেন তার বইতে। বলেছেন, “লেখার সময় মনে রাখুন গল্প লিখছেন, ভুলে যান ফিচারের কোনো কাঠামো আছে।” এ প্রসঙ্গ যখন এনেছেন, তখন তিনি গল্প বলার ধরন নিয়ে আলোচনা করেছেন, কীভাবে সহজ ভাষায় গল্পের ছলে ফিচার হয়ে উঠতে পারে প্রাণবন্ত সে বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন। পুরো বই জুড়ে সংবাদ এবং ফিচারের বিষয়ে স্পষ্ট পার্থক্য দাঁড় করানোর একটা চেষ্টা করেছেন তিনি। অল্প কথায় কৌশল শিখিয়েছেন লেখার, সেই কৌশল মেনে তার লেখা ফিচার তুলে দিয়েছেন তার পরের অংশেই।
ফিচার বিষয়ে ক্ষুদ্র জ্ঞান থেকে বইতে সোর্স বিষয়ক কিছু তথ্য এড়িয়ে যেতে দেখেছি আমি। ফিচার যেহেতু সংবাদ নয়, সংবাদ থেকেও বেশি কিছু, তাই ফিচারে প্রাসঙ্গিক অনেক তথ্য প্রয়োজন হয় এবং তা খুঁজতে হয় নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে। অনেক সময় হয় কী, সংশ্লিষ্ট যারা তথ্যগুলো দিতে পারেন তারা হয়তো মনের ভুলে (বা অন্য কোনো কারণে) সঠিক তথ্য এড়িয়ে যান। সেক্ষেত্রে ক্রসচেক করে নেওয়াটা জরুরি। এক্ষেত্রে দ্বারস্থ হতে হয় ইন্টারনেট দুনিয়ার। আবার ইন্টারনেট দুনিয়ার সব তথ্যই যে সঠিক তা-ও কিন্তু নয়। তাই প্রযুক্তির সহজলভ্যতার এই সময়ে নির্ভরযোগ্য সূত্রের বিষয়ে কিছু আলাপ করা যেতেই পারতো। তবে একেবারেই যে আলাপ করা হয়নি তা বললে বোধহয় ভুল হবে। খ্যাতিমান মানুষের জীবনী খুঁজে পাওয়ার সূত্র হিসেবে বইতে উইকিপিডিয়ার কথা বলা হয়েছে। জানিয়ে রাখা ভালো, উইকিপিডিয়ার সকল তথ্যই যে শতভাগ নির্ভরযোগ্য এমন দাবি উইকিপিডিয়া নিজেও করে না। বিশ্বকোষটির যাত্রা শুরুর পর থেকে নানান সময়ে এর প্রমাণও মিলেছে, দেখা গেছে ভুল তথ্যের ছড়াছড়িও।
বইতে একটি জাতীয় দৈনিকের (লেখকের সাবেক কর্মস্থল) ভেতরের বেশ কিছু ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। একটি উদাহরণ যদি উল্লেখ করি, বিনোদন পাতায় একজনের সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছে সেই একজনের কোনো ইন্টারভিউ না নিয়েই! বইটির পাতায় পাতায় পত্রিকাটির নাম উল্লেখ করে এর প্রদায়ক এবং সাংবাদিকদের সমালোচনা করা হয়েছে। লেখক অবশ্য ফিচার লেখার কায়দাকানুন শেখাতে গিয়েই এসব ঘটনাকে উদাহরণ বা শিক্ষা হিসেবে টেনে এনেছেন। কিন্তু রীতিমতো পত্রিকাটির নাম উল্লেখ সমেত স্পর্শকাতর তথ্যগুলো প্রকাশ করে দেওয়া কতটা নীতিসাপেক্ষ তা ভাবনার বিষয় বৈকি।
শেষ করার আগে বইয়ের ব্যাককভারে কী লেখা আছে সেটা আপনাদের জানাতে চাই। লেখক লিখেছেন, “ফিচার নিয়ে এ রকম বই কোনোদিন লেখা হয়নি, হবেও না কখনো।…এই বইয়ের তুলনা শুধু এই বইটিই।…’ পাঠক হিসেবে আমার কাছে এই দুই বাক্যের মধ্য দিয়ে লেখকের অহমিকাই প্রকাশ পেয়েছে বলে মনে হয়েছে। কারণ, বাংলায় এমন বই হয়তো লেখা হয়নি, কিন্তু ভবিষ্যতে লেখা হবে না এমন গ্যারান্টি কেউ দিতে পারে না।
সব মিলিয়ে, ফিচার লেখার কায়দাকানুন বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ একটি গাইডলাইন লেখক জাহিদ রেজা নূরের এই বই। ফিচার বিষয়ে জানাশোনা যে কাউকেই বইটির প্রতি আগ্রহী করে তুলতে সক্ষম।
সংক্ষিপ্ত বই পরিচিতি
বই: ভালো ফিচার লিখতে হলে
লেখক: জাহিদ রেজা নূর
প্রকাশকাল: ২০২১
প্রকাশনী: কথা প্রকাশ
প্রচ্ছদশিল্পী: সব্যসাচী হাজরা
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ২৩১
মুদ্রিত মূল্য: ৪০০ টাকা