ওয়ার এন্ড পীস: শান্তি কোথা আছে!

উনিশশো দশ সালের শীতকাল। নভেম্বরের কুয়াশাচ্ছন্ন রাত্রিতে টলস্তয় পরিবারের চিকিৎসক আচমকা কারো ডাকে ঘুম ছেড়ে উঠলেন, সামনে দাঁড়ানো খালি পায়ে নাইট গাউন গায়ে কর্তা স্বয়ং। অশীতিবর্ষ আরো কয়েকবছর আগেই পেরিয়ে আসা এই বৃদ্ধ সাহিত্যিকের পারিবারিক জীবন ভাল চলছে না- জানতেন চিকিৎসক পেত্রভিচ ম্যাকোভিতস্কি। মধ্যরাত্রিতে ডেকে তুলে চুপিচুপি তিনি বলছেন সবকিছু ছেড়ে যাবার কথা। চিকিৎসক ভাবলেন, নাতির জমিদারিতে বেড়াতে যাওয়ার কথা বলছেন বোধহয়। তড়িঘড়ি বেরিয়ে পড়লেন দুজনে, গন্তব্য স্টেশন। 

পৃথিবীর অন্যতম প্রভাবশালী সাহিত্যিক লিও টলস্টয়, বেঁচে থাকতেই যাকে অভিহিত করা হতো দ্বিতীয় জার হিসেবে। ভরা যৌবনে যার হাতে রচিত হয়েছে ক্ল্যাসিক কিছু রচনা, যেগুলো পরবর্তী একশো বছরেও সেরা বইয়ের তালিকায় রয়ে যাবে। সেসবের মাঝে একটি ‘ওয়ার এন্ড পীস’ নিয়েই আমাদের আজকের আলোচনা।

Courtesy: GETTY IMAGES (TOLSTOY) // AMAZON (BOOK COVER)

মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই 

সংক্ষেপে বললে, এটি এমন একটি বই, যাকে ঠিক উপন্যাসও বলা যায় না, কারণ চরিত্র ও ঘটনাসমূহ বাস্তব। আবার ঠিক ইতিহাসও বলা যায় না, কারণ ঐতিহাসিক বইয়ের সব গুণ তাতে নেই। এই না উপন্যাস, না ইতিহাসের বইতেই তলস্তয় আঁকলেন একটি জাতির একটু একটু করে বদলে যাওয়া, লড়াই করবার ইতিহাস। নিজ দেশের জনতাকে বীরমাল্য দেওয়া, নিজভূমির মর্যাদা বিষয়ে সদা সচেতন তলস্তয় আবার কোনো অর্থেই কিন্তু সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবাদী নন। আবেগে থরো থরো হয়ে মানুষকে পতাকার পক্ষে লড়াই করতে উত্তেজিত করে তোলেন না, বরং দেশের মানুষ তথা বিশ্বমানবের শান্তিই কেবল কামনা করে তার এই প্রেম।

সমাজের ধনী আর দরিদ্রের বিভেদ নিয়ে লিখছেন, মানুষের আরও চাই মানসিকতাকে সমালোচনা করছেন। বরং সর্বস্তরের মানুষের সাথে মেলামেশা, সমাজের উচুস্তরে বসে তাদের মেকি ভদ্রতাকে কাছ থেকে দেখা তলস্তয় মানুষের যাপিত জীবনের এমন একটি তরিকা দেখিয়েছেন, যার মূল লক্ষ্য শান্তি। যুদ্ধভারাক্রান্ত একটি সময়ের ইতিহাস নিয়ে লিখছেন, কিন্তু পাখির চোখ করে আছেন প্রেমের দিকে, কল্যাণের দিকে। এই নিখাঁদ মানবপ্রেমই তাকে এনে দিয়েছিল জনতার ভালবাসা। চার্চ কর্তৃক নাস্তিক ঘোষণার পর মানুষ যাকে আপন করে নিয়েছিন নিজেদের ঋষি বলে।

একটি গাড়ি যখন চলে, বাইরে থেকে দেখা যায় কেবল তার ধোঁয়া উড়িয়ে ছুটে চলা। আরেকটু কাছাকাছি গেলে অনুভব করা যায় আরোহীদের পরস্পরের আলাপ, হাসি-কান্না আর আনন্দ-বেদনা। আর একেবারে মিশে গেলে জানা যায় গাড়ির ভেতরকার অন্তসলিলা ধারা, গতির ভেতরেও যে স্থিরতা আছে বোঝা যায় তখন।

ওয়ার এন্ড পীসের’ বাহ্যিক উদ্দেশ্য দেখতে চাইলে সবার আগে চোখে পড়বে একজন দার্শনিকের কিছু মৌলিক জিজ্ঞাসা। যু্দ্ধের অসারতা, ঐতিহাসিক চরিত্র, ক্ষমতার উৎস সম্পর্কে নির্মোহ কিছু প্রশ্ন তোলার ইচ্ছে।

যুদ্ধ কেন ঘটে? তলস্তয় পুরো উপন্যাসে কখনোই যুদ্ধকে মহৎ কোনো বিষয় বলে উল্লেখ করেননি। বরং, বরাবর একে আখ্যায়িত করেছেন মানুষ হত্যার কৌশল হিসেবে। আখ্যায়িত করেছেন পাগলামী বলে। আর এই যুদ্ধের পেছনে কলকাঠি নাড়ে যে সমস্ত মানুষ, তাদেরকে বলেছেন কেবলই নিয়তির জালে আটকে পড়া সাধারণ একজন মানুষ, কোনো মহৎ বীর কিংবা বিরল প্রতিভার অধিকারী নয়।

যুদ্ধ কেন ঘটে? Image Source: Britannica
 

কারণ, যুদ্ধের উদ্দেশ্য হিসেবে কী কী প্রস্তাব পেশ করা হয়? শান্তি প্রতিষ্ঠার দোহাই যদি দেওয়া হয় তবে প্রশ্ন আসবে- হাজারো মানুষের প্রাণ বিপন্ন করে, আয়-উন্নতি ক্ষেত-খামার বন্ধ রেখে, স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করে, মোটকথা শান্তির সকল প্রকার উপাদান ধ্বংস করে কীভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায়! আর যদি মতবাদের প্রচারই উদ্দেশ্য হয় তবে একটি জাতি অন্য জাতিকে কচুকাটা করে ফেলবার কী প্রয়োজন, যেখানে সামান্য মুদ্রণযন্ত্রই সেই প্রচারের কাজটি সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে পারে।

তবে কেন যুদ্ধ হয়, এর উত্তর তলস্তয় দিয়েছেন তার অন্যতম নায়ক প্রিন্স আন্দ্রুর জবানে, যখন সে সরকারি চাকরি, সুন্দরী স্ত্রী আর জমিদারি ছেড়ে যুদ্ধে রওয়ানা হয়। তার বন্ধু পিয়ের তাকে জিজ্ঞেস করছে আন্দ্রু কেন যুদ্ধে যেতে চায়, তার জবাব, “আমি যুদ্ধে যাচ্ছি কারণ এখানে যে জীবনযাপন করছি সেটা আমার ভাল লাগছে না!

তলস্তয়ের এই বইতে কোনো বিরল প্রতিভাবান স্তুতিযোগ্য বীরপুরুষ নেই, ঐতিহাসিক যে ক’টি চরিত্র আছে তাদেরকে তলস্তয়ের দৃষ্টিতে সেই বীরমাল্য দেয়া চলে না। কারণ, বস্তুত সাধারণ দৃষ্টিতে যাদেরকে বীর মনে হয়, তাদের যে সকল কাজকে বিরল প্রতিভার স্বাক্ষর বলে ধরা হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় সেসব সিদ্ধান্ত তারা মূলত স্বেচ্ছায় সুচিন্তিতভাবে দেয়নি, বরং এমন পরিস্থিতির শিকার হয়েছে যে নিতান্ত বাধ্য হয়ে তারা সেটা গ্রহণ করেছে।

নেপোলিয়নের আক্রমণে রুশ বাহিনী পশ্চাদপসরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, যা পরবর্তীতে রুশ বাহিনীর গভীর রণ-কৌশলের পরিচায়ক হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। কিন্তু তলস্তয় একে অভিহিত করছেন কেবলই কিছু ঘটনাবলির কারণে অনিবার্য হয়ে ওঠা বিষয় হিসেবে। কারণ, রুশ সেনাপতির এই সিদ্ধান্ত ছিল সকল জেনারেলের মতের বিরুদ্ধে নেওয়া একটি সিদ্ধান্ত। এবং যে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরে, স্বয়ং সেনাপতিও বুঝে উঠতে পারছেন না, কখন যুদ্ধক্ষেত্রে ছেড়ে পলায়নের আদেশ দেওয়া অনিবার্য হয়ে উঠল।

নেপোলিয়নের আক্রমণে রুশ বাহিনী পশ্চাদপসরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, যা পরবর্তীতে রুশ বাহিনীর গভীর রণ-কৌশলের পরিচায়ক হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল; Image Source: Napoleon Bonaparte Podcast
 

তাহলে ইতিহাসের ঘটনাবলী কীভাবে ঘটে, এই প্রশ্নের উত্তরে তলস্তয় যে কারণ নির্ণয় করতে চেয়েছেন সেটাই অন্যসব দার্শনিক থেকে তাকে আলাদা করে দিয়েছে। তলস্তয়ের ভাষায়, “ঐতিহাসিক ঘটনাবলী কীসে ঘটে সে প্রশ্নের আরেকটা জবাব হলো: মানবিক ঘটনাবলীর গতি নির্ভর করে সেই ঘটনায় অংশগ্রহণকারী প্রতিটি মানুষের ওপরে; এসব ঘটনার ওপরে একজন নেপোলিয়নের প্রভাব সম্পূর্ণ বাহ্যিক ও অলীক।

এখানে এসে সম্ভবত আমরা ‘ওয়ার এন্ড পীসের’ একটি মৌলিক উদ্দেশ্যের কাছাকাছি পৌঁছাতে পেরেছি। তলস্তয় তার মহাকাব্যিক উপন্যাস জুড়ে এই সাধারণ মানুষদেরই জয়গান গেয়েছেন, ইতিহাসে তাদের কর্মের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেছেন, “ইতিহাসের নিয়মকে জানতে হলে আমাদের পর্যবেক্ষণের বিষয়বস্তুকে পাল্টাতে হবে, রাজা মন্ত্রী ও সেনাপতিদের ছেড়ে আমাদের দৃষ্টি ফেরাতে হবে সেসব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়ের দিকে, যা জনসাধারণকে অনুপ্রাণিত করে।” এবং সেই বিষয়গুলোকেই তলস্তয় ক্ষমতার কারণ হিসেবে নির্ণয় করেছেন। ১৮১২ সালের ফরাসী-রুশ যুদ্ধকে উদাহরণ ধরে নিয়ে তিনি বলেছেন, যেকোনো ঐতিহাসিক ঘটনায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব রাখে কোনো সেনাপতি বা রাষ্ট্রপ্রধান নয়, বরং সেই ঘটনায় অংশগ্রহণকারী প্রতিটি মানুষ। যদিও সেই ঘটনার দায় তাদের ওপর বর্তায় না।

অবশ্য সাধারণ মানুষ স্বাধীন। কিন্তু তাদের আপাতঃস্বাধীন সত্ত্বাও এমন একটি নিয়তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এই নিয়তির কথা তলস্তয় বারবার উল্লেখ করেছেন, যার উদ্দেশ্য সম্পর্কে সাধারণ মানুষ অবগত থাকে না। ফলে তাদের সম্মিলিত স্বাধীন কর্মকাণ্ড হয়তো ব্যক্তিপর্যায়ে স্বাধীন, কিন্তু ইতিহাসের অংশ হিসেবে তাদের সকলের প্রতিটি কাজই এমন একটি বিরাট উদ্দেশ্যকে সাধিত করে চলে, যা তারা দেখতে পায় কেবল ঘটনাটি অতীত হয়ে যাবার পর।

বারো ঘর এক উঠোন

যদিও ‘ওয়ার এন্ড পীসের’  উদ্দেশ্য ইতিহাসে সাধারণ মানুষের প্রভাবের কথা তুলে ধরা, কিন্তু উপন্যাসের চরিত্ররা সকলেই সমাজের উচ্চকোটির মানুষ। উনিশ শতকে রাশিয়ায় ধনী ও গরীব ছাড়াও আরও একরকম বিভাজন ছিল সমাজে। যাদের অর্থকড়ি আছে তাদের কিছু কেবল ধনী, আবার কিছু জারের পক্ষ থেকে উপাধীধারী—প্রিন্স, কাউন্ট এরকম। আর এসব উপাধী কেবল প্রাপকের নয়, বংশধারা জুড়ে তা বাহিত হতো অধঃস্তন পুরুষের মাঝে। তলস্তয় নিজেও বাবার থেকে পেয়েছিলেন কাউন্ট উপাধী, আর মা ছিলেন প্রিন্সেস। অবশ্য এই প্রিন্স মানে রাজপুত্র নয়। ওয়ার এন্ড পীসের সমাজ ছিল এই স্তরের।

Image Source: So It Goes… – WordPress.com
 

তলস্তয়ের লেখার একটি গুণ ছিল, অনায়াসে কোনোকিছু চিত্রিত করতে পারা। যখন সাইবেরিয়ার হিমশীতল দৃশ্যের কথা তিনি লেখেন, কিংবা যুদ্ধের ভয়াবহতার চিত্র আঁকেন তখন মনে হয় তিনি সেই ঘটনার দর্শক। কোথাও সরাসরি কোনো দৃশ্যে উপস্থিত না থেকেও সবেতেই তিনি আছেন। এই যখন কল্পনাশক্তি, তখন তলস্তয়ের নিজের যে সমাজ তাকে উপজীব্য করে লেখার বেলায় সেই চিত্রায়ন আরও মোহিনী হয়ে উঠবে, সন্দেহ নেই।

প্রথম দৃশ্যটির কথাই ধরা যাক, আন্না পাভলভনা শেরারের বাড়িতে সান্ধ্য-আসর জমে উঠেছে। প্রিন্স-প্রিন্সেসে কাউন্ট-কাউন্টেসে একেবারে গমগমে ব্যাপার। রাজনীতি, যুদ্ধ, প্রেম আর কূটনীতির আড্ডায় চারদিক মেতে উঠেছে। পুরো উপন্যাসের মূল চরিত্রগুলো একে একে এসে সেঁটে যাচ্ছে ঘটনার সাথে, আর নানা দৃশ্যের মধ্যে দিয়ে একটি বিরাট আখ্যানের সূচনা ঘটছে। সেই থেকে শুরু, তারপর প্রায় শতাধিক উজ্জ্বল চরিত্রের সম্ভার, বিশাল প্রেক্ষাপটে রচিত জটিল একটি কাহিনী গড়ে উঠেছে, যেন বটবৃক্ষের ডালে ডালে পাখিদের আলাদা সংসার। কিন্তু একবারের জন্যও মনে হয়নি কাহিনী জটিল হয়ে উঠছে, বিরক্তি আসছে। শোনা যায়, এই চমৎকার ‘ধরতা’টির জন্য তলস্তয় একটি বছর অপেক্ষা করেছিলেন। অবশ্য বারবার সংশোধন করে পারফেক্ট করে তোলার দিকে তার নজর ছিল সবসময়ই।

ওয়ার এন্ড পীসে রুশ অভিজাত জীবনের সংকট, সামাজিক আচার, নানা উৎসব, শিকার ইত্যাদির সমন্বয়ে তলস্তয় একটি উনিশ শতকীয় আবহাওয়া তৈরি করতে চেয়েছেন, যার ফলে পাঠকের পক্ষে সহজ হয়ে ওঠে উপন্যাসের মূল উদ্দেশ্য তথা, যুদ্ধের অসারতা ও শান্তির পথে যাত্রার পথপরিক্রমা আরও ভালভাবে অনুভব করা।

কাহিনীর শুরুতে দেশের সীমান্তে যে যুদ্ধ চলমান থাকে, শহরজীবনে তার অস্তিত্ব থাকে কেবল এসব সান্ধ্য-আড্ডায়। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নানা মুখরোচক গল্পের বিষয়বস্তু হয়ে যে যুদ্ধ হাজির থাকে, ধীরে ধীরে তা ছড়িয়ে পড়ে পরিবারের বাস্তব জীবনে। আমোদ আর বিনোদনের জায়গায় স্থান করে নেয় উৎকণ্ঠা, নিছক ঠাট্টার বদলে পৃথিবীর জটিল সব সমস্যায় ভারাক্রান্ত হয়ে এসব মিলনমেলা রং বদলাতে থাকে। আর যুদ্ধ তার কালো দাঁত ফুটিয়ে দিয়ে যায় সমাজের উঁচু-নিচু সব মহলে।

হৃদয় পিদিমে জ্বালাই বাতি

বিস্তৃত রাষ্ট্রই হোক আর গুচ্ছের সমাজই হোক সবের কাঁচামাল হচ্ছে মানুষ। একক মানুষ না হলে সমাজ তার চেহারা পায় না, রাষ্ট্র তো দূরের কথা। তলস্তয়ের উপন্যাস একদিকে যেমন মহৎ রাষ্ট্র-চিন্তার কারণে অনন্য, তেমনি ব্যক্তির মানসচিত্রনেও তার ভূমিকা অসাধারণ। তাঁর দীর্ঘ কাহিনীর বিস্তারে অন্যান্য লেখকদের মতো নিখুঁত পরিবেশ কিংবা প্রকৃতি চিত্রায়ণের নজির হয়তো সেভাবে নেই, কিন্তু ব্যক্তিমানুষের হৃদয়ের তাপ-সন্তাপ, হাহাকার, প্রেমের অন্তরঙ্গ বয়ানে তার তুলনা মেলা ভার। তাই তাঁর কাহিনী সুদূর বিস্তৃত হলেও চৌম্বকীয়, হৃদয়ের গহীনতল ঢুঁড়ে দেখালেও তা আকর্ষণীয়।

প্রায় বারোশো পৃষ্ঠায় ছড়িয়ে থাকা কাহিনীর প্রয়োজনে ওয়ার এন্ড পিসের চরিত্র সংখ্যা অগণিত। খুব ছেড়েছুড়ে সবচেয়ে উজ্জ্বল ক’টি চরিত্রের খোঁজ যদি করতে হয়, তবে শুরুতেই মনে পড়বে নাচ-গান জানা সুন্দরী নাতাশা রস্তভার কথা, সেই সাথে তার কৈশোরের প্রথম প্রেম বরিসের কথা। পরিবারের চাপে তাকে ছেড়ে দেওয়ার পর সে প্রেমে পড়ল বড় ভাই নিকোলাসের বন্ধু দেনিসভের সাথে। বেচারা বিয়ের প্রস্তাব করতেই তাকে অপমানিত হতে হলো। কিন্তু প্রতিভাবান সুন্দরী কখনো একা থাকে না। সদ্য স্ত্রী-বিয়োগ হওয়া প্রিন্স আন্দ্রু এবার তার প্রেমে পড়ল, বাগদানও হলো। বছরখানেক পর বিয়ে।

সেই বিয়ের প্রস্তুতি নিতে মস্কোতে এসে পরিচয় হলো আরেক কাউন্ট পিয়ের ও তার পরিবারের সাথে। পিয়েরের শ্যালক আনাতোল আর তার চতুর বন্ধু দলোখভ মিলে প্রেমের ফাঁদে ফেলল নাতাশাকে। বাগদান, বিয়ে সব মাথায় তুলে পালিয়ে বিয়ে করবার সব পরিকল্পনা ঠিক হয়ে গেল। কিন্তু পালানো তো হলোই না, শেষে জানা গেল আনাতোল এক নারীঘটিত কেলেংকারিতে বিবাহিত। সব শুনে বেচারি নাতাশা চাইল আত্মহত্যা করতে। হা কপাল, তাতেও ব্যর্থ! তারপর এলো যুদ্ধ, মস্কো ছেড়ে যাবার সময় দেখা হলো সেই বাগদত্তা আন্দ্রুর সাথে। যুদ্ধে, ক্লান্তিতে, আঘাতে সে তখন বিপর্যস্ত।

এবার আর নাতাশার ভুল হলো না। আঘাতে আঘাতে পোড় খাওয়া তরী তীরে ভিড়লো। মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আন্দ্রু দেখে গেল অলৌকিক ভালোবাসার যাদু। পেয়ে গেল পবিত্র প্রেমের পরশ। আর নাতাশা, বাগদত্তার মৃত্যুতে ক্ষয়ে যাওয়া, ভাইয়ের মৃত্যুতে জেগে ওঠা নাতাশা পেল জীবনের স্বাদ। শেষাবধি ঘর বাঁধল পাখি আরেক যুদ্ধফেরত পিয়েরের সাথে।

এ তো কেবল একটি চরিত্র, এরকম প্রতিটি চরিত্রই আলাদাভাবে একেকটি কাহিনী, প্রত্যেকেই নিজস্বতায় আলাদা। কেউ হয়তো যুদ্ধের আহ্বানে ছুটে যাচ্ছে ময়দানে, কেউ বা অন্তর্জগতে ঝড় মোকাবিলা করছে আকাশের দিকে চেয়ে, কেউ খুঁজছে জীবনের মানে বারবার দর্শন বদলে বদলে, কেউ আবার পেতে চাইছে ভক্তিতে প্রেম, কিন্তু সকলের উদ্দেশ্য আখেরে এক, শান্তি। জগতের নানা ভিড় হট্টগোলের শেষে, দিনান্তে পথের পাশে বসে চরিত্ররা দেখছে অনন্ত বিস্তৃত আকাশ, পেতে চাইছে বিন্দুতে সিন্ধু, অল্পে প্রভূত সুখ। “লড়াই করতে করতে আর চিৎকার করতে করতে আমরা যখন ছুটছিলাম, ভীত ক্রুদ্ধ মুখে এক টুকরো ন্যাকড়ার জন্য যখন ফরাসিটি লড়াই করছিল… অসীম আকাশের বুকে মেঘেদের ভেসে চলা তার থেকে কত আলাদা! এই উঁচু আকাশটা আগে কেন চোখে পড়েনি? শেষ পর্যন্ত ঐ আকাশকে দেখতে পেয়ে আমি কত খুশি। হ্যাঁ, ওই অসীম আকাশ ছাড়া সবকছুই বৃথা। সবই মিথ্যা। ও ছাড়া আর কিছু নেই, কিছুই নেই। এমনকি ওই আকাশও নেই, স্তব্ধতা আর শান্তি ছাড়া আর কিছু নেই।

সমসাময়িক সাাহিত্যিকদের তুলনায় তলস্তয় আলাদা এই হিসেবে যে, তিনি দস্তয়েভস্কির মতো নির্মম নন, চেকভের মতো নির্মোহ কিংবা তুর্গেনিভের মতো আবেগী নন। বরং সবেতেই তার মন্তব্য আছে, নীতি আছে, সরলতা আছে। শেষাবধি তার চরিত্ররা বঞ্চিত নয়, কিছু না কিছুর ব্যবস্থা তিনি করছেন। তিনি বলছেন, “নির্ভেজাল পরিপূর্ণ সুখের মতোই নির্ভেজাল পরিপূর্ণ দুঃখও অসম্ভব।” তবে উপায় কি, “সুখের মুহূর্তটাকে আঁকড়ে ধরো, ভালবাস, ভালবাসা পাও। পৃথিবীতে এটাই একমাত্র সত্য। আর সবই বোকামি।

বিশ্বের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/

অনলাইনে বইটি কিনতে চাইলে ভিজিট করুন এই লিঙ্কে:

১) ওয়ার অ্যান্ড পিস

This article is a book review on Leo Tolstoy's famous book 'War & Peace'.

Feature Image: BBC

Related Articles

Exit mobile version