‘প্রহসন’, ‘স্যাটায়ার’– শব্দগুলোর সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। এই ঘরানায় আরেকটি শব্দ আছে। ‘নক্সা’ বা ‘নকশা’। নকশা বলতে সাধারণত বোঝায় এমন লেখা, যেগুলো হবে বিদ্রূপাত্মক এবং সমাজের কোনো অংশের সমালোচনামূলক। আরেকভাবে বলা হয়, নকশা হলো সেই রচনা, যেখানে একটি ‘ভ্যালু অভ স্ফেয়ার’ আরেকটি ‘ভ্যালু অভ স্ফেয়ার’কে নিজের স্থান থেকে দেখবে এবং তার সমালোচনা করবে। ঊনিশ শতকে ভবানীচরণ ও রামনারায়ণ এ জাতীয় লেখা লিখতে আরম্ভ করেন।
এরই ধারাবাহিকতায় বাংলা ভাষায় অনেকেই প্রহসন বা নকশা প্রণয়ন করেছেন। মাইকেল মধুসূদন দত্তও বাদ যাননি। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর, বলতে গেলে পুরো বাংলা ভাষায় প্রথম যথার্থ ও সর্বজনগ্রাহ্য নকশা প্রণয়ন করেছিলেন কালীপ্রসন্ন সিংহ। ‘হুতোম প্যাঁচা’ ছদ্মনামে তিনি এই নকশা প্রকাশ করতেন। ১৮৬১ সালে মাত্র একুশ বছর বয়সে ‘চড়ক’ নামক এক পত্রিকায় প্রথম তিনি নকশাটি প্রকাশ করেন। দু’ বছর পর নকশাটি আরো পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত করে প্রকাশিত হয়। তবে এবার দু’ভাগে বের করা হয়। ’৬৩-তে প্রথম ভাগ এবং ’৬৪ তে দ্বিতীয় ভাগ।
ঊনবিংশ শতাব্দীর কলকাতার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চিত্র ও অসঙ্গতিগুলো খুব সুচিন্তিতভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে গ্রন্থটির প্রতিটি নকশায়। ইংরেজ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রণীত নতুন শাসনব্যবস্থায় নব্যশিক্ষিত ও চাকুরে বাবু-সম্প্রদায়কে লেখক বিশেষভাবে কটাক্ষ করেছেন। তবে বাদ যায়নি অন্যরাও। গ্রন্থের ভূমিকাটিও যথেষ্ট রসসিক্ত। এখানে অনেক কথা বলার পর কালীপ্রসন্ন সিংহ শেষে বলেছেন, তার এই নকশা প্রণয়নের কারণ। এই নকশা যে লেখক সর্বশ্রেণিকে ব্যাপ্ত করে লিখেছেন এবং নিজেও এর ভেতরে থাকতে ভোলেননি- সে কথাও অকপটে স্বীকার করেছেন। লেখক নিজেই বলেছেন,
“কী অভিপ্রায়ে এই নক্সা প্রচারিত হলো, নক্সাখানির দু পাত দেখলেই সহৃদয়মাত্রেই তা অনুভব কত্তে সমর্থ হবেন; কারণ আমি এই নক্সায় একটি কথাও অলীক বা অমূলক ব্যবহার করি নাই। সত্য বটে, অনেকে নক্সাখানিতে আপনারে আপনি দেখতে পেলেও পেতে পারেন, কিন্তু বাস্তবিক সেটি যে তিনি নন, তা আমার বলা বাহুল্য। তবে কেবল এই মাত্র বলিতে পারি যে, আমি কারেও লক্ষ্য করি না, অথচ সকলেরেই লক্ষ্য করিচি। এমনকি, স্বয়ংও নক্সার মধ্যে থাকতে ভুলি নাই।“
তৎকালীন কলকাতার ইতিহাসের সাথে আরো কয়েকটি জিনিস মিশে আছে। নীল বিদ্রোহ, সিপাহী বিদ্রোহ, লখনৌ থেকে নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ-এর কলকাতায় স্থানান্তর। এ কয়েকটি বিষয়ও নকশাতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বেশ রসিকভাবেই। ঐতিহাসিক বিষয় ছাড়াও কলকাতায় সেসময়কার প্রচলিত প্রথা, আচার-অনুষ্ঠান নিয়েও লেখা হয়েছে এখানে। এর মধ্যে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য- খ্রিস্টান মিশনারিদের উপদ্রব, চড়কপুজো, বারোইয়ারি পুজো, দূর্গাপুজো, রামলীলা উৎসব। পুজোগুলোয় চাঁদা তোলা নিয়ে যে ঘটনাগুলো ঘটত, সেগুলো ইঙ্গিত করে সে যুগের মানুষজনের ধর্মীয় ভাবাবেগ। ছেলেধরা বা ঠগীদের নিয়ে কলকাতার জনমানুষের হুজোগপ্রিয়তাকেও লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন। গাঁজাখোর বা গেঁজেলদের ছদ্মবেশে ঘুরে বেরিয়ে ভিক্ষা করতে দেখা যায়, ভণ্ড ধর্মব্যবসায়ীদের মুখোশের আড়ালের মুখছবি দেখা যায়, আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া নব্য ধনিক শ্রেণির ‘খেমটা’ নাচে টাকা ওড়ানো দেখা যায় এ গ্রন্থে প্রণীত নকশাগুলোয়। মোগল বা নবাবি আমলে প্রচলিত বাঈজী নাচেরই যেন নব সংস্করণ ছিল ‘খেমটা’।
খেমটাগুলোতে টাকা ওড়ানোর মাত্রা দিয়ে ধনিকশ্রেণি পুরো শহরতলিতে জানান দিত তাদের অর্থাহংকার। গ্রাম থেকে শহরে আসা জমিদারের কেতাদুরস্তপনা দেখা যায় নকশায়। জমিদারবাবুরা মোসাহেব সাথে নিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে চেপে শহরে আসতেন প্রজার থেকে শোষণ করা অর্থ খরচ করার জন্য। তাদের মোসাহেবরা শহরে বাড়ি ভাড়া থেকে শুরু করে বাঈজী ঠিক করা সবকিছুর বন্দোবস্ত করত। আর বাবুর ট্যাকের পয়সা খসিয়ে নিজেদের ক্ষুদ্রপ্রাণ বাঁচাত। রমরমা জুয়োর আসরে ফতুর হয়ে কুলীন বংশীয় যুবকদের পতিতালয়মুখিতাও লক্ষ করা যায় এ নকশায়। সামন্ত সমাজ থেকে বের হওয়া অধিবাসীদের হঠাৎ আরেকটি নতুন সমাজের সাথে মিলেমিশে চলার বিপত্তি যে কতটা হাস্যকর হতে পারে, নকশাটি না পড়লে তা বোঝা যাবে না। অর্থনীতির অসঙ্গতির ফলে এক শ্রেণির প্রভাবশালী হয়ে ওঠা, অন্যদের ওপর শাসন কায়েম করা ইত্যাদি বিষয়গুলো নকশাতে সুগভীরভাবে ইঙ্গিত করা হয়েছে।
নকশায় নবগঠিত সমাজের উঁচুশ্রেণিকে লেখক তিনটি ভাগে ভাগ করে আমাদের সাথে পরিচিত করিয়েছেন।
লেখকের ভাষায় প্রথমটি হচ্ছে ‘সাহেবি ওল্ড’। এরা সবাই ইংরেজি জানে। এদের চালচলন, বেশভূষা পুরো ইংরেজদের মতো। ইংরেজদের এরা অন্ধভাবে অনুকরণ করতে ভালোবাসে। দ্বিতীয় শ্রেণিটি হচ্ছে, ইংরেজি শিক্ষিত নব্যপন্থী। এরা ইংরেজদের স্কুল-কলেজে পড়ে ইংরেজি শিখেছে, কিন্তু এখনো ধুতি-চাদর ছাড়তে পারেনি। এরা ইংরেজি শিখেছে পেটের দায়ে। ইংরেজ সরকারের কেরানি বা ডেপুটিগিরি করে এদের কেউ কেউ। আর তৃতীয় ভাগে রয়েছে ইংরেজি না জানা গোঁড়া হিন্দু। এরা সকালে উঠে স্নানাহ্নিক সেরে ঘর থেকে বের হয়। কঠোরভাবে জাতপাত মেনে চলে। এদের আড্ডার বিষয়বস্তু ধর্ম-কর্ম। ইংরেজ সরকারের প্রতি এদের কোনো ক্ষোভ নেই, যদি না সরকার বাহাদুরের কোনো আইন ধর্মের বিপক্ষে যায়।
এই তিনটি শ্রেণিই সেসময় পুরো কলকাতা দাপিয়ে বেড়াতো। সাধারণ মানুষ এদের শৃঙ্খল থেকে বের হতে পারেনি। এমন হয়েছে যে, কোনো বামুনের সন্তান হয়ত ইংরেজি পড়ে সাহেবি চালে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে।
‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’-র সফল হওয়ার আরেকটি কারণ ছিল এর ভাষাগুণ। প্রচলিত সাধু বা সংস্কৃতকে আশ্রয় করে এটি লেখা হয়নি। বরং, এটি লেখা হয়েছিল কলকাতার সাধারণ মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত ভাষায়। এর বর্ণনাভঙ্গি অনেকটা সাবলীল। এর জন্য অনেকে একে নিম্নস্তরের সাহিত্য বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। সেকালের প্রচলিত সমালোচনায় সাধারণত অশ্লীল বা কটু ভাষা ব্যবহারের রেওয়াজ দেখা গেলেও ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’-তে সেরকম তীব্রতা দেখা যায়নি।
সমালোচনা থাকলেও সেগুলো সীমা অতিক্রম করেনি। চলিত ভাষায় সাথে সাথে আর যে বিষয়টি লক্ষ করার মতো, সেটি এর শব্দগুলো। সেকালের কলকাতায় প্রচলিত অসংখ্য শব্দ এখানে লেখক ব্যবহার করেছেন নির্দ্বিধায়। শব্দগুলোই প্রমাণ দেয় যে, এ নকশা উঁচু-নিচু সবার মধ্যে কতটা প্রচলিত হয়েছিল। নকশাটিতে লেখক যে ভাষার প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন, সেটি পরে ‘হুতোমী ভাষা’ নামে প্রসিদ্ধ হয়।
কালীপ্রসন্ন সিংহের নকশার প্রথম প্রকাশের পর থেকেই হুমকি আসতে থাকে বিভিন্ন মহল থেকে। অনেক সমালোচনার তীরও এসে বেঁধে। ধর্মচ্যুত করারও হুমকিও আসে কতিপয় ধর্মীয় মহল থেকে। তবুও লেখক টলেননি এক বিন্দু। সামনাসামনি সমালোচনা করলেও গোপনে অনেক বড় বড় তর্কালঙ্কার কালীপ্রসন্ন সিংহকে সাধুবাদ জানান। মজার বিষয় হচ্ছে, কালীপ্রসন্ন সিংহ নিজেই ছিলেন জমিদার বংশের সন্তান। উত্তর কলকাতার জোঁড়াসাকোর বিখ্যাত সিংহ পরিবারে তার জন্ম হয়েছিল। জমিদার ঘরানায় জন্ম নেওয়ার জন্য কালীপ্রসন্ন সিংহ সমাজের এই অসঙ্গতিগুলো খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। আর সেগুলো লিখেছিলেনও দুঃসাহসিকভাবে।
মাত্র ঊনত্রিশ বছরের জীবনে কালীপ্রসন্ন সিংহ কয়েকটি নাটক রচনা ও অনুবাদ করেছিলেন। এগুলোর কয়েকটিতে তিনি নিজেও অভিনয় করতেন। কালীপ্রসন্ন সিংহ আরেকটি কাজের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। মহাভারতের বঙ্গানুবাদ। কালীপ্রসন্ন সিংহ ছিলেন বাংলা, ইংরেজি ও সংস্কৃত ভাষায় পারদর্শী। ব্যাসদেবের সংস্কৃত মহাভারতকে তিনি বাংলায় অনুবাদ করেন। আঠারো খণ্ডের এ গ্রন্থ তিনি বিনামূল্যে বিতরণ করেন। এর জন্য শেষ জীবনে তাকে প্রচণ্ড অর্থকষ্ট পোহাতে হয়েছে।
কালীপ্রসন্ন সিংহের রচিত ও অনুবাদিত সাহিত্যকর্মগুলোর মধ্যে ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ও স্বমহিমায় উজ্জ্বল। বইটির ইংরেজি অনুবাদ ‘স্কেচেস বাই অ্যা ওয়াচিং আউল’ নামে ২০০৮ সালে প্রকাশিত হয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার ‘সেই সময়’ উপন্যাসের অবয়ব তৈরি করেছিলেন এই নকশাকে আশ্রয় করেই।
হুতোম প্যাঁচার নকশা বইটি কিনতে ভিজিট করুন রকমারিতে।