নু মং এক নির্ভীক তরুণ পাহাড়ী অধিবাসীর নাম। নিশুতি রাতের আঁধারে গা শিরশির করা অনুভূতি নিয়ে সে এগিয়ে যায় গভীর জঙ্গল থেকে ভেসে আসা অমানুষিক এক চিৎকারের রহস্যভেদ করতে। তার এই সাহসী পদক্ষেপের পরিণতি জানতে হলে যেতে হবে সেই গহীনে। আঁধার রাতের সেই অমানবিক চিৎকারে ভয় পেলে চলবে না মোটেও। কেননা, এখানেই রোমাঞ্চকর এক কাহিনীর শুরু।
ভারত সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের খোঁড়াখুঁড়িতে প্রায় আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন এক লিপি মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতেই কিছু মানুষ ব্যস্ত হয়ে পড়ল এর প্রায়োগিক দিক নিয়ে। প্রাচীন ভারতীয় অর্থনীতিবিদ, দার্শনিক ও রাজ-উপদেষ্টা পণ্ডিত চাণক্যের মস্তিষ্কপ্রসূত সেই গোপন বিদ্যার বাস্তবিক রূপ দিতে সম্রাট অশোকের মতো ব্যক্তিত্ব পর্যন্ত মরিয়া হয়ে পড়েছিলেন।
ইতিহাসনির্ভর এই গল্পে বুঁদ হয়ে থাকলে চলবে না, এগিয়ে চলুন তৃতীয় মৌর্য সম্রাটের সঙ্গী হয়ে। অ্যাডভেঞ্চারের গল্পটি খুঁজে পাবেন শখের পর্যটক দুই বন্ধু সাকিব আর অয়নকে ঘিরে। একসময় কিশোরদ্বয়ের সাথে দেখা হয় বিশ্বখ্যাত অভিযাত্রী শাহরিয়ার সুলতানের, যিনি বিশেষ একটি উদ্দেশ্যে ঐ ভীষণ অরণ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
ওৎ পেতে থাকা বিপদের সম্মুখীন হয়েই অর্জুন বুঝতে পারে, বাংলাদেশে আসা একটা ভুল সিন্ধান্ত ছিল। অন্যদিকে, ভারতীয় আর্মি ইন্টেলিজেন্সের প্রবল নজরদারি সেঁটে আছে বাংলাদেশ ও মায়ানমারের সীমান্তঘেঁষা গহীন বনাঞ্চলে। এখানেই কোথাও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে অত্যন্ত দক্ষ দুই পাগলাটে বুড়ো ফ্যান্টাসি আর বাস্তবতার নিখাদ সমীকরণ ভুল প্রমাণিত করতে যাচ্ছেন।
নিষ্ঠুর ক্ষমতালোভী আন্তর্জাতিক এক কর্পোরেশনের চক্রান্ত রুখে দিতে বর্তমান আর অতীতের স্থবির সময়কে সাময়িক বিরতি দিয়ে চলুন, দুঃসাহসের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিই! শেষে যদি মনে হয় ঠকে গিয়েছি, তাতে কি? একটা অ্যাডভেঞ্চার তো অন্তত!
এই সময়ের জনপ্রিয় থ্রিলার লেখক শরিফুল হাসান, মাশুদুল হক, রবিন জামান খান; এদের সবার উপন্যাসেই ইতিহাসনির্ভর তথ্যের মিশেল লক্ষ্যণীয়। ইতিহাস ভালো লাগে আমার। আর সেই ইঙ্গিত পেয়েই ঋভু’র মাধ্যমে শরিফুল হাসানের লেখার সাথে পরিচিত হই। মূলত থ্রিলার ঘরানার হলেও এতে বিজ্ঞান, ফ্যান্টাসি আর অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ রয়েছে পুরোদমে; ইতিহাস তো আছেই।
থ্রিলারের শুরু সাধারণত একটা রহস্যাবৃত চটকদার ঘটনা দিয়ে হয়। ‘ঋভু’ এমন তিনটি ঘটনা নিয়ে ব্যতিক্রমভাবে শুরু হয়েছে। সেই ঘটনাগুলো পাঠককে এমনভাবে আগ্রহী করে তুলবে যে, বাকি পথটুকু লেখকের সাজানো তালে এমনিতেই তাল মিলাবেন। নানান ঘটনার মোড় ঘুরে কখনো দ্রুত, কখনো ধীরগতিতে এগিয়েছে গল্প। পাঠককে কাহিনীর ভিতর নিয়ে গেছেন ভিন্ন ভিন্ন দু’টি সময়ের হাত ধরে। টুইস্ট আর সাসপেন্সে ভরপুর খণ্ড খণ্ড ঘটনার মধ্য দিয়ে রহস্যময় ধোঁয়াশা কেটে পুরো গল্পটি স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়েছে।
নজর কেড়েছে গল্পের চরিত্রগুলির রূপায়ন। ব্যক্তিকেন্দ্রিক না হয়ে দলবদ্ধভাবে কাহিনীর চরিত্রগুলোর রূপায়ন ঘটেছে। সেই সূত্রে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে দুলেছে চরিত্রগুলো। কখন, কোথায় বিপদ থাবা উঁচিয়ে আছে, বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। এর মধ্যেই সবাইকে একে অন্যের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে, ঝুঁকিপূর্ণ অনিশ্চিত পথে একাকী চলা অসম্ভব! লেখক খুবই দক্ষতার সাথে পণ্ডিত চানক্য ও সম্রাট অশোকের দুর্দান্ত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যাবলী ফুটিয়ে তুলেছেন। গভীর বনে পথ হারানো দুই বন্ধু, ঢাকায় প্রথম পা রাখা অর্জুন, বিখ্যাত পর্যটক শাহরিয়ার সুলতান, এরা সকলেই নিজ বিশেষত্বের গুণে উপন্যাসকে সুপাঠ্য করে তুলেছে। এছাড়া পার্শ্ব চরিত্রগুলিও ফুটে উঠেছে গল্পের সাথে যথাযথ তাল মিলিয়ে।
এবার আসা যাক নাজুক কিছু ব্যাপারে। বাতিঘর প্রকাশনী সবসময়ই আমাকে বানান-বিভ্রাটে ফেলেছে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। চীনের দুঃখ হোয়াংহো, কুমিল্লার দুঃখ গোমতি, আর আমার দুঃখ বাতিঘরের প্রুফ রিডিং! সাধারণ কিছু বানানের ভুল মেনে নেওয়া কষ্টকর। যেমন; ক্ষণ, সাক্ষাৎ, সূর্য, বর্ণ, মুহূর্ত। আমি ব্যাকরণবিদ নই, এ ব্যাপারে জ্ঞানটাও যৎকিঞ্চিত। তবে আলোচ্য উপন্যাসে ণ-ত্ব বানান রীতি যে অনুসরণ করা হয়নি, এই কথা বলতে পারি। যুক্তাক্ষর আলাদা হয়ে যাওয়া বা দু’টি শব্দ একসাথে হয়ে যাওয়ার মতো প্রিন্টিং মিসটেক মেনে নেওয়া যায়। তবে একই ব্যক্তির নামের ভিন্নতা স্পষ্টতই প্রুফ রিডিংয়ের সমস্যা। অতিরিক্ত ভুল বানানে ক্ষতি কিন্তু পাঠকেরই বেশি। সুখপাঠ্য হয়ে উঠার ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলি অন্তরায় হয়ে ওঠে।
উপন্যাসের আন্ডারগ্রাউন্ড কর্পোরেশনের নামটি ২০০২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত জনপ্রিয় মুভি সিরিজ ‘Resident Evil’-এর ‘Umbrella Corporation’ থেকে হুবহু নেওয়া বলে মনে হলো। সেখানেও কাল্পনিক জেনেটিক রিসার্চ নিয়ে কাজ করে কর্পোরেশনটি। ব্যক্তিগতভাবে এটা ভালো লাগেনি। ইতোমধ্যে প্রচারিত নামটির বদলে ভিন্নধর্মী একটি নাম গৃহীত হলেই ভালো হতো।
প্রচ্ছদের কথা না বললেই নয়। কাহিনীর মূল বিষয়বস্তুর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এমন প্রচ্ছদ খুব কম দেখা যায়। ধন্যবাদ প্রচ্ছদশিল্পীকে তার চমৎকার কাজের জন্য।
সবশেষে বলতে চাই, লেখক প্রাচীন ভারতের একটি বিষয়কে রহস্যমণ্ডিত করে বর্তমানের সাথে মিলিয়ে অত্যন্ত নৈপুণ্যের সাথে ফুটিয়ে তুলেছেন। বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে ফ্যান্টাসির আদলে ইতিহাসকে কেন্দ্র করে অ্যাডভেঞ্চারপূর্ণ, রোমাঞ্চকর এই উপাখ্যানের অবতারণা সহজ ছিল না। লেখক তার মুন্সিয়ানা দিয়ে সেই কঠিন কাজ সম্ভব করেছেন।