“হে মহাসম্মানিত শিক্ষক, ভারত পৃথিবীর চাকতির প্রান্তের কাছাকাছি অবস্থিত এবং ঊষর ও অনাবিষ্কৃত মরুভূমি দ্বারা এই প্রান্ত থেকে বিচ্ছিন্ন, কারণ পূর্বে কোনো পশুপাখি বসবাস করে না। ভারত একটি খুবই ধনী দেশ এবং এর সম্পদ নিহিত এর স্বর্ণের মধ্যে। অন্যান্য দেশের মতো সেখানে এটি মাটি খুঁড়ে বের করা হয় না, বরং স্বর্ণবাহক ও কুকুরের সমান আকৃতিবিশিষ্ট এক প্রজাতির অক্লান্ত পিঁপড়া দিনরাত এই স্বর্ণ উৎপাদন করে… ভারতের উত্তরে এবং পশ্চিমে রয়েছে টাক লোকেদের দেশ। এই দেশের নারী–পুরুষ ও এমনকি শিশুরাও টাক। এই অদ্ভুত জাতি কাঁচা মাছ ও পাইন গাছের ফল খেয়ে বাঁচে। তাদের আরো কাছে একটি দেশ রয়েছে যেখানে না কিছু দেখা যায় আর না যাওয়া যায়, কারণ এটি একেবারে উপর পর্যন্ত পালক দিয়ে ভর্তি। সেখানকার মাটি ও বাতাস পালকে ভর্তি, এজন্য সেদেশে কিছু দেখতে পাওয়া যায় না।”
ধরুন, আপনি একজন ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। ভূগোল বিষয়ে মৌখিক পরীক্ষা দিচ্ছেন। আপনাকে প্রশ্ন করা হলো, ভারত সম্পর্কে আপনি কী জানেন? উত্তরে আপনি উপরে বর্ণিত বাক্যগুচ্ছ সুন্দরভাবে শিক্ষকদের সামনে বলে দিলেন। কী ভাবছেন? পরীক্ষার সময় কেউ এরকম উদ্ভট বক্তব্য দিতে পারে না? তাই যদি ভেবে থাকেন, তাহলে জেনে রাখুন, তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র ভ্লাদিমির কোস্তিলকভ ভারতের সম্পর্কে এই উত্তরটিই দিয়েছিল তার মৌখিক পরীক্ষার সময়। অবশ্য ঠিক বাস্তবে না, বিখ্যাত সোভিয়েত শিশুতোষ লেখক লাজার লাগিন কর্তৃক রচিত এবং ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত ‘স্তারিক হোত্তাবিচ’ বইয়ে!
১৩ বছর বয়সী ভ্লাদিমির কোস্তিলকভ (ডাক নাম ‘ভোলকা’) মস্কোর একটি স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী। বাবা–মা আর দাদীর সঙ্গে সবে একটি নতুন অ্যাপার্টমেন্টে উঠেছে। মস্কভা নদীতে গোসল করতে গিয়ে সে মাটির তৈরি একটি অদ্ভুত কারুকার্যখচিত জগ আকৃতির পাত্র খুঁজে পায়। পাত্রটির ব্যাপক প্রত্নতাত্ত্বিক মূল্য থাকতে পারে, এই ভেবে সে পাত্রটিকে বাড়িতে নিয়ে যায়। নিজের কক্ষে গিয়ে সে পাত্রটির সিল খুলে ফেলে। সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে আসে একরাশ ধোঁয়ার কুণ্ডলী, আর তার মধ্য থেকে আবির্ভাব হয় এক মহাশক্তিশালী জ্বিনের, যার নাম হাসান আব্দুররহমান ইবন হোত্তাব!
হাসান আব্দুররহমান ইবন হোত্তাব, বা রুশ ভাষার নিয়ম অনুসারে, হাসান আব্দুররহমান হোত্তাবিচ, ৩,৭৩২ বছর বয়সী এক অতি প্রাচীন এবং অত্যন্ত ক্ষমতাধর জ্বিন। কয়েক হাজার বছর আগে সে এবং তার ভাই ওমর আসাফ হোত্তাবিচ বাদশাহ সুলাইমান (আ.)–এর নির্দেশ মানতে অমান্য করেছিল, তাই বাদশাহ শাস্তি হিসেবে তাদেরকে দুটি পৃথক পাত্রে ভরে সেগুলো মোহরাঙ্কিত করে সমুদ্রে নিক্ষেও করেছিলেন। ভোলকা নিজের অজান্তে তাকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে দিয়েছে।
হোত্তাবিচ তাকে মুক্তি দেয়ার জন্য ভোলকাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে এবং কৃতজ্ঞতার নিদর্শনস্বরূপ তার সকল নির্দেশ মেনে চলার অঙ্গীকার করে। বিস্মিত ভোলকার অবশ্য প্রথমে হোত্তাবিচকে জ্বিন হিসেবে মানতেই কষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু হোত্তাবিচের অলৌকিক জাদুকরী ক্ষমতা দেখে সে নিশ্চিত হয় যে, হোত্তাবিচ আসলেই জ্বিন! সেদিন ভোলকার ভূগোলের পরীক্ষা ছিল, কিন্তু ভোলকার প্রস্তুতি ভালো ছিল না। এজন্য সে চিন্তিত ছিল। হোত্তাবিচ তাকে এই বলে আশ্বস্ত করে যে, ভূগোল সম্পর্কে জ্বিনদের মধ্যে তার মতো জ্ঞানী আর কেউ নেই এবং সে ভোলকাকে পরীক্ষার সময় সহায়তা করবে। আর ভোলকার শিক্ষকরা যদি তাকে ভালো নম্বর না দেয়, তাহলে সে তাদেরকে ব্যাঙ বানিয়ে দেবে!
যথারীতি ভূগোল পরীক্ষার সময় ভোলকাকে জিজ্ঞাসা করা হয় ভারত সম্পর্কে। ভারতের বিষয়ে ভোলকা অনেক কিছুই জানত, কিন্তু হোত্তাবিচ তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ভারত সম্পর্কে তার মতো করে বলে যেতে থাকে, আর ভোলকা অনিচ্ছা সত্ত্বেও জাদুর বশবর্তী হয়ে হোত্তাবিচের বলা বাক্যগুলোই উচ্চারণ করতে থাকে। উপরে বর্ণিত ভারত সম্পর্কিত বাক্যগুলো হোত্তাবিচেরই বলা। ভোলকার উত্তর শুনে পরীক্ষকরা হতবাক হয়ে যান। তারা ভোলকাকে বলেন যে, সে ভারত সম্পর্কে যা বলছে, সেগুলো ভারত সম্পর্কে প্রাচীন কালের মানুষের ধারণা। কিন্তু ভোলকার কণ্ঠে হোত্তাবিচ দাবি করে, এটিই একমাত্র সঠিক বিজ্ঞান।
ভোলকার পরীক্ষকরা অবশ্য হোত্তাবিচের সম্পর্কে কিছু জানতেন না। তাদের ধারণা হয়, পরীক্ষার আগে অতিরিক্ত পড়াশোনার চাপের কারণে ভোলকা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এজন্য ভোলকার শ্রেণিশিক্ষিকা বার্বারা স্তেপানোভা ভোলকাকে স্কুলের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। ডাক্তার পরীক্ষা করে জানান যে, ভোলকার কোনো অসুখ নেই, কিন্তু তার বিশ্রাম নেয়া উচিত। স্তেপানোভা ভোলকাকে জানান, সে পরবর্তীতে আবার পরীক্ষা দিতে পারবে।
হোত্তাবিচ অবশ্য বুঝতেই পারেনি যে, সে নিজের অজান্তে ভোলকাকে পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দিয়েছে। ভোলকাও তাকে এই বিষয়ে কিচ্ছু বলেনি, কারণ তার ভয় ছিল, সে ফেল করেছে জানতে পারলে হোত্তাবিচ সত্যি সত্যিই তার প্রিয় শিক্ষকদের ব্যাঙ বানিয়ে দেবে! ভোলকার পরিবারের সদস্যরা হোত্তাবিচ সম্পর্কে কিছু জানে না, কিন্তু বাইরের মানুষের কাছে ভোলকা হোত্তাবিচকে পরিচয় করিয়ে দেয় তাসখন্দ থেকে আসা তার বাবার বন্ধু হিসেবে।
এরকমভাবে আবর্তিত হতে থাকে ভোলকা আর হোত্তাবিচের কাহিনী। হোত্তাবিচ সব সময়ই ভোলকাকে খুশি করার জন্য বিভিন্ন কিছু করতে যায়, কিন্তু তার প্রচেষ্টা প্রায়শই ব্যর্থ হয়, কারণ বিশ্ব সম্পর্কে তার ধারণা অনেক পুরনো। আধুনিক বিশ্ব সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই নেই। এর ফলে কখনো সে ভোলকাকে এমন একটি স্বর্ণের ঘড়ি উপহার দেয়, যেটির ভেতরে কোনো যন্ত্রপাতি নেই (ফলে সেটি অচল); কখনো বা সে ভোলকাকে বিরাট এক পণ্যের কাফেলা উপহার দেয়, যেটিকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বড় হওয়া ভোলকা ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে গ্রহণ করতে ইচ্ছুক নয়; আবার কখনো সে ভোলকার সঙ্গে ঝগড়া করার শাস্তি হিসেবে তার বন্ধু ঝেনিয়াকে ভারতে পাঠিয়ে দেয় (কিন্তু শাস্তি হিসেবে না নিয়ে ঝেনিয়া উল্টো তার ভারত ভ্রমণ উপভোগ করে)!
হোত্তাবিচ কখনো কখনো খুবই রাগী, দাম্ভিক ও চতুরের মতো আচরণ করে, কিন্তু মূলত সে খুবই দয়ালু এবং ভোলকার প্রতি খুবই যত্নশীল। এজন্য ভোলকা ও হোত্তাবিচের মধ্যে এক ধরনের বন্ধনের সৃষ্টি হয়। ভোলকা অনুধাবন করতে পারে যে, হোত্তাবিচের আধুনিক বিশ্ব সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। এজন্য সে ঝেনিয়ার সহায়তায় হোত্তাবিচকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে শুরু করে!
সোভিয়েত শিশুতোষ লেখক লাজার লাগিন (যার প্রকৃত নাম লাজার গিঞ্জবুর্গ) কর্তৃক রচিত বইগুলোর মধ্যে ‘স্তারিক হোত্তাবিচ’ সবচেয়ে বেশি পরিচিতি অর্জন করেছে। রুশ ভাষায় ‘স্তারিক হোত্তাবিচ’ শব্দগুচ্ছের অর্থ ‘বৃদ্ধ হোত্তাবিচ’। ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত এই শিশুতোষ বইটি সোভিয়েত ইউনিয়নে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। সোভিয়েত আমলে দেশটিতে যে অসাধারণ শিশুতোষ বইগুলো রচিত হয়েছিল, তারই মধ্যে একটি হচ্ছে এই বইটি।
লাগিনের ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি এই গল্পটি লেখার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন মধ্যপ্রাচ্যের রূপকথা সংকলন ‘আলিফ লায়লা ওয়া–লায়লা’র (সংক্ষেপে ‘আরব্য রজনী’ বা ‘আলিফ লায়লা’) একটি গল্প থেকে। আলিফ লায়লার উক্ত গল্পটিতে এক জেলে মাছ ধরার সময় তার জালে একটি সিলমোহরযুক্ত পাত্র উঠেছিল এবং সেই পাত্র বন্দি ছিল এক ভয়ঙ্কর জ্বিন। এই বিষয়টিকে পটভূমি হিসেবে ব্যবহার করে লাগিন অবতারণা করেছেন একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের রূপকথার, যেমনটির অস্তিত্ব অতীতে তো দূরে থাকুক, বর্তমানেও বিরল।
লাগিনের গল্পের জ্বিন হোত্তাবিচ কখনো কখনো আলিফ লায়লার অধিকাংশ জ্বিনের মতোই অহঙ্কারী, ক্রোধযুক্ত এবং সুচতুর, কিন্তু তার মধ্যে লাগিন সঞ্চার করেছেন মানবীয় গুণাবলির। আলিফ লায়লার জ্বিনগুলো যেরকম চাইলেই পরিস্থিতির কর্তৃত্ব সম্পূর্ণরূপে নিজেদের হাতে নিয়ে নিতে পারে, লাগিনের গল্পে তেমনটি ঘটে না। অবশ্য আলিফ লায়লার জ্বিনগুলো তাদের ক্ষমতা প্রদর্শন করে হাজার বছর আগের পৃথিবীতে, যখন বিজ্ঞানের অগ্রগতি হয়েছিল সামান্যই। এদিকে হোত্তাবিচ খুবই ক্ষমতাবান জ্বিন, কিন্তু আধুনিক বিশ্ব সম্পর্কে ধারণা একেবারেই না থাকার কারণে তার জাদুর ফলাফল প্রায়ই অপ্রত্যাশিত হয়। কখনো কখনো তার জাদুকে কেউ জাদু বলে বিশ্বাসই করে না, বরং সম্মোহন হিসেবে আখ্যায়িত করে!
বস্তুত ‘স্তারিক হোত্তাবিচ’ বইয়ে লাগিন সৃষ্টি করেছেন এমন এক বিশ্বের, যেখানে হোত্তাবিচকে তার জাদু প্রয়োগ করতে হচ্ছে আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক এক সমাজে। শেষ পর্যন্ত হোত্তাবিচ নিজেই বুঝতে পেরেছে যে, আধুনিক যুগে টিকে থাকার জন্য তাকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে! অর্থাৎ লাগিন তার গল্পে জ্বিন হোত্তাবিচকে দিয়ে মানুষের শিক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন! এর উদ্দেশ্য হচ্ছে – যে শিশুদের উদ্দেশ্যে এই বই লেখা, তাদের মধ্যে যেন এই বোধ জাগ্রত হয় যে, জাগতিক সমস্যার কোনো জাদুকরী সমাধান নেই এবং বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষাই কেবল আধুনিক সমস্যাগুলোর কার্যকর সমাধান দিতে পারে। সোভিয়েত আমলে নতুন প্রজন্মকে আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক করে গড়ে তোলার যে সরকারি নীতি ছিল, সেটিই এই গল্পে চিত্রায়িত হয়েছে।
গল্পে হোত্তাবিচ ভোলকাকে রাজকীয় প্রাসাদ এবং বিপুল মূল্যবান পণ্যদ্রব্যের কাফেলাসহ নানা ধরনের মূল্যবান উপহার দিতে চায়। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বেড়ে ওঠা ভোলকার ব্যক্তিগত সম্পত্তির কোনো লোভ নেই। সে প্রাসাদটি দিয়ে দিতে চায় সোভিয়েত শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে, কাফেলার পণ্যদ্রব্য দিয়ে দিতে চায় খাদ্য ও অন্যান্য মন্ত্রণালয়কে আর পণ্যবাহী পশুগুলোকে পাঠিয়ে দিতে চায় চিড়িয়াখানায়। কিন্তু এই ক্ষেত্রে বাধা দেয় হোত্তাবিচ। সে তার জাদুর ফলে সৃষ্ট সম্পদ ভোলকাকে দিতে খুবই আগ্রহী, কিন্তু অন্য কাউকে দিতে আগ্রহী নয়। তার এই মানসিকতায় প্রতিফলন ঘটেছে পুঁজিবাদী চিন্তাধারার, যা ভোলকার সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা বিপরীত।
এর মধ্যেও একটি প্রতীকী বার্তা রয়েছে। হোত্তাবিচ অতি প্রাচীন জ্বিন এবং তার চিন্তাধারা ও বিশ্বধারণা সেকেলে। অন্যদিকে ভোলকা একজন কমবয়সী কিশোর এবং সে গড়ে উঠেছে আধুনিক মনমানসিকতা নিয়ে। এই অবস্থায় হোত্তাবিচের মধ্যে পুঁজিবাদী এবং ভোলকার মধ্যে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার প্রকাশ ঘটিয়ে লেখক বুঝিয়েছেন, পুঁজিবাদ সেকেলে ও অতীতের নিদর্শন, আর সমাজতন্ত্র আধুনিক ও ভবিষ্যতের পথ! একটি শিশুতোষ গল্পের মাধ্যমেও যে সূক্ষ্মভাবে রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রচার ঘটানো যেতে পারে, স্তারিক হোত্তাবিচ তার উৎকৃষ্ট নমুনা।
সর্বোপরি, বইটিতে প্রাচ্য (Orient) সম্পর্কে খুবই ইতিবাচক একটি দৃষ্টিভঙ্গি রূপায়িত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রাচ্য (ককেশাস ও মধ্য এশিয়া) এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের বাইরের প্রাচ্য উভয়ই অন্তর্ভুক্ত। ভোলকা হোত্তাবিচকে পরিচয় করিয়ে দেয় উজবেকিস্তানের তাসখন্দ থেকে আসা একজন পারিবারিক বন্ধু হিসেবে। ভোলকা, ঝেনিয়া আর হোত্তাবিচ যখন জাদু গালিচা (magic carpet) থেকে পড়ে সোচিতে পতিত হয়, সেখানে একজন আজারবাইজানি প্রকৌশলী তাদের সর্বতোভাবে সহায়তা করে। বইটিতে ভারত ও পাকিস্তানের জনসাধারণকে বর্ণনা করা হয়েছে ‘খুবই দয়ালু ও বন্ধুত্বপূর্ণ’ হিসেবে। কার্যত হোত্তাবিচ যখন ঝেনিয়াকে ভারতে নির্বাসনে পাঠিয়েছিল, তখন ভারতীয়রা তাকে খুবই সমাদর করে এবং ‘হিন্দি–রুশি ভাই ভাই’ স্লোগান দিয়ে স্বাগত জানায়!
স্তারিক হোত্তাবিচ বইটি প্রকাশিত হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেরও আগে। সেসময় পশ্চিমা বিশ্বে সাধারণভাবে প্রাচ্যকে বিবেচনা করা হতো ‘অসভ্য’, ‘সংস্কৃতিহীন’ ও ‘বর্বর’ হিসেবে এবং তাদের বইপত্রেও প্রাচ্যের সেই ধরনের একটি ভাবমূর্তিই ফুটিয়ে তোলা হতো। এই সময়ে লাগিনের বইয়ে প্রাচ্য সম্পর্কে যে ইতিবাচক বর্ণনা প্রদান করা হয়েছে, সেটি নজর কাড়ার মতো। বস্তুত সোভিয়েত সরকার সেসময় সোভিয়েত প্রাচ্যকে সম্পূর্ণভাবে সোভিয়েত রাষ্ট্রের সঙ্গে অঙ্গীভূত করে নেয়ার প্রক্রিয়া চালাচ্ছিল। এর অংশ হিসেবে সোভিয়েত প্রাচ্যের অধিবাসীরা যাতে নিজেদেরকে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যান্য জাতির মতোই সমমর্যাদাসম্পন্ন নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করে এবং অন্যান্য জাতিও জাতে সেই ধারণায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে, এর ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল। একই সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রাচ্যে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছিল এবং এজন্য তাদেরকে সোভিয়েত জনসাধারণের মিত্র হিসেবে উপস্থাপন করা হতো। এজন্যই সেসময় দেশটিতে প্রকাশিত অন্যান্য বইয়ের মতো লাগিনের বইয়েও প্রাচ্যপ্রীতির নিদর্শন লক্ষণীয়।
অবশ্য এক হিসেবে ‘স্তারিক হোত্তাবিচ’ বইটিকেই প্রাচ্যপ্রীতির নিদর্শন হিসেবে বর্ণনা করা যায়, কারণ গল্পের নাম চরিত্র হোত্তাবিচ উদ্ভূত হয়েছেই মধ্যপ্রাচ্যে সৃষ্ট ‘আরব্য রজনী’ থেকে। এদিক থেকে ‘স্তারিক হোত্তাবিচ’কে আরব্য রজনীর ১,০০১টি গল্পের সংকলনে একটি নতুন সোভিয়েত সংযোজন হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। একই সঙ্গে বিনোদনমূলক ও শিক্ষণীয় শিশুতোষ গল্প হিসেবে ‘স্তারিক হোত্তাবিচে’র জুড়ে মেলা ভার। এজন্য বর্তমানে রুশ শিক্ষা মন্ত্রণালয় দেশটির প্রতিটি স্কুলের গ্রন্থাগারে এই বইটি রাখার জন্য নির্দেশ দিয়েছে।
বইয়ের নাম: স্তারিক হোত্তাবিচ
লেখকের নাম: লাজার লাগিন
মূল ভাষা: রুশ
প্রকাশক: ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ পাবলিশিং হাউজ, মস্কো
প্রকাশকাল: ১৯৩৮ (১ম সংস্করণ)