একটুকরো কাচের এক পৃষ্ঠে ধাতুর প্রলেপ দিলেই অপর পৃষ্ঠ স্বচ্ছ আয়নাতে পরিণত হয়। দৃষ্টিশক্তি আছে অথচ আয়নার ব্যবহার করেনি- সভ্য পৃথিবীতে এমন একজন মানুষও খুঁজে পাওয়া যাবে না। আয়নার সামনে কোনো বস্তু রাখলেই প্রতিফলক পৃষ্ঠে পরিষ্কারভাবে সেটির অবয়ব ফুটে ওঠে। তবে কাচ, ধাতু এসব ছাড়াও কিন্তু আরেক প্রকারের আয়না তৈরি করা যায়!। সেই আয়নার প্রতিবিম্ব চোখে দেখা যায় না, এটি মস্তিষ্কে ছবি তৈরি করে যা অনুভব করতে হয়। অদ্ভুত না ব্যাপারটা?
আচ্ছা, একটু বুঝিয়ে বলা যাক। এই আয়নাটি তৈরি হয় সাদা কাগজের উপর প্রিন্টিং মেশিন কিংবা কলমের কালিতে লেখা কতগুলো শব্দগুচ্ছের সমন্বয়ে। আর এই কাজটি যারা করেন তাদেরকে আমরা লেখক বলি। একজন লেখক বিভিন্ন রকম আয়না তৈরি করতে পারেন, যে আয়নাগুলোতে কখনো বর্তমান, কখনো অতীত আবার কখনো লেখকের কল্পনার প্রতিবিম্ব ফুটে ওঠে।
আজকের লেখায় বলা হচ্ছে এমনই একটি আয়নার কথা, যার নাম ‘সানজাক-ই উসমান’। প্রিন্স মুহাম্মাদ সজল এর লেখা একটি ইতিহাস নির্ভর গ্রন্থ। বইটিকে টাইম ট্রাভেল মেশিনও বলা যায়। কারণ আপনি যখন সানজাক-ই উসমান পড়তে বসবেন, নিঃসন্দেহে এটি আপনাকে হাজার বছর আগের এক দুনিয়াতে নিয়ে যাবে। চোখের সামনে ফুটে উঠবে ইতিহাসের বিখ্যাত বীর যোদ্ধাদের রুদ্রমূর্তি। কান পাতলেই শুনতে পাবেন দুর্ধর্ষ মোঙ্গল বাহিনীর ঘোড়ার খুড়ের আওয়াজ কিংবা সুলতান বায়জিদের মতো মহাবীরদের তরবারির ঝংকার।
‘সানজাক-ই উসমান’ বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৬ এপ্রিল ২০১৮ সালে। একই বছর ২২ ডিসেম্বর বইটির তৃতীয় মুদ্রণ বাজারে আসে। বইটির লেখক প্রিন্স মুহাম্মাদ সজল পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইন্সটিটিউটে। যদিও তার প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা বিজ্ঞান বিষয়ে, এরপরও তিনি সমসাময়িক আন্তর্জাতিক রাজনীতি, ইতিহাস ও ভূগোলের দক্ষ একজন বিশ্লেষক।
সাধারণত ইতিহাসনির্ভর বই পড়ার সময় অতিরিক্ত তথ্যের সমাবেশ পাঠকের বিরক্তির কারণ হয়। কিন্তু এই বইয়ের ক্ষেত্রে লেখক দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন বলতে হবে। সানজাক-ই উসমানে অজস্র তথ্য থাকলেও সেগুলো উপস্থাপন করা হয়েছে অত্যন্ত চমকপ্রদভাবে। ফলে এটি যেমন একটি গবেষণাধর্মী বই, তেমনি পাঠকের মনোরঞ্জন করার উদ্দেশ্যেও সফল।
কী আছে সানজাক-ই উসমানে?
সানজাক-ই উসমান শব্দের বাংলা অর্থ উসমানীয়দের পতাকা। বইটি যে একটি উসমানীয় প্যাকেজ, তা নিশ্চয়ই নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে। তবে এখানে শুধু তাদের ইতিহাসই নয়, বরং ৭টি অধ্যায় জুড়ে বর্ণনা করা হয়েছে সেসময়কার ভূ-রাজনীতিসহ সভ্যতার উত্থান-পতনের সুনির্দিষ্ট কারণসমূহ।
বর্ণনার খাতিরে ৪২৯ পৃষ্ঠার এই বইটিকে ৩টি ভাগে বিভক্ত করা যায়।
১
আরব্য রজনীর হাজার রাতের গল্পগুলোর কথা জানেন নিশ্চয়ই, যা তৎকালীন পৃথিবীর বাগদাদ শহর কেন্দ্র করে রচিত হয়েছিল। যে গল্পগুলো পড়তে গেলে হয়তো আজও আমরা স্বপ্নের শহর বাগদাদের কথা মনে করে হাপিত্যেশ করি।
সত্যিকার অর্থে গল্পের মতোই বাগদাদ ছিল সেসময়কার স্বপ্নের শহর। আব্বাসীয় শাসকরা তাদের রাজধানী সাজিয়েছিলেন সেভাবেই। উমাইয়া শাসকদের হটিয়ে আব্বাসীয়রা ক্ষমতায় বসেন, কিন্তু সভ্যতার উত্থান-পতনের ধারাবাহিকতায় তাদেরও পতন হয়।
১১৬২ সালে মধ্য এশিয়ার এক মোঙ্গল গোত্রে জন্ম হয় চেঙ্গিস খানের। বাল্যকালে তার বাবা খুন হয় দুই গোত্রের সমস্যার জের ধরে। এরপর জীবনের অর্ধেকেরও বেশি সময় বনে-জঙ্গলে পালিয়ে বেড়াতে হয় তাকে। এ সময়টায় নির্যাতিতও হয়েছেন অনেক। এমনকি চোখের সামনে সৎ ভাইয়ের কাছে নিজের মাকে ধর্ষিত হতে দেখেছেন। বলা যায়, ৪০ বছর বয়স অব্দি কোনো রকম টিকে থাকার সংগ্রাম করেই পার করেছেন। কিন্তু যে ব্যক্তি বিশ্ব শাসন করার ভাগ্য নিয়ে জন্মেছে, তাকে কি আর দমিয়ে রাখা যায়!
নানা প্রতিকূলতার মধ্যেই চেঙ্গিস খান গড়ে তোলেন নিজের একটি যোদ্ধা দল। ধীরে ধীরে সংগঠিত করেন ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মোঙ্গল গোত্রগুলোকে। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। শুরু হয় একের পর এক বিজয়াভিযান আর অমানবিক বর্বরতা।
চেঙ্গিস খানের বিজয় ধারা বজায় রাখে তার পরবর্তী প্রজন্ম। মধ্য এশিয়া ছেড়ে পুরো অর্ধেক পৃথিবীতে মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়ে তারা। মোঙ্গল বাহিনীর বর্বরতা এতটাই ভয়াবহ ছিল যে সেসময় মুসলিম বিশ্বের অনেক মানুষের ধারণা ছিল মোঙ্গলরা কোরআনে বর্ণিত সেই বর্বর ইয়াজুজ-মাজুজ জাতি।
মোঙ্গলরা কোনো একটি শহরে আক্রমণের পর হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠতো। মানুষের মাথার খুলি দিয়ে পিরামিড না সাজালে তাদের বিজয়োল্লাস যেন পূর্ণই হতো না। এমনকি আত্মসমর্পণ করেও রক্ষা পাওয়া যেত না তাদের হাত থেকে।
মোঙ্গল নামের যে দুর্যোগ পুরো পৃথিবীকেই গ্রাস করে নিচ্ছিল, তা থেকে রক্ষা পায়নি আব্বাসীয় খিলাফতও। চেঙ্গিস খানের নাতি হালাকু খানের বর্বরোচিত হামলায় পতন হয় স্বপ্নের শহর বাগদাদ তথা আব্বাসীয় শাসনের।
সানজাক-ই উসমানের প্রথমাংশে ফুটে উঠেছে মোঙ্গল ইতিহাসের সেই ভয়ংকর চিত্র।
২
আব্বাসীয় খিলাফতের সাথে মোঙ্গল বাহিনী প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দেয় পাঁচশো বছরের মুসলিম সভ্যতার নিদর্শন। এমন সময় মিশরে উত্থান ঘটে আরেক পরাশক্তির। আইয়ুবী রাজবংশের পর মিশরে ক্ষমতায় আসে মামলুকরা। এই মামলুকরাই মোঙ্গল বাহিনীর জয়রথ থামিয়ে দেয়।
মোঙ্গলরা বেশ কয়েকবার মিশর আক্রমণ করলেও মামলুকদের তীব্র প্রতিরোধের মুখে তা ব্যর্থ হয়। এসময় আবার চেঙ্গিস খানের এক বংশধর বারকে খানের সাথে মিত্রতা হয় মামলুকদের। তখন বারকে খানের সাথে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ আরো অগণিত মোঙ্গল জনসাধারণ। সেই সাথে মোঙ্গল শিবিরে বন্দী থাকা মুসলিম নারীরাও ব্যাপকভাবে ধর্ম প্রচারের কার্যক্রম চালাতে থাকে। ফলে অল্প সময়ের ব্যবধানেই মোঙ্গলদের এক বিরাট অংশ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে এবং সমাপ্তি ঘটতে শুরু করে ইতিহাসের এক বর্বরোচিত অধ্যায়ের।
বইয়ের দ্বিতীয়াংশে রয়েছে মামলুক ও মোঙ্গলদের এই উত্থান-পতনের গল্প, যেখানে অত্যন্ত চমৎকারভাবে বর্ণনা করা হয়েছে আইনে জালুতের যুদ্ধ, যুদ্ধক্ষেত্রে সুলতান বাইবার্সের অসাধারণ বীরত্ব ও মামলুকদের কূটনীতিক সফলতার পেছনের কাহিনী।
৩
মামলুক-মোঙ্গল অধ্যায়ের পর পৃথিবী প্রবেশ করে আরেক নতুন অধ্যায়ে। তুরস্কের আনাতোলিয়ায় আরতুগ্রুল বে-র ছেলে উসমান গাজির হাত ধরে একরকম সেলজুক সাম্রাজ্যের গর্ভে গোড়াপত্তন হয় উসমানীয় সালতানাতের। যে উসমানীয়দের হাত ধরেই মুসলিমরা পুনরায় শিরদাঁড়া সোজা করে মাথা তুলে দাঁড়ায়।
সানজাক-ই উসমান বইটির মূল আলোচ্য বিষয় জুড়ে রয়েছে উসমানীয় সালাতানাতের শুরু থেকে সুলতান মুহাম্মাদ আল-ফাতিহর কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের আদ্যোপান্ত।
উসমানীয়রা মূলত ন্যায়-নিষ্ঠার আদর্শকে সামনে রেখে তাদের জীবন উৎসর্গ করার মাধ্যমে সাম্রাজ্যের সীমানা বর্ধিত করে। ফলে কয়েকশো বছরের মাঝেই আনাতোলিয়া থেকে আদ্রিয়ানোপোল, বল্কান থেকে মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে যায় উসমানীয় সানজাক।
সেই গোড়াপত্তন থেকেই উসমানীয়রা একইসাথে একাধিক শত্রুর মোকাবেলা করেছে। একদিকে প্রতিপক্ষ ইউরোপের সম্মিলিত ক্রুসেডার বাহিনী, অন্যদিকে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য- কোনো কিছুই তাদের সুশৃঙ্খল সালতানাতের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।
উসমানীয় সুলতান বায়োজিদের অসাধারণ কৃতিত্ব সেসময় চূড়ান্ত পতন ডেকে আনে ইউরোপের। আবার সেই বায়োজিদের ভুল সিদ্ধান্তের কারণেই মহাবীর তৈমুর লঙের সাথে যুদ্ধ বেধে যায় উসমানীয়দের। ইতিহাসের সেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে আঙ্কারার ময়দানে পরাজিত হন বায়োজিদ। এরপরই টুকরো টুকরো হয়ে যায় উসমানীয় সাম্রাজ্য।
কিন্তু না, অটোমান অধ্যায়ের শেষ হওয়ার সময় তখনও আসেনি। এরপর আবারও তারা ঘুরে দাঁড়িয়ে সুলতান মুহাম্মদ আল-ফাতিহর নেতৃত্বে জয় করে কনস্টান্টিনোপল। আর এই উত্থান-পতনের গল্পগুলো জানার জন্য পড়তে হবে সানজাক-ই-উসমান।
এছাড়াও বইটিতে উঠে এসেছে মহামারী প্লেগসহ মধ্যযুগের শেষের দিকে ইউরোপের কৌশলগত উত্থানের চিত্র। তৎকালের মশলানির্ভর বাণিজ্য, আমেরিকা আবিষ্কার, রোগ-জীবাণুর বিশ্বায়ন নিয়ে খুঁটিনাটি সবই।
আরেকটি ব্যাপার যা আলাদা করে বলতেই হবে তা হলো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বইটিতে থাকা অসংখ্য যুদ্ধের বর্ণনা। সানজাক-ই উসমানে এমনভাবে যুদ্ধের কৌশলগত বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে যা পাঠককে আলাদা এক উত্তেজনাপূর্ণ জগতে নিয়ে যাবে। লেখার শেষে তাই বলতেই হয়, সানজাক-ই উসমান হলো থ্রিলার, অ্যাডভেঞ্চার ও ইতিহাসের দুর্দান্ত একটি প্যাকেজ।
বইটি অনলাইনে কিনতে চাইলে ক্লিক করতে পারেন এই লিংকে- সানজাক-ই উসমান