নীরবে পড়তে থাকা তুষার কয়েক মিনিটেই পাথুরে রাস্তাটিকে ঢেকে দিল, বিছানার উপর চাদর পেতে দেওয়ার মতো করে। তার মাঝ দিয়েই ছোট কিন্তু একেকটি দৃঢ় পদক্ষেপে তুষার পায়ে ঠেলে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। পদক্ষেপগুলো ছোট তার শরীরের আয়তনে, কিন্তু দৃঢ় তার স্বাধীনচেতা সত্ত্বায় ভর করে। নিউইয়র্কের এই সোহো শহরেই গত দু বছর যাবত বাস করছেন তিনি। সাধারণত এই সোহো তারুণ্যে উচ্ছল, হৈ-হুল্লোড়ে ব্যস্ত শহর হলেও ক্রিসমাসের হপ্তা আগের এই সময়টায় খানিক ভাঁটা পড়েছে তারুণ্যের সেই উচ্ছলতায়।
এবং এই সময়টাই সবচেয়ে প্রিয় হেঁটে চলা পথিকটির, নাম তার ‘হোপ ডান’। পেশায় একজন ফটোগ্রাফার। ব্যক্তিগতভাবে যিনি ভিড়ভাট্টা হতে আপাত দূরত্ব রেখে চলাতেই স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজে পান। ভিড়ে এগিয়ে যান যদি, তা তবে নিজের ফটোগ্রাফির সাবজেক্ট খুঁজে নিতেই। অবশ্য ভিড়ের মাঝে তাকে নজরে পড়বে না তার খর্বকায় আয়তনের শরীরের কারণে। শরীরের গঠন-আকৃতি একদম শিশুদের মতো এবং অস্বাভাবিক রকমের নমনীয় স্বভাব তার। অতি স্বল্প জায়গায়ও মানুষের নজর এড়িয়ে থাকতে পারেন তিনি। তার ত্বক যেন সাদা পোর্সেলিনের মতো।
হোপ ডানের সবচেয়ে চমকপ্রদ ব্যাপার হলো তার নয়নযুগল। গাঢ় বেগুনি রঙের ওই দুটি চোখ, যে কারো নজর কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে। চোখ দুটি যেন ভরে উঠেছে রাজ্যের মায়ায়। সমবেদনা আছে লুকিয়ে, তার ওই দুটি চোখে। তার দুই চোখে তাকালেই বোঝা যায়, অনেক কিছু সহ্য করে, লড়ে এসেছেন এই নারী। ওই বেগুনির অতলে, গাঢ় নীলাভ কষ্ট ছেয়ে আছে। তবে তার বেদনাগুলো তাকে হতাশায় নিমজ্জিত করেনি, বরং প্রকৃত ‘শান্তি’ খুঁজে পাওয়ার রাস্তা চিনিয়েছে। তিনি বৌদ্ধ নন, কিন্তু বুদ্ধের দর্শন তাকে প্রভাবিত করেছে। যা ঘটে গেছে, তা ভুলে যেতে যুদ্ধ না করে কিংবা তাতে ডুবে না গিয়ে, নিজেকে ভাসতে দিয়েছেন হোপ। সে অভিজ্ঞতা থেকে অর্জিত পাণ্ডিত্য, প্রগাঢ়তা তার কাজগুলোতে ঝলকে উঠে।
৪৪ বছর বয়সী এই হোপ ডানেরও একদিন সংসার ছিল। কিশোর বয়সে তাদের মেয়েটি মারা গেল। স্বামীও আক্রান্ত হলেন পার্কিনসনে। স্বামী পল রোগাক্রান্ত হবার পর হোপকে যন্ত্রণার হাত থেকে আগেই মুক্তি দিতে ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নেন। সেই অমানিশার সময়টা পার করে হোপ এখন স্থির হয়েছেন। জীবনে বন্ধু বলতে একজনই আছে, তার এজেন্ট মার্ক। এজেন্ট মার্কই তাকে ফোন করে জানালো, নতুন একজন ক্লায়েন্টের ছবি তোলার কাজ হাতে এসেছে। লেখালেখির জগতে জনপ্রিয় এক নাম এবারের ক্লায়েন্ট।
‘ফিন ও’নিল’, আয়ারল্যান্ডীয় এই লেখকের নতুন বইয়ের প্রচ্ছদের জন্যই এই আয়োজন। হোপ সায় জানালো। ফোনালাপের শেষে এজেন্ট মার্ক খানিকটা রাশভারি কণ্ঠে হোপকে ওই লোকের সাথে সখ্যতায় না জড়াতে সাবধান করলো। ‘মেয়েবাজ’ হিসেবে বেশ নামডাক আছে এই লেখকের। চল্লিশোর্ধ্ব বয়স হলেও নাকি তার তরুণ সুলভ কমনীয়তায় ঘায়েল হতে পারে যেকোনো নারী। হোপ অবশ্য তা হেসেই উড়িয়ে দিলেন তখনকার মতো।
‘ফিন ও’নিল’; ঘন কালো চুল, চওড়া কাঁধ, নীল চোখের ব্যক্তিটিকে দেখে কয়েক সেকেন্ডের জন্য যেন বিদ্যুতাড়িত হলেন হোপ। হোপের ভাষায়, “অত্যন্ত সুদর্শন একজন পুরুষ। তার সবকিছুই বেশ অভিব্যক্তিপূর্ণ।” হোপ সাধারণত ছবি তোলার আগে তার সাবজেক্টকে যথাযথরূপে জেনেবুঝে নিতে চান। ফিনও সেক্ষেত্রে আদর্শ সাবজেক্ট হয়ে ধরা দিয়েছেন হোপের চোখে। তার কথাবার্তায় সহজেই মোহাবিষ্ট হয়ে পড়েন হোপ। কথায় কথায় আলগোছে হোপকে ডিনারে নিমন্ত্রণ জানান ফিন। হোপ ভ্রূকুটি করলেও ফিনের ওই আন্তরিক ভঙ্গীতে আঘাত হানতেও চাননি। তাই ‘হ্যাঁ’ বলেই দিলেন।
ডিনারে তারা আরো গভীরভাবে আবিষ্কার করলেন নিজেদের। অনেকটা চেনাজানাও হলো। ফটোশ্যুট শেষে লন্ডন থেকে ফিরলেও প্রতিনিয়ত ইমেইলে হোপের খোঁজ নিতে শুরু করেন মোহময় এই লেখক। হোপের জন্য মেইলগুলোয় প্রকাশ পাওয়া ফিনের উদ্বেগ কেন জানি হোপের কাছে খুব মিষ্টি লাগে। গোটা ব্যাপার কোনদিকে গড়াচ্ছে, তা বুঝে ওঠার আগেই ক্রিসমাসে হোপের দোরগোড়ায় হাজির হন ফিন। হোপ বিস্মিত হন। শঙ্কাও প্রকাশ করেন।
কিন্তু, ফিনের সংস্পর্শ অন্যরকম অনুভূতি জাগায় হোপের মাঝে, যা পল তাকে ছেড়ে যাওয়ার পর অনেকদিন অব্দি অনুভব করেনি হোপ। নিজেকে রুখতে চায় হোপ, কিন্তু ফিনের শিশুসুলভ হাসিমাখা মুখটাকে থমথমে করে তুলবে ভাবতেই অপরাধবোধে ভোগেন তিনি।
ফিনের আলতো ছোঁয়ায় বাকি পৃথিবী শত মাইল দূরে আর তাদের দুজনকে আরো নিকটে দেখতে পাণ হোপ। ফিন ছাড়া হোপের বাকি জগতে নেমেছে স্থবিরতা। হোপ, তার আর ফিনের হঠাৎ এই সম্পর্ক এবং তা এগোনোর গতিতে খুবই অবাক হন। সবকিছু অবিশ্বাস্য ঠেকে তার কাছে। ফিন শুধু ফিন নন। ফিন হচ্ছেন সেই পুরুষ, প্রতিটি নারী কল্পনায় যার প্রতীক্ষায় পথ চেয়ে থাকে। হোপের ‘প্রিন্স চার্মিং’। হোপ ভাবেন, এত দ্রুত এতসব ঘটে যাওয়া অবাস্তবিক। কিন্তু, তিনি যা অনুভব করছেন, তার চেয়ে বাস্তবিক আর কী হতে পারে?
প্রেমের এই গল্পের শুরুটা রহস্যমাখা প্রেম দিয়ে হলেও গল্পের মোড় ঘুরতে ঘুরতে কোনদিকে গিয়ে থিতু হবে, তা জানতে চাইলে বইটি পড়তেই হবে।
লেখিকা ড্যানিয়েল স্টিলের ‘ম্যাটারস অভ দ্য হার্ট’ উপন্যাসটি রোমান্টিক, সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার ঘরানার। রোমান্টিক উপন্যাস লেখায় সুখ্যাতি তো তার বরাবরই আছে। তবে এ উপন্যাসে নিজের বৃত্তে থেকেই একটু ভিন্ন ছক কেটেছেন তিনি। প্রবল ভালোবাসার এই আখ্যানকে সোশিওপ্যাথির ধারণার সাথে মিশিয়ে টুইস্টেড করে তুলেছেন তিনি। একইসাথে এই গল্পে উঠে এসেছে সম্পর্কের নানাবিধ জটিলতার বিবরণীয় বয়ান, যা পড়তে গিয়ে বুঁদ হয়ে থাকবে পাঠক।
সহজে বুঁদ হওয়ার আরেকটি কারণ, উপন্যাসের বয়ানভঙ্গি। লেখিকার আকর্ষণীয় জবানিতে বর্ণিত হয়েছে গোটা গল্প। এবং গল্পটিকে তিনি বর্ণনা করেছেন অতীতকাল ধরে, যেন যৌবনের স্মৃতির পাতা হাতড়ে উষ্ণ ভালোবাসা ও আচ্ছন্নতার এক গল্প তরুণ প্রেমিক-প্রেমিকাদের শোনাচ্ছেন একজন বৃদ্ধা। খুব সূক্ষ্মভাবে দিচ্ছেন কিছু সাবধানবাণীও। আবার কখনো মনে হয়, লেখিকা নিজেই তার দুঃসহ অতীতের এক অভিজ্ঞতাকে কিছুটা কল্পনা মিশিয়ে বয়ান করছেন। হোপ চরিত্রটিতে হয়তো নিজেরই ছায়া রেখেছেন ড্যানিয়েল স্টীল।
তবে এ উপন্যাসে সমালোচনার জায়গাও রয়েছে বেশ। উপন্যাসে, গোটা গল্প বর্ণনা করা হয়েছে ‘হোপ’ চরিত্রটির দৃষ্টিকোণ হতে, যার কারণে সোশিওপ্যাথ চরিত্রটির মনস্তত্ত্ব জানতে চাইলে পাঠককে হতাশ হতে হবে। এবং এই ব্যাপারটি উপন্যাসটিকে করে তুলেছে একমাত্রিক। অভিযোগ তোলা যায় বইয়ের দীর্ঘ আয়তন নিয়েও। কতখানি বড় উপন্যাস, তা নিয়ে অভিযোগ উঠত না কিন্তু উঠেছে লেখায় পুনরাবৃত্তিমূলক প্রকৃতির জন্য।
তিনটি অঙ্কের গঠনে গোটা উপন্যাসটিকে ভাগ করা হলে, প্রথম অঙ্কের শেষ থেকে বাকি সময়ে হোপকে ফিনের বারবার তার অনুরাগের কথা জানানোতে হোপ খুশি হলেও একই কথা, একই লাইন কয়েক পৃষ্ঠা পর পর পড়তে পাঠক ঠিকই বিরক্তি বোধ করবেন। ঘুরেফিরে একইরকম কিছু বিশেষণের অতি ব্যবহার তার বাক্যগঠনকে করে তুলেছে তুলনামূলক দুর্বল। আর এমন বাক্যগঠন লেখার মানকে বড়জোর মিডিওকোর বা মাঝারি পর্যায়ে নিয়ে যেতে পেরেছে।
উপন্যাসের সমাপ্তি অংশটা ভারি অদ্ভুত এবং খুবই তাড়াহুড়োয় হয়েছে। সমাপ্তি অংশটুকু পড়ে মনে হতে পারে, লেখিকা গল্পের নতুন গতিপথ খুঁজে না পেয়ে এবং শব্দের ভাণ্ডারও ফুরিয়ে যাওয়ার আশংকায় শেষ দাড়ি টানার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। দৃষ্টিকটু লাগার মতো বেশকিছু ভুল ও খামতি রেখেই ইতি টেনেছেন তিনি। মনোযোগী পাঠকের কাছে সহজেই অনুমেয় ঠেকবে ক্লাইম্যাক্স। ক্লাইম্যাক্সে বিশ্বাসযোগ্যতাও কম।
ধীরে ধীরে যে সোশিওপ্যাথ চরিত্রটিকে লেখিকা তৈরি করে এসেছেন, সেই ভয়াবহতা, বিপদসঙ্কুল ছায়া শেষে এসে ফুঁ দিয়ে দেশলাই নেভানোর মতোই উবে গিয়েছে। আসন্ন বিপদের আঁচ করেও হোপের কোনোরকম সিদ্ধান্ত না নেওয়া এবং তার পিঠে উপস্থাপিত যুক্তি যথেষ্ট একপেশে, যা হোপ চরিত্রের প্রতি পাঠকের সহমর্মী অবস্থানকে নাড়িয়ে দেয়।
তবে আলোচনা-সমালোচনার স্থান পাশে রেখেই বলতে হয়, ড্যানিয়েল স্টিলের ভক্তগণ এবং গাঢ় প্রেমময় উপন্যাসের পাঠকদের কাছে সুখপাঠ্য হিসেবে বিবেচিত হতে পারে, হৃদয়ের এইসব খুঁটিনাটি।