খোলা আসমান, অথৈ জলরাশি, বিশাল বড় জাহাজ, ঘুটঘুটে অন্ধকারকে সাক্ষী রেখে ঝড়-ঝঞ্ঝা উপেক্ষা করে সমুদ্রের বুক চিড়ে এগিয়ে চলা, মুহুর্মুহু লুট-তরাজ, বিশ্বাসঘাতকতা, জীর্ণশীর্ণ বস্ত্র, ময়লা দাঁত- এসকল বিশেষণ শুধু জলদস্যুদের সঙ্গেই খাপ খায়। আর সেই জলদস্যুদের জলদস্যু হচ্ছে ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারো। ডিজনির বদৌলতে জলপথের সেই দস্যুবৃত্তির উপাখ্যান জীবন্ত হয়েছে রূপালী পর্দায়, ‘পাইরেটস অভ দ্য ক্যারিবিয়ান’ নামে। ডিজনির কাছে এই ফ্র্যাঞ্চাইজি হলো সোনার ডিম পাড়া হাসের মতো। তুমুল জনপ্রিয়তা কুড়ানোর পাশাপাশি বক্স অফিসেও দারুণ সফলতার মুখ দেখেছে প্রতিটি সিনেমা। তুখোড় অভিনেতা জনি ডেপ অভিনীত জলদস্যু ‘জ্যাক স্প্যারো’ এখন সারা বিশ্বের সমাদৃত এক আইকনিক পপ কালচার। ডিজনির সাড়ে চার বিলিয়ন ডলারের এই পাইরেটস অভ দ্য ক্যারিবিয়ান ফ্র্যাঞ্চাইজির অজানা কিছু দিক নিয়েই আজকের এই আয়োজন।
১.
পাইরেটস অভ দ্য ক্যারিবিয়ান ফ্র্যাঞ্চাইজি শুরু করার কথা ডিজনি ভেবেছিল সেই ১৯৯০ এর দশকেই। কিছু রিপোর্ট থেকে জানা যায়, জুরাসিক পার্কের পরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গকে দিয়ে ফ্র্যাঞ্চাইজির প্রথম সিনেমা বানানোর আলাপ চালিয়ে যাচ্ছিল ডিজনি। স্পিলবার্গ চাচ্ছিলেন, জাদুবিদ্যা, ফ্যান্টাসি, আধিভৌতিকতার ছাপ থেকে দূরে রেখে সোজাসাপ্টা এক ইতিহাসভিত্তিক জলদস্যুর সিনেমা নির্মাণ করবেন, যেটার রন্ধ্রে রন্ধ্রে থাকবে ভরপুর অ্যাকশন।
কিন্তু ফ্যান্টাসি আর কাল্পনিক জিনিসপত্র ছাড়া তো ডিজনির কোনোকিছু কল্পনা করাই দুরূহ। তাই ডিজনির স্পিলবার্গের এই প্রস্তাব মনে ধরেনি। সেজন্য বাতিল করে দেওয়া হয় এই প্রজেক্ট। একটা সময় ডিজনি এই ফ্র্যাঞ্চাইজিকে থিয়েটারের বদলে ডিভিডি আকারে রিলিজ দেওয়ার মনস্থির করেছিল। কিন্তু ডিজনির অ্যানিমেটেড মুভি আলাদীনের লেখক টেড ইলিয়ট এবং টেরি রোসিও ডিজনিকে আশ্বস্ত করে, তারা দুজন মিলে সিনেমার প্লট গুছিয়ে দেবেন। ইলিয়ট-রোসিওর লিখা কাহিনিকেই সেলুলয়েডের ফিতায় বুননের কাজ হাতে নেন পরিচালক গর ভার্বিনস্কি। ফলে, ২০০৩ সালে মুক্তি পায় ফ্র্যাঞ্চাইজির প্রথম সিনেমা ‘পাইরেটস অভ দ্য ক্যারিবিয়ান: কার্স অভ দ্য ব্ল্যাক পার্ল’।
২.
শুরুতে ডিজনি ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারোর ব্যক্তিত্ব নির্মাণের জন্য জন্য প্রয়াত আমেরিকান অভিনেতা বার্ট ল্যানক্যাস্টারকে মডেল বানাতে চেয়েছিল। অস্ট্রেলীয় চিত্রনাট্যকার স্টুয়ার্ট ব্যাটি জ্যাক স্প্যারোর চরিত্রকে ঘিরে গল্প নির্মাণের সময় অভিনেতা হিসেবে হিউ জ্যাকম্যানের কথা মাথায় রেখেছিলেন। তার বিশ্বাস ছিল, জ্যাকম্যানকে চরিত্রে কাস্ট করা হবে। কিন্তু সেসময় হিউ কোনো প্রতিষ্ঠিত অভিনেতা ছিলেন না। তাই, ডিজনিও তাকে ওই চরিত্রে নিতে রাজি হয়নি।
৩.
Pirates of the Caribbean: At World’s End সিনেমায় বাংলাদেশের খানিকটা সম্পৃক্ততা রয়েছে। এই মুভিতে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশী সফটওয়্যার প্রকৌশলী এবং অ্যানিমেশন বিশেষজ্ঞ নাফিস বিন জাফর টেকনিক্যাল ডেভেলপার হিসেবে কাজ করেছেন। এই মুভিতে কাজ করার মাধ্যমে প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড (অস্কার) জেতার গৌরব অর্জন করেন তিনি। ছবিতে ফ্লুইড অ্যানিমেশনে জন্য সায়েন্টিফিক এন্ড টেকনিক্যাল ক্যাটেগরিতে ২০০৭ সালে অস্কার জেতেন নাফিস।
৪.
এবার অরল্যান্ডো ব্লুমের চরিত্র উইল টার্নার সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। এই চরিত্রে অভিনয়ের জন্য জন্য টবি ম্যাগুয়ের, ইভান ম্যাকগ্রেগর, জুড ল, হিথ লেজারের মতো ঝানু অভিনেতাদের কথা ভাবা হয়েছিল। তালিকায় ছিলেন লোকিখ্যাত টম হিডলস্টোনও। কিন্তু যেকোনো কারণে কারোরই ব্যাটে-বলে মেলেনি। পরবর্তীতে দ্য লর্ড অভ দ্য রিংস ট্রিলজিতে লেগোলাসের চরিত্রে ব্লুমের অভিনয় দক্ষতা দেখে তাকেই বেছে নেওয়া হয়।
৫.
সকলেই জানে পাইরেটস অভ দ্য ক্যারিবিয়ান ফ্র্যাঞ্চাইজি মূলত ডিজনির মুভি। টাইটেলেই ডিজনি তার নাম সাথে জুড়ে দিয়েছিল। ডিজনির টাইটেল ছাড়াও ফ্র্যাঞ্চাইজির বহু জায়গায় ছিল মিকি মাউসের ইস্টার এগের ছড়াছড়ি। প্রথম মুভি কার্স অভ দ্য ব্ল্যাক পার্লে, তোপ থেকে নির্গত হওয়া ধোয়া উপরে গিয়ে মিকি মাউসের মাথার আকার ধারণ করে। দ্বিতীয় মুভিতে ডেড ম্যান চেস্টের তালা খোলার সময় তা মিকির মাথার মতো দেখায়। তৃতীয় সিনেমায় জলদস্যুদের মানচিত্রের এক কোণায় তো স্পষ্টভাবেই মিকির চিত্র দেওয়া রয়েছে।
৬.
ফ্র্যাঞ্চাইজির প্রথম সিনেমা কার্স অভ ব্ল্যাক পার্ল মুক্তি পেয়েছিল ২০০৩ সালে। ওদিকে দ্য লর্ড অভ দ্য রিংস ফ্র্যাঞ্চাইজির তৃতীয় কিস্তি ‘রিটার্ন অভ দ্য কিং’-ও একই বছর মুক্তি পায়। দুই সিনেমার মধ্যে অন্যতম এক মিল হলো দুটোতেই মৃতের বাহিনীকে প্রদর্শিত করা হয়েছে। কাকতালীয়ভাবে তাদের ডিজাইনও প্রায় মিলে গিয়েছিল। সেজন্য একটু ঝামেলায় পড়তে হয়েছিল লর্ড অভ রিংস দলকে। কার্স অভ দ্য ব্ল্যাক পার্লের ট্রেলার মুক্তির পর লর্ড অভ রিংসের কলাকুশলীরা বুঝতে পারে, তাদের মৃত বাহিনীর উপর নতুন করে ভিএফএক্সের ছুরি-কাঁচি চালাতে হবে। তাই, রিটার্ন অভ দ্য কিংস সিনেমার মৃতের দলকে দেখে অস্বাভাবিক কিছু মনে হলে সেটা সম্পূর্ণ ব্ল্যাক পার্লের অভিশাপ।
৭.
ভিন্টেজ আইকনিক পিস্তল হাতে ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারোকে বেশ মানিয়েছিল। মজার ব্যাপার হলো, সেটা সত্যিকারের ১৮ শতকের একটা ফ্লিন্টলক পিস্তল। মুভির জন্য ফিল্মমেকার দ্বারা পিস্তলটি কেনা হয়েছিল। কে জানে, হয়তো এই পিস্তল দিয়েও কোনো এক দস্যু সমুদ্রের বুকে ত্রাস সঞ্চার করে বেরিয়েছে।
৮.
জনির ডেপকে জ্যাক স্প্যারো চরিত্রটিকে আক্ষরিক অর্থে অমরত্ব দান করেছেন। তবে এই চরিত্রের অভিনয়ের জন্য শিল্পী তালিকা ছিল বেশ লম্বা। ডিজনি শুরুতে নিতে চেয়েছিল আমেরিকান-কানাডিয়ান অভিনেতা জিম ক্যারিকে। এছাড়াও লাইনে ছিলেন ম্যাথিউ ম্যাককোনাঘেই, এবং রবার্ট ডি নিরোর মতো যশস্বী অভিনেতারাও। কিন্তু শেষমেশ তা এসে পৌঁছায় জনি ডেপের কাছে।
৯.
মেথড অ্যাক্টর এবং ভার্সেটাইল অভিনেতা হিসেবে জনি ডেপের বেশ খ্যাতি আছে সারাবিশ্বে। ভিন্ন ভিন্ন বৈচিত্র্যময় চরিত্রে তিনি সবসময় নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছেন। পাইরেটস অভ দ্য ক্যারিবিয়ান সিনেমায় জ্যাক স্প্যারোর চরিত্রে জনি ডেপের বদলে অন্য কাউকে ভাবা পুরোপুরি অসম্ভব। কিন্তু একসময় ডিজনি এই জনি ডেপকেই সরিয়ে দিতে চেয়েছিল ফ্র্যাঞ্চাইজি থেকে। কারণ, তিনি জ্যাক স্প্যারোকে নিজের মতো গড়তে চেয়েছিলেন। এজন্য ডিজনি তার স্বাধীনতায় সরাসরি হস্তক্ষেপ করে বসে। অস্ফুট স্বরে বিড়বিড়-ফিসফিস করে তিনি বিভিন্ন ভঙ্গিমায় কথা বলতেন যা কারও বুঝে আসত না। তাই অনেকে প্রশ্ন তুলেছিল তিনি মাতাল কি-না। নির্মাতারা জ্যাক স্প্যারো চরিত্রের সংলাপ বলার সময় সাবটাইটেলও ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কেউ হটাতে পারলেন না জনি ডেপকে।
১০.
জনি ডেপ ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারো চরিত্রের অনুপ্রেরণা নিয়েছেন কার্টুন লুনি টিউনসের স্কাঙ্ক পেপে লে পিউ এবং রোলিং স্টোনসের গিটারিস্ট কিথ রিচার্ডসের কাছ থেকে। ডেপের ভাষ্যমতে, আদতে জলদস্যুদের ভাবসাব ছিল রকস্টারদের মতো। তাই শুটিংয়ের আগে তিনি রিচার্ডসের সাথে যতটা সম্ভব সময় কাটানোর চেষ্টা করেছিলেন। সে সূত্র ধরে কিথ রিচার্ডস আবার ‘অ্যাট ওয়ার্ল্ডস এন্ড এবং অন স্ট্রেঞ্জার টাইড’ মুভিতে ক্যাপ্টেন টিগের ভূমিকায় ক্যামিও দিয়েছিলেন।
১২.
জ্যাক স্প্যারো, ক্যাপ্টেন বারবোসা, এবং ক্যাপ্টেন ব্ল্যাকবেয়ার্ড তিনটি চরিত্রই বাস্তব জগতের চরিত্র থেকে অনুপ্রাণিত। জ্যাক স্প্যারো চরিত্রটি ঐতিহাসিক চরিত্র জন ওয়ার্ড বা জ্যাক ওয়ার্ড থেকে নেওয়া হয়েছে। পাখিপ্রেমী জন ওয়ার্ডের ডাকনাম ছিল স্প্যারো। ষোড়শ শতকে তাকে শত্রু-জাহাজ আক্রমণ ও লুণ্ঠনের অধিকারপ্রাপ্ত বেসরকারি জাহাজের নাবিক হিসেবে নিযুক্ত করে ইংল্যান্ড সরকার। কিন্তু ক্ষমতার পালাবদলে ইংল্যান্ডে এই পেশা একসময় অবৈধ ঘোষণা করে দেওয়া হলে, তিনি পুরোদমে জলদুস্যবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়েন। শোনা যায়, ষোড়শ শতাব্দীর শেষদিকে তিনি তিউনিসিয়া চলে যান। তখন তিউনিসিয়া ছিল উসমানি খিলাফতের অধীনে। সেখানে তিনি ও তার শিষ্যবৃন্দ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তখন তিনি হয়ে যান ‘ইউসুফ রেইস‘।
ক্যাপ্টেন বারবোসার চরিত্রটি মূলত খাইর এদ্দিন পাশা (১৪৭৬ খ্রি.-১৫৪৬ খ্রি.) থেকে অনুপ্রাণিত। তিনি বারবারোসা হাইরেদ্দিন পাশা, হিজির হায়রেদ্দিন পাশা নামেও পরিচিত ছিলেন। তৎকালীন মিডিলি দ্বীপে জন্মগ্রহণ কারী হাইরেদ্দিন পাশা ছিলেন অটোমান নৌবহরের প্রধান নৌসেনাপতি। অটোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপলে (ইস্তাম্বুল) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
ব্ল্যাকবেয়ার্ড কিংবা এডওয়ার্ড টিচ (১৬৮০ খ্রি.-১৭১৮ খ্রি.) ছিলেন পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম কুখ্যাত জলদস্যু। সমুদ্রজুড়ে ভয়ের রাজত্ব কায়েম করে রেখেছিলেন তিনি। ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং উত্তর আমেরিকার পূর্ব উপকূলে তার কিংবদন্তি বহু জলদস্যুর অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। এই ব্ল্যাকবেয়ার্ড চরিত্রটি অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে পাইরেটস অভ দ্য ক্যারিবিয়ানে।
১৩.
ফ্র্যাঞ্চাইজির প্রথম মুভির জন্য ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের আগ্নেয়গিরি দ্বীপ সেন্ট ভিনসেন্টকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। এখানেই এই মুভির বেশিরভাগ শুটিং সম্পন্ন হয়েছে। পোর্ট রয়েল টর্টোগার শুটিং সেট নির্মাণ করা হয়েছিল এই দ্বীপেই। স্থানীয় বাসিন্দাদের দিয়ে ক্রু মেম্বার, এক্সট্রা আর্টিস্টদের কাজ চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাই, জায়গাটি পাইরেটস ভক্তদের জন্য এক ভ্রমণকেন্দ্র হিসেবে রূপ নিয়েছে। সকল শুটিং সেট যেমন ছিল তেমনই আছে এখন পর্যন্ত।
ডেড ম্যান চেস্টের শুটিংয়ের জন্য আইল্যান্ড অভ ডমিনিকাকে ব্যবহার করা হয়েছিল। দুর্গম এই দ্বীপে, ক্রু মেম্বারদের জন্য ডিজনিকে রাস্তা পর্যন্ত বানাতে হয়েছিল। অধিকাংশ জায়গা পানিতে আবদ্ধ থাকায় কয়েকবার প্রয়োজনীয় রসদ এবং ক্রু মেম্বারদের নৌকা এবং হেলিকপ্টারের সাহায্যে আনা-নেওয়া করতে হয়েছে। কার্স অভ দ্য ব্ল্যাক পার্ল মুভির গুপ্তধনওয়ালা গুহার সেট বানাতে শ’খানেক শিল্পীর প্রায় ৫ মাসের মতো সময় লেগেছিল।