কিছু কিছু নক্ষত্রের দ্যুতি আকাশ ঝলকানো আলো দিলেও হারিয়ে যায় বড্ড তাড়াতাড়ি। অভিনয় জগতেও এমন নক্ষত্রের দেখা মেলে, মীনা কুমারী তাদেরই একজন। জনপ্রিয়তার শীর্ষে চড়েও হঠাৎ মুখ থুবড়ে পড়ার হতাশা, অতঃপর খুব কমবয়সেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া। নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলাই ছিল এর মূল কারণ।
নাম বদলের মধ্য দিয়ে বড় পর্দার সকল কুশীলবকেই যেতে হয়, এ যেন তাদের ভবিতব্য। এ থেকে বাদ পড়েননি মীনা কুমারীও। বলিউডের রূপালি পর্দার একসময়ের প্রতিভাময়ী এই নায়িকার প্রকৃত নাম ‘মেহজাবিন বানু’। শৈশব থেকেই কর্মচাঞ্চল্যে ভরপুর তার জীবন, তাই শৈশবকে ঠিক আর অন্য দশটা শিশুর মতো করে পাননি মীনা কুমারী। পরবর্তী জীবনে তিনি বলেছিলেন, “আমার কখনো অন্য বাচ্চাদের মতো অনেকগুলো রঙিন মার্বেল ছিল না।” তার বাবা আলি বকশ এবং মা ইকবাল বেগম। তারা দুজনেই থিয়েটারকর্মী ছিলেন। বাবা গানের শিক্ষক ও হারমোনিয়ামবাদক, মা সিনেমায় জুনিয়র আর্টিস্ট। মা ইকবাল বেগম অবশ্য থিয়েটার অভিনেত্রী এবং নৃত্যশিল্পীও ছিলেন। মঞ্চে মায়ের নাম ছিলো ‘কামিনী’। পারিবারিক অস্বচ্ছলতা আর নাচ-গান-অভিনয়ের আবহাওয়া, দুটো মিলিয়ে যেন তার জন্য ঠিক হয়েই ছিলো অভিনয়ের জগত। জ্ঞান-বুদ্ধি ভালো করে হবার আগেই ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে শেখেন তিনি।
১৯৩৯ সালে প্রথম লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশনের সাথে পরিচিত হয় মাত্র সাত বছর বয়সী মেহজাবিন নামের সেই শিশুটি। সেও স্কুলে যেতে চেয়েছিলো, চেয়েছিলো আর সবার মতোই নিশ্চিন্ত আমোদে ভাসতে। পারিবারিক চাপে পড়ে সেদিনের সেই কাঁদতে থাকা শিশুটিকে তার মা প্রায় জোর করেই দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলো চোখ ধাঁধানো আলোর দুনিয়ায়। বিজয় ভটের পরিচালনায় ‘লেদারফেস’ সিনেমায় অভিনয় করে সেদিন তার প্রথম উপার্জন ছিলো ভারতীয় ২৫ রুপি। সেই প্রথম শ্যুটিং থেকে তার নাম হয় ‘বেবি মীনা’। বেবি মীনা শ্যুটিং স্পটেই নিয়ে যেত তার পড়ার বই, স্কুলে না যেতে পারার ক্ষতিটুকু এভাবেই সে পুষিয়ে নিতে চাইতো।
শিশুশিল্পী হিসেবে যাত্রা শুরু করা ‘মেহজাবিন’ কিংবা ‘বেবি মীনা’ অভ্যস্ত হয়ে উঠতে থাকে সেই আলোর সাথে, অভিনয়ের সকল অভ্যাসের সাথে। শিশুশিল্পী থেকে ক্রমেই নায়িকা হয়ে ওঠার যাত্রা মীনা কুমারীর জন্য যেন অনেকটা পূর্বনির্ধারিতই ছিলো। হয়তো তা নির্ধারণ করেছিলেন তার মা ইকবাল বেগম, হয়তো চলচ্চিত্র জগত অথবা হয়তো খোদ মীনা কুমারীই!
চলচ্চিত্রে তার ক্যারিয়ার
মীনা কুমারীর অভিনয় নিয়ে কারো কোনো সন্দেহের অবকাশ ছিল না, নেই। তার কন্ঠস্বরের প্রেমে পড়েননি এমন কোনো সহকর্মীও নেই। আরেক বিখ্যাত নায়িকা মধুবালা তার কণ্ঠস্বর আর ডায়লগ বলার ধরনের উচ্ছসিত প্রশংসা করেছিলেন। মীনা কুমারীর সাথে কাজ করতে গেলে মুগ্ধতাবশত নাকি ডায়লগ ভুলে যেতেন স্বয়ং দীলিপ কুমারও! এমনই এক জাদু ছড়িয়ে রেখেছিলেন এই অভিনেত্রী। চলচ্চিত্র সমালোচকদের মতে ভারতীয় চলচ্চিত্রজগতে মীনা কুমারী হচ্ছেন ‘ঐতিহাসিকভাবে অতুলনীয়’! শৈশব থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ৩৩ বছরের ক্যারিয়ার ধারণ করেছিলেন তিনি। এতে স্বাভাবিকভাবেই ছিল কিছু চড়াই-উতরাই। কিন্তু তারপরও তার অভিনয় সম্পর্কে আজও কারো মনে নেই কোনো দ্বিধা।
৯২টি চলচ্চিত্রে অভিনয়ের অভিজ্ঞতা ছিল তার ঝুলিতে। ‘সাহেব বিবি গোলাম’ সিনেমায় ‘ছোটি বহু’ চরিত্রটি তার নিজের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে মিলে গিয়েছিলো বলে এটি তার জন্য অন্যতম সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হয়। এছাড়াও মীনা কুমারীর উল্লেখযোগ্য সফল কাজ ছিলো ‘মেরে আপনে’, ‘আরতি’, ‘পরিণীতা’, দিল আপনা আউর প্রীত পরায়ে’, ‘কোহিনূর’ ইত্যাদি সিনেমায়। তিনি চারবার ফিল্মফেয়ার পুরষ্কারও জিতেছিলেন। ১৯৩৩ সালের ১লা আগস্ট জন্ম নেয়া, ঐতিহাসিকভাবে অতুলনীয় এই অভিনেত্রীর জীবনী পরবর্তীতে উঠে এসেছে বিনোদ মেহতার লেখনীতে।
ধর্মেন্দ্র-মীনা কুমারী
প্রচন্ড রূপ আর অভিনয় প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও জীবনে তিনি খুব কমই পেয়েছেন আকাঙ্ক্ষিত প্রেম। তৃষিত মরুভূমিতে এক আঁজলা জল হয়ে এলেন ধর্মেন্দ্র। হ্যাঁ, বড় পর্দা কাঁপানো আরেক মুখ, নায়ক ধর্মেন্দ্র। শোনা যায়, তাদের প্রেমকাহিনীর গভীরতা সব মীনা কুমারীরই ছিল, ধর্মেন্দ্র তেমন করে প্রেমে পড়েননি! সে যা-ই হোক, কমল আমরোহীর সাথে বিবাহবিচ্ছেদের পর একটা সময় তারা দুজন এতটাই কাছে এসেছিলেন যে প্রায় প্রতি সন্ধ্যাই তাদের কাটতো মীনা কুমারীর বাসস্থান ‘জানকী কুটিরে’। কিন্তু সে সম্পর্কও ভেঙে যায় এবং জীবনের প্রতি মীনা কুমারীর হতাশা আরো কয়েক ধাপ বেড়ে যায়। ক্রমাগত মদ্যপানে ডুবে যান তিনি। ‘পূর্ণিমা’, ‘কাজল’, ‘ফুল আউর পাত্থর’, ‘চন্দন কা পালনা’ ইত্যাদি সহ ধর্মেন্দ্র-মীনা কুমারীর একসাথে করা সিনেমাগুলো বেশ ভালো খ্যাতি অর্জন করেছিলো। মীনা কুমারীর শেষ দিনগুলোতে আর্থিক কিংবা অন্য কোনোপ্রকার সাহায্যেও এগিয়ে আসেননি একসময়ের তার এই প্রেমিক ধর্মেন্দ্র। এজন্য অনেকেই ধর্মেন্দ্রের সাথে তার এই সম্পর্কে ধর্মেন্দ্র ঠিক কতটা বিশ্বস্ত ছিলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
তখনকার বিখ্যাত পরিচালক কমল আমরোহীর স্ত্রী ছিলেন এই নায়িকা। অসম বয়স, সাথে প্রথম বিয়ের বন্ধন। কামালের জীবনে দ্বিতীয় নারী হয়েই রয়ে গিয়েছিলেন তাই মীনা কুমারী। ক্যারিয়ারে কোনো আঁচ না আনার জন্য তারা সন্তানও নেননি। নায়িকা স্ত্রীকে দিয়ে নতুন নতুন সফল সিনেমা তৈরি করার পরিকল্পনা ছিল পরিচালকের, ব্যক্তিজীবনে মীনা কুমারীকে নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা ছিল না। ১৯৫৬ সালে কামাল আমরোহীর পরিচালনায় ‘পাকিজা’ সিনেমাটিকে দুজনের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ বলে মনে করা হয়। ক্যারিয়ারে একের পর এক যৌথ সফলতা আর দাম্পত্যে শীতলতা, ব্যক্তিজীবনে এমন এক অবহেলার সময় কাটাচ্ছিলেন যখন, তখনই হঠাৎ আশার ঝলকানি হয়ে এই গল্পে প্রবেশ করলেন ধর্মেন্দ্র। কিন্তু সেই প্রবেশও মীনা কুমারীর জন্য ছিল না খুব সৌভাগ্যের। অন্তত তার শেষজীবনের ফলাফলগুলো তা-ই বলে।
‘পাকিজা’ ও এক বিষাদগাথা
১৯৫৬ সালে কাজ শুরু হয় সিনেমাটির। কমল আমরোহীর পরিচালনা আর মীনা কুমারীর অভিনয়, ভালো একটি চিত্রনাট্য- শুরুতেই এটি নিয়ে আশার বাণী শোনা যায় সিনেমহলে। কিন্তু সিনেমাটির ভাগ্যে ছিল না এত সহজ মুক্তি। ১৯৬৪ সালের দিকে এসে কমল আমরোহী-মীনা কুমারীর দাম্পত্যজীবন আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়ে যায় এবং সেইসাথে থেমে যায় ‘পাকিজা’-র শ্যুটিং। এর মধ্যে কেটে যায় বেশ কয়েকটি বছর, মীনা কুমারীর জীবনে দেখা দেয় নানা উত্থান-পতন। ক্যারিয়ার এবং ব্যক্তিজীবন, উভয় ক্ষেত্রেই মীনা কুমারী সম্মুখীন হন ক্রমাগত হতাশার। হতাশা যত বাড়তে থাকে, ততই আপন করেন মদ্যপানকে। এতোটাই আসক্তি এসে গিয়েছিলো তার যে তার বাথরুমের ডেটলের বোতলে পর্যন্ত পাওয়া যেত অ্যালকোহল!
মীনা কুমারী লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হন। অসুস্থ অবস্থায় তার সাথে দেখা করতে আসেন কমল আমরোহী। সেদিনের সেই সাক্ষাতে তিনি নিয়ে আসেননি কোনো ব্যক্তিগত অনুভূতি, শুধুমাত্র ‘পাকিজা’ সিনেমার শ্যুটিং শেষ করার ডাক নিয়েই এসেছিলেন পরিচালক কমল আমরোহী। কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এটি তার ক্যারিয়ারের এবং চলচ্চিত্রজগতের জন্য একটি মাইলফলক হয়ে থাকবার অপার সম্ভাবনা নিয়ে অপেক্ষা করছে। অতঃপর নায়িকাও রাজি হলেন, অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও সিনেমার শ্যুটিং চললো। এতে আরো ছিলেন অশোক কুমার ও রাজকুমার। মীনা কুমারীর অভিনয় ছিল দ্বৈত চরিত্রে, মা-মেয়ে হিসেবে। অক্লান্ত পরিশ্রমের পর শেষমেশ ‘পাকিজা’ মুক্তি পায় ১৯৭২ সালে।
ব্যক্তিগত টানাপোড়েনের জেরে পড়ে প্রায় পনেরো-ষোলো বছর পর মুক্তি পায় সিনেমাটি এবং মীনা কুমারীর নামের সাথে বিষাদগাথা হয়ে যুক্ত হয়ে যায়। জীবনের সেরা কাজটি করবার দু-তিন সপ্তাহ পরেই মারা যান মীনা কুমারী। ১৯৭২ সালের ৩১ মার্চ ইতি ঘটে মীনা কুমারীর জীবনের আর তার মৃত্যু যেন বাণিজ্যিকভাবে আরো সফল করে তুলেছিলো ‘পাকিজা’কে। ভক্তদের ছুটে আসাটুকু হয়তো ছিল তাদের প্রিয় অভিনেত্রীকে শেষ ভালোবাসা জানানো!
কবিতায় কথকতা
একাকিত্ব আর বিষণ্ণতাকে মীনা কুমারী কীসের রূপ দিয়েছিলেন? পর্দায় রঙ চড়ানো অভিনয় নাকি নাকি একলা ডায়েরিতে হিজিবিজি লিখে যাওয়াতে? হয়তো দুটোই, দুটো দু’ভাবে। তার সবচেয়ে প্রিয় দুটো কাজের মধ্য দিয়ে নিজেকে বারবার সেঁচে বের করেছেন ঝিনুকের মুক্তো কিংবা সিন্ধু নদের অমৃত। কবিতায় কথা বলতেন তিনি নিজের সঙ্গে। তার একান্ত অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটতো তার ডায়েরির সেই পাতাগুলোয়, যা মারা যাবার আগে তিনি দিয়ে গিয়েছিলেন তার প্রকৃত শুভাকাঙ্খী ভারতের বিখ্যাত কবি নির্দেশক গুলজারকে। অভিনয় জীবনের নিচে চাপা পড়ে গিয়েছিলো মীনা কুমারীর কবিসত্ত্বাটুকু। যদিও অনালোকিত ও অনালোচিত তার এই অংশটুকু পরে গুলজারের মাধ্যমেই পরিচিতি পায়। ‘চান্দ তানহা’, ‘মীনা কুমারী কি শায়েরি’ নামের কাব্য সংকলনে গুলজার উর্দু ভাষায় লেখা তার এই কবিতাগুলো প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে ভারতীয় এক শিক্ষক ও অনুবাদক নুরুল ইসলামের অনুবাদে তার কবিতা আরো জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
উড়ে চলা মেঘেদের প্রতি সুপ্ত ঈর্ষা নিয়ে মীনা কুমারী তার কবিতায় বলেছেন,
“You are clouds?
Came with the winds
Lingered for a while?
On the sky?
Burst? And? Vanished into some remoteness
We are rocks
Stuck in our places
Knowing that
Those who go away
Shall never return.”
পুরো পৃথিবীর কাছ থেকে যশ-খ্যাতি নয়, মীনা কুমারী দিনশেষে চেয়েছেন তার আপন বলতে পারার মতো কিছু স্থান। আর সেই অপ্রাপ্তি তার কবিতা হয়ে ফুটে উঠতো, মনের আনাচে-কানাচে গুমরে মরতো জীবনের সংজ্ঞা আর কুড়োনো নামের বাহার। ট্র্যাজিক কুইন খ্যাত মীনা কুমারী নিজের জীবনের ট্র্যাজেডির কাছে যেন শেষদিকে হার মানতে বাধ্য হয়েছিলেন। জীবন তাকে যতটুকু দিয়েছিলো, তার চেয়ে বেশি শুষে নিয়েছিলো তার জীবনীশক্তি। কখনো হাসতে না পারা সেই শৈশব, প্রতারণা ভরা এক যৌবন আর স্বাভাবিক মধ্যবয়সেই জীবনের ইতি টানা- সব মিলে রচিত হয়েছিলো তার নিজস্ব এক বিষাদগাঁথা।