সাদাত হাসান মান্টোকে নিয়ে চাইলে পাতার পর পাতা লিখে ফেলা যাবে অনায়াসেই। বৈচিত্র্যময় ব্যক্তিগত জীবন আর বিস্তীর্ণ ক্যানভাসের আড়াইশো গল্প মিলিয়ে-মিশিয়ে তিনি আদতেই একজন আলো-আঁধারের চরিত্র। লেখক জীবন এবং ব্যক্তিগত জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে ক্রমশ বিপর্যস্ত মানুষটি দেশভাগকে পর্যবেক্ষণ করেন ভিন্ন চোখে, লেখেন সর্পিল সময়ের হিমশীতল সব গল্প। উর্দুতে ফেল করা একজন মানুষ কীভাবে হয়ে ওঠেন উর্দু সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এবং আলোচিত লেখক, সে নিয়ে লিখতে বসলে চমকিত হতে হয় ক্ষণে ক্ষণেই। সারাজীবন যিনি লিখেছেন বিচিত্র সব গল্প, তার জীবনের গল্পেও বৈচিত্র্যের কোনো কমতি রাখেন না স্বয়ং বিধাতাও।
স্বর্গ থেকে পতিত দেবদূত
জন্ম পাঞ্জাবের লুধিয়ানা থেকে বাইশ কিলোমিটার দূরে সমরালায়; ১১ মে, ১৯১২ সালে। বাবা মৌলবি গুলাম হোসেন ছিলেন কঠোর ও বদমেজাজি। বাবার কাছ থেকে স্নেহ, ভালোবাসা একটু কম পেয়েছেন মান্টো। পরিবারেও উপেক্ষিত ছিলেন সবার কাছ থেকে। ভালোবাসা পেয়েছেন শুধুমাত্র মায়ের কাছ থেকে। মাকে আদর করে তিনি ডাকতেন ‘বিবিজান’।
মান্টো পড়াশোনা শুরু করেন অমৃতসরের এম. এ. ও. মিডল হাই স্কুলে। এরপর ভর্তি হন অমৃতসরের শরিফপুরায় মুসলিম হাই স্কুলে। ম্যাট্রিক পর্যন্ত তার পড়াশোনার দৌড়। তা-ও পাশ করেন তিনবারের চেষ্টায়, তৃতীয় বিভাগে। এরপর পড়াশোনা বাদ দিয়ে কিছুদিন কাটান সুরার কবলে, জুয়ার আসরে, নেশাদ্রব্যের সাথে, চূড়ান্ত বাউণ্ডুলেপনায়।
কলমের সাথে সখ্যতা
অমৃতসরের রাস্তায় রাস্তায় বাউণ্ডুলে জীবন যখন কাটছিল তার, তখন স্থানীয় আজিজ হোটেলে কিছু মানুষের সাথে সম্পর্ক হয় তার, আলাপ হয় পত্রিকার কিছু মানুষজনের সাথে। আস্তে আস্তে সাহিত্যের দিকে আগ্রহী হন মান্টো। পড়াশোনা শুরু করেন। একসময়ে লিখতেও শুরু করেন। লেখক হিসেবে যাত্রা শুরু হয় ‘তামাসা’ গল্প দিয়ে। ১৯৩৫ সালে বোম্বাইয়ের ‘মুসসাবের’ পত্রিকার সম্পাদনা শুরু করেন। এরপর ১৯৪২ সালে চলে যান দিল্লীতে, অল ইন্ডিয়া রেডিওর নাট্যকার হয়ে। ১৯৪৩ সালে বিখ্যাত ‘ফিল্মিস্তান’-এ গল্পলেখক হিসেবে যোগ দেন। বলিউডের তারকাদের সাথে সম্পর্কের শুরু তখনই।
এরপর দেশভাগের ছোবল। ভারত ছেড়ে চলে যান পাকিস্তানে ৷ ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানেই রয়ে যান। লেখেন গল্প, প্রবন্ধ, নাটক। মৃত্যুর ঠিক আগের দিনেও লেখেন ‘কবুতর অউর কবুতরি’ নামে এক গল্প।
প্রবল মদ্যপান আর অনিয়মের কারণে লিভার সিরোসিস হয়ে ১৯৫৫ সালের ১৮ জানুয়ারি মাত্র ৪৩ বছর বয়সে মারা যান এই লেখক। তিনি রেখে যান আড়াইশোরও বেশি ছোট গল্প আর হয়ে যান উর্দু সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক।
বইয়ের কথা
সাধারণত বইয়ের ‘ভূমিকা’ অংশটা অনেকেই পড়েন না। তবে এ বইয়ের ভূমিকা ‘মন্টো, একটি ক্ষত’ লেখাটি পাঠককে খুবই প্রাসঙ্গিক কিছু ধারণা দেবে মান্টোকে নিয়ে। এই অংশটি রবিশঙ্কর বল লিখেছেন, যিনি নিজেও পশ্চিমবঙ্গের বেশ জনপ্রিয় লেখক ও সাংবাদিক। রবিশঙ্কর বলের আরেকটি অসাধারণ বই ‘দোজখনামা‘। সেই বইয়ের উপজীব্য মান্টো ও মির্জা গালিবের কাল্পনিক কথোপকথন। ‘দোজখনামা’র জন্য রবিশঙ্কর পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রবর্তিত বঙ্কিমচন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার ও খোঁজ সাহিত্য পুরস্কার।
‘সদত হসন মন্টো রচনাসংগ্রহ’ বইয়ে আছে মান্টোর ২৫টি গল্প, একটি নাটক ও চারটি গদ্য। এই ২৫টি গল্পের মধ্যে ছয়টি অবিভক্ত ভারতবর্ষে বসে লেখা, বাকি ১৯টিই লিখেছেন পাকিস্তানে গিয়ে। অনেকেই বলেন, পাকিস্তানে গিয়ে মান্টোর আসল লেখক সত্ত্বা মারা গিয়েছে। সেটা কতটুকু সত্য বা মিথ্যে, তা যাচাই করা যাবে এ বইয়ের গল্পগুলো পড়লেই।
ভারতবর্ষে থাকাকালীন গল্প: ১৯৩৪-১৯৪৭
এই অংশের ছয়টি গল্প, যেগুলো ভারতবর্ষে বসে লেখা, সেই গল্পগুলোর প্রত্যেকটিই আগেরটি থেকে অনেকটা ভিন্ন। ‘দশ টাকা’ গল্পে যৌনকর্মীর পেশার সাথে জীবনের মানবীয় জটিলতার ভিন্ন ভিন্ন টুকরো গল্প উঠে আসে। ‘আমার নাম রাধা’ গল্পটি অস্তিত্বসংকটের মানসিক অস্থিরতাকে খুব যুগপৎভাবে দর্শকের সামনে স্পষ্ট করে রাখে। ‘বাবু গোপীনাথ’ গল্পে পাঠক লক্ষ্য করে দেহব্যবসার এক ভিন্ন প্রেক্ষাপটের গল্প, যে প্রেক্ষাপট নিয়ে আগে খুব একটা চিন্তাভাবনা হয়নি।
পরের গল্পটি ‘গন্ধ’ অথবা হিন্দি ‘বু’। এ গল্পটি নিয়ে অনেক সমালোচনা আছে। ১৯৪৪ সালে এই গল্প যখন ‘আদব-এ-লতিফ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, সমাজের প্রতিক্রিয়াশীল মহল গল্পটিকে ‘অশ্লীল’ বলে দুয়ো তোলে। লাহোরের ‘দৈনিক প্রভাত’ মান্টোকে তিন বছর জেলবন্দি করার দাবিও তোলে। কোনো কোনো প্রগতিশীল লেখক ‘গন্ধ’কে ‘দুর্গন্ধ’ বলেও অভিহিত করেন। অথচ মেটাফোরিক্যালি এবং লিরিক্যালি, সেই সাথে ফিজিক্যাল এবং মেন্টাল কমপ্লেক্সিটি মিশিয়ে এরকম গল্প উপমহাদেশে খুব কম লেখকই লিখেছেন।
পরের গল্পটি ‘কালো শালোয়ার’। মানুষের অতৃপ্ত আত্মা এবং প্রাপ্তির প্রত্যাশা ও হারানোর হতাশাকে মিলিয়ে এ গল্প এক ভিন্ন মনস্তত্ত্বের সন্ধান দেয় পাঠককে। শেষ গল্পটি- ‘ওপর, নিচে আর মাঝখানে’। এই গল্পটি সমাজের তিন স্তরের কিছু মানুষের জীবনবোধের রসায়ন। শুধুমাত্র কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে পুরো গল্পটা এগিয়ে যায়।
পাকিস্তানে থাকাকালীন গল্প: ১৯৪৮-১৯৫৫
এই অংশের ১৯টি গল্প পাকিস্তানে বসে লেখা। যখন বম্বেতে বাস করতেন, মান্টো ছিলেন বেশ জনপ্রিয় লেখক। সেখান থেকে দেশভাগ। হুট করে তিনি টের পান, তার লেখক সত্ত্বাকে গ্রাস করছে তার ধর্মপরিচয়। বাধ্য হন শেকড় কেটে পাকিস্তানে যেতে। পাকিস্তানে থাকাকালীন এই ১৯টি গল্পের মধ্যে তাই ক্রমশ দেখতে পাওয়া যায় লেখকের মানসিক অস্থিরতার ছাপ এবং দেশভাগের দুঃসহ যন্ত্রণা গল্পের চরিত্র দিয়ে বের করে আনার চেষ্টা।
প্রথমেই বলা যেতে পারে- ‘খালেদ মিয়া’ গল্পের কথা, যেখানে ভয়-সংকট-উৎকণ্ঠাকে খুব তীব্র একটা পারিবারিক অন্তর্দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে লেখক দেখাতে চান। ‘বুনো ঝোপের পেছনে’, ‘পেরিন’- এই গল্পগুলো মানসিক অন্তর্দৃষ্টিকে ক্রমশ বিদ্ধ করে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে। ‘আল্লার দোহাই’ গল্পে মান্টো উপস্থিত হন দেশভাগের রক্তাক্ত চেহারা নিয়ে। পাঠক শিউরে ওঠে হিন্দু-মুসলমানের আক্রোশের গল্পে। পার্টিশনের ও দাঙ্গার ওপরে লেখেন গল্পগুচ্ছ ‘সিয়া হাশিয়ে’। অনেকগুলো অণুগল্প একটি গল্পের মধ্যে স্থান পায় এই সিয়া হাশিয়েতে। এবং দাঙ্গার ভয়াবহতা বোঝার জন্যে এই একটি ‘সিয়া হাশিয়ে’ই যথেষ্ট হয়ে দাঁড়ায় প্রকারান্তরে।
এছাড়াও বাকিসব গল্পের মধ্যে ‘ঠাণ্ডা গোস্ত’ আলাদা করে আলোচনার যোগ্য। পাকিস্তানে যাওয়ার পরে প্রথমেই এই গল্পটি লেখেন তিনি। গল্পটি পাকিস্তানের ‘জাভেদ’ পত্রিকায় প্রকাশের কিছুদিনের মধ্যেই কট্টরপন্থীদের তোপের মুখে পড়ে। এই গল্পের জন্যে মান্টোর কারাদণ্ডও ঘোষণা করা হয়। অশ্লীলতার অভিযোগে তাকে আখ্যায়িত করা হয় ‘পর্নো সাহিত্যের লেখক’ বলে।
এই অংশের বাকি গল্পগুলোও নিজ মহিমায় উজ্জ্বল। ‘সাতটি জাদুফুল’, ‘রাম খিলবান’, ‘তুতু’, ‘মোজেল’ মানব চরিত্রের ভিন্ন ভিন্ন দিককেই ক্রমশ তুলে ধরে পাঠকের কাছে। কখনো সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে গল্পগুলো হয়ে যায় অসহনীয়। আবার কোনো গল্প শোনায় হিংস্র দাঙ্গার মধ্যেও অহিংস ভালোবাসার উপাখ্যান। পাঠক ক্রমাগত ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে পড়ে টালমাটাল হয়, হতবিহ্বল হয়, হয় চমকিত।
বইয়ের শেষের অংশে একটি নাটিকা ‘ঘূর্ণি’ রয়েছে। যেটা খুব একটা মান্টোসুলভ অসাধারণ নয়। তাছাড়া রয়েছে চারটি প্রবন্ধও। যে প্রবন্ধগুলো মান্টো সম্পর্কে বেশকিছু অপ্রচারিত তথ্যের সন্ধান দেয় পাঠককে।
শেষের কথা
‘সদত হোসেন মন্টো রচনাসংগ্রহ’ এর ব্লার্বে লেখা ছিলো কথাগুলো-
যে সময়ে আমরা বেঁঁচে আছি, তার সঙ্গে যদি আপনার পরিচয় না থাকে, আমার গল্পগুলো পড়ুন। আপনি যদি আমার গল্পকে সহ্য করতে না পারেন, তবে বুঝবেন, এই সময়টাই অসহনীয়।
এই অসহনীয় সময়ের গল্পই দৃষ্টিগোচর হয় এই বইয়ের লেখাগুলোতে। দিশেহারা অক্ষরগুলোর মধ্যে মান্টো হেঁটে বেড়ান ইতস্তত। প্রচণ্ড অস্থিতিশীল সময়, প্রবল ঘৃণার বাতাসের মধ্যে তিনি হেঁটে বেড়ান আগ্রহী চোখে। খুঁজতে থাকেন চরিত্র। জড়ো করেন শব্দ। পরে সেগুলোকে তুলে রাখেন কাগজে। যে শব্দ, যে কাগজ মান্টোর মৃত্যুর পরেও তাকে মুছে যেতে দেয় না। মান্টো বেঁচে থাকেন দেশভাগের গল্পের মধ্য দিয়ে, বেঁচে থাকেন উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পের মধ্যে দিয়ে। বলেন-
স্বাভাবিকের চেয়ে এক ডিগ্রি ওপরে থাকে আমার শরীরের তাপমাত্রা আর তা থেকেই বুঝবেন, আমার ভেতরে কী আগুন জ্বলছে।
এই আগুন দিয়েই তিনি ক্রমাগত দগ্ধ করেন সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্মকে। লিখতে থাকেন একের পর এক গল্প। বলেন-
লেখকের অনুভূতি যখন আহত হয়, তখনই সে হাতে তুলে নেয় কলম।
এই বইটি পড়া যেতে পারে সাম্প্রদায়িকতা, দাঙ্গা, দেশভাগের করুণ ইতিহাস নিয়ে ধারণা পাওয়ার জন্যে। বইটি পড়া যেতে নিজের মনস্তত্ত্বকে আরেকটু পরিশীলিত, পরিণত করার জন্যে। সেই সাথে এই বইটি পড়া যেতে পারে এক পাগলাটে মানুষের জন্যেও, যার নাম সাদত হাসান মান্টো। যিনি এপিটাফে লিখে যেতে চেয়েছিলেন,
কে ভালো গল্প লেখে? খোদা, না মান্টো?