ক্যামেরার সামনে যখন একজন অভিনয়শিল্পী হাজির হন, তখন তাকে নিজের চিরায়ত অভ্যাস থেকে বেরিয়ে সম্পূর্ণ নতুন কোনো চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে হয় অনেক সময়। গল্পের চরিত্রকে নিজের ভেতর ধারণ করে সেটাকে আবার সবার সামনে অভিনয়ের মাধ্যমে উপস্থাপন করা সহজ কোনো কাজ নয়!
কখনো-বা শরীরের ওজন কমিয়ে একেবারে লিকলিকে হয়ে যেতে হয়, কিংবা সেই মানুষটাকেই আবার মোটা সাজতে হয়! এটি ছাড়াও চরিত্রের প্রয়োজনে আচার-আচরণ কিংবা নিজের সম্পূর্ণ লাইফস্টাইলটাই কিছুদিনের জন্য বদলে ফেলেছেন, এমন অভিনয়শিল্পীর সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়।
একটা গল্পকে পুরোপুরিভাবে তুলে ধরতে তাদের যে প্রয়াস, তার জন্যই আমরা পূর্ণাঙ্গ আর উপভোগ্য একটা সিনেমা দেখে নিয়ে বাহবা দিই। আজকের লেখায় এমন কিছু অভিনয়শিল্পীর কথা বলবো, যারা চরিত্রের প্রয়োজনে শরীরের ওজন বদলে ফেলেছিলেন।
১. জেইক জিলেনহাল, সিনেমা: নাইটক্রলার
জিলেনহালকে আমরা সবাই প্রিন্স অব পার্সিয়া সিনেমার বদৌলতে চিনি ইতোমধ্যে। সুঠাম দেহ, খোঁচা-খোঁচা দাড়ি আর কাঁধ অবধি ছড়ানো লম্বা চুলের প্রিন্স সিনেমার মাধ্যমে সবার মন জয় করে নিতে পেরেছিল।
এবার তিনি হাজির হয়েছিলেন আরেকটি চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে। নাইটক্রলার সিনেমার জন্য জিলেনহালকে শরীরের ওজন কমাতে হয়েছিল। সিনেমাটিতে জিলেনহাল অভিনয়ের পাশাপাশি প্রযোজক হিসেবেও ছিলেন।
সিনেমার গল্পটি ক্যারিয়ার নিয়ে সংগ্রাম করা এক ফ্রিল্যান্স ফটোসাংবাদিকের, যে ঘটনাচক্রে লস এঞ্জেলসে’র আন্ডারওয়ার্ল্ড ক্রাইম জগতের মুখোমুখি হয়।
চরিত্রটিকে ফুটিয়ে তুলতে জিলেনহালকে নিজের স্বাভাবিক ওজনের চেয়ে অনেকটা ওজন কমাতে হয়েছিল। তবে তাকে স্পেশাল কোনো ডায়েটই মেনে চলতে হয়নি। কেবল নিজের খাওয়ার অভ্যাসকে একটু কমিয়ে ফেলতে হয়েছে।
ব্যাস, এতেই তিনি হয়ে হয়ে গেলেন গড়পড়তা একজন সাধারণ মানুষ। শুটিং চলাকালীন বেশিরভাগ সময়েই জিলেনহাল চুইংগাম চিবুতেন। নিজেকেই যেন বুঝ দেওয়া, সবসময়ই কিছু না কিছু খাচ্ছি; ব্রেইনের সাথে প্রতারণা যাকে বলে আর কী!
বিশেষ করে রাতের খাবার বলতে গেলে ছেড়েই দিয়েছিলেন পুরো শুটিংয়ের সময়জুড়ে। হালকা নাশতা আর সবজির সালাদ খেয়েই নিজেকে অভ্যস্ত করে তুলেছিলেন। ২০১৪ সালে রিলিজ পাওয়া নাইটক্রলার সিনেমাটির বাজেট ছিল ৮.৫ মিলিয়ন ডলার এবং এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে সিনেমাটি।
২. ন্যাটালি পোর্টম্যান, সিনেমা: ব্ল্যাক সোয়ান
ন্যাটালি পোর্টম্যানের জন্য ব্ল্যাক সোয়ান সিনেমাটি ছিল একটি পরীক্ষা। সম্পূর্ণ নতুন একটি চরিত্রের জন্য নিজেকে তৈরি করে তুলেছিলেন তিনি। তবে যাত্রাটা মোটেই সহজ ছিল না। প্রায় ১ বছর ধরে তাকে ৫-৬ ঘন্টা ব্যায়াম করতে হয়েছে নিজের শরীরকে নির্দিষ্ট আকারে আনতে।
পুরো সময়টা জুড়ে কড়া রুটিন, ব্যায়াম আর ডায়েটের মাধ্যমে একজন নর্তকী চরিত্রের জন্য তৈরি হতে হয়েছে। তাকে সিনেমার শুটিংয়ের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে বলেন,
মাঝে মাঝে মনে হতো, আমি এখনই না খেয়ে মারা যাব।
এই দীর্ঘ যাত্রাপথে তাকে নাচের সব কলাকৌশল শেখানো হয়। স্টেজে পারফর্ম করার জন্য সকল খুঁটিনাটি তাকে আয়ত্ত করতে হয়েছিল। নিজের অভিনয়ের মেধা আর দীর্ঘ প্রশিক্ষণ তাকে নর্তকীর চরিত্রটিকে ফুটিয়ে তুলতে পথ দেখিয়েছে।
ভি ফর ভেন্ডেটা সিনেমায়ও ন্যাটালি পোর্টম্যান ছিলেন সহজাত, যার পেছনে ছিল কঠোর পরিশ্রম, ইচ্ছাশক্তি আর তার মেধা।
৩. ক্রিস প্র্যাট, সিনেমা: গার্ডিয়ান্স অব দ্য গ্যালাক্সি
সাইফাই সিনেমা গার্ডিয়ান্স অব দ্য গ্যালাক্সিতে একজন স্টারলর্ডের ভূমিকায় অভিনয় করা ক্রিস প্র্যাটকেও শরীরের ওজন কমাতে হয়েছিল। তিনি যখন মার্ভেল স্টুডিওতে সিনেমাটির জন্য অডিশন দিচ্ছিলেন, তার ওজন ছিল ১৩০ কেজির আশপাশে!
স্টারলর্ডের ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য তাকে ৬ মাস ধরে কায়িক পরিশ্রম করতে হয়। নিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস আর ব্যায়ামের মাধ্যমে ক্রিস নিজেকে চরিত্রটির জন্য পারফেক্ট করে তোলেন।
নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে ক্রিস বলেন,
আমাকে শরীরের ওজন কমাতে বেশি-বেশি খেতে হয়েছে আর ব্যায়াম করে ক্যালরি ঝরাতে হয়েছে।
তবে বেশি খাওয়া-দাওয়া করে ওজন কমানোর জন্য তাকে নির্দিষ্ট কিছু খাবারই খেতে হয়েছে পুরো সময়টাজুড়ে। প্রতিদিনের ব্যায়ামের মাঝে ছিল দৌড়, সাঁতার, বক্সিংসহ ঘাম ঝরানো সব কৌশল। সিনেমায় স্টারলর্ডের ভূমিকায় ক্রিস ছিলেন তুলনামূলক হাস্যরসাত্মক। সিরিয়াস মুহূর্তেও তার সেন্স অব হিউমার দর্শকদের হাসিয়েছে।
৪. ক্রিশ্চিয়ান বেল, সিনেমা: দ্য মেশিনিস্ট
সিনেমাটি একজন ফ্যাক্টরি কর্মীর গল্প নিয়ে সাজানো, যে কি না এক বছর যাবত অনিদ্রায় ভুগছে। প্রতিনিয়ত নিজের শরীর ভেঙে যেতে দেখছে সে, মৃত্যুর প্রহর গোনা ছাড়া তার আর কিছু করার নেই।
এই সিনেমাটির জন্য ক্রিশ্চিয়ান প্রায় ৩০ কেজি ওজন কমিয়ে ফেলেন। যদিও সিনেমাটির পরিচালক এতটা চাননি, কিন্তু তার ওজন কমানোটা শেষ পর্যন্ত বিপজ্জনক পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। মাত্র চার মাসের প্রচেষ্টায় ভিটামিন, সামান্য টুনা মাছ খেয়েই কাটিয়ে দিয়েছেন! একটা সময় গিয়ে তার হাড্ডিসার শরীর ছাড়া কিছুই ছিল না!
এই সিনেমায় অভিনয়ের কিছুদিন পরই ব্যাটম্যান বিগিন’স সিনেমার জন্য অফার আসে। ক্রিশ্চিয়ান ৬ মাসের ভেতর তার শরীর আবার ঠিকঠাক করে নেন। পরিমিত খাদ্য, প্রোটিন গ্রহণ আর ব্যায়ামের মাধ্যমে ব্যাটম্যান সিনেমার জন্য পুরোপুরি ফিট করেন নিজেকে।
৫. টম হ্যাঙ্কস, সিনেমা: কাস্ট অ্যাওয়ে
টম হ্যাঙ্কস তার অভিনয়ের জন্য বিশ্বব্যাপী সিনেমা বোদ্ধাদের মনে জায়গা করে নিয়েছেন। তার অভিনয় দক্ষতার কথা আর না বলি, বরং সিনেমায় অভিনয়ের জন্য তার খাটাখাটনি সম্পর্কে জানি।
২০০০ সালে টম হ্যাঙ্কস কাস্ট অ্যাওয়ে নামের একটি সিনেমার জন্য চুক্তিবদ্ধ হন। যেখানে তাকে একবার ওজন বাড়াতে হয়েছিল এবং গল্পের প্রয়োজনেই আবার ৩০ কেজি ওজন কমাতে হয়! সেই সময় তার বয়স হয়েছিল ৪৪ বছর, তারপরও টম চরিত্রটি করার ব্যাপারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন। প্রায় ১৬ মাস ধরে দুই কিস্তিতে সিনেমার দৃশ্য ধারণ করা হয়।
প্রথম পর্বে টমকে ওজন বাড়াতে হয় কিছুটা, তারপর চার মাসের বিরতিতে ৩০ কেজি ওজন কমিয়ে ফেলা। দীর্ঘ একটা সময়জুড়ে টম হ্যাঙ্কস বলতে গেলে পছন্দের কিছুই খেতে পারেননি। প্রতিদিনের ব্যায়াম আর ডায়েটের বদৌলতে তিনি তার কাঙ্ক্ষিত আকৃতিতে আসতে পেরেছিলেন।
এটা কী মিলিয়ন ডলার আয় করার প্রেরণা থেকে, নাকি সিনেমার প্রতি ভালোবাসা থেকে- সেটি তিনিই ভালো বলতে পারবেন। সে যা-ই হোক, সিনেমাপ্রেমীদের কাছে তার স্থান অন্য এক উচ্চতায়। এর আগে ১৯৯২ সালে আ লীগ অভ দেয়ার ওউন সিনেমায় জিমি ডুগান চরিত্রের জন্য টম ১৩ কেজি ওজন বাড়িয়েছিলেন।
৬. অ্যানা হ্যাথওয়ে, সিনেমা: লা মিজারেবল
ফরাসি ঔপন্যাসিক ভিক্টর হুগোর রচিত লা মিজারেবল এর কাহিনী টিভির পর্দায় তুলে আনা হয় ২০১২ সালে। সিনেমায় গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশে অভিনয় করেন অ্যানা হ্যাথওয়ে। একজন পতিতার চরিত্রে অভিনয়ের জন্য এনাকে ১১ কেজি ওজন কমাতে হয়েছিল।
সিনেমাটিকে অ্যানা এতটাই সিরিয়াসলি নিয়েছিলেন যে, তার স্বাভাবিক জীবন থেকে একরকম বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এটা তাকে নিজের কাজ থেকে বিরত রাখতে পারেনি।
কাজ শেষে যখন তিনি ফিরে আসেন, বলতে গেলে তার জন্য কেউই অপেক্ষা করছিল না। ৩০ বছর বয়সী অ্যানা হ্যাথওয়ে সেই বছরই অ্যাডাম সুলম্যানকে বিয়ে করেন। যখন অ্যানার অভিনয়ের পুরো সময়টা জুড়ে কেউ ছিল না, এই মানুষটাই তাকে আগলে রেখেছিলেন।
সেই সময়ে মিডিয়া পাড়ায় গুজব ছড়াতে থাকে অ্যানা দৈনিক ৫০০ ক্যালরির বেশি গ্রহণ করেন না! যেটা তাকে দ্রুত ওজন কমাতে সাহায্য করেছিল।
এছাড়াও দ্য ডার্ক নাইট রাইজেস সিনেমায় অভিনয়ের জন্য অ্যানা হ্যাথওয়ে পুরোদস্তুর একজন ভেজটেরিয়ান বনে গিয়েছিলেন। তার অভিনয় আর সিনেমার সাফল্যের কথা সবারই জানা।
৭. জোয়াকিন ফিনিক্স, সিনেমা: জোকার
গোথাম শহরের একচ্ছত্র ভিলেন আর ব্যাটম্যানের গলার কাঁটা এই ‘জোকার’ চরিত্রটি বিশ্বব্যাপী দর্শক সমাদৃত। সেই শুরু থেকেই চরিত্রটি ফুটিয়ে তুলেছেন আধাডজন অভিনেতা।
হিথ লেজার জোকার চরিত্রটিতে অন্য একটি মাত্রা যোগ করেছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় এবার জোকারকে নিয়েই পুরো একটি সিনেমা তৈরি হচ্ছে! জোকারপ্রেমীদের কাছে এটা আনন্দেরই সংবাদ বটে।
কিন্তু জোয়াকিন ফিনিক্সের জন্য সিনেমাটি ‘ক্যারিয়ার জাম্প’ হতে পারে। তাই জোয়াকিনও নিজেকে তৈরি হয়েছেন সেভাবেই। এরকম চ্যালেঞ্জিং একটি চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে তার চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না।
জোয়াকিন প্রথমে ভেবেছিলেন সিনেমার জন্য তাকে ওজন বাড়াতে হবে। কিন্তু উল্টো ৫৫ পাউন্ড ওজন কমিয়ে ফেলেছেন চোখের পলকে! ফিনিক্সের মতে,
জোকার একটি মনস্তাত্ত্বিক কাল্পনিক চরিত্র। তাই চরিত্রটিকে এমনভাবে ফুটিয়ে তুলতে হবে, যাতে কোনো সাইকিয়াট্রিস্টও তাকে ব্যাখ্যা করতে না পারে।
বর্তমানে বিশ্বমিডিয়া জোকারকে নিয়ে খুবই আগ্রহী, তাদের সঙ্গে পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে থাকা হাজার-হাজার জোকারপ্রেমীও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে সিনেমাটির জন্য।