এ পৃথিবীতে দারিদ্র্য এক ভয়াবহ ব্যাধির নাম। আর এই ব্যাধিতে আক্রান্ত মানুষেরাই বোঝে এর যন্ত্রণা। তবে সেই যন্ত্রণা একসময় যখন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখন তা মানুষকে অন্যায় করতে শেখায়।
ট্যানার ও টবি হাওয়ার্ড নামের দুই ভাইয়ের জন্ম টেক্সাসের এক দরিদ্র পরিবারে। বড় ভাই ট্যানার মাত্র এক বছর আগে নিজের বাবাকে খুনের দায়ে দশ বছর জেল খেটে এসেছে। জীবনের কাছে তার চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। আপন বলতে এক ভাই বাদে আর কেউ নেই তার। যেভাবে চলছে চলুক মনোভাব নিয়েই কেটে যাচ্ছে তার দিন।
আর অন্যদিকে টবি বরাবরই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিল। বিচ্ছেদের পর তার স্ত্রী দুই সন্তান নিয়ে আলাদা থাকে। তবে স্ত্রী-সন্তানের নিয়মিত দেখভাল, সংসারের যাবতীয় খরচ সবই বহন করে টবি। বড় ভাইয়ের মতো নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবে না সে। কিন্তু সে চায় না, তাদের ভাইয়ের মতো অবস্থা হোক তার দুই সন্তানের। তাই সবসময় মাথায় একটাই চিন্তা, কীভাবে তার দুই সন্তানের ভবিষ্যৎ সুন্দর ও স্বচ্ছল করা যায়।
আর সে লক্ষ্যেই মৃত মায়ের র্যাঞ্চের মালিকানা ফিরিয়ে আনা জরুরি হয়ে পড়েছিল। মা মারা যাওয়ার আগ থেকেই টেক্সাসের এক মিডল্যান্ড ব্যাংকের কাছে বন্ধক ছিল র্যাঞ্চটি। টাকার অঙ্কটা এতটাই বেশি ছিল তার পক্ষে সহজ কোনো উপায়ে তা পরিশোধ করার উপায় ছিল না। তাই বাধ্য হয়েই অসৎ উপায়ের আশ্রয় নেয় দুই ভাই।
ছবি শুরু হয় ছোটখাট দুটি ব্যাংক ডাকাতি দিয়ে। নিজেদের র্যাঞ্চ বাঁচাতে শেষমেশ মিডল্যান্ড ব্যাংকেরই দুটি ব্রাঞ্চ লুট করে ট্যানার আর টবি। লুটের অংক দেখে এফবিআই কেস নিতে তেমন আগ্রহ না দেখালে কেসটি চলে যায় দুই প্রবীণ টেক্সান রেঞ্জারের হাতে। তৃতীয় ডাকাতির পর, পুরোদস্তুরভাবে দুই ভাইয়ের পেছনে লাগেন রেঞ্জার মার্কাস হ্যামিল্টন এবং আলবার্তো পার্কার। অপেক্ষা করতে থাকেন পরবর্তী ডাকাতির।
২০১৫ সালে সিকারিও দিয়ে বাজিমাত করার পরের বছরই আরও একটি অসাধারণ চলচ্চিত্র নিয়ে হাজির হয়েছেন চিত্রনাট্যকার টেইলর শেরিডান। আর চলচ্চিত্র পরিচালনায় ছিলেন ব্রিটিশ চিত্র পরিচালক ডেভিড ম্যাকেঞ্জি। তবে মজার ব্যাপার হলো- সেই ২০১২ সাল থেকে ব্ল্যাকলিস্টে পড়ে ছিল এই সিনেমার স্ক্রিপ্ট। শেষমেশ তাতে হাত দেন ম্যাকেঞ্জি। দেরিতে হলেও এই দুজন মিলে যেন ভিন্নধর্মী এক ওয়েস্টার্নের স্বাদ দিলেন দর্শকদের।
এ ছবির পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে দারিদ্র্যের বিষাদ আর তা অতিক্রম করার জন্য একটি পরিবারের লড়াই ও আত্মত্যাগ। স্বল্প পরিসরের ছবিতে চেষ্টা করা হয়েছে সামাজিক রাজনৈতিক পটভূমি তুলে ধরার।
পুরো ছবি জুড়েই যে বিষয়টি স্পষ্টভাবে বোঝানো হয়েছে তা হলো আধুনিক পশ্চিমা সমাজের আসল খলনায়ক হচ্ছে ব্যাংকগুলো। লুট হওয়া প্রথম ব্যাংকের দেয়ালে স্প্রে করে লেখা ছিল, ‘ইরাকে তিনটি ট্যুর অথচ মুক্তি নেই আমাদের মতো মানুষেরও’। ঋণের কঠিন মারপ্যাঁচে পড়ে ভূমিহীন সুবিধাবঞ্চিত মানুষেরা বিরক্ত ও ক্রুদ্ধ সমসাময়িক ব্যাংকিং ব্যবস্থার উপর। তাই ব্যাংক ডাকাতদের শনাক্ত করতে গিয়ে স্থানীয়দের কাছ থেকে তেমন কোনো সহযোগিতা পাননি রেঞ্জাররা; সেই দৃশ্যে এক মধ্যবয়স্ক লোক বলেন, “গত ত্রিশ বছর ধরে ব্যাংকই তো আমাদের লুট করে যাচ্ছে।”
ছবিটি মূলত চারটি চরিত্রকে ঘিরেই। বাকি চরিত্রগুলো ছিল অনেকটা ক্যামিওর মতো। তবে কেউই নিজেদের অভিনয়ে কোনো ত্রুটি রাখেননি। ট্যানারের চরিত্রে বেন ফস্টার আর মারকাসের চরিত্রে জেফ্রি ব্রিজেসের অভিনয় ছিল অসাধারণ। বেন ফস্টার সচরাচরই চমৎকার অভিনয় করে থাকেন। বিশেষ করে ইন্ডি ফিল্মগুলোতে তার অভিনয় অবাক করার মতো। তিনি হলিউডের আন্ডাররেটেড অভিনেতাদের মধ্যে একজন। আর ড্যুডখ্যাত জেফ ব্রিজেসের কথা নতুন করে আর কী বলার আছে। তিনি হলিউডের চমৎকার অভিনেতাদের মধ্যে একজন এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তবে মানুষ চোখ দিয়েও এত সুন্দর অভিনয় করতে পারে, তা এই সিনেমা না দেখলে বোঝা যাবে না!
সবচেয়ে বেশি অবাক করেছেন টবি চরিত্রে অভিনয় করা ক্রিস পাইন। তিনি বরাবরই বিগ বাজেট সিনেমাতে অভিনয় করে থাকেন। কিন্তু ইন্ডি ফিল্মে বেন ফস্টার আর জেফ ব্রিজেসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করার দক্ষতাও যে তার আছে, সে ব্যাপারটি ভালো করে দেখিয়ে দিয়েছেন। যদিও পাননি, কিন্তু অস্কারের মনোনয়ন পাওয়ার মতোই কাজ দেখিয়েছেন।
বেস্ট পিকচারসহ মোট চারটি ক্যাটাগরিতে অস্কারে নমিনেশন পেয়েছে সিনেমাটি। জেফ ব্রিজেস পেয়েছেন সেরা সহ-অভিনেতার মনোনয়ন, মৌলিক চিত্রনাট্যের জন্য টেইলার শেরিডান এবং ফিল্ম এডিটিং ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন পেয়েছেন জেইক রবার্টস।
এই সিনেমার সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, সিনেমাটি টেক্সাসকেন্দ্রিক হওয়া সত্ত্বেও এর কোনো দৃশ্য ধারণ করা হয়নি টেক্সাসে। সম্পূর্ণ চলচ্চিত্রের শুটিং হয়েছে নিউ মেক্সিকোতে। হাইওয়ে থেকে শুরু করে এর চারপাশে দৃশ্যগুলো এতটাই সজীব ও প্রাণবন্ত যে তা বোঝার কোনো উপায় নেই। সিনেমাটোগ্রাফার গিলস নাজেন্স প্রত্যেকটি দৃশ্য এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যেন মনে হয়েছে, আসলেই টেক্সাসের কোনো অঞ্চলের গল্প।
আবহ সঙ্গীত হিসেবে এতে ব্যবহার করা হয়েছে চমৎকার সব সাউন্ডট্র্যাক। টেইলর শেরিডানের চিত্রনাট্য তথাকথিত কপট সংলাপের পরিবর্তে মানুষের কথা বলার বাস্তব রূপকে ফুটিয়ে তুলেছে, যা কি না একইসঙ্গে শ্রুতিমধুরও। সংলাপগুলো খুব সাধারণ হয়েও ছিল মনে রাখার মতো অসাধারণ।