ঋতুপর্ণ ঘোষ– এই নামটির সাথে জড়িয়ে আছে হাজারো আলোচনা-সমালোচনা, তর্ক-বিতর্ক, ভালোবাসা-ঘৃণা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির গল্প। বাংলা সিনেমার জগতে তার পদচারণা ছিল বীরের মতো। পারিবারিক বা মানবজীবনের পারস্পারিক সম্পর্কগুলোর মধ্যকার জটিল মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েনকে এতো সহজ করে উপস্থাপন করেছেন তিনি যে, যেকোনো শ্রেণীর দর্শক তাতে মুগ্ধ না হয়ে পারবে না। তিতলি, উনিশে এপ্রিল, দহন, বাড়িওয়ালি, অসুখ, উৎসব, শুভ মহরত, চোখের বালি, রেইনকোট, অন্তরমহল, দোসর, সব চরিত্র কাল্পনিক, আবহমান, আরেকটি প্রেমের গল্প, নৌকাডুবি, চিত্রাঙ্গদা, সানগ্লাস, মেমোরিজ ইন মার্চ, জীবনস্মৃতি, সত্যান্বেষী, খেলা, দ্য লাস্ট লিয়ার তার অনবদ্য সব চলচ্চিত্র।
১৯৬৩ সালের ৩১ আগস্ট কলকাতার এক চলচ্চিত্রপ্রেমী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন বরেণ্য এই চলচ্চিত্র নির্মাতা। তার বাবা সুনীল ঘোষ ছিলেন চিত্রশিল্পী এবং ডকুমেন্টারি ফিল্ম নির্মাতা। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্র ঋতুপর্ণের কর্মজীবন শুরু হয় বিজ্ঞাপন সংস্থার ক্রিয়েটিভ আর্টিস্ট হিসেবে। ১৯৯২ সালে তিনি পা রাখেন চলচ্চিত্রে জগতে। প্রথম সিনেমা ‘হীরের আংটি’ মুক্তি পায় সেই বছর। ১৯৯৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত দ্বিতীয় সিনেমা ‘উনিশে এপ্রিল’ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এনে দেয় তাকে। ২০১৩ সালের ৩০মে কলকাতায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণকারী এই চলচ্চিত্র পরিচালক তার দুই দশকের কর্মজীবনে বারোটি জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেছেন।
ঋতুপর্ণ ঘোষের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আগ্রহের কোনো কমতি নেই দর্শক কিংবা তার ভক্তদের মাঝে। কৌস্তভ বকসীকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি তুলে ধরেন একান্ত ব্যক্তিগত বেশ কিছু বিষয়। পাঠকদের জন্য সেই সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশের অনুবাদ উপস্থাপন করা হলো।
বেশ কিছু জায়গায় আপনি বলেছেন যে সত্যজিৎ রায় আপনার গুরু। আবছাভাবে আমার মনে পড়ছে আপনি একটি আর্টিকেলে লিখেছিলেন, “তাকে অভিভাবক বলব না কেন”, কিন্তু আপনি কি নিজেকে রায় ঘরানার একজন বলে মনে করেন? নাকি অজয় কর, অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়, তপন সিনহা, তরুণ মজুমদারদের দেখানো বাংলা সিনেমার জনপ্রিয় ধারাটিই বজায় রাখছেন আপনি?
ঋতুপর্ণ ঘোষ: সত্যজিৎ রায়ই আমাকে চলচ্চিত্র নির্মাতা হতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। আমি জানি না আমার সিনেমাগুলো তপন সিনহা কিংবা অজয় করের মতো মনে হয় কিনা। যদি হয়, তাহলে তা একেবারেই কাকতালীয়। তবে হ্যাঁ, আমি অজয় কর বা তরুণ মজুমদারের সিনেমা দেখতে ভালোবাসি। আমি করের সাত পাকে বাঁধার বেশ ভক্তও বলা যায়। তার শিল্পভাণ্ডারের মধ্যে এই সিনেমাটির আলাদা একটা আবেদন আছে। আপাতদৃষ্টিতে এই ছবিটির কিছুটা ছায়া পাওয়া যায় উনিশে এপ্রিলে। তবে উনিশে এপ্রিল মূলত সত্যজিৎ রায়ের জলসাঘর থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই তৈরি করেছি আমি। দূরদর্শনে দেখছিলাম সিনেমাটি, তখনই মাথায় আসে উনিশে এপ্রিলের আইডিয়া। খেয়াল করে দেখবেন, টেলিভিশনে কোনো সিনেমা দেখার সময় সিনেমাটির প্রতি আপনার দৃষ্টিভঙ্গিই বদলে যাবে। টেলিভিশনে খুব কাছ থেকে চরিত্রগুলো দেখা যায়, পর্যবেক্ষণ করা যায়, তাদের সাথে নিজেকে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত করা যায়। টেলিভিশনের পর্দায় জলসাঘর দেখাটা আমার জীবনে বেশ উল্লেখযোগ্য একটা পরিবর্তন আনে। অবসরপ্রাপ্ত এক নাচিয়ের গল্প তাৎক্ষণিকভাবে আমার মাথায় খেলে যায়। মেয়ের চরিত্রটি অবশ্য অনেক পরে ভেবেছিলাম, মাকে নিয়ে গল্প সাজাতে গিয়েই মেয়ের আগমন ঘটে এখানে।
উনিশে এপ্রিল সিনেমাটির নামটা কিছুটা অগতানুগতিক। এই দিনটি কি আপনি রবীন্দ্রনাথের নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবীর আত্মহত্যা চেষ্টার তারিখটি মাথায় রেখেই বেছে নিয়েছিলেন? আপনার গল্পের মূল চরিত্রও তো আত্মহত্যার চেষ্টা করে।
ঋতুপর্ণ ঘোষ: মোটেই না। সত্যি বলতে, আমি তখন জানতামই না কাদম্বরী দেবী ঐদিন আত্মহত্যার চেষ্টা করে দু’দিন পরে মারা যান। আমি ১৯ তারিখটি বেছে নিয়েছিলাম একেবারেই ভিন্ন একটি কারণে। দেখুন, ক্যালেন্ডার এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা পালন করেছে। আমার একটা তারিখের দরকার ছিল, এমন একটা সংখ্যার কথা ভাবছিলাম পরদিন যেটার দুটো অংকই বদলে যাবে, একদম নতুন একটি দিন শুরু হবে। ১৯ তারিখ শেষে আসবে ২০ তারিখ, সংখ্যাটা পুরোপুরি বদলে যাবে। বদলে যাবে চরিত্রগুলোর জীবনও। নতুন দিনের শুরুর সাথেই গল্পের শেষের সংযোগ ঘটাতে চেয়েছিলাম আমি।
আর এপ্রিল মাসটা বেছে নেয়া একেবারেই ভিন্ন কারণে। এপ্রিলের সন্ধ্যার দিকে প্রায়সময় কালবৈশাখী ঝড় ওঠে। ঝড়-বৃষ্টির ঐ দৃশ্যটা আমার খুব দরকার ছিল। এ কারণেই অমন একটি শিরোনাম বেছে নিয়েছিলাম আমি!
আপনি অনেক সময় বলেছেন আপনার বেড়ে ওঠাটা অনেকটা ঘরের আঙিনাকে কেন্দ্র করেই হয়েছে, মানে ভারতীয় সিনেমাকে ঘিরেই আপনার শৈশব-কৈশোর গড়ে উঠেছে। আপনি নাকি ইউরো-আমেরিকান চলচ্চিত্রগুলোতে ততোটা দক্ষ নন।
ঋতুপর্ণ ঘোষ: হ্যাঁ, সেটা সত্যি। হলিউডের সিনেমার সাথে আমার সখ্যতা গড়ে উঠেছে অনেক দেরিতে। আসলে উচ্চারণ নিয়ে আমার বড্ড ঝামেলা ছিল। আমার মনে আছে, ছোটবেলায় একবার ইংরেজি মুভি দেখতে গিয়ে একটা দৃশ্য কোনোভাবেই আমি বুঝতে পারছিলাম না। অভিনেতাদের কথা তো আরও দুর্বোধ্য মনে হচ্ছিল। এরপর থেকে ইংরেজি মুভির প্রতি টানই কমে গেছিল। আর সে সময় থিয়েটারে সাবটাইটেলের কোনো ব্যবস্থাও ছিল না। বিশ্বাস করবেন, মার্লন ব্রান্ডোর সাথে আমার পরিচয় হয় ডিভিডিতে? এই দিনগুলোতে আমি বেছে বেছে হলিউডের কয়েকজন অভিনেতা আর পরিচালকের সিনেমা দেখতাম।
আমার ধারণা, সাক্ষাৎকার নিতে এসে যে কেউ আপনাকে একটি প্রশ্ন অবশ্যই করবে। যেকোনো মানুষকে এমন দুর্দান্ত অভিনেতায় পরিণত করা- কিভাবে করতেন আপনি কাজটি? আমি জানতে চাইছি, প্রতিষ্ঠিত তারকারা কিংবা যারা নাম করে গেছেন কিন্তু ভালো অভিনয় জানেন না বা একেবারেই নবাগত, শিশুশিল্পী সবাইকে কীভাবে সামলান আপনি? শ্রেণীভেদে কি ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি প্রয়োগ করেন?
ঋতুপর্ণ ঘোষ: অবশ্যই, একেকজনের জন্য একেবারেই আলাদা পদ্ধতির কথা ভাবি।
কার সাথে কাজ করে আপনি সবচেয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছেন?
ঋতুপর্ণ ঘোষ: আমি বলব, কিরণ খেরের সাথে কাজ করতে আমার বেশি ভালো লেগেছে। তিনি যদি বাংলা জানতেন, আমি আরও অসংখ্যবার তার সাথে কাজ করতাম। আমি শুধু তাকে বলেছি আমি কী চাই, বাকিটা উনি একেবারেই সাবলীলভাবে করে গেছেন। আমি তাকে বলেছিলাম বনলতার বয়স বাড়ছে আর তার সাথে শরীরের প্রতিটি জোড়ায় ব্যথাও বাড়ছে। কাজেই বসা অবস্থা থেকে হঠাৎ করে উঠে দাঁড়ানোটা তার জন্য কষ্টকর, সেই অভিব্যক্তিটা এভাবে বোঝাতে হবে (ঋতুপর্ণ দাঁড়িয়ে হেঁটে দেখান)। আমাকে অবাক করে দিয়ে প্রথমবারেই কিরণ তার চেহারায় সেই কস্তটা ফুটিয়ে তোলেন! সাধারণত তিনি ওয়েস্টার্ন জামাকাপড় পরতে বেশি পছন্দ করেন। কিন্তু যে কদিন তিনি আমার সাথে কাজ করেছেন, চরিত্রের সাথে মিল রেখে প্রতিদিন তিনি শাড়ি পরেই আসতেন।
এবার একেবারে ভিন্ন একটি প্রসঙ্গে জানতে চাইছি। আপনার প্রায় সবগুলো সিনেমাতে শারীরিক সম্পর্ক বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আপনি কখনো রুপক অর্থে শারীরিক মিলন তুলে ধরেননি, বরং বিনয়ের সাথে আপনি যৌনতাকেই দেখিয়েছেন। তাহলে অন্তরমহল সিনেমার ব্যাপারে মধ্যবিত্ত বাঙালি শ্রেণী যখন আপত্তি জানালো তখন আপনি ক্ষমা চাইলেন কেন?
ঋতুপর্ণ ঘোষ: আচ্ছা, সিনেমার বিষয়বস্তুর সাথে প্রাসঙ্গিক যা কিছু দেখানো হয়েছে তা নিয়ে কখনোই আমার মধ্যে কোনো অনুশোচনা কাজ করেনি। আমি ক্ষমা চেয়েছিলাম দর্শকের সাথে ভুল বোঝাবুঝির জন্য। মানে, সিনেমার কোনো পোস্টারেই এমন ঘনিষ্ঠ দৃশ্যের ব্যাপারে কোনো ইঙ্গিত দেয়া হয়নি। চারজন প্রধান চরিত্রের ক্লোজ আপই পোস্টারে প্রাধান্য পেয়েছে। প্রায় একই সময়ে নির্মিত বিবর চলচ্চিত্রটির বেলায় সব ধরনের প্রমোশনে ‘অ্যাডাল্ট’ বিষয়বস্তু আছে তা উল্লেখ করে দিয়েছিলাম। আমি অবশ্য চাইনি সিনেমার পোস্টারগুলো উত্তেজক হোক, হতে পারে এটাই একটা ভুল ছিল। মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারগুলো, বিশেষ করে যারা বাচ্চা নিয়ে সিনেমা দেখতে গিয়েছিল, এই ধরনের কোনো দৃশ্য দেখার জন্য তারা মোটেই প্রস্তুত ছিল না।
আপনার প্রায় সব চলচ্চিত্রেই নারীর অন্তর্নিহিত অনুভূতিগুলো উঠে এসেছে, কিন্তু একটিকেও ঠিক নারীবাদী সিনেমা বলা চলে না। র্যাডিকেল ফেমিনিজম নিয়ে ভারত কিংবা বিশ্বের আর কোথাও কি কোনো চলচ্চিত্র নির্মাণ করা সম্ভব নয়?
ঋতুপর্ণ ঘোষ: ঠিক বলেছেন, পিতৃতান্ত্রিক সমাজে বসে একেবারেই উল্টো ধারায় গিয়ে নারীবাদ নিয়ে কাজ করাটা খুব কষ্টকর। আমি তাই সিনেমাগুলোকে ‘উইমেনিস্ট’ বলে ডাকি, ‘ফেমিনিস্ট’ না।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল? তাকে নিয়ে গবেষণা করে ডকুমেন্টারি তৈরি করার সময় নতুন কিছু পেলেন?
রবীন্দ্রনাথ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমি সবসময় অনুভব করেছি যে তার লেখায় প্রতি মুহূর্তে তার ব্যক্তিত্বের প্রতিফলন ঘটে। আর একটি ডকুমেন্টারিতে রবীন্দ্রনাথকে চিত্রায়িত করা মোটামুটি অসম্ভব একটা কাজ… দশটা ডকুমেন্টারিও বোধহয় কম হয়ে যাবে।
ঠাকুরবাড়ির এই প্রজেক্ট ছাড়া আর কোন ধরনের কাজ করার কথা ভাবছেন? সিনেমা নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
দেখুন, আমি সবসময় নতুন ঘরানার সিনেমা তৈরি করতে চাই। তাছাড়া আমি ঠিক তা-ই বানাই, যা আমি নিজে বানাতে চাই। উনিশে এপ্রিল, বাড়িওয়ালি, দোসর, আবহমান এগুলো তো হলো। আমি এবার আরও ভিন্ন রকম কিছু বানাতে চাই। মহাভারত সবসময় আমাকে ভীষণভাবে টানে। বৃহন্নলা অর্জুনের চরিত্রটি নিয়ে কাজ করতে চাই এবার। তার জন্য অবশ্য অনেক মাথা খাটিয়ে গবেষণা করতে হবে, হোমওয়ার্ক করতে হবে। একদিন আমি এই চরিত্রটি নিয়ে সিনেমা বানাবো।
(শেষ পর্যন্ত ‘চিত্রাঙ্গদা’ সিনেমায় চিত্রাঙ্গদার পাশাপাশি বৃহন্নলা অর্জুনকেও কিছুটা চিত্রায়িত করেছিলেন তিনি, তবে শুধু অর্জুনকে নিয়ে সিনেমা বানানো আর হয়ে ওঠেনি তার।)
(সংক্ষেপিত)
ফিচার ইমেজঃ gaysifamily.com