নাম তার হার্লিন ফ্রান্সিস কুইঞ্জেল। সে বেড়ে উঠেছে রগচটা বদমেজাজি মা আর ভাঁওতাবাজ নারীলোভী পিতার পরিবারে এক বিদঘুটে পরিবেশে। তার মা তাকে সারাদিন বকাঝকা করতো। মায়ের স্নেহবঞ্চিত হার্লি চুপচাপ সয়ে নিতো সব। তার দু’চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়তো বিষাদের অশ্রু। সে মা-বাবার একমাত্র সন্তান নয়। তার একটি ছোট ভাইও ছিল। ছোটভাই তার ছেলেমেয়ে নিয়ে তাদের সাথেই একসাথে থাকতো। হার্লি মাঝে মাঝেই ভাইকে মোটা অংকের টাকা দিতো, যাতে সে স্বাবলম্বী হতে পারে। কিন্তু প্রত্যেকবারই সে টাকাগুলো অযথা নষ্ট করতো।
হাই স্কুল পাশ করার পর হার্লি ঠিক করে, সে মনোবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করবে। মূলত বাবার কাণ্ডকারখানাই ছিল মনোবিদ্যার প্রতি তার আকর্ষণের মূল হেতু। তার জানার খুব ইচ্ছা, কেন তার বাবা অন্যা মহিলাদের সাথে প্রতারণা করে বেড়ায়। সেখানে তার বন্ধুত্ব হয় গাই কপস্কি নামের এক যুবকের সাথে। সেই বন্ধুত্ব প্রণয়ে পরিণত হওয়ার পর প্রেমে পড়া আর অপরাধ বিষয়ে অদ্ভুত এক যুক্তি খুঁজে বের করে হার্লি। সে মনে করতে শুরু করে, প্রেম আর অপরাধের ভেতরে রয়েছে গভীর কোনো যোগাযোগ। একজন মানুষ ভালোবাসার জন্য বড় ধরনের অপরাধ করতে দ্বিধা বোধ করে না। ভালোবাসার জন্য মানুষ কতদূর যেতে পারে সেটা পরীক্ষা করার জন্য গিনিপিগ হিসেবে সে বেছে নেয় নিজের প্রেমিককেই।
গাইয়ের কাছে নিজেকে অপরাধী হিসেবে তুলে ধরার জন্য বানিয়ে বানিয়ে নিজের ব্যাপারে বিভিন্ন কাহিনী শোনাতে থাকে সে। ভালোবাসায় অন্ধ ছেলেটি সেগুলো বিশ্বাস করতে শুরু করে। তারপর একদিন হার্লি তার সামনে হাজির হয় নতুন এক ঘটনা নিয়ে। ঘটনাচক্রে সে নাকি তাদের অধ্যাপককে খুন করেছে এবং এই অপরাধ থেকে বাঁচানোর জন্যে গাইয়ের কাছে অনুনয় করে। গাই হার্লিকে নিয়ে ঘটনাস্থলে যায় এবং তাকে বাঁচাতে মৃত ভেবে নিরপরাধ জীবিত ব্যক্তিকে খুন করে বসে। পরে তার ভুল বুঝতে পেরে দুর্ঘটনায় অনুতপ্ত গাই আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং এজন্য হার্লির কাছে সাহায্য চায়। প্রেমিককে এই মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে ভালোবাসার স্বার্থে তাকে খুন করে পুরো ঘটনাকে আত্মহত্যা হিসেবে চালিয়ে দেয় হার্লি!
গাই প্রায়ই তাকে বলতো যে, পৃথিবী আসলে একটি বিশৃঙ্খল জায়গা। তখন কথাটি সেভাবে পাত্তা না দিলেও সম্প্রতি ঘটা দুর্ঘটনায় মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হার্লি সেটা বিশ্বাস করতে শুরু করে। ঠিক সেই সময় গোথামে হাজির হয় নতুন এক অপরাধী, নাম তার জোকার। লোকমুখে জোকারের অতীত নিয়ে বিভিন্ন কাহিনী শোনার পর নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা এবং তার প্রেমিকের সাথে জোকারের অদ্ভুত মিল খুঁজে পায় সে। জোকারের সাথে একবার দেখা করার জন্যে উতলা হয়ে ওঠে হার্লি, খোঁজ নিয়ে জানতে পারে ব্যাটম্যান জোকারকে ধরে পাঠিয়ে দিয়েছে আরখামের মানসিক হাসপাতালে।
ততদিনে পড়াশোনা শেষ তার। তাই সে সিদ্ধান্ত নেয় আরখামে চাকরি নেওয়ার। প্রথমে সে আরখাম মানসিক হাসপাতালে যোগদান করে একজন শিক্ষানবিশ ডাক্তার হিসেবে। জোকারের সাথে তার প্রথম দেখা হয় সেখানেই। তার নামের সাথে ইতালির নামকরা ভাঁড় হার্লেকুইনের নামের মিল থাকায় জোকারেরও নজর পড়ে তার উপর। প্রথম দিনেই সে হার্লির অফিসে একটি চিরকুট পাঠায় যাতে লেখা ছিল- “মাঝেমধ্যে আমাকে দেখতে এসো।” জোকারের এসব উদ্ভট কাজকর্মে তার উপর কৌতূহল বাড়তে থাকে হার্লির। নিজ থেকেই জোকারের থেরাপি সেশনের দায়িত্ব নেয় সে। তাদের বিভিন্ন সেশনে জোকারের কাছ থেকে তার বিষাদময় অতীত এবং পাষণ্ড বাবার হাতে নির্যাতিত হবার বিভিন্ন গল্প শুনতে শুনতে তার জন্য সহানুভূতির পাশাপাশি ভালোবাসা জেগে উঠে হার্লির মধ্যে। একসময় সে জোকারের প্রেমে পড়ে যায়। কিছুদিন পর জোকার আরখাম থেকে পালিয়ে গেলে ব্যাটম্যান তাকে পিটিয়ে আধমরা করে আরখামে ফেরত নিয়ে আসে। জোকারের মুমূর্ষু অবস্থা দেখে হার্লি মানসিকভাবে খুব কষ্ট পায়। রাগে-দুঃখে সেদিনই হার্লেকুইনের কস্টিউম জোগাড় করে ছদ্মবেশে জোকারকে নিয়ে আরখাম থেকে পালিয়ে যায় সে। হারলিন কুইঞ্জেল থেকে জন্ম হয় হার্লি কুইনের, শুরু হয় নতুন করে তার পথচলা।
পরে হার্লি জানতে পারে, জোকার তাকে যা কিছু বলেছে এর সবই মিথ্যা এবং তার মনগড়া কাহিনী। সে ইচ্ছাকৃতভাবে হার্লিকে এই গল্প শুনিয়েছে যাতে হার্লি নিজের সাথে জোকারের জীবনের মিল খুঁজে পায়। জোকার তাকে তা-ই শুনায়, ঠিক যতটুকু তার জানার প্রয়োজন। জোকারের শত অবহেলা-অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করে যায় হার্লি। তবে কখনও পালানোর চেষ্টা যে করেনি তা কিন্তু নয়; জোকারের জুলুম যখন সহ্যের সীমা অতিক্রম করে যেতো, তখন সে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যেতো। কিন্তু অনেকটা নির্যাতিত স্ত্রীর মতো আবার পরদিন ফিরে আসতো। সে কখনোই জোকারকে পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেনি। সে কখনও মনে করে জোকার তাকে প্রচণ্ড ভালবাসে, আবার কখনও তার মনে হয় জোকার তাকে ব্যবহার করেছে। রাগ-অভিমান আর বিরহের কঠিন মারপ্যাঁচ হার্লির ভালোবাসার জগতকে আচ্ছন্ন করে রাখে এবং তাদের সম্পর্কের পুরোটা সময় জুড়েই সে বিনয়ীর ভূমিকা পালন করে যায়।
হার্লি ডিসি কমিকসের জোকারের কুখ্যাত সাইডকিক হিসেবে বিশেষভাবে সুপরিচিত। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, কমিকস চরিত্র হিসেবে পরিচিত পেলেও হার্লি কুইনের অভিষেক হয়েছিল ‘ব্যাটম্যান দ্য অ্যানিমেটেড সিরিজ’ দিয়ে। প্রথম সিজনের ২২ নাম্বার পর্বে ‘জোকার’স ফেভার’-এ প্রথম দেখা মিলেছিল হার্লির। সিরিজের জন্য পল দিনি ও ব্রুস টিম মিলে চরিত্রটি তৈরি করেন। পরে সিরিজে দেখানো গল্প অনুসরণ করে প্রকাশিত কমিকস সিরিজ ‘দ্য ব্যাটম্যান অ্যাডভেঞ্চার’ এর ম্যাড লাভ ইস্যুতে হার্লির অতীত তুলে ধরা হয় এবং এই ইস্যুর উপর ভিত্তি করে অ্যানিমেশন সিরিজের চতুর্থ সিজনে একই নামে তৈরি একটি পর্বে হার্লির সেই অতীতের গল্প দেখানো হয়।
হার্লির সৃষ্টি পেছনে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করছেন অভিনেত্রী আর্লিন সরকিন। মূলত তার অভিনীত ‘ডেইজ অব আওয়ার লাইভস’ ড্রামার একটি পর্বে তাকে জেস্টারের কস্টিউম পরতে দেখা যায়। সেখান থেকে দিনি হার্লির পোশাক ও ব্যক্তিত্বের সুনির্দিষ্ট ধারণা খুঁজে পান। এমনকি হার্লির কণ্ঠস্বর দেয়ার জন্য নিয়ে আসা হয় স্বয়ং আর্লিনকেই। একটা সময় হার্লি এতোটাই জনপ্রিয়তা পায় যে, ডিসির প্রকাশকরা তাকে বিশেষ প্রাধান্য দিতে শুরু করেন এবং তাকে ডিসি মূল ধারার গল্পে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেন।
২০০২ সালে টিভিতে প্রচারিত লাইভ অ্যাকশন ড্রামা ‘বার্ডস অফ প্রে’তে অভিনেত্রী মিয়া সারা হার্লির চরিত্রে অভিনয় করেন।
পরে ২০১৬ সালে মুক্তি পাওয়া সুইসাইড স্কোয়াড সিনেমা ছাড়া অন্য কোনো মোশন ছবিতে আগে হার্লি কুইনের দেখা মেলেনি। এতে হার্লির চরিত্রে অভিনয় করেন অস্ট্রেলিয়ান অভিনেত্রী মার্গট রবি। ডিসি এক্সটেন্ড ইউনিভার্সের পুরোটা সময় জুড়েই হার্লির চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা যাবে তাকে।