১৯১২ সাল, টাইটানিক ডুবেছে কিছুদিন হলো। ঠিক এরকম থমথমে সময়ে প্রকাশিত হয় স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের একটি ক্লাসিক অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাস দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড। পরবর্তীতে অনেক লেখক এই উপন্যাস থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাস রচনা করেছেন। তবে স্যার আর্থার কোনান ডয়েল এর আগেই সুখ্যাতি লাভ করেছিলেন তাঁর রচিত চৌকষ চরিত্র শার্লক হোমস-এর মাধ্যমে। লস্ট ওয়ার্ল্ড প্রকাশিত হওয়ার পরবর্তী সময়ে এক সাক্ষাৎকারে স্যার আর্থার কোনান ডয়েল তাঁর লেখক জীবন ও ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছিলেন। বাংলা ভাষা-ভাষী আগ্রহী পাঠকদের জন্য সেই সাক্ষাৎকারটি উপস্থাপন করা হলো।
স্যার আর্থার কোনান ডয়েল আপনার সাথে দেখা করতে পেরে আনন্দিতবোধ করছি।
আমিও আনন্দিত আপনার সাক্ষাৎ পেয়ে। কিন্তু আমাকে স্যার বলতে হবে না, স্রেফ আর্থার বলে ডাকলেই হবে। হ্যাঁ, এটা ঠিক রাজা সপ্তম এডওয়্যার্ড ১৯০২ সালে আমাকে নাইট খেতাবে ভূষিত করেছেন দ্য ওয়ার ইন সাউথ আফ্রিকা নামের একটি বই লেখার জন্য। ওই বইয়ে আমি বোয়ারদের বিরুদ্ধে আমাদের সৈন্য পরিচালনা করার সমর্থনে বিশ্লেষণধর্মী বক্তব্য পেশ করেছিলাম।
কিন্তু আমি রাজার কাছ থেকে খেতাব নিতে আপত্তি জানিয়েছিলাম। কারণ, একজন ইংরেজ নাগরিক হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন করে এতবড় খেতাব পেয়ে যাওয়াটাকে আমার ঠিক যৌক্তিক মনে হয়নি। যদিও শেষমেশ আমার মা আমাকে খেতাবটি গ্রহণ করতে রাজি করাতে সমর্থ হন।
আপনার মা? তার মানে দাঁড়াচ্ছে আপনার মায়ের সাথে আপনার বেশ ভাল সম্পর্ক ছিল?
হ্যাঁ, অবশ্যই। খুব ভাল বোঝাপড়া ছিল আমাদের মধ্যে। দেখুন, ১৮৫৯ সালে আমার জন্মের পর থেকেই আমাকে বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। আমার বাবা ছিলেন একজন মদ্যপ ব্যক্তি, পরবর্তীতে অবস্থার অবনতির কারণে তাঁকে পাগলাগারদে রাখতে হয়েছে। তবে আমার মা আমাদের ভাই-বোনদের খুব যত্ন নিতেন। বিভিন্ন বীরদের বীরত্বগাঁথা নিয়ে গল্প শোনাতেন আমাদেরকে। খুব ভাল গল্প বলতে পারতেন তিনি।
এখানে একটা বিষয় জানিয়ে রাখি, আমার নামটা রাজা আর্থার-এর নামানুসারে রাখা হয়েছিল। মধ্যযুগীয় ব্রিটনে রাজত্ব কায়েম করা কিংবদন্তী রাজা ছিলেন তিনি। হতে পারে আমার মায়ের মুখ থেকে গল্প শুনে শুনে লেখক সত্ত্বা তৈরি হয়েছিল আমার ভেতরে। আমি প্রথম যখন গল্প লিখি তখন আমার বয়স মাত্র ছয় বছর।
আচ্ছা, তারপর থেকে মজার মজার গল্প লেখার যাত্রা শুরু হয় আপনার? ছোটগল্প, উপন্যাস সব লিখতে শুরু করেন?
না, ঠিক তা নয়। লেখালেখি করা ছাড়াও অনেক কিছু করেছি আমি। ১৮৯১ সালের আগে আমি কিন্তু লেখালেখিকে পেশা হিসেবে নিইনি। সৈনিক, সাংবাদিক, ডাক্তার এমনকি তিমি শিকারী হিসেবেও কাজ করেছি বিভিন্ন সময়ে।
তাহলে লেখালেখি জগতে আপনার অভিজ্ঞতা শোনার আগে এসব ভিন্ন ভিন্ন পেশায় আপনার কেমন অভিজ্ঞতা হয়েছিল সেগুলো শুনতে চাই…
এডিনবার্গ ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করেছিলাম মূলত ডাক্তার হওয়ার জন্য। মেডিসিন নিয়ে প্রাকটিসও করেছিলাম কয়েক বছর। কিন্তু ডাক্তারি পড়াবস্থায়, তৃতীয় বর্ষের পর আমি এক তিমি শিকারের জাহাজে শিপ সার্জন হিসেবে কাজ করেছি। দুই মাসব্যাপী গ্রিনল্যাণ্ড উপকূলে প্রচুর সীল মাছ ধরেছিলাম আমরা। তারপর তিমির খোঁজে উত্তরদিকেও রওনা হয়েছিলাম।
অন্যদিকে সৈনিক হিসেবে ছিলাম বোয়ার যুদ্ধে। ফিল্ড হাসপাতালে সিনিয়র ফিজিশিয়ানের দায়িত্ব পালন করেছি সেখানে। ওখান থেকে ফিরে আসার দুই বছর পর সেই যুদ্ধের যৌক্তিকতা ও অভিজ্ঞতা নিয়ে আমি দ্য ওয়ার ইন সাউথ আফ্রিকা বইটি লিখি।
এবার লেখালেখিতে আপনার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাই। প্লিজ, আমাদেরকে আপনার সৃষ্ট সবচেয়ে বিখ্যাত চরিত্র শার্লক সম্পর্কে জানান। চরিত্রটি তৈরির অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন কোত্থেকে?
চরিত্রটি আমার ইউনিভার্সিটির এক প্রফেসর থেকে অনুপ্রাণিত। তাঁর নাম ড. জোসেফ বেল। আমি খুব কাছ থেকে তাঁকে দেখেছি, কাজ করেছি তাঁর সাথে। রোগীর দিকে একবার তাকিয়েই তিনি প্রচুর তথ্য বলে দিতে পারতেন।
বিখ্যাত গোয়েন্দা শার্লক হোমসের ২২১বি বেকার স্ট্রিটের গল্পগুলো কীভাবে শুরু হয়েছিল?
অ্যা স্টাডি ইন স্কারলেট লিখি ১৮৮৬ সালে, এটা ছিল শার্লক হোমসকে নিয়ে রচিত প্রথম গল্প। মাত্র তিন সপ্তাহে গল্পটা লিখে শেষ করেছিলাম। পরের বছর বিটন ক্রিসমাস বার্ষিকীতে সেটা প্রকাশিত হয়। গল্পে শার্লক হোমসের সাথে তার একান্ত সহযোগী ড. ওয়াটসনকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। শার্লকের গল্পগুলো ড. ওয়াটসনের জবানিতে লেখা।
পরবর্তীতে, ১৮৯০ সালে আমি দি অ্যাডভেঞ্চারস অব শার্লক হোমস ও দ্য মেমোয়ার্স অব শার্লক হোমস লিখি দ্য স্ট্যাণ্ড ম্যাগাজিনের জন্য। অ্যা স্ক্যাণ্ডাল ইন বোহেমিয়া, দ্য বসকম্ব ভ্যালি মিস্ট্রি, দ্য ফাইভ অরেঞ্জ পিপস, দি অ্যাডভেঞ্চার অব স্পেকলেড ব্যাণ্ড, দি অ্যাডভেঞ্চার অব কোপার বিচেস গল্পগুলো প্রকাশ হয় তখন। কিন্তু লাগাতার শার্লক হোমসের গল্প লিখতে লিখতে আমি একঘেঁয়েমি অনুভব করতে শুরু করি। রহস্য গল্প বাদ দিয়ে ইতিহাস ভিত্তিক উপন্যাস লেখার ইচ্ছে জাগে।
তারপর কী করলেন?
যদিও আমার রহস্য গল্পগুলো খুব সফল ছিল, তারপরও আমি সিদ্ধান্ত নিলাম শার্লক হোমস চরিত্রটিকে একটি মর্মান্তিক পরিণতি দিয়ে ইতি টানব। দি অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য ফাইনাল প্রবলেম গল্পটি ১৮৯৩ সালে প্রকাশিত হয়। এই গল্পে একটি জলপ্রপাতের উপর থেকে শার্লক হোমস আর ওর জানে দুশমন প্রফেসর মরিয়ার্টি পড়ে নিখোঁজ হয়ে যায়। গল্পটা লেখার আগে আমি সুইজ্যারল্যাণ্ড ঘুরতে গিয়েছিলাম। ওখানকার একটি জলপ্রপাত দেখে আমার মনে হয়েছিল, শার্লক হোমসের মতো একজন বিখ্যাত ব্যক্তির মৃত্যুর জন্য এই জায়গাটি একদম উপযুক্ত।
শার্লক হোমসের এমন অকাল সমাপ্তিতে জনতা কীরকম প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল?
সম্ভবত আমি কাজটা করে ভুল করেছিলাম। ঠিক জানি না, তবে এর ফলে দ্য স্ট্র্যাণ্ড ম্যাগাজিন তাদের ২০ হাজার গ্রাহক হারিয়েছিল এবং খুব ক্ষুব্ধ হয়েছিল আমজনতা।
তাহলে পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত গোয়েন্দার সমাপ্তি ঘটল সেখানে?
না, ১৯০২ সালে আমি দ্য হাউণ্ড অব দ্য বাস্কারভিলস লিখি। এই গল্পে আমি শার্লক হোমসের পুরোনো একটি কেস উপস্থাপন করি পাঠকদের সামনে। এই গল্পের প্রেক্ষাপট শার্লকের জলপ্রপাত থেকে পড়ে গিয়ে নিখোঁজ হওয়ার অনেক পূর্বরর্তী সময়ের। ব্যাপক সফলতা পায় গল্পটি। দ্য স্ট্র্যাণ্ড ম্যাগাজিন তাদের প্রকাশনার পরিমাণ বাড়িয়ে ৩০ হাজার কপিতে উন্নীত করে।
এরপর আমি আবার শার্লক হোমসের রহস্য গল্প লিখতে শুরু করি। তারই ধারাবাহিকতায় দি অ্যাডভেঞ্চার অব এম্পটি হাউজ-এ আমি শার্লক হোমসকে জীবিত ফিরিয়ে আনি। পাঠকদের জানাই, জলপ্রপাত থেকে পতনের মুহূর্তে পাহাড়ের কিনারা ধরে শার্লক নিজের জীবন বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিল। গত বছর শার্লক হোমসের দ্য রেড সার্কেল ও লেডি ফ্রান্সিস ক্যারাফ্যাক্স নামের দুটো গল্প বেরিয়েছে।
আর্থার এবার আপনার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কিছু প্রশ্ন করতে চাচ্ছি। আশা করি, আপনি কিছু মনে করবেন না?
একদমই না। আমার জীবন তো আপনাদের জন্য একটি খোলা বইয়ের মতো! হা হা হা!
আচ্ছা, বেশ। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি কি কখনও প্রেমে পড়েছিলেন?
বলছেন কী! এখন তো আমার গোঁফ পেকে গেছে, আমাকে দেখতে গম্ভীর মনে হয়। কিন্তু আপনি ধারণাও করতে পারবেন না আমি কতটা প্রেম করেছি!
১৮৮৫ সালের কথা। জ্যাক হকিন্স নামের এক ব্যক্তি সাথে আমার পরিচয় হয়। বেচারা মস্তিষ্কের কঠিন অসুখে ভুগছিল। মৃত্যু আসন্ন ছিল তার। আমি তখন তাকে ও তার পরিবারকে যথাসাধ্য সাহায্য করার চেষ্টা শুরু করি। পরবর্তীতে জ্যাক মারা যায়। তবে আমি আর ওর বোন লুইস একে অন্যের প্রেমে পড়ে যাই। খুব ভাল সম্পর্ক ছিল আমাদের। বিয়েও করেছিলাম, দুটো সন্তানও ছিল।
কিন্তু জীবন আমাদেরকে কঠিন পরীক্ষা নিতে পছন্দ করে। ১৮৯৩ সালে যক্ষায় আক্রান্ত হয় লুইস। ওর স্বাস্থ্যের কথা ভেবে আমরা সুইজারল্যাণ্ডে চলে যাওয়া সিদ্ধান্ত নিই। ভেবেছিলাম আবহাওয়া, স্থান বদল করলে ওর স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে।
সুইজারল্যাণ্ডে থাকাবস্থায় আমি স্কি করতে শিখি। স্কি তখন আল্পসে এমন একটি অপ্রচলিত খেলা যে কেউ সেটার চর্চা করে না বললেই চলে। কিন্তু আমি জানতাম একদিন না একদিন এই খেলা খুব জনপ্রিয় হবে। বিষয়টা সময়ের ব্যাপার মাত্র। যা হোক, তখনকার দিকে নিজেদের বাসস্থান ছেড়ে দূর দেশে গিয়ে অবস্থান করা বেশ কষ্টসাধ্য ছিল। তাই আমরা অবশেষে সিদ্ধান্ত নিই সারে-তে চলে যাব। ওখানকার আবহাওয়া যক্ষা আক্রান্তদের জন্য বেশ উপকারী ছিল।
যক্ষায় লুইস মারা যাবে সেটা তো অবধারিত হলেও ওর মৃত্যুর পর খুব বিষণ্নতায় ভুগতে শুরু করি আমি। যদিও পরবর্তীতে সেটা কাটিয়ে উঠে ১৯০৭ সালে বিয়ে করি জেন-কে।
স্কি করা ছাড়া আপনার আর কি অন্য কোনো শখ আছে?
বিষয়টা আপনার কাছে শুনতে অদ্ভুত লাগতে পারে। আমি আসলে জানি না, এটা কোনো শখের কাতারে ফেলা যায় কিনা তবে আমি নির্দোষ ব্যক্তিদেরকে সাহায্য করতে পছন্দ করি। যাদেরকে অযৌক্তিকভাবে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয় তাদেরকে সাহায্য করি। কয়েক বছর আগে আমি জর্জ ইডালজি নামের এক ব্যক্তিকে সাহায্য করেছিলাম। ওর বাবা ছিলেন একজন পার্সি ইণ্ডিয়ান। ফার্মের প্রাণীদেরকে পঙ্গু করার ভূয়া অভিযোগে ওকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। আমি সশরীরে গোয়েন্দাদের মতো মাঠে নেমে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে জর্জকে অভিযোগ থেকে মুক্ত করতে সাহায্য করেছিলাম।
বর্তমানে অস্কার স্লাটার নামের এক ব্যক্তিকে সাহায্য করছি। যার বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ আনা হয়েছে। কিন্তু আমি টের পেয়েছি এই ব্যক্তি নির্দোষ। আমি যেসব তথ্য-প্রমাণ যোগাড় করেছি সেগুলো পরিষ্কার বলে দিচ্ছে অস্কার কাউকে খুন করেনি। তাই আমি তাকে মুক্ত করার জন্য শেষ পর্যন্ত লড়ে যাব। (সাক্ষাৎকারটি নেয়ার সময় স্যার আর্থার কোনান ডয়েল জানতেন না ১৯২৭ সালে অস্কার স্লাটার খুনের অভিযোগ থেকে মুক্তি লাভ করতে যাচ্ছে)।
বেশ, অনেক কথা হলো আপনার সাথে। কর্মজীবনের পাশাপাশি আমার ব্যক্তিজীবন নিয়েও কথা বললাম। এবার আমাকে রেহাই দিন। এখন ডেইলি নিউজ অ্যাণ্ড লিডার পত্রিকার জন্য একটি আর্টিকেলের কাজ নিয়ে বসতে হবে।
এভাবেই সাক্ষাৎকারটির ইতি টানেন স্যার আর্থার কোনান ডয়েল। ১৯২৫ সালে তাঁর রচিত উপন্যাস অবলম্বনে ‘দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড’ নামের একটি সিনেমা রূপোলী পর্দায় মুক্তি পায়। সিনেমাটি দেখে যেতে পেরেছিলেন তিনি। ১৯৩০ সালে এই কিংবদন্তী লেখক পরলোক গমন করেন। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার পূর্বে আর্থার কোনান ডয়েল বলে যান, ‘পাঠকরা ভাববে আমি জীবনে প্রচুর অ্যাডভেঞ্চার করেছি। কিন্তু সবচেয়ে বড় ও চমৎকার অ্যাডভেঞ্চারটি এখন আমার জন্য অপেক্ষা করছে।’
ফিচার ইমেজ: harringtonbooks.co.uk