ইতিহাসের প্রফেসর জন ওল্ডম্যান হঠাৎ করেই তার অধ্যাপনার চাকরি এবং ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। বিদায় জানাতে ভালো না লাগার কারণে কারোর সাথে দেখা না করেই চলে যাওয়ার জন্য প্রফেসর জন ওল্ডম্যান যখন গাড়িতে মালামাল তুলতে ব্যস্ত, ঠিক তখনই পুরনো সহকর্মীরা তাকে বিদায় জানাতে তার বাসায় চলে আসেন। পরে প্রফেসর জন ও তার সহকর্মীদের অসাধারণ সব সংলাপের মধ্য দিয়ে ‘দ্য ম্যান ফ্রম আর্থ’ সিনেমাটির কাহিনী এগিয়ে যেতে থাকে এবং ধীরে ধীরে সিনেমার নাম দর্শকদের মনে অর্থবহ হয়ে ধরা দিতে থাকে।
জন ওল্ডম্যানের সহকর্মীদের মধ্যে অনেকে জীববিজ্ঞানী, নৃতত্ত্ববিদ, ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতত্ত্ববিদ। একজন ছাত্রীও এসেছিল। তারা জনের রুমে বসে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নিজেদের মধ্যে খুনসুটিতে মজে ছিলেন এবং তাদের মধ্য থেকে একজন বলে ওঠেন যে গত দশ বছরে নাকি জনের মধ্যে বয়স বাড়ার একটুও ছাপ পড়েনি। সহকর্মীরা নাছোড়বান্দার মতো প্রফেসর জনের কাছ থেকে বারবার জানতে চান, কেন তিনি এমন হঠাৎ করে তার এক দশকের সাফল্যমণ্ডিত অধ্যাপনার চাকরি এবং পুরনো বন্ধুদের ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। জন ওল্ডম্যান ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন কিন্তু সহকর্মীরা জনকে রহস্য না করে কারণটি প্রকাশ করতে জোরাজুরি করতে থাকেন।
একপর্যায়ে প্রফেসর জন তার প্রস্থানের কারণ বলতে সম্মত হন এবং তার সহকর্মীদের উদ্দেশে প্রশ্ন রাখেন এই বলে যে-
“কেমন হবে, যদি উচ্চতর প্রস্তরযুগের কেউ বর্তমান সময় পর্যন্ত টিকে থাকে?”
এমন প্রশ্ন শুনে সহকর্মীরা মজার ছলে বিভিন্ন হাস্যরস করতে থাকেন আবার কেউ কেউ জীব-বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে এর সম্ভাব্যতা যাচাই করে উত্তর দিতে থাকেন। এটি সম্ভব বলে এর পক্ষে যুক্তি দিয়ে এক জীববিজ্ঞানী বলেন-
“এক শতাব্দীতে যা কল্পকাহিনী, অন্য শতাব্দীতে তা বিজ্ঞান। ”
জন ওল্ডম্যান বলতে থাকেন যে তিনি ১,৪০০ হাজার বছর ধরে জীবিত আছেন। তাছাড়া কলম্বাসের সাথে অভিযাত্রী হিসেবে তিনিও জাহাজের পাল তুলেছিলেন এবং অন্য অনেকের মতো জন নিজেও বিশ্বাস করতেন যে পৃথিবী সমতল, গোলাকার নয়।
সহকর্মীরা তখন তাকে অবিশ্বাস করে টিপ্পনি কেটে ক্রো-ম্যাগনন ও গুহামানব ডাকতে থাকেন। কিন্তু প্রফেসর জন ওল্ডম্যান উত্তরে বলেন,
“প্রতি দশ বছর বা এর কাছাকাছি সময়ে মানুষ যখন বুঝতে শুরু করে, আমার বয়স বাড়ছে না, তখন আমি এক জায়গা হতে অন্য জায়গায় চলে যাই।”
উপস্থিত সবাই প্রফেসর জনের এরকম উত্তরে তাজ্জব বনে যান। কেননা গত দশ বছরে জনের বয়স যে একটুও বাড়েনি, এটা তারাই আড্ডার প্রথমদিকে বলাবলি করছিলেন। প্রফেসর জন আরো যোগ করতে থাকেন, প্রায় ৩৫ বছর বয়স থেকে তার বয়সবৃদ্ধি আটকে যায় এবং একপর্যায়ে তার আদিম গোত্রের লোকেরা তাকে পরিত্যাগ করে। কেননা তাকে সবাই জাদুকর ভাবতে শুরু করে, যে অন্যের জীবনকাল চুরি করে নিজের বয়স আটকে রেখেছে।
বিজ্ঞানমনষ্ক সহকর্মীরা তার কথা বিশ্বাস না করলেও জানার উৎসাহ দমন করে রাখতে পারেননি। বরং তারা তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রফেসর জনকে বিভিন্ন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের প্রশ্ন করতে থাকেন এবং প্রফেসর জন ওল্ডম্যান একে একে বলতে শুরু করেন যে তিনি আদিমকালে প্রায় দুই হাজার বছর সুমেরিয়ান নাগরিক ছিলেন এবং পরবর্তী সময়ে ব্যাবিলনীয় সভ্যতারও নাগরিক ছিলেন। জন আরো বলেন, তিনি ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ দেখেছিলেন, বর্তমানে যা ফরাসি উপকূল। বরফ গলে সাগর তৈরি হওয়ার প্রত্যক্ষদর্শীও নাকি তিনি। চিত্রশিল্পী ভ্যান গগ তার খামারে আসতেন, এবং সেসময় তার নাম ছিল জ্যাকুইস বোর্ন।
এমনকি তার বয়স যে বৃদ্ধি পায় না, এটা বুঝে ফেলার আগেই তিনি তার স্ত্রী-সন্তানদের ছেড়ে চলে যেতেন। এভাবে ধীরে ধীরে ভালোবাসা সম্পর্কে এবং ধর্ম-বিশ্বাস সম্পর্কে তার চিন্তা-ভাবনা বদলাতে থাকে। ১৮৬২ সালে বেলজিয়ামে সরকারি কাগজ নকল করার জন্য এক বছর জেলও খাটতে হয়েছিল তাকে। ১৮৯০ সালের দিকে একদল ফরাসি অভিবাসীর সাথে তিনি আমেরিকায় স্থানান্তরিত হন। একসময় পূর্বদিকে যাত্রা শুরু করে তিনি ভারতবর্ষে পৌঁছে যান এবং গৌতম বুদ্ধের শিষ্য হয়। তাছাড়া বাইবেলে উল্লিখিত খ্রিস্টধর্মের অনেক ঘটনা তিনি কাছ থেকে দেখেছেন বলে বর্ণনা করেন সহকর্মীদের কাছে।
জীববিজ্ঞানী সহকর্মী কিছু মেডিক্যাল চেকআপের জন্য প্রফেসর জন ওল্ডম্যানকে ল্যাবে যেতে বলেন। কারণ এর মধ্য দিয়ে হয়তো ১,৪০০ বছর জীবিত থাকার ব্যাপারে এর পক্ষে-বিপক্ষে কোনো নমুনা সংগ্রহ করা যেতে পারে। কিন্তু জন ওল্ডম্যান ল্যাবে যেতে অস্বীকৃতি জানান। কারণ তিনি কোনো গবেষকের গবেষণার বিষয়বস্তু হতে চান না, এভাবেই হয়তো তাকে হাজার বছর বন্দী হয়ে থাকতে হতে পারে।
এই সিনেমায় আরেক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হচ্ছে জনের সহকর্মী ড. উইল গার্বার। প্রফেসর জন ওল্ডম্যান এবং ড. উইল গার্বারের মধ্যে এক অবিশ্বাস্য যোগসূত্র ঘটে, যা ছিল খুবই অভাবনীয় এবং এর মধ্য দিয়ে সিনেমাটি আকস্মিক বাঁকবদল করে। এভাবেই বিশ্বাস-অবিশ্বাস, যুক্তি-পাল্টা যুক্তির ধারালো সব সংলাপের মধ্য দিয়ে সিনেমাটি পরিণতি লাভ করে। যা শেষ দিকে এসে প্রতি পরতে পরতে দর্শকদের স্নায়বিক শক্তির পরীক্ষা নেয়।
জেরোম বিক্সবির লেখা অবলম্বনে ২০০৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দ্য ম্যান ফ্রম আর্থ’-এর পরিচালক হলেন রিচার্ড শেঙ্কম্যান, যিনি একাধারে চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক এবং চিত্রনাট্যকার। প্রফেসর জন ওল্ডম্যান তথা সিনেমার প্রোটাগনিস্ট চরিত্রে অভিনয় করেন আমেরিকান অভিনেতা ডেভিড লি স্মিথ। তার চমৎকার অভিনয় এবং নাটকীয় কথা বলার ভঙ্গিমার কারণে কাহিনীটি আরো বিশ্বাস উপযোগ্য হয়ে ওঠে। সিনেমায় অভিনীত প্রত্যেকের অভিনয়ই ছিল স্বতঃস্ফূর্ত।
‘দ্য ম্যান ফ্রম আর্থ’ মাইক্রো বাজেটে নির্মিত একটি ইন্ডি-ফিল্ম। সাই-ফাই জনরার এ সিনেমার প্রায় ৯০ শতাংশ দৃশ্য চিত্রায়িত হয়েছে একটি কক্ষে। সিনেমাটির নিউক্লিয়াস নিহিত এর প্রতিটি সংলাপে। যার মধ্য দিয়ে পরিচালক রিচার্ড প্রমাণ করলেন যে শুধুমাত্র নিখুঁত চিত্রনাট্য, সুনিপুণ গল্প বলা এবং মসৃণ সম্পাদনার মধ্য দিয়ে অল্প বাজেট ও স্বল্প পরিসরেও সেরা চলচ্চিত্র বানানো সম্ভব। এর জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে থাকবে ‘দ্য ম্যান ফ্রম আর্থ’। চিত্রায়নের দিক থেকে এই সিনেমাটির সাথে ‘রিয়ার উইন্ডো’ (১৯৫৪), ‘টুয়েলভ অ্যাংরি ম্যান’ (১৯৫৭) সিনেমার সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়।
ফায়ার প্লেসের আগুনের আলোয় কক্ষে থাকা চরিত্রদের আলোকিত করে তোলে এবং ব্যাকগ্রাউন্ডে বিথোভেনের সুরের মূর্ছনায় মুহূর্তগুলোকে প্রাণ দিয়ে এমন এক পরিবেশ তৈরি করে, যে মনে হতে থাকে পৃথিবীর মহাকালের তাবৎ রহস্য যেন এই কক্ষে পুঞ্জীভূত হয়েছে। ফায়ার প্লেসের আগুন যেন জন ওল্ডম্যানের সাহসের প্রতিরূপ; যে আগুন তাকে আদিমকালে সাহসী করে তুলেছিল।
যারা সিনেমা দেখার পর তা নিয়ে ভাবতে বা চিন্তা করতে পছন্দ করে, তাদের জন্য ‘দ্য ম্যান ফ্রম আর্থ’ বিশেষ একটি সিনেমা হয়ে থাকবে।