অস্কারে প্রেরিত সৌদি আরবের দ্বিতীয় চলচ্চিত্র বারাকা মিটস বারাকা (২০১৬)। জনরা বিচারে রোম্যান্টিক কমেডি হলেও প্রচ্ছন্ন ডার্ক হিউমার এ ফিল্মের প্রতি বিশেষ মুগ্ধতা জাগায়। ৬৬ তম বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রিমিয়ার হওয়া চলচ্চিত্রটি ছিল টরেন্টো ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালেও। সেখানে জুরিদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা পেয়েছে মাহমুদ শাব্বাগের বারাকা মিটস বারাকা।
“Freewheeling, engaging romantic romp [that] has real weight even though its humorous touch is as light as air”.
তাত্ত্বিক আলাপ কপচানোর আগে একটা সহজ প্রশ্নের উত্তরে আসা যাক। বলুন তো, একটি ফিল্ম দেখা শুরু করলে কোন বিষয়টি একদম প্রথমে চোখে পড়ে? কাহিনি? মিউজিক? ফলি সাউন্ড? সিনেমাটোগ্রাফি? এডিটিং? আর্ট ডিরেকশন? ডায়লগ? মেকআপ? কস্টিউম? না, কোনোটাই নয়। মুভি শুরুর পর সবার আগে আপনি ধারণা পাবেন কালার গ্রেডিংয়ের ব্যাপারে। এরপর বাকি সব নজরে আসবে। সেজন্য আধুনিক সিনেমায় কালারিস্টের চাহিদা এবং গুরুত্ব দিনকে দিন বেড়েই চলছে। আর জনরা যদি হয় রম-কম, সেক্ষেত্রে তো চোখের স্বস্তি মুখ্য হয়ে দাড়ায়। এই পয়েন্টে বারাকা মিটস বারাকা একটি চমৎকার কালারফুল সিনেমা।
বারাকা উরাবি জেদ্দায় একটি মিউনিসিপ্যালে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মরত। তার কাজ উক্ত এরিয়ার অস্থায়ী স্থাপনা উৎখাত এবং রাষ্ট্রের নিয়মভঙ্গকারীদের মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে জরিমানার আওতায় আনা। তবে উদারচেতা হবার কারণে সে কঠোরভাবে সবাইকে জরিমানা করতে পারে না। এক্ষেত্রে কখনো মৌখিক সতর্ক, কখনো আবার অস্থায়ী দোকান ও ফেরিওয়ালাদের দেখেও না দেখার ভান করে চলে যায়। রাষ্ট্রের বেতনভুক্ত কর্মকর্তার বাইরে তার আরেক পরিচয়- সে একজন থিয়েটারকর্মী। তাদের নাট্যদলের পরবর্তী শো’তে হ্যামলেট নাটকে সে বিশেষ একটি চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পাচ্ছে। সারাদিনের ডিউটি শেষে সন্ধ্যায় প্র্যাকটিসে এসে বারাকা জানতে পারে, তাকে পারফর্ম করতে হবে হ্যামলেটের প্রেমিকা অফেলিয়া চরিত্রে। সৌদি আরবের থিয়েটারে নারীদের অংশগ্রহণের নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি নির্মাতা এখানে হাস্যরসের অন্তরালে নিপুণ সুচারুতায় চিত্রিত করেছেন।
“Barakah, you are being promoted
You’ll play the daughter of Polonius.
Hamlet’s love Barakah!
You are playing Ophelia”
এতক্ষণ পর্যন্ত পড়ে ফিল্মটি যে কমেডি— সেই আভাস দেয়া হলেও রোমান্সের কথা এখনও শুরু হয়নি। চলুন তাহলে সিনেমার বদৌলতে নাহয় সৌদির রোমান্সের সাথেও একটু পরিচিত হয়ে নেয়া যাক। মিউনিসিপ্যাল থেকে কল আসে বিনা অনুমতিতে শহরে কারা যেন মডেল নিয়ে এসে ফটোশুট করছে। বারাকা তৎক্ষণাৎ সেখানে গিয়ে আবিষ্কার করে ইন্সটাগ্রামের উঠতি সেনসেশন বিবি হারিথকে। ধনীর দুলালী বিবি সোশ্যাল মিডিয়ার একজন জনপ্রিয় ইনফ্লুয়েন্সার মডেল। ভাবছেন- সৌদিতে আবার সোশ্যাল মিডিয়া মডেল! আসলেই তাই, তবে নিয়ম হলো- আপনি মডেল হোন আর যে-ই হোন না কেন, চেহারার ছবি দেখানো বা প্রকাশ্যে আনা যাবে না। অর্থাৎ ভিডিওতে প্রোডাক্টের প্রোমোশন করা যাবে, কিন্তু মডেলের চোখ কোনো অবস্থাতেই যেন দেখা না যায়। চলচ্চিত্রে অনুরূপ স্যাটায়ার নির্মাতা বহুবার করেছেন। যেমন- কিছু দৃশ্যে জেদ্দার রাস্তায় বড় বড় বিলবোর্ডে ফ্যাশন মডেলদের চেহারা ব্লার করে দিয়ে কীভাবে ব্যবহার করা হয় তা দেখে একদম বেরসিক মানুষটিও হো হো শব্দে হেসে উঠবে। তা যা-ই হোক, সেদিন বারাকা বিবি হারিথের সৌন্দর্যে মাতোয়ারা হয়ে শুটিং বন্ধ না করে চলে আসে। এরপর তাদের আবার দেখা হয় শহরের রাস্তায়। চোখে চোখে কথা হয়। আর্ট গ্যালারিতে মুঠোফোন নাম্বার বিনিময়ের মাধ্যমে শুরু হয় প্রেমালাপ। কিন্তু ঝামেলা সাধে ডেটিং প্লেস নিয়ে। সৌদি আরবের পাবলিক প্লেসে কোথাও তাদের জন্য জায়গা নেই।
“The land may be narrow
but a rooftop is a great escape.”
অতঃপর তারা বেছে নেয় বাসার ছাদ। বিপত্তি সেখানেও। আমার মতে, বিপত্তির এ দৃশ্যকে ফিল্মের সবচেয়ে নান্দনিক সিন বিবেচনা করা যেতে পারে। টেকনিক্যাল আস্পেক্টে দৃশ্যটি যথেষ্ট মনস্তাত্ত্বিক। বিবিকে জন্মদিনের সারপ্রাইজ দেবার সময় চোখ বন্ধ করে নিয়ে যাওয়ার সময়টুকু বিবির পয়েন্ট অব ভিউ থেকে দর্শকও কিছু সময়ের জন্য অপেক্ষা করে স্ক্রিনে ফের আলোর দেখা পাবার। হিউমার ব্যবহার করে নির্মাতা মাহমুদ শাব্বাগ দর্শক মনস্তত্ত্বকে বারবার জয় করেছেন। এবং তা দৃশ্যায়ন ও সংলাপ উভয়তেই প্রতীয়মান হয়েছে।
আংকেল দা’শ চলচ্চিত্রের রসিক আরেক চরিত্র। হিউমারাস সংলাপ আর অঙ্গভঙ্গিতে তিনি দেখিয়েছেন ভাঁড়ামো না করেও সাবলীলভাবে কীরূপে নির্মল বিনোদন দিতে হয়। সম্পর্কের দিক থেকে এই ব্যক্তি বারাকার নিকট প্রতিবেশী। দা’শের স্ত্রী আন্টি সাদিয়া, বারাকাকে নিজের ছেলের মতোই স্নেহ করে। সংস্কৃতিমনা আংকেল দা’শ সৌদি রাষ্ট্রের পরিবর্তন কাছ থেকে দেখেছেন। বারাকার সাথে নিজের দুরন্ত শৈশবের গল্প শেয়ার করতে গিয়ে তাই বর্তমান প্রজন্ম নিয়ে আফসোসের শেষ থাকে না তার। সে পরামর্শ দেয় বিবিকে বিশেষ কিছু উপহার দেয়ার জন্য।
তার ভাষ্যমতে,
Rich, poor whatever the class
All females love gifts.
অবশ্য বিবি, বারাকার সেই বিশেষ উপহার প্রত্যাখ্যান করে। বারাকার চিন্তা-ভাবনাকে সেকেলে বলে আধুনিক পাশ্চাত্য ফ্যাশন ও ট্রেন্ডের সাথে আপডেটেড হতে পরামর্শ দেয়। একজন প্রেমিকের দেয়া উপহার কেমন হওয়া শোভনীয়, তা নিয়ে উপদেশ দেয়,
“When you want to gift a lady nowadays.
nothing’s better than roses and flowers.
White for purity, red for passion and longing, and violet for new beginnings.”
বিবির কথাবার্তা বারাকা তার আংকেলের সাথে শেয়ার করলে তিনি উল্টো প্রশ্ন তোলেন,
“Westerners don’t get engaged?
Marriage is old fashioned now?”
বারাকা মিটস বারাকা আধুনিক মননের সৃজনশীল সিনেমা। জনরা বিচারে রম-কম হলেও পরিচালক একপর্যায়ে তার শক্ত রাজনৈতিক অবস্থানে দাঁড়িয়ে বর্তমান সৌদির পশ্চাৎপদ চিন্তাভাবনাকে সূক্ষ্মভাবে কটাক্ষ করে দেশের একাল-সেকালের তুলনায় ঐতিহাসিক ফ্ল্যাশব্যাক ব্যবহারের মাধ্যমে স্ববক্তব্যকে যৌক্তিক অবস্থানে নিয়ে গেছেন। রাষ্ট্রের কূপমণ্ডূক রক্ষণশীলতাকে শ্লেষাত্মক আঘাত করে বারাকা মিটস বারাকা। তা খুব বেশি ভাবাবে এমনটা নয়। তবে নির্মল বিনোদনের পাশাপাশি সৌদি আরবের বর্তমান অবস্থা এবং অতীতের কৃষ্টি কালচার সম্পর্কে খানিকটা ধারণা পাওয়া যাবে সিনেমাতে। মডেল বিবির অজানা অতীত জানতে, আর নামকরণের সার্থকতা খুঁজতে নির্মাতা আপনাকে অপেক্ষা করাবে দীর্ঘক্ষণ। তবে আশ্বস্ত করছি, অপেক্ষার ফলে নিরাশ হবেন না। দারুণ উপভোগ করবেন ৮৮ মিনিটের সেলুলয়েড জার্নি।
চলচ্চিত্র: بركة يقابل بركة (Barakah Meets Barakah)
সাল: ২০১৬
পরিচালক: মাহমুদ শাব্বাগ
জনরা: রোমান্টিক কমেডি