১৯৫৮ ফিফা বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বের ম্যাচ। প্রতিপক্ষ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। ইতোমধ্যে ইনজুরি আক্রান্ত ব্রাজিল দলের মূল একাদশের অনেককেই খেলাতে পারছেন না কোচ ভিসেন্তে ফিয়োলা। বাধ্য হয়ে তাই সাইড বেঞ্চকে পরীক্ষায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিতে হলো। দলের নিয়মিত স্ট্রাইকার মাজ্জোলার ইনজুরিতে জিতো, গারিঞ্চা, ডিডি, ভাভা, জিগালোদের মতো অভিজ্ঞদের সাথে ঐ ম্যাচেই অভিষিক্ত হলো টুর্নামেন্টের সবচেয়ে তরুণ খেলোয়াড়ের। মাত্র ১৭ বছর বয়সে হাঁটুর ইঞ্জুরি নিয়েই সেদিন মাঠে নামল সান্তোস ফুটবল ক্লাবের ক্ষুদে স্ট্রাইকার এডসন ডিকো আরান্তেস দো নাসিমেন্তো। ১০ নম্বর জার্সি পরিহিত হ্যাংলা মতোন কিশোরকে মাঠে নামতে দেখে সেদিন সবাই খানিকটা বিস্মিতই হলো বোধহয়। হালকা কুঁজো হয়ে হাঁটা কিশোর নাসিমেন্তোর বুটের ফিতে বাঁধতে গিয়ে ভড়কে যাওয়া দেখে চারপাশের গ্যালারিতে মৃদু গুঞ্জন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে শুরু করে। গ্যালারিকে সমর্থন জানিয়েই বোধহয় মাঠের ফটোগ্রাফারদের ক্যামেরার শাটার অফ হয়ে গেল নিদারুণ অবহেলায়।
অসুস্থ শরীর নিয়ে সেদিন আর সবার অবহেলার জবাব দেয়া হয়নি নাসিমেন্তোর। ম্যাচে সান্তোসের বিস্ময়কর স্ট্রাইকার কোনো বিস্ময় উপহার দিতে পারেননি ঠিকই, তবে কোচের আস্থা অর্জন করে সাইড বেঞ্চের ছেলেটি আবারও মাঠে নামার সুযোগ পেয়ে গেছে সেমিফাইনালের ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ম্যাচে। আর সেই ম্যাচ গোটা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে আবিষ্কার করে নিয়েছে ১৭ বছর বয়সী অবিশ্বাস্য দক্ষতা সম্পন্ন ব্রাজিলিয়ান বিস্ময়বালক ডিকো নাসিমেন্তোকে। ঐদিন প্রথমে ১ গোলে পিছিয়ে থেকেও নাসিমেন্তোর হ্যাটট্রিকে শক্তিশালী ফ্রান্সকে ৩-১ গোলের ব্যবধানে পরাজিত করে ব্রাজিল। ফুটবলবিশ্বকে সেদিন ঘোর লাগায় নাসিমেন্তোর স্বতন্ত্র নৈপুণ্যের পায়ের কারিকুরি, ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের স্বতন্ত্র ঐতিহ্য ‘জিঙ্গা স্টাইল’।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে- এই জিঙ্গা স্টাইল আসলে কী? মূলত মার্শাল আর্ট এবং নিজেকে শত্রুপক্ষের হাত থেকে রক্ষা করার ঐতিহাসিক এক সমর কৌশলকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় জিঙ্গা। যে সমর কৌশলই পরে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল ব্রাজিলিয়ান ফুটবলে।
It all started at the beginning of the 16th century … The Portuguese arrived in Brazil with African slaves. But the Africans will was strong, and many escaped to the jungle. To protect themselves, the runaway slaves called upon the Ginga, the foundation of Capoeira, the martial art of war.
A boy with nothing who changed everything!
চলচ্চিত্রের ট্যাগলাইনে এমনটা বলা। জেফ জিম্বালিস্ট এবং মাইকেল জিম্বালিস্ট পরিচালিত বায়োপিক ‘পেলে : দ্য বার্থ অব এ লিজেন্ড’ সিনেমাটি একজন তরুণ ফুটবলার এবং তার খেলা কিছু ফুটবল ম্যাচের ঘটনা নিয়ে নির্মিত। ২০১৬ সালে মুক্তির পর হলিউডের এই ফিল্ম সমালোচকমহলের তীব্র তোপের মুখে পড়ে। কথা ওঠে এর ন্যারেটিভ স্টাইল, এবং অগভীর, দুর্বল চিত্রনাট্য নিয়ে। এছাড়া তথ্যগত বিভ্রান্তি আর কারিগরি ত্রুটি নিয়েও নানা সমালোচনা হয়।
রোটেন টম্যাটোতে রিলিজের পর পরই এই ফিল্মকে তিরস্কার করে রীতিমতো ধুয়ে দেয়া হয়। বক্স অফিসে বাণিজ্যিক সফলতাও সেই অর্থে আহামরি কিছু ছিল না শুরুতে। কিন্তু তারপরেও এ ফিল্ম অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে দ্রুততার সাথে। একমাত্র কারণ— এডসন ডিকো আরন্তেস দো নাসিমেন্তো, যাকে কিনা গোটা ফুটবল দুনিয়া এক নামে ‘পেলে’ (হাওয়াইন দেবতা) বলেই চেনে। তবে এই সিনেমা পেলের জীবনের পুরো বায়োগ্রাফিকে তুলে ধরে না। কেবল সান্তোসের এক কিশোর স্ট্রাইকার নাসিমেন্তোর পেলে হয়ে ওঠার গল্পই উঠে আসে এতে।
বর্তমানে বিশ্ব ফুটবলে ১০ নম্বর জার্সির এত যে মাহাত্ম্য, তার পেছনে যে কিশোর বালকের একক নৈপুণ্য জড়িত, তা দৃশ্যায়িত হয়েছে ‘পেলে: বার্থ অব অ্যা লিজেন্ড’-এর ফ্রেমে ফ্রেমে। এই সিনেমায় নির্মাতা পেলেকে অতিরঞ্জনায় যেমন রাঙিয়েছেন, ঠিক তেমনি ফুটবলকে ঘিরে ব্রাজিলের মানুষের মধ্যে যে আবেগ-ভালবাসা-উৎসাহ-উন্মাদনা তা-ও তুলে ধরেছেন অত্যন্ত সুনিপুণভাবে। ক্যামেরার জাদুতে পেলের কারিকুরি মেলোড্রামায় রূপ নিয়েছে কখনও, কখনও আবার ফুটবলকে ঘিরে যে উচ্ছ্বাস ফ্রেমবন্দি হয়েছে, তা দর্শকদেরও আবেগঘন করেছে। ব্রাজিলের ফুটবলপ্রেমকে রীতিমতো স্পর্শ করে গেছে এ চলচ্চিত্র। সেই সাথে সদ্য কৈশোর পেরোনো নাসিমেন্তো হয়ে উঠেছে অনুপ্রেরণার এক নাম। যার জাদুকরী সংস্পর্শে গোটা দল উজ্জীবনী শক্তিতে জেগে উঠেছিল। যার উপস্থিতিতে দল খুঁজে পেয়েছিল ‘৫৮ বিশ্বকাপের স্বাগতিক হট ফেবারিট সুইডেনকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো ফুটবলে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হবার মন্ত্র।
ভারতীয় উপমহাদেশবাসীর জন্য আনন্দের খবর হচ্ছে, পেলে: দ্য বার্থ অব অ্যা লিজেন্ডের মিউজিক ডিরেকশন এ. আর. রহমানের। যিনি স্ক্রিপ্ট হাতে পাবার সময় চিনতেনও না কিংবদন্তি ফুটবলারকে। অতঃপর ইন্টারনেটে পেলের সম্পর্কে পড়াশোনা করে হয়ে গেলেন তার একনিষ্ঠ ভক্ত। ব্রাজিলিয়ান মিউজিক শুনে শুনে প্রথমে তা আত্মস্থ করলেন। তারপর সেই ফ্লেভার মাথায় নিয়ে চিত্রনাট্যের চাহিদানুসারে কম্পোজিশন করলেন। যার ফলে মিউজিকে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলের ছোঁয়া সুস্পষ্টভাবে লক্ষণীয়।
নানা তথ্যগত ভুলে এ ফিল্ম বিতর্কিত হয়েছে। ব্রাজিল-ফ্রান্স সেমিফাইনাল ম্যাচে হাফ টাইমে স্কোরলাইন ১-১ দেখানো হলেও প্রকৃতপক্ষে ব্রাজিল প্রথমার্ধ শেষে ২-১ ব্যবধানে এগিয়ে ছিল। অনুরূপ পেলের মাকে অন্যের বাড়িতে কাজ করতে দেখা গেলেও বাস্তবে তারা অতটা হতদরিদ্রও ছিল না। আবার ষাটের দশকে ব্রাজিলে লাইভ টেলিকাস্টের সুযোগ না থাকলেও ফিল্মে এমন দৃশ্য কয়েকবারই দেখানো হয়। তাছাড়া ফুটবলে হলুদ ও লাল কার্ডের প্রচলন ১৯৭০ বিশ্বকাপ থেকে হলেও ফিল্মে ১৯৫৮ বিশ্বকাপের ধারাভাষ্যে কার্ডের কথা শোনা যায়। আর সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ডিসক্লেইমারের দেখা মেলে ফিল্মের শেষে ক্রেডিট লাইনে,
The persons and events in this motion picture are fictitious. Any similarity to actual persons or events is unintentional.
অথচ আমরা সবাই জানি এই ফিল্মের টাইটেল থেকে শুরু করে সবই কিংবদন্তী ফুটবলার পেলের প্রথম ফুটবল বিশ্বকাপ জয়ের গল্প নিয়ে!
মুভিটি শেষ হয় ১৯৫৮ বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচের শেষ বাঁশির মধ্য দিয়ে। যেখানে হুইসেল বাজার সাথে সাথে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেখা যায় আসরের সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় ফাইনালের ম্যাচজয়ী সিনেমার প্রটাগনিস্টকে। জিঙ্গা স্টাইলের উন্মাদনায় গ্যালারি যখন উন্মাতাল, তখন তার সতীর্থরা ব্যস্ত তরুণ নাসিমেন্তোকে নিয়ে। অসাধারণ এই দৃশ্য দর্শকমন ছুঁয়ে যাবে নিশ্চিত। তাতে ব্রাজিল কিংবা পেলে সমর্থক হবার প্রয়োজন পড়বে না। ফুটবল যে কতটা প্রাণবন্ত, কতটা উত্তেজক, কতটা আবেগসঞ্চারী, কতটা বিস্ময়কর খেলা- তা উপলব্ধি করতে এই ফিল্মের বিকল্প খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ৮ বছরের বিস্ময়বালক নাসিমেন্তোর কৈশোরে সান্তোস ক্লাবের সাথে যুক্ত হওয়া, সেখানকার মূল কোচের সাথে মনোমালিন্য, সহকারী কোচ দি ব্রিতর অনুপ্রেরণা, সান্তোসে জিঙ্গা স্টাইলকে জনপ্রিয় করে দিয়ে বিশ্বকাপ স্কোয়াডে সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে জায়গা করে নেয়া, এবং সেখানে থেকেও নিজেকে স্রোতের বিপরীতে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার ১ ঘণ্টা ৪৭ মিনিটের এক অদম্য গল্প পেলে: বার্থ অব অ্যা লিজেন্ড।