১৯৩৯ সালের শুরুর দিককার কথা। পূর্ব ইউরোপের কোনো এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের গল্প। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজছে তখন পুরো ইউরোপ জুড়েই। চারিদিকে হিটলারের নাৎসি বাহিনী ইহুদিদের উপর ব্যাপক নির্যাতন চালাচ্ছে। জার্মানরা ইহুদিদের মেরে ফেলছে, আর নয়তো ধরে নিয়ে বন্দী করে রাখছে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। এমনই একটা সময়ে, এই প্রত্যন্ত গ্রামের এক আত্মীয়ের বাড়িতে ছ’ বছর বয়সী এক ইহুদি ছেলেকে পাঠিয়ে দেন তার বাবা-মা। তারা নিজেরাও প্রাণ বাঁচাতে লুকিয়ে পড়েন কোনো এক আশ্রয়ে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই আবার পরিবারটি একত্র হবে, এ আশা নিয়ে বিচ্ছিন্ন হয় তারা। যুদ্ধ ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে। মিত্রপক্ষ তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলা শুরু করেছে। কিন্তু এ অঞ্চলে যুদ্ধ এখনো আসেনি।
ধীর আর শান্তভাবে চলছে এখানকার জীবনযাপন। মার্তা নামের এক বয়স্কার বিভিন্ন কাজেকর্মে সাহায্য করে ছেলেটি। বিনিময়ে থাকা-খাওয়া আর জীবনের নিরাপত্তা। একদিন মার্তাও তাকে একা রেখে চলে যান মৃত্যুর দেশে। অসতর্কতায় বাড়িটিতে আগুন লেগে যায় আর ছেলেটি ভয়ে পালিয়ে যায় অন্য এক গ্রামে।
গ্রামের সবাই তাকে বেদম মারে অন্ধবিশ্বাসের দোষে। কেননা, তার চোখ আর চুল অনেক বেশি কালো। যা নাকি হয় শয়তানের ‘আছর’, নয়তো এ তার খাঁটি ইহুদি হবার প্রমাণ। শয়তান হলে তো তাকে মারতেই হবে; আর যদি ইহুদিও হয়, তাও মারতে হবে। কেননা ইহুদিকে আশ্রয় দেবার অপরাধে গ্রামের সবাইকেই মরতে হবে নাৎসি বাহিনীর হাতে। তাই তাকে পুড়িয়ে মারতে চায় গ্রামের সকলে। এমতাবস্থায় দৃশ্যপটে আবির্ভাব ঘটে এক প্রবীণা তান্ত্রিকের। সে বিভিন্ন রোগবালাই এবং অশুভ আত্মার ঝাড়ফুঁক করে অর্থোপার্জন করে থাকে। তাই শয়তানের বালক বলে সে ছেলেটাকে নিজের সঙ্গে করে নিয়ে যায়; যাতে তার কাজে কিছু সাহায্য হয়।
কলেরা রোগীকে পুড়িয়ে মারা থেকে শুরু করে, আগুন জ্বালানো এবং এমনকি বৈরী পরিস্থিতিতেও বেঁচে থাকার সব কৌশলও শিখে ফেলে ছেলেটা। একদিন নদীতে মাছ ধরতে গেলে এক গ্রামবাসী তাকে নদীতে ফেলে দেয়। ভেলার সঙ্গে ভাসতে ভাসতে সে চলে যায় দূরে; কোনো এক অজানা আর আরো প্রত্যন্ত গ্রামে। এক কাঠমিস্ত্রি ছেলেটাকে পানি থেকে তুলে নিজের কাজে লাগিয়ে দেয়। সেখান থেকেও পালিয়ে গিয়ে সে এক পাখি বিক্রেতার হাতে পড়ে। এভাবে পালিয়ে পালিয়ে একদিন এমন এক গ্রামে চলে যায়, যেখানে জার্মানদের ক্যাম্প আছে। নাৎসি বাহিনীর কাছে ধরা পড়ে সে। একজন জার্মান সৈন্যকে আদেশ দেওয়া হয় জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে গিয়ে তাকে মেরে ফেলার।
‘দ্য পেইন্টেড বার্ড’ সিনেমাটি আসলে একই শিরোনামের গ্রন্থ অবলম্বনে নির্মিত। পোলিশ-আমেরিকান লেখক ইয়োর্জি কোসিনস্কির লেখা ‘দ্য পেইন্টেড বার্ড’ গ্রন্থ প্রকাশ পায় ১৯৬৫ সালে। বই প্রকাশের পরপরই সেটি সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং পাঠকদের কাছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এক অজানা অধ্যায় উন্মোচিত করে। এ বই সম্পর্কে বিখ্যাত পত্রিকা লস অ্যাঞ্জেলস টাইমস বলে, এ দশকের অন্যতম সেরা একটি উপন্যাস হচ্ছে দ্য পেইন্টেড বার্ড। তিরিশটিরও অধিক ভাষায় অনুবাদ হয়েছে এই বইটি। পোল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করা সত্ত্বেও কোসিনস্কির বইটি সেখানে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় প্রকাশের পরপরই। তবে ১৯৮৯ সালের পর, পোলিশ সরকার বইটির উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে দেয়।
২০১৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বর, ইতালির ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শনীর মাধ্যমে সিনেমাটির শুভমুক্তি দেয়া হয়। এরপর একে একে বিখ্যাত সব ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শনের পাশাপাশি পুরস্কার এবং দর্শক-সমালোচকদের প্রশংসা কুড়িয়ে নেয় সিনেমাটি। যার মধ্যে লন্ডন ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল এবং শিকাগো ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল উল্লেখযোগ্য। ক্যামেরিমেজ বা ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অভ দ্য আর্ট অভ সিনেমাটোগ্রাফি’র ২০১৯ সালের আয়োজনে ‘দ্য পেইন্টেড বার্ড’ পুরস্কৃত হয়। ডিরেক্টর অভ ফটোগ্রাফিতে ব্রোঞ্জ ফ্রগ, সিনেমাটোগ্রাফার ক্যাটাগরিতে ফিপ্রেরেস্কি প্রাইজও আসে এ সিনেমার ঝুলিতে।
শিকাগো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সিলভার হুগো অ্যাওয়ার্ডের মতো সম্মানজনক পুরস্কারও বাগিয়ে নেয় এর সিনেমাটোগ্রাফি বিভাগ। ইউরোপ এবং চেক রিপাবলিকের সম্মানজনক চেক লায়নস ফেস্টিভ্যালে সর্বমোট আটটি বিভাগে পুরস্কৃত হয় এটি। এর মধ্যে সেরা ছবি, সেরা পরিচালক, সেরা চিত্রগ্রহণ এবং সেরা সঙ্গীতের মতো উল্লেখযোগ্য বিভাগ অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া, ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের পক্ষ থেকে সিনেমাটির পরিচালককে দেয়া হয় ইউনিসেফ অ্যাওয়ার্ড সম্মাননা।
কোসিনস্কির বইয়ের শুরুর দিকের পৃষ্ঠাগুলো যেমন খুন, ধর্ষণ, নির্যাতন, পাশবিকতা আর বর্বরতায় পূর্ণ; ঠিক তেমনি শেষের দিকের পৃষ্ঠাগুলো পড়ে মনে হয় আদতে বইটি একটি আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ। যেটা কল্পনার সঙ্গে মিশে অন্য রূপ নিয়েছে। যার ধারাবাহিকতায় চেক রিপাবলিকের নির্মাতা ভাচ্যাভ মারহৌল সাদা-কালো চলচ্চিত্রায়নে কোসিনস্কির কল্পনামিশ্রিত আত্মীজীবনীর চিত্রিত এক রূপ দিয়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি বাহিনী যখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল, তখন কোসিনস্কিও নিজেকে এক অনাথ ইহুদি বালকের বেশে আবিষ্কার করেছিলেন। যেমনটা তার বন্ধু বিখ্যাত পরিচালক রোমান পোলোনস্কির ক্ষেত্রেও ঘটেছিল। পোলিশ ক্যাথলিক পরিবারগুলোতে আশ্রয় নিতে হয়েছিল তাকে। তাই গল্পটা সত্যের উপর ভিত্তি করেই গড়া বলে মনে হয়।
এ সিনেমায় প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন ১৩ বছর বয়সী পিটার কোটলার। চেক রিপাবলিকে জন্ম নেয়া এ বালক ইতোমধ্যেই দারুণভাবে প্রশংসিত হয়েছেন। এমনকি চেক রিপাবলিকের সম্মানজনক লায়ন অ্যাওয়ার্ড পুরস্কারের জন্যও মনোনীত করা হয়েছে তাকে। সিনেমার শ্যুটিং করার সময় ১১ বছর বয়স কোটলারের। টানা ১৬ মাস ধরে চলতে থাকা এই সিনেমার শ্যুটিংয়ে তার বয়স বাড়ার ব্যাপারটাও স্পষ্টভাবে চোখে পড়বে।
চরিত্রায়নের প্রয়োজনে মলমূত্রের ডোবার মধ্যেও নামতে হয়েছে পিটারকে। পিটারের এ যাত্রায় বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকমের মানুষের সঙ্গে পরিচিত হতে হয় দর্শককে। প্রচলিত মানবসত্ত্বার আড়ালে থাকা অন্ধকার এক সত্ত্বার গল্প ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক এবং পরিচালক। পিটার যেন এক প্রতীক মাত্র; আর পুরো গল্পটাই যেন আমাদের চিরাচরিত জীবনযাপনের গল্পে সাজানো। দৃশ্যগুলো এতটাই পরিপূর্ণতা পেয়েছে পিটারের অভিনয়ে, সিনেমাটিকে জীবন্ত আর সত্য এক ঘটনার চিত্রায়ন ব্যতীত দ্বিতীয় কোনো চিন্তা আসবেই না দর্শকের মনে।
‘চেরনোবিল’ সিরিজ এবং ‘অ্যাঞ্জেলস অ্যান্ড ডেমন্স’ সিনেমায় অভিনয় করা সুইডিশ অভিনয়শিল্পী স্টেলান স্কার্সগার্ড ছিলেন এক জার্মান সৈন্যের চরিত্রে। স্টেলানের অভিনয় দক্ষতা সত্যিকার অর্থেই মুগ্ধ করার মতো। যেকোনো চরিত্রে অনায়াসে ডুবে যেতে পারেন স্টেলান, তাই চরিত্র উপস্থাপনে কোনো খামতি লক্ষ করা যায় না। নাৎসি বাহিনীর বর্বর এক সৈনিকের চরিত্রে অভিনয় করা সত্ত্বেও দর্শকের কাছে প্রশংসা কুড়িয়েছেন স্টেলান। এছাড়াও, পাদ্রীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন হার্বে কেইটেল; সোভিয়েত এক সৈনিকের চরিত্রে ছিলেন ব্যারি পেপার। ইউরোপ ছাড়াও আমেরিকা এবং কানাডার অনেক অভিনয় শিল্পী আছেন এ সিনেমার বিভিন্ন চরিত্রে।
গল্প এবং অভিনয় বাদে সিনেমাটির উপভোগ্য দিক নিঃসন্দেহে এর দৃশ্যায়নের যর্থার্থ বাস্তবায়ন, যেটিকে সিনেমার ভাষার সিনেমাটোগ্রাফি বলা হয়ে থাকে। একটি গল্প তখনই পরিপূর্ণতা লাভ করে, যখন এর দৃশ্যায়নেই গল্পের আবহটা ফুটে ওঠে। এক্ষেত্রে ‘দ্য পেইন্টেড বার্ড’ সফল। চেক রিপাবলিক, স্লোভাকিয়া এবং ইউক্রেনের জনবিরল গ্রাম্য অঞ্চলগুলোতে এর শ্যুটিং হয়েছে। জনবিরলতা একদিকে যেমন যুদ্ধের প্রভাবকে জাহির করে; অন্যদিকে আবার ইহুদি বালক পিটারের নিঃসঙ্গ জীবনকেও প্রতীকরূপে প্রতিফলিত করে।
সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে ছিলেন ভ্লাদিমির স্মুটনি। গল্পটা যুদ্ধের নৃশংসতা এবং ভয়াবহতার; আর এই বিষয়টাই দর্শকের মনে গেঁথে থাকবে স্মুটনির দারুণ দক্ষতার কারণে। আগুনে জ্বলতে থাকা এক বাড়ি, জঙ্গলে সঙ্গমের দৃশ্য, মৃত মানুষের পোশাক খুলে নেয়া, নাৎসি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা, বাঁচার প্রয়োজনে অন্যকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেয়া– এসব দৃশ্য স্মুটনি এমনভাবে চিত্রায়ন করেছেন যে নৃশংসতা আর ভয়াবহতা প্রতি দৃশ্যায়নে ফুটে উঠেছে।
মারহৌলের এ সিনেমা বর্বরতা আর নৃশংসতার এক নিদর্শন স্বরূপ। ইতিহাসের অজানা অধ্যায়কে তুলে ধরতে যুক্তিহীন কোনো গল্পের আশ্রয় নেননি পরিচালক। যুদ্ধের প্রভাবে পূর্ব ইউরোপের সংকটগুলোকে তুলে ধরা হয়েছে। না, শুধুমাত্র জীবনযাপন কিংবা অর্থনৈতিক বিপর্যয় নয়; বরং শারীরিক, মানসিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বিপর্যয়গুলো কীভাবে যুদ্ধের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়, তার প্রতিফলিত রূপ হচ্ছে ‘দ্য পেইন্টেড বার্ড’।