স্কারফেইস সিনেমাটি সিনেমা-প্রেমীদের ব্রায়ান দে পালমা কিংবা অ্যাল পাচিনোর ভার্সনের কথা মনে করিয়ে দিতে পারে যেটি মুক্তি পায় ১৯৮৩ সালে। তবে অনেকেরই অজানা যে, সেটি ছিল ১৯৩২ সালের ‘স্কারফেইস: দ্যা শেইম অফ আ নেশন’ এর পুনর্নির্মাণ। এই সিনেমাটি পরবর্তীকালের গ্যাংস্টার সিনেমাগুলো কীভাবে নির্মিত হবে তার একটি স্ট্যান্ডার্ড সেট করে দিয়েছিল।
অনেকের মতে, সর্বকালের সেরা গ্যাংস্টার ফিল্ম হলো স্কারফেইস: শেইম অফ আ নেশন। পরিচালক হাওয়ার্ড হকস এখানে প্রোবেশন আমলের গ্যাংস্টার লাইফস্টাইলকে তুলে ধরেছেন কোনোপ্রকার রাখঢাক ছাড়া। বিষয়বস্তু প্রদর্শনের দিক থেকে এটি ছিল অবিচল, অকাট্য, এবং বন্য হিংস্রতায় পরিপূর্ণ।
এই বিতর্কিত সিনেমাটির পরিকল্পনা করা হয় ১৯৩০ সালের দিকে। পরিচালনার পাশাপাশি কো-প্রোডিউসার হিসেবেও ছিলেন হকস। তার সাথে আরেক কো-প্রোডিউসার হিসেবে যোগ দেন আরেকজন হাওয়ার্ড, হাওয়ার্ড হিউজ। কথিত আছে মাত্র ১১ দিনেই এটির চিত্রনাট্য লিখে সম্পন্ন করেন বেন হেক্ট। যাতে সহায়তা করেন ডব্লিউ আর বার্নেট, জন লি মাহিন এবং সেটন আই মিলার।
১৯৩১ সালের জানুয়ারি নাগাদ চিত্রনাট্য প্রস্তুত হয়ে গেলে, ৩ মাস শ্যুটিংয়ের পর সে বছরেই মুভি সংক্রান্ত যাবতীয় কার্য সম্পন্ন করা হয়। ১৯৩২ সালের জানুয়ারিতে মুক্তি পাওয়ার কথা থাকলেও কয়েক মাস পিছিয়ে যায়। কারণ হকস এবং হিউজের সাথে সেন্সরের দ্বন্দ্ব। সেন্সরের মতে এই সিনেমা মবস্টারদের কর্মকাণ্ডকে গ্লোরিফাই এবং সেনসেশনালাইজ করছিল। তারা সিনেমার নাম পরিবর্তনেরও পরামর্শ দিয়েছিল।
এসব কারণে সকল গুণাবলী থাকা সত্ত্বেও ত্রিশের দশকের শুরুতে গ্যাংস্টার সিনেমা নিয়ে যে ক্রেজ শুরু হয়, তা আরম্ভের কৃতিত্ব পায়নি স্কারফেইস। এই কৃতিত্ব গেছে ওয়ার্নার ব্রাদার্সের দুই সিনেমা লিটল সেজার (১৯৩০) এবং পাবলিক এনিমির (১৯৩১)-র দখলে। তবে এগুলোর সাথে স্কারফেইসকে সংযুক্ত করে ট্রিলজি হিসেবে ধরলে বলা যায়, এই তিনটি সিনেমাই গ্যাংস্টার জনরার কাঠামো কেমন হবে তা নির্ধারণ করে দিয়েছিল।
সিনেমার শুরুতে আমরা পর্দায় একটি টাইটেল কার্ড ভেসে উঠতে দেখি। যেখানে বলা হয় সিনেমাটি আমেরিকায় বিদ্যমান গ্যাং কালচার এবং এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের নীরব দর্শকের ভূমিকা পালনের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগপত্রের মতো। এখানে জনগণের কাছে ফিল্মমেকারদের আর্জিও ফুটে ওঠে। বলা হয়— জনগণই পারে এই ভয়ংকর পরিস্থিতি থেকে নিজেদের মুক্তির পথ খুঁজে নিতে। জনগণের উচিত রাজনীতিবিদ এবং কর্তৃপক্ষকে তাদের দায়িত্ব ঠিকমত পালন করতে বাধ্য করা এবং এই পরিস্থিতির সুরাহা করা।
মূলত এই টাইটেল কার্ডের মাধ্যমেই হকস এবং হিউজ তদানীন্তন সময়ে অর্গানাইজড ক্রাইম এবং কর্তৃপক্ষের ভূমিকাকে কীভাবে দেখতেন তা পরিষ্কার হয়ে যায়। হাতে থাকা ম্যাটেরিয়ালকে তারা কীভাবে ব্যবহার করবেন তার একটা আভাসও এখান থেকে পাওয়া যায়।
চিত্রনাট্য লেখার ক্ষেত্রে বেন হেক্ট যে উপন্যাসটিকে অবলম্বন হিসেবে ব্যবহার করেছেন সেটির নামও স্কারফেইস। ১৯২৯ সালে প্রকাশিত ঐ উপন্যাসের লেখক আর্মিটেজ ট্রেইল; যেটি আসলে মরিস আর কুন্সের ছদ্মনাম। ক্ষণজন্মা এই পাল্প ফিকশন লেখক মারা যান মাত্র ২৮ বছর বয়সে।
সিনেমার গল্পে আমরা ১৯২০-এর দশকের শেষের দিকের শিকাগো শহরকে দেখি, যে দশক পরিচিতি পেয়েছে রোরিং টুয়েন্টিজ নামে। অ্যালকোহলের নিষিদ্ধকরণ এখানে জন্ম দিয়েছে নতুন একধরনের ব্যাধি, অর্গানাইজড বা গ্যাংল্যান্ড ক্রাইম। মবস্টারদের হিংস্রতা সম্পর্কে জনগণ, সংবাদ মাধ্যমের মতো কর্তৃপক্ষও ওয়াকিবহাল; কিন্তু তবুও এই ব্যাধির ছড়িয়ে পড়া বন্ধ করার ব্যাপারে তারা কিছুই করতে পারছে না।
এমতাবস্থায় গ্যাং মেম্বার ইতালিয়ান ইমিগ্র্যান্ট অ্যান্টিনিও ‘টনি’ কামোন্তে (পল মুনি)-র হাতে খুন হন মাফিয়া বস লুই ‘বিগ’ কস্তিও। যার ফলে শহরের এক অংশে চোরাই মদ চালান করার ক্ষেত্রে একচ্ছত্র অধিপতিতে পরিণত হন কস্তিওর প্রতিদ্বন্দ্বী জনি লোভো (অসগুড পার্কিন্স)। ফলে স্বাভাবিকভাবেই লোভোর সাথে টনির নৈকট্য সৃষ্টি হয়। কিন্তু এত অল্পতে টনি সন্তুষ্ট হয় না, সম্পদ এবং ক্ষমতার জন্য তার যে তৃষ্ণা সেটির নিবারণ হয় না। সে আরো চায়। যার ফলে আমরা শহরের অন্য অংশেও তার বন্য উন্মত্ততা চলতে দেখি। এতে করে সূচনা হয় ফুল স্কেল গ্যাং ওয়ারের, যার একদিকে আছে লোভোর গ্যাং এবং তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী আরেক মাফিয়া বসের গ্যাং।
চারপাশে আসন্ন গ্যাং ওয়ারের আবহে ভারী হওয়া বাতাস, সম্পদ এবং ক্ষমতার প্রতি টনির অপ্রশমনীয় ক্ষুধা এবং কর্তৃপক্ষের ভূমিকার উপর ভিত্তি করে এগিয়ে গিয়েছে সিনেমার প্লট। হকসের স্কারফেইস নিয়ে যতবার আলোচনা হবে, ততবারই পল মুনির কথা বলতে হবে। তার অভিনীত টনি চরিত্রটিই সিনেমার মূল উপজীব্য। এখানে টনিকে চিত্রিত করা হয়েছে অনেকটা আদিম বন্য প্রাণীর মতো করে। যে প্রাণী দাঙ্গা-হাঙ্গামা এবং বিশৃঙ্খলাকে গ্লোরিফাই করে এবং নিজের সুখ খুঁজে পায় ধ্বংসযজ্ঞের মাঝে।
লিটল সেজারের রিকো বা পাবলিক এনিমির ক্যাগনি চরিত্রের সাথে একই কাতারে শামিল হতে হলে মুনিকে টনি হিসেবে নিজের সেরাটা দিতে হতো। আর ঠিক সেটাই করেছেন তিনি নিপুণ দক্ষতায়। হাবভাবে, আচার-আচরণে টনির আদিম বন্যতা ঠিকরে বেরিয়েছে তার অভিনয়ে। এই চলচ্চিত্রই অপরিচিত মুনিকে দিয়েছে তারকার সম্মান, স্থান করে দিয়েছে হলিউডের আলো ঝলমলে আকাশে।
পরিচালক যেভাবে তার সিনেমার মূল চরিত্রের সাথে আমাদেরকে পরিচয় করিয়ে দেন সেটা বেশ চমকপ্রদ। কস্তিওর খুনের পর পুলিশ সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে শুরু করে। সে তালিকায় ছিল টনিও। টনির কাছে যখন পুলিশ সদস্য যান, তখন সে বসে ছিল একটি স্যালুনে। স্যালুনের লোকজনের আচার-আচরণে বোঝা যায় তারা আইন বা পুলিশের ব্যাপারে কতটা শ্রদ্ধাশীল। পুলিশ যখন তার সাথে দেখা করতে যায়, তখন তার মুখের উপর ছিল একটি পত্রিকা। কথোপকথনের শুরুতে সে পত্রিকাটি সরিয়ে ফেলে আর আমরা তার মুখের একপাশে থাকা তিনটি কাটা দাগ দেখতে পাই।
আমেরিকার ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত মব বসের নাম অ্যাল ক্যাপোন। তার মুখেও ছিল এমন দাগ আর ডাকনামও ছিল স্কারফেইস। তাই টনি চরিত্রের ক্ষেত্রে যে ক্যাপোন ছাপ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই মব বসের ব্যাপারে পরিচালকের মনোভাব কেমন ছিল সেটি প্রতীয়মান হয় সিনেমায় তার চরিত্রের অজাচার দিকটির প্রতি সূক্ষ্ম ইঙ্গিতে। আর টনির যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর ক্ষমতা লিপ্সা, সেটি প্রতীয়মান হয় তার এই উক্তিতে- “বুঝলে লিটল বয়, এই ব্যবসায় ঝামেলা থেকে বাঁচার কেবল একটাই উপায়: যা করার সেটা অন্যের আগেই করো, নিজে করো এবং করতে থাকো।”
এই সিকোয়েন্সে টনি লিটল বয় ডাকনামের যে ব্যক্তির সাথে কথা বলে, তার নাম রিনালদো (জর্জ র্যাফ্ট)। টনির ছায়া সঙ্গী রিনালদো চরিত্রে জর্জ ছিলেন অসাধারণ। তাকে এরপর হরহামেশা এ ধরনের গ্যাংস্টার চরিত্রে দেখা গেছে। যেকোনো কাজের আগে টস করা লিটল বয় হয়তো কমিক ফ্যানদের ব্যাটম্যান ভিলেন টু ফেইসের কথা স্মরণ করিয়ে দেবে। সিনেমায় টনির চরিত্রের বিকাশে বিশেষ ভূমিকা রাখে দুটি নারী চরিত্র। এদের একজন তার বোন সেস্কা (অ্যান ডিভোরাক) এবং আরেকজন তার প্রেমিকা পপি (কারেন মর্লে)। নিজেদের চরিত্রে উভয়েই ভালো নৈপুণ্য দেখিয়েছেন।
চিত্রনাট্যকার বেন হেক্ট কর্মজীবনের শুরুতে ছিলেন সাংবাদিক। তাই মাফিয়াদের তাণ্ডব সম্পর্কে তার ভালোই ধারণা ছিল। এই অভিজ্ঞতার প্রতিফলন দেখা গেছে সিনেমার গল্পে। এখানে এমন অনেক ঘটনা প্রদর্শিত হয়েছে যেগুলো বাস্তব ঘটনার রিক্রিয়েশন। যেমন: নৃশংস সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে ম্যাসাকার। এটি ঘটেছিল ১৯২৯ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারিতে এবং এতে জর্জ ‘বাগস’ মোরানে গ্রুপের ৭ জন প্রাণ হারায়। ছায়ার ব্যবহারের মাধ্যমে এই ম্যাসাকারের দৃশ্যের উপস্থাপন সিনেমা কৌশলের অনবদ্য উদাহরণ। এছাড়া হাসপাতালে সংঘটিত হত্যা দৃশ্য, ফুলের দোকানে ক্যাপোনের প্রতিদ্বন্দ্বীকে হত্যা দৃশ্যগুলোর পুনর্নির্মাণও দেখা গেছে পর্দায়।
টনি ছাড়া অন্যান্য চরিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রেও বাস্তবের মব বসদের জীবন থেকে অনুপ্রেরণা নেওয়া হয়েছে। যেমন: জনি লোভোর চরিত্র বাস্তবের জন টোরিওর প্রতিভূ, এবং কস্তিও ‘বিগ জিম’ কলোসিমোর ছায়া অবলম্বনে রচিত।
মুক্তির পর সেন্সর বোর্ডের সাথে সমস্যাসহ নানাবিধ জটিলতা সৃষ্টি হয়। একটা সময় সিনেমা সংশ্লিষ্ট লোকজন আবিষ্কার করেন এই সিনেমার দুটি ভার্সন আছে। এক ভার্সনে সেন্সরবোর্ডের নীতি মেনে সবকিছু করা হয়েছে, অন্যটিতে তা করা হয়নি। যার ফলে দর্শকদের মাঝে সংশয় দেখা দেয়। এছাড়া সিনেমার বিষয়বস্তু দেখে মানুষজন ক্ষুব্ধ হয়। হকস নিজের সিনেমায় গ্যাংস্টারদের কাজকে প্রশ্নবিদ্ধ করলেও, লোকজন তাকেই তাদের কাজ গ্লোরিফাই করার দায়ে অভিযুক্ত করে। ফলশ্রুতিতে তারা স্কারফেইসকে হল থেকে সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়।
বাণিজ্যিকভাবে স্কারফেইস ছিল ফ্লপ। পুরস্কার বা মনোনয়নের দিক থেকেও একই ভাগ্য বরণ করতে হয়েছিল এটিকে। আমেরিকার ইতিহাসে অন্যতম সেরা পরিচালকের গ্রাউন্ড ব্রেকিং কাজ হওয়া সত্ত্বেও অ্যাকাডেমি গুরুত্ব দেয়নি স্কারফেইসকে। জনগণের কাছে আবার গুরুত্ব পেতে এটিকে অপেক্ষা করতে হয় ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে। হাওয়ার্ড হিউজের মৃত্যুর পর আশির দশকে আবার স্কারফেইস জনগণের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে স্থান করে নিতে শুরু করে।
তবে চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের কাছে কখনোই এটির গুরুত্ব কমেনি। এখানে হকসের ব্যবহৃত ডলি এবং ট্র্যাকিং শটগুলো তখনকার সময়ে তেমন একটা দেখা যেত না। এগুলো সিনেমার পেসিং বা অনবদ্য গতিময়তার আবহ সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছে। এছাড়া টাইটেল কার্ড থেকে শুরু করে সর্বত্র সিম্বোলিজমের সূক্ষ্ম ব্যবহার সিনেমার মূল বক্তব্যকে পরিবেশন করতে সহায়তা করেছে। বর্তমান কালের স্ট্যান্ডার্ডেও স্কারফেইসকে ভীতিকর মনে হবে। অনস্ক্রিনে মোট ২৮টি মৃত্যু হতে দেখা গেছে, যা সেসময়ের জন্য ছিল অভাবনীয়। শেষের গানফাইট, বিস্ফোরণের দৃশ্যসমূহ থেকে শুরু করে কার চেইস; সর্বত্র যতটা সম্ভব বাস্তবমুখী করে এটিকে নির্মাণ করার চেষ্টা করেছেন হকস। সে সময়ের সীমিত কারিগরি সামর্থ্যে তিনি এই দৃশ্যগুলো যেভাবে সুনিপুণতার সাথে ধারণ করেছেন, তা বিমুগ্ধ করবে সিনেফাইলদের। যা পরিচালক হিসেবে হাওয়ার্ড হকসের ক্রিয়েটিভ জিনিয়াসের প্রমাণ।
সময়ের সাথে এটি হলিউডের রূপকথার অনিবার্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে। একে ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে নানা মিথ। যেমন: এটির শ্যুটিংয়ে এক ব্যক্তিকে চোখ হারাতে হয়েছে, বাস্তবমুখীতার জন্য বন্দুক-পিস্তলে সত্যিকারের বুলেট ব্যবহৃত হয়েছে। কেউ কেউ বলেন এই সিনেমায় পর্দার পেছনে থেকে নানা ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছিল খোদ গ্যাংস্টাররাই। একথাও শোনা যায়, বাস্তবের ‘স্কারফেইস’ অ্যাল ক্যাপোনও নাকি এই সিনেমা খুব পছন্দ করেছিলেন।
তবে মিথের সত্য-মিথ্যা নিরূপণে না গিয়ে কেবল বিষয়বস্তুর ট্রিটমেন্ট আর উপস্থাপনের জন্যই এই মুভি দেখা যায়। লিটল সেজার আর পাবলিক এনিমির সাথে মিলে যেটি নির্ধারণ করে দিয়েছিল ভবিষ্যতের গ্যাংস্টার সিনেমা নির্মাণের ধরন।