সমকালীন দেশীয় সাহিত্যের ডালা থেকে নেওয়া ৩ পুস্তাকালাপ

শাহজাদীর শয্যা

বিশ্বজিৎ চৌধুরীর এই ছোটগল্প সংকলনের নাম ওল্ড স্কুল ভাইব দিলেও, গল্পগুলো ওল্ড স্কুল/নিউ স্কুল/মডার্ন স্কুল; সব স্কুলেই আবেদন রাখার মতো। গল্পগুলোর নামও গল্পের প্রধান বিষয়টির কথা মাথায় রেখে সরাসরি দেওয়া। সৌকর্য, সূক্ষ্মতা যা দেখানোর সেসব তিনি গল্পের বর্ণনায় ও বিষয়াদিতে দেখিয়েছেন।

১১টি গল্পের সমাহার। এমন নয় যে গল্পগুলো ভীষণ নতুন কিংবা একদমই অপ্রত্যাশিত চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে সেখানে। কিন্তু যেটা পাঠকমনে তড়িৎ অনুনাদ জাগায় তা হলো সবকিছুতে এর পরিমিতিবোধ, মমতা এবং অন্তর্দৃষ্টি। চলমান সব ঘটনা থেকেই সূক্ষ্মতায় ছেঁকে অনুরণিত হবার মতো বিষয়গুলোকে তিনি গল্পে ধরেছেন। স্বর উচ্চকিত রাখেননি, যতখানি সম্ভব মৃদু রেখেছেন। ওটাই ভাষার মাঝে, চরিত্রগুলোর মিথস্ক্রিয়ায় কমনীয়তা ঢেলেছে।

যেমন; ‘অপহরণ’ গল্পটি খুব জটিল যেকোনো দিকে যেতে পারতো। পাহাড়ের ওই চিত্রে রাজনীতি, অন্যায় অনেক কিছুর বয়ান হতে পারতো। সেসব তো অন্যান্য অনেক গল্পে আর কম হয়নি। কিন্তু বিশ্বজিৎ চৌধুরী সেসবের মাঝ দিয়ে ধরেছেন প্রেমকে। ভিন্ন সম্প্রদায়ের অভিন্ন প্রেমকে। এবং ওই অপহরণের নাটকীয়তার মাঝেই কিন্তু রাজনৈতিক কারণ, বর্ণভিন্নতা, বৈষম্য চলে আসে। ওগুলোর প্রতি না বলেও তাই বলা হয়ে যায়। সিদ্ধান্ত তো এসবের যাঁতাকল থেকে বাঁচতেই। ঠিক এমন অন্তর্দৃষ্টির কারণেই চেনা বাঁকের গল্পগুলোর মাঝে এক ভিন্ন ছন্দের আওয়াজ পাওয়া যায়। 

Image Courtesy: We Love Art

আবার, ‘অসম’ গল্পে কী সহজাতভাবেই না নিঃসঙ্গতার বয়ানে যৌনতা ও প্রেমের একটা সূক্ষ্মরূপ কাচে তার প্রতিফলন রেখে গেলো। ‘নায়িকার অটোগ্রাফ’-এও আছে সেই নিঃসঙ্গতা, যৌবন ও প্রেম। সেই সাথে একদম মসৃণভাবে মিশিয়ে দেওয়া একটুখানি রহস্য! ঠিক জনরা টুইচ করার মতো। ‘মা তোর বদনখানি’ তো ছুটে যায় এক তরুণীর পরিচিতি খুঁজবার যাত্রায়। সাথে নেয় মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট ও স্মৃতিচারণের ভার। পরিচিত গল্প, কিন্তু মমতা দিয়ে লেখা। ‘দুরকম বন্ধু’, এক অন্যরকম বন্ধুত্বের গল্পের পাশাপাশি গ্লানিতে ভরা জীবনবোধের কথা বলে। ‘অপূর্ব নিবিড় নিদ্রা’, ‘পুনর্মিলনী’, ‘সুর ও সম্পর্ক’- এসবে রয়েছে ব্যক্তি নিঃসঙ্গতা, পরিচিতি হারানোর বেদনা ও অন্যভাবে শুরু হওয়া স্নেহের সম্পর্কের গল্প। ‘হ্যাভ আ নাইস জার্নি’ একদম মিষ্টিমধুর প্রেম। ‘বেগম সাহেবা’য় আছে রূঢ় বাস্তবতার দীর্ঘশ্বাস আর নামগল্প ‘শাহজাদীর শয্যা’য় আছে যৌনতা, ক্ষমতা আর আকাঙ্ক্ষার বয়ান। 

বিশ্বজিৎ চৌধুরী বেশিরভাগ গল্পই ফার্স্ট পারসন ন্যারেটিভে লিখেছেন। প্রতিটি গল্পই বয়ানের দিক থেকে সরল। কিছু আলাপ অতিচেনা হলেও আত্মমগ্ন, কোমল, কিন্তু অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন গদ্যের কারণে পড়তে গিয়ে কম্পন অনুভব করা যায়। এই ঋজু ভাষার ছন্দই ভালো লাগায়।

শাহজাদীর শয্যা; Image Source: Scrapbooks

কালঘুম

মুহাম্মদ মহিউদ্দিনের ‘কালঘুম’ উপন্যাসটি আশির কাছাকাছি বয়সের শক্তসমর্থ বৃদ্ধ মহব্বত খান পাটোয়ারি, বাড়ি ‘ক্ষণিকালয়’ এবং এর সদস্যদের ঘিরে। মহব্বত খান চান মৃত্যুর পর তার কবর বাড়ির উঠোনেই হবে। গোরস্থানে এক কবরের উপর কত কবরই না পড়ে!

তার এই ইচ্ছা নিয়েই গল্প এগোয়। চিলেকোঠায় ভাড়া থাকা প্রুফরিডার আবেদ আলী এই বিষয়ে একটি বই লিখবেন বলে মনস্থির করেন, এবং বেশ গবেষণাও শুরু করেন কাফনের কাপড় বিক্রেতা, গোরখোদকদের সাথে। বিভিন্ন দেশের অদ্ভুত সব অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পর্কেও আবেদ আলী জানতে পারেন এর সুবাদে। এক নেক্রোফিলিক গোরখোদকেরও সন্ধান পাযন। বাড়ির অন্যান্য সদস্য, যেমন- রক্ষণাবেক্ষণকারী বাচ্চু মিয়া ও তার হঠাৎ আসা পরিবার, পাটোয়ারি সাহেবের মেয়ে মারিয়া এবং তাদের অতীতের নানা দুঃখস্মৃতিকে বাহুডোরে নিয়ে উপন্যাস এগোয়। 

খুবই সরলরৈখিক উপন্যাস। মহব্বত খান মৃত্যুর আগে শুধু কবর নির্বাচন নয়, তার ‘জেয়াফত’-এরও আয়োজন করেন! তার এই ইচ্ছে, কিংবা বলা যায়, এই সিংগেল প্লটপয়েন্টই আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে কাজ করে। কিন্তু শেষ অব্দি সেই উৎসাহের ফলাফল পেয়ে বা পরিণতি দেখে সন্তুষ্ট হওয়া যায় না।

কালঘুম; Image Source: Scrapbooks

পাটোয়ারির এই ইচ্ছায় এমনিতেই একটা অ্যাবসার্ড টোন আছে। পেসিমিস্টিক ভাইব পাওয়া যায়। চাইলে সেটাকে আরো নিগূঢ় কোনো জায়গায় নিয়ে যাওয়া যেত। কোনো রাজনৈতিক বা সামাজিক বক্তব্যের একটা গম্ভীর রূপক হতে পারতো। কিন্তু অমন অমোঘ কিছু হয়নি। ও নাহয় থাক। যতটুকু দর্শন আছে, সেসবও কিন্তু অতি সহজপাচ্য এবং স্বভাবজাত ক্লিশের মোড়কেই বন্দী থেকেছে। ওতে ঠিকঠাক কোনো গভীরতা পাওয়া যায়নি।

নানা দেশের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া আর নেক্রোফিলিয়া অল্পবিস্তর কথাবার্তা আছে, যা জায়গা কামড়ে পৃষ্ঠায় বসে থাকা ছাড়া আলাদা কিছু করতে পারেনি। তাছাড়া, উপন্যাসের শুরুর দিকের বর্ণনার ঢং আর চরিত্রায়নের রীতি ‘হুমায়ূনীয়’ মনে হলো, পড়তে গিয়ে যা কিছুটা দৃষ্টিকটু লাগে। পরবর্তীতে ওই প্রভাব কম লাগলেও বলিষ্ঠ স্বরে লেখকের স্বকীয় কোনো গদ্যভাষা চোখে পড়েনি। আর আবেদ আলী চরিত্রটি আগেও মুহাম্মদ মহিউদ্দিনের গল্প/উপন্যাসে এসেছে দেখলাম। এমন চরিত্র, তার বৈশিষ্ট্য এবং বৃত্ত দেখে পাঠক খুব সহজেই তাকে চিনে নিতে পারবেন, কিন্তু অন্য চরিত্র/চরিত্রদের ছায়ায়।

Image Source: 𝑫𝒆𝒂𝒕𝒉 𝒃𝒚 𝑯𝒊𝒃𝒂𝒄𝒉𝒊/Twitter

আলাদা করতে পারার মতো খুব বেশি সক্ষমতা অন্তত এই উপন্যাসে দেখা যায়নি। হয়তো তার কাজই লেখকের দৃষ্টি হয়ে অনেককিছুতে নির্লিপ্তভাবে জড়িয়ে যাওয়া এবং হলিউডি অনেক সিনেমার মতো ‘এভ্রিম্যান’ টাইপ গাই হয়ে নিজের মতো করেই একটা গন্তব্যে পৌঁছানো কিংবা সমাপ্তি দেওয়া। মারিয়া এবং পাটোয়ারির অতীত সম্বন্ধিত দু-একটা সাধারণ গোছের টুইস্ট এখানে আছে। থাকাটা জরুরি না। তবে যা আছে, তাতে নতুন করে তেমন অভিঘাতপূর্ণ কোনো জটিলতাও দাঁড়ায় না। 

‘কালঘুম’ পাঠকের নিরবচ্ছিন্ন মনোযোগ পাবার মতো কিছু না। তবে ‘ক্ষণিকালয়’ বাড়িটি দিয়ে যে ইহকালের সংক্ষিপ্ত সময়ের দিকেই ইঙ্গিত করা হচ্ছে, এই রূপক যেমন সহজেই টেক্সট থেকে তুলে নেওয়া যায়, তেমনি আরো কিছু সহজ ও রোজকার টুকরো বাস্তবিক দর্শন এবং দীর্ঘশ্বাসের কথা (অত দীর্ঘ নয়) হালকাচালের গতিময় গদ্যভাষায় মৃদুমন্দ হাওয়ার তালে পড়ে নেওয়া যায়।

নোনা জল

নোনা জলের প্রচ্ছদ; Image Source: Scrapbooks

অনিন্দিতা গোস্বামীর ‘নোনা জল’ উপন্যাস ব্রিটিশ শাসিত তৎকালীন ভারতবর্ষ আর আদিবাসীদের প্রতিবাদী এক গল্পকে একইসাথে সংযুক্ত করে এগিয়ে যায়। বিস্তৃত প্রেক্ষাপট। সাথে দুই মানব-মানবীর ভালোবাসার গল্প। সেই অনুযায়ী ১৫০ পাতার কলেবর খুব বড় নয়।

অবশ্য গল্পের মূল কথা ঠিকঠাক ধরে বর্ণনা করতে পারলে এই দৈর্ঘ্যেই অনেক ভালো কিছু দাঁড় করাতে পারতেন। মূল গতিতে এসেছেন অনেক পরে। টোন দোলাচলে ভুগেছে তাই। আর সেই তুলনায় শেষ করেছেন প্রচন্ড তাড়াহুড়োয়। যার কারণে বড়/ছোট কোনো ধাক্কা কিংবা কোনো রেশ রেখে যায়নি গল্প। বড় কোনো দান নেই। কিছু কিছু অংশে ভালো বর্ণনা। খুব বেশি ক্লেশ অবশ্য জাগায়নি।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও আদিবাসী নিপীড়ন আর প্রতিবাদের যে চিত্র লেখিকা তার বর্ণনার ভাষায় এঁকেছেন, তা নতুন কিংবা ভিন্ন কিছু নয়। পাঠকের পড়তে গিয়ে অনেককিছুই খুব চেনা ঠেকবে। সেসব আরো বিভিন্ন গল্পসাহিত্যে যেমন এসেছে, তেমনি ভিজ্যুয়াল মাধ্যমেও বেশ দেখা গেছে। আরো বহুমাত্রিকভাবে এবং অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন গদ্যে দেখা গেছে, যা এই উপন্যাসে পাওয়া যায়নি।

This article is a compiled review of 3 books of recent Bangladeshi literature. Each one of them contains different tastes, mixed different genres.

Feature Image: Goodreads

Related Articles

Exit mobile version