জগতে কত মহান নারীর কথা আমরা জানি, তাদের কর্ম ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। জ্ঞানী, গুনী, বিজ্ঞানী, দার্শনিক, সমাজসেবক, রাজনীতিক, সংস্কারক, সাহিত্যিক ইত্যাদি নানা কাজের মাধ্যমে তারা পৃথিবীকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। এসবের বাইরেও এমন অসংখ্য নারী আছেন, যারা অতি সাধারণ জীবনযাপন করেন। কন্যা, গৃহবধূ হয়েই জীবন কাটিয়ে দেন, সন্তানের মা হওয়াতেই তাদের স্বার্থকতা। এই নারীদের জীবনেও জোয়ার-ভাটার কমতি নেই। সেই জীবনও কখনও কখনও তীব্রভাবে আকর্ষণের বিষয় হয়ে ওঠে।
এমনই একজন নারী আয়েশা ফয়েজ, যার স্বামী শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ফয়জুর রহমান। একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিধবা হয়ে সন্তানদের ‘মানুষ’ করার জন্য যিনি পুরোটা জীবন যুদ্ধ করে নিজেই ‘সংগ্রামী মা’ হয়েছেন। স্বাধীন দেশে শহীদের বিধবা স্ত্রী হিসেবে যেমন অনেকের কাছে সম্মান পেয়েছেন, বিপরীতে তিরস্কারও জুটেছে। একসময় বাস্তুচ্যুত হয়ে রাস্তায় নেমেছেন, নিজ চেষ্টায় ঘুরে দাঁড়িয়েছেন, সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সন্তানের সুখই মায়ের সুখ- এভাবেই তিনি ভাবতেন। সম্ভ্রান্ত্র পরিবারের সন্তান হয়েও সমাজের নিয়মের জালে পড়ে ছোটবেলাতেই লেখাপড়ার ইতি ঘটেছে। অল্প বয়সে একজন বেকার যুবকের সাথে বিয়ে হলো। সাদাসিধে ভাবুক টাইপের স্বামী ফয়জুর রহমান, শিক্ষকতা ছাড়া অন্য পেশায় জড়াতে চান না। বিয়ের চার বছর পার হলেও সন্তানের দেখা নেই- এ নিয়ে কটুকথা মুখ বুঝে সয়েছেন। একসময় হয়ে গেলেন রত্নগর্ভা মা। তার স্বপ্ন সত্যি হয়েছে, সন্তানরা স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শুধু প্রতিষ্ঠিতই নয়, বড় ছেলে তো দেশের সর্বজনপ্রিয় সাহিত্যিক।
এবার নিশ্চয়ই পাঠক ধরে ফেলেছেন কার কথা বলছি! হ্যাঁ, আমাদের সবার প্রিয় হুমায়ূন আহমেদের মা আয়েশা ফয়েজের কথাই বলছি। তবে তিনি শুধু হুমায়ূন আহমেদের মা নন, তার আরো পাঁচ সন্তান আছে। মেঝ ছেলে মুহাম্মদ জাফর ইকবাল কিশোর সাহিত্য ও সায়েন্স ফিকশন জগতের মহারথী, ছোট ছেলে আহসান হাবীব আঁকাআঁকিতে নামডাক করেছেন।
বাংলাদেশে মা-বাবাদের বড় সন্তানের নামে ডাকার প্রবণতা আছে। আয়েশা ফয়েজকেও সবাই কাজলের (হুমায়ূন আহমেদের ডাকনাম) মা বলে ডাকত। তিনি যেদিন মারা যান, সেদিন বেশিরভাগ পত্রিকায় লেখা হলো- হুমায়ূন আহমেদের মা মারা গেছেন। এ ধরনের পরিচয়ে আয়েশা ফয়েজ গর্ববোধ করতেন। তার অন্য ছেলেরা লেখালেখিতে হাত পাকালেও দেশের পাঠকসমাজের মতো আয়েশা ফয়েজেরও সবচেয়ে পছন্দের লেখক বড় ছেলে হুমায়ূন আহমেদ। তিনি তার আত্মজীবনী ‘জীবন যে রকম’সহ নানা সাক্ষাৎকারেও সেটি জানিয়েছেন। আরো মজার বিষয় হলো- আত্মজীবনীতে অন্য সন্তানদের চেয়ে বড় ছেলের কথাই বেশি লিখেছেন। একে প্রথম সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের প্রচ্ছন্ন পক্ষপাতও বলা যেতে পারে।
মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে ১৯৪৪ সালে আয়েশা ফয়েজ ফয়জুর রহমানের ঘরে বউ হয়ে আসেন। শ্বশুর সম্ভ্রান্ত বংশধারী হলেও সম্পদশালী ছিলেন না। তার শ্বশুর বলতেন, “আল্লাহ, আমি তোমার কাছে ধন চাই না, জন চেয়েছি।” তিনি সুফী মানুষ ছিলেন, নিজের ও অন্যদের নিয়ে করা ভবিষ্যদ্বাণী প্রায় সময় ফলে যেত। মৃত্যুর এক সপ্তাহ আগে সবাইকে ডেকে বললেন, অমুক দিন অমুক সময়ে তার মৃত্যু হবে, হয়েছেও সেটাই!
একসময় স্বামী ফয়জুর রহমান পুলিশের ডিএসপি হলেন। বদলির চাকরির বদৌলতে বৌ-বাচ্চাদের নিয়ে দেশের নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছেন। সেসব এলাকার নানা বিচিত্র ঘটনা আত্মজীবনীতে তুলে এনেছেন নিজের মতো করে।
একবার সিলেটের এক হিন্দু নিঃসন্তান ব্যক্তি মানত করলেন তার সন্তান হলে মুসলমানদের মতো গরু কোরবানি দেবেন। অবাক করা ব্যাপার হলো, কয়েক বছরের মধ্যে তিনি সন্তানের বাবা হলেন। এবার মানত পূর্ণ করার পালা। এলাকার মুসলিমরা আপত্তি করল। কোনো হিন্দু ধর্মাবলম্বী ব্যক্তি গরু কোরবানি দেবে এটা তারা মানতে পারল না। নালিশ গেল জমিদারের কাছে। হিন্দু জমিদার ব্রিটেন থেকে কোরআন শরীফের ইংরেজি তরজমা এনে নিজে পড়ে জানালেন, ইসলাম ধর্মে হিন্দুরা কোরবানি দিতে পারবে না- এমন কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। মুসলমানরা দুই ভাগ হয়ে গেল, কেউ কেউ তার কথা বিশ্বাস করল, কেউ করল না।
হিন্দু-মুসলিম সমস্যা নিয়ে আরেকটি ঘটনা দেখেছেন বান্দরবানে। এক হিন্দু ব্যক্তির সন্তান পানিতে ডুবে মারা গেল। তার লাশ তুলে আনল কয়েকজন মুসলিম যুবক। এরপরের ঘটনা লেখিকার মুখ থেকেই শোনা যাক,
“ছেলেটির শেষকৃত্যের পরে শ্রাদ্ধের দিন স্থানীয় ব্রাহ্মণেরা বেঁকে বসল। তারা বলল, মৃতদেহ নদীর পানি থেকে উপরে তুলেছে মুসলমানেরা। তাদের হাতের স্পর্শে এই ব্রাহ্মণ তরুণের দেহ অশুচি হয়েছে, তার শ্রাদ্ধ করা যাবে না। কাজলের বাবার কাছে খবর আসতেই তিনি গোঁড়া ব্রাহ্মণদেরকে জানিয়ে দিলেন, শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে বাধা দিলে এলাকার শান্তি নষ্ট করার জন্য বেত্রাঘাত করা যেতে পারে। এ ঘোষণা ম্যাজিকের মতো কাজ হল, হতভাগ্য তরুণের শ্রাদ্ধ সুচারুভাবে শেষ হলো।
আয়েশা ফয়েজের জীবনে সবচেয়ে সংগ্রামমুখর ক্ষণ এলো মুক্তিযুদ্ধের সময়। পুলিশ অফিসার স্বামীকে পাকিস্তানি আর্মি বিগ্রেডিয়ার আতিক রশীদ হত্যা করে। পাক বাহিনীর চক্ষুশূল হয়ে তিনি সন্তানদের নিয়ে হাওরে-জঙ্গলে পালিয়ে বেড়ান। এর মধ্যে লেখিকার বাবাকে না জানিয়ে পাক আর্মি শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান বানিয়ে দেয়, যার খেসারত দিতে হলো একাত্তরের ৮ ডিসেম্বর; তার বাবা ও এক ভাইকে মুক্তিযোদ্ধারা গুলি করে হত্যা করে।
লেখিকার মতে, তার বাবা পরিবারকে বাঁচাতে শান্তি কমিটিতে থাকতে বাধ্য হয়েছেন। তার কাজ ছিল পাক আর্মি যাদের ধরে নিয়ে যেত, বন্দুকের নল থেকে তাদের ছাড়িয়ে আনা। এভাবে তিনি অনেকের জীবন বাঁচিয়েছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ পরে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে। তারা সাক্ষী আছে, তার বাবা কোনো অন্যায় করেনি।
শহীদ পরিবারের সদস্য হিসেবে লেখিকাকে ঢাকা শহরে বঙ্গবন্ধু সরকারের পক্ষ থেকে একটি বাড়ি দেয়া হয়। সরকারের বিশেষ বাহিনী কয়েক বছরের মাথায় সেই বাড়ি জবরদখল করে নেয়। সন্তানদের নিয়ে তিনি রাস্তায় নামতে বাধ্য হন। যে দেশের জন্য তার স্বামী জীবন দিলেন, সেই দেশে তিনি বাস্তুহারা হলেন- এই বেদনা তাকে পুঁড়িয়েছে বহুবার।
এরপরও জীবনযুদ্ধে হার মানেননি; একসময় দারিদ্র্যকে জয় করে সন্তানরা প্রতিষ্ঠিত হলো। দেশসেরা সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, কার্টুনিস্ট হয়ে তারা মায়ের স্বপ্ন পূরণ করে।
বইটিতে লেখিকা সেই প্রাচীন সময়ের নানা সংস্কার, ঘটনাক্রম নিজের মতো করে লিপিবদ্ধ করেছেন। জন্মের পর হুমায়ূন আহমেদকে মধুর সাথে লোহার টুকরাও খাওয়ানো হয়, এই তথ্য তিনি জানিয়েছেন। স্বামী ফয়জুর রহমানের লেখালেখির বাতিক ছিল- সেটা সন্তানরা পেয়েছে। শখের বশে হাত দেখা, ভৌতিক কর্মকান্ড- এসবও করতেন। বাবার এসব অদ্ভুত কাজের প্রতিফলন হুমায়ূন আহমেদের লেখায় আমরা দেখতে পাই।
আয়েশা ফয়েজ একজন গৃহবধূর জীবনযাপন করলেও, একজীবনে তাকে নানা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। তিনি বাংলাদেশের জন্ম দেখেছেন, নতুন দেশে নতুন আশার বীজ বুনেছেন, কতটুকু সত্যি হলো তা বইয়ে প্রকাশ করেছেন। তার সন্তান ও আশেপাশের মানুষদের নিয়ে লিখেছেন।
নিজেকে নিয়ে কমই লিখেছেন। ছোট ছোট বাক্যে জীবনের নানা ঘটনাকে কাগজে প্রকাশ করেছেন। বইয়ে একজন মায়ের দেখা পাওয়া যায়, যিনি অন্য যেকোনো পরিচয়ের চেয়ে মা পরিচয়কেই বড় করে দেখতেন। নিজের সন্তানদের মা তো ছিলেনই, আরো অনেকে তাকে মা বলে ডেকেছে। একসময় তার সন্তানরা ‘স্বার্থক মা’ পদক লেখা একটি ক্রেস্ট তার হাতে তুলে দেয়। পুরো ব্যাপারটা একটা হালকা হাসিখুশির ব্যাপার হলেও আয়েশা ফয়েজের চোখ তাতেই আর্দ্র হয়ে ওঠে।
তথ্যসূত্র
জীবন যে রকম, আয়েশা ফয়েজ, সময় প্রকাশনী, ১৩ তম সংস্করণ ২০১৫।