“অতীত একটা মিথ্যে ছাড়া আর কিছু নয়, স্মৃতির দিকে প্রত্যাবর্তন সম্ভব নয়, চলে যাওয়া বসন্তদিন কখনো ফেরবার নয়, আর সবচেয়ে উন্মত্ত সবচেয়ে একনিষ্ঠ প্রেমও শেষ অব্দি একটা ক্ষণস্থায়ী সত্য ছাড়া কিছু নয়।” – গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ।
সভ্যতার গোড়াপত্তন হয়েছিল একজন নর আর একজন নারীর দ্বারা। তাদের জৈবিক চাহিদার ফলাফল তাদের সন্তানাদি। পর্যায়ক্রমে আর ধারাবাহিকতায় এগিয়ে চলে এই জীবনযাপন আর জীবনধারা। আর সেখান থেকেই গড়ে ওঠে একটি পরিবার, আবার এই পরিবারেরও শাখা প্রশাখা বের হয় অনেক। এমনই একটি পরিবারের সাত প্রজন্মের নিত্যদিনের গল্পগুলো থরে থরে সাজানো আছে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ রচিত নোবেলজয়ী উপন্যাস নিঃসঙ্গতার একশো বছর – বইটি।
স্প্যানিশ ভাষায় লেখা মূল বইটির নাম সিয়েন আনোস দে সোলেদাদ- যা মূলত বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পায় গ্রেগরি রাবাসার ইংরেজি অনুবাদের জন্য যার নামকরণ হয় One Hundred Years of Solitude. পরবর্তীতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ভাষায় এই বইটির অনুবাদ হয় এবং সাহিত্যে নোবেল পায় বইটি। বাংলায় অনুবাদ করেন জি এইচ হাবীব। নামকরণ করেন নিঃসঙ্গতার একশো বছর।
লাতিন আমেরিকার গভীর এক জঙ্গলে এক পরিবারের বসবাস। যার পূর্বদিকে এক দুর্গম পর্বতমালা, আর পাহাড়ের ওপাশে প্রাচীন শহর রিয়োহাচা। পরিবারের কর্তা হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া যে কিনা কৌতূহলী এবং উদ্ভাবনীশক্তি সম্পন্ন চরিত্রের অধিকারী। তার নিজের হাতে খুন হওয়া এক লোকের ভূতের উৎপাত থেকে রক্ষা পেতে হঠাৎই একদিন পুরনো গ্রামটা ছেড়ে নতুন আবাসের খোঁজে নিজের বউ আর কিছু অনুসারী নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সে। ২৬ মাসের দীর্ঘ অভিযান ইস্তফা দিয়ে এক জায়গায় এসে বসতি স্থাপন করে তারা। গ্রামটার নাম রাখে মাকোন্দো। নিজেদের সুবিধা মতো সব নিয়মকানুন বানায় সেখানে। ত্রিশ বছর বয়সের ঊর্ধ্বে কেউ নেই এ গ্রামে। এমনকি এখনো পর্যন্ত কেউ মারা যায়নি। তারা বলে, এখানে কোন ঈশ্বরের দরকার নেই; এমনকি দরকার নেই কোন সরকারি ব্যবস্থারও।
বোহেমিয়ান জিপসিরা একদিন মাকোন্দোতে আসে। সাথে করে নিয়ে আসে নতুন নতুন আবিষ্কৃত সব যন্ত্রপাতি যেগুলা দিয়ে জিপসিরা সবাইকে অবাক করে দিয়ে টাকা উপার্জন করে। জিপসিদের মধ্যে একজনের নাম মেলকেদিয়াস যে কিনা পুরো দুনিয়া ঘুরে বেড়ায়, বিদগ্ধ, রহস্যময় এক জিপসি। মেলকেদিয়াসের বুদ্ধিমত্তা আর উদ্ভাবনী শক্তিতে প্রভাবিত হয়ে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া তাকে নিজ বাড়িতে আশ্রয় দেয়।
আর হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়াও সমস্ত কাজ ফেলে লেগে যায় পরশ পাথর আবিষ্কারের পেছনে, নিজের তৈরি গবেষণাগারে। আর একদিন সে আবিষ্কার করে ফেলে যে পৃথিবীটা কমলালেবুর মতো গোল। উরসুলা বুয়েন্দিয়া যে কিনা হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার স্ত্রী সেও স্বামীর এইসব কাজকর্মে অতিষ্ঠ হয়ে নিজে থেকে পরিবারের হাল ধরে। তাদের তিন সন্তান। হোসে আর্কাদিও, আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া এবং আমারান্তা উরসুলা।
হোসে আর্কাদিও এক উদ্দাম জীবন পালন করে, তার স্ত্রী রেবেকা বুয়েন্দিয়া, যে সম্পর্কে তার বোন ছিল। তাদের কোন সন্তান হয় না কিন্তু হোসে আর্কাদিও’র সন্তান হয় যার নাম রাখা হয় আর্কাদিও, আর যার পেটে এই বাচ্চাটা বেড়ে উঠে সে আর কেউ নয় গণিকা পিলার তারনেরা। যে কিনা তার আপন ভাই কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ারও শয্যাসঙ্গিনী এবং তাদের সন্তান আউরেলিয়ানো হোসে। যদিও রেমেদিওস মসকোত তার স্ত্রী কিন্তু সে ঘরেও কোন সন্তান নেই। কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া দীর্ঘ বিশ বছর ধরে বত্রিশটা অর্থহীন যুদ্ধ চালিয়ে যায় আর প্রত্যেকটাতেই পরাজিত হয়। এই যুদ্ধের গভীরে জৈবিক প্রয়োজনে আরো সতেরো জন আউরেলিয়ানো জন্ম নেয়।
মেয়ে আমারান্তা উরসুলা কাউকে ভালোবেসে মনের কথা জানাতে না পেরে কোন এক অদ্ভুত রহস্যে বরণ করে নেয় নিঃসঙ্গ এক কুমারী জীবন। কিন্তু তার এই জ্বলন্ত নিঃসঙ্গ জীবনে তার ভাইপো আউরেলিয়ানো হোসে আসে অঙ্গার হয়ে যে কিনা পিলার তারনেরা আর কর্নেল আউরেলিয়ানোর সন্তান। হাতে কালো পট্টি বাধা একাকীত্বের প্রতীক আমারান্তা তার ভাইপোর সাথেই এক রঙ্গ লীলায় মেতে উঠে নিজের নিঃসঙ্গতাকে ভুলে। গণিকা পিলার তারনেরা আর হোসে আকার্দিওর সন্তান আর্কাদিও একদিন নিজের শারীরিক চাহিদা মিটাতে আসে নিজের মা পিলার তারনেরারই কাছে। আর্কাদিও আর তার স্ত্রী সান্তা সোফিয়া দে লা পিয়েদাদ এর তিন সন্তান। আউরেলিয়ানো সেগান্দো, হোসে আর্কাদিও সেগান্দো এবং সুন্দরী রেমেদিওস।
উরসুলা বুয়েন্দিয়ার শত বছর পূর্ণ হয়। চোখে ছানি পড়ায় ঠিকমতো দেখতে পারে না। দেয়াল হাতড়ে হাতড়ে চলে। উরসুলা বুয়েন্দিয়া মৃত্যুপথে এসে বুঝতে পারে বুয়েন্দিয়া পরিবারে শুধুমাত্র নিঃসঙ্গতা কিংবা অনিদ্রা রোগেরই অভিশাপ নয় বরং দূষিত রক্তের অভিশাপও আছে। এছাড়াও যে ব্যাপারটা সে উপলব্ধি করে তা হল- আউরেলিয়ানোরা উদাসীন ধরনের হলেও মনটা তাদের নির্মল, অন্যদিকে হোসে আর্কাদিওরা আবেগপ্রবণ, উদাসী আর সাহসী, যদিও তারা সবাই দুঃখজনক ঘটনার পূর্বলক্ষণ চিহ্নিত। এভাবেই এগিয়ে চলে শতবর্ষী বুয়েন্দিয়া পরিবারের গল্প।
জগতে এমন জ্যোতির্ময় মানুষ আছেন, যারা এমন মনীষা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন যে তাদের ছোঁয়ায় অমরত্বের ঠিকানা মেলে। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, গাবো নামেই যিনি অধিক পরিচিত, তাদেরই একজন। ঐন্দ্রজালিক বা পৌরাণিক, প্রেম বা অপ্রেম, দেখা বা অদেখা যাই হোক না কেন তার লেখাতে এমন এক মোহিনী শক্তি আছে যা পাঠককে ভাবাতুর বানাতে বাধ্য করে।
সাংবাদিকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু হলেও ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত সিয়েন আনিওস দে সোলেদাদ (নিঃসঙ্গতার একশ বছর) তাকে জগৎজোড়া খ্যাতি এনে দেয় যার ফলশ্রুতি সাহিত্যে নোবেল প্রাপ্তি। এছাড়াও এল কোরোনেল নো তিয়েনে কিয়েন লে এস্ক্রিবা (কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না), মেমোরিয়া দে মিস পুতাস ত্রিস্তেস (আমার দুঃখ ভারাক্রান্ত বেশ্যাদের স্মৃতিকথা), এল আমোরে এন লোস তিয়েমপোস দে কোলেরা (কলেরার দিনগুলোতে প্রেম), ক্রোনিকা দে উনা মুয়ের্তে আনুনসিয়াদা (একটি পূর্বঘোষিত মৃত্যুর কালপঞ্জি), বিবির পারা কোনতারলা (বেঁচে আছি গল্পটা বলবো বলে) অন্যতম বিশ্বখ্যাত সাহিত্যকর্ম।
বাংলা অনুবাদ প্রসঙ্গে কিছু বলতে হয়। আমি পড়েছি জি এইচ হাবীব বা গোলাম হোসেন হাবীবের অনুবাদ। তার অনূদিত এই বইটির শব্দচয়ন, বাক্য গঠন খুবই দক্ষতার সাথে করা হয়েছে তা প্রতিটা লাইনেই বোঝা যায়। মার্কেসের লেখা অনুবাদ করা চাট্টিখানি কথা নয় কিন্তু সেই দুঃসাহসিক কাজটি খুব সহজ আর সাবলীলভাবে করেছেন অনুবাদক। এমনকি প্রত্যেকটা শব্দের সৌন্দর্য যাতে না হারায় সেদিকে বিশেষ লক্ষ্য রেখেছেন।
বুয়েন্দিয়া পরিবারের সাত প্রজন্মকে নিয়ে রচিত মহাকাব্য ধর্মী উপন্যাসটি মহাদেশটির উপনিবেশ-উত্তর স্বাধীনতা পর্বের ইতিহাসের একটি রূপক। লাতিন আমেরিকা মহাদেশের মধ্যে মাকোন্দো এক অনুবিশ্ব আর বুয়েন্দিয়া পরিবারের সাত প্রজন্মের কাহিনী একই সঙ্গে বাস্তবতার ধরন-ধারণ, বিশ্বজনীন মানবজাতির নিয়তি ও সমস্যা সংকুল লাতিন আমেরিকার কথা বলে। এই বইটি শুধুমাত্র বই না এটি একটি আলাদা জগতও বটে। সে জগতে চরম বাস্তবতার সাথে মিশে আছে অলৌকিকতা।
যেখানে দিনেদুপুরে চাদর জড়িয়ে বাতাসে উড়ে যায় সৃষ্টিছাড়া সৌন্দর্যের অধিকারী নারী, যে জগতে পাপের ফলস্বরূপ জন্ম নেয় শূয়রের লেজসহ শিশু, যে জগতে একটানা চার বছর এগারো মাস দুই দিন ধরে অনবরত ধারায় বৃষ্টি পড়ে তছনছ করে দেয় সবকিছু, যেখানে শারীরিক চাহিদায় নিজের ফুফু কিংবা মা’কেও শয্যাসঙ্গিনী করা যায়, যে জগতে অনিদ্রা রোগ নিত্যদিনের সঙ্গী। বইটির প্রত্যেকটি পাতায় আছে মন্ত্রমুগ্ধতার ছোঁয়া। চরম বাস্তবতার সাথে অলীক বাস্তবতার মিশ্রণে এক ভিন্নতার সৃষ্টি করেছে তিনি।
বই : সিয়েন আনোস দে সোলেদাদ (স্প্যানিশ), One Hundred Years of Solitude (ইংরেজি), নিঃসঙ্গতার একশো বছর (বাংলা)
লেখক : গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস Gabriel Garcia Marquez || অনুবাদ : গ্রেগরি রাবাসা Gregory Rabasa (ইংরেজি) জি এইচ হাবীব G H Habib (বাংলা)
প্রকাশনী : বাতিঘর প্রকাশনা সংস্থা || অনলাইন প্রাপ্তিস্থান: রকমারি.কম