কুঁচকে থাকা সস্তা শার্ট, সুতো ওঠা প্যান্ট, ধুলাতে মুড়িয়ে থাকা মলিন জুতোর ভেতরে পরিচয় গলিয়ে নেওয়া শরীরটা শওকত সাহেবের। নিরামিষ জীবনে ফিকে হওয়া অস্তিত্ব আরো ফিকে হয়ে যায় তার নির্লিপ্ত স্বভাবের দোষে। কিন্তু শওকত সাহেবই একদিন আমূল বদলে ফেলেন নিজের অস্তিত্ব। খোলসবন্দী ছিলেন যেন এতদিন! শওকত সাহেব আদৌ এই পৃথিবীর তো! অন্য পৃথিবী যে কেউ একজনের আগমনে খুলবে স্বর্গদ্বার!
আগ্রহ টানতে একটু রসিয়ে লেখা, তবে বাড়িয়ে নয় কিঞ্চিৎ পরিমাণও। গল্প আবর্তিত হতে শুরু করে এই নীরস শওকত সাহেব এবং তার রোজকার একঘেয়ে জীবনের বর্ণনা দিয়ে। তার স্ত্রী রানুর কথা দিয়ে। অফিসের পিয়নও তাকে ধমকিয়ে কথা বলার ধৃষ্টতা রাখে। বহু বছর ধরে তার প্রমোশন হয় না। সংসার চলে না। একদিন বস জামান সাহেবের রুমে ডাক পড়ে তার। হাতে টাকা ধরিয়ে দেন। ডাবল প্রমোশনের প্রতিশ্রুতি দেন। শুধু ছোট্ট কাজের বিনিময়ে। দুম্বার মাংস এক জায়গা থেকে নিয়ে আরেক জায়গায় ডেলিভার করতে হবে। ঠিক এই জায়গায় একটা ছোট্ট সাবভার্সন লেখক এনেছেন, অতিপরিচিত হিরোইক আর্কিটাইপের মধ্যে। সেটা হচ্ছে, প্রধান চরিত্রকে নীতির পুরোহিত না বানিয়ে এক দ্বান্দ্বিক জায়গায় নিয়ে গিয়েছেন। পরবর্তীতে চরিত্রের যে রূপ উন্মোচিত হয়, সেক্ষেত্রেও একটা ছোট্ট ভূমিকা পালন করে এই সাবভার্সন।
শওকত সাহেব ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে টাকা নেন। তবে বসের ১০ হাজার টাকা যখন সরিয়ে রাখেন, তখন ভীতির পাশাপাশি লোভ নয়, বরং তার ভালো থাকার আকাঙ্ক্ষাই কাজ করে বেশি। সাধারণ মানুষের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য যেটা। যা তাকে ত্রুটিযুক্ত করে আরো বাস্তবিক করে তুলে। এতে বসের প্রিয় মানুষ তো শওকত সাহেব হয়ে ওঠে, কিন্তু দিন দুয়েক বাদের একটা ফোনকল দৃশ্যপট আমূল বদলে দেয়। এলভিস নামের একজন কল করে অফিসে, এবং চায় ত্রিদিবকে! এই ত্রিদিব কে? সেই ভীতসন্ত্রস্ত, সংকোচে কপাল ঘামিয়ে যাওয়া, সাধারণভাবে গুটিয়ে রাখা আস্তিনের শওকত হঠাৎই যেন এক অন্য কোনো মানুষে রূপান্তরিত হন। এ যেন খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসা শামুক! পাঠক খুব তাড়াতাড়িই প্রবেশ করেন সেই শামুকের অন্য গল্পে। যেখানে আছে ম্যাটেরিয়ালিস্টিক জীবন ঠেলে এই বিশ্বের অপার রহস্যে মগ্ন হয়ে থাকা এহসান।
সেই এহসানের হাত ধরেই আসা এক ছোট্ট অদ্ভুত ছেলে। অন্য দশজনের মতো যে না, ছোট থেকেই সেই কথা তাকে বোঝায় এহসান। যে ছেলের চাহনিতে এক অপার্থিব মায়া আর ভয় খেলে যায়। সেই ছেলে বড় হবার পরে জানতে পারে এক অবিশ্বাস্য সত্য, যা তার অস্তিত্বকে দাঁড় করায় হুমকির মুখে। তার পরিচিতি ভোগে শংকায়। কিন্তু তার ভেতরেই যে বাস সেই অরিত্রিকার! এই অরিত্রিকা কে? কোনো যেন-তেন মানবের ভেতরে বাস করে না অরিত্রিকা। একদিন পাকস্থলী উগড়ে কুচকুচে লম্বা কালো চুল বেরিয়ে এলো। এসব যে ‘সে’ আসার ইঙ্গিত। ৩,৫০০ বছর ধরে অপেক্ষায় আছে যে। ঐ সূত্র ধরে আসে গোপন সংঘের আধার, পৃথিবীর অজানা সত্য, অধিবাস্তববাদী চিন্তা, অপার্থিবতা আর তার চেয়েও সন্নিকটে বাজছে সভ্যতা ধ্বংসের ভয়ংকর বীণা!
লেখক নসিব পঞ্চম জিহাদী এই বইকে বিশেষায়িত করেছেন পুরোপুরি নিরীক্ষামূলক লেখা হিসেবে। ওভাবেই পাঠমূল্যায়ন হওয়া দরকার এই উপন্যাসের। কোনো নির্দিষ্ট জনরায় এই উপন্যাসকে বাঁধা যায় না। কখনো মিস্ট্রি, কখনো সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার, কখনো লাভক্রাফটিয়ান হরর হয়ে প্রধানত এগিয়েছে দার্শনিক, কল্পবাদী দিকে। গল্পের প্রধান চরিত্রের একটা ফিলোসফিক্যাল জার্নি হিসেবেই একে দেখতে/পড়তে হয়। সংশয়বাদ, আত্মজিজ্ঞাসা, নৈরাশ্যের ভেতর দিয়ে যার এগিয়ে চলা। এই পৃথিবীর অপার সত্য কী, এই পৃথিবীর পরে কী(?); সীমানা থেকেও বাইরে ছুটে দেখবার (লেখকের) আকুতিই এই উপন্যাসে ছিন্ন খঞ্জনীর মতো বেজে বেজে উঠেছে।
বইয়ের একদম শুরুতেই লেখক ফ্রেডরিক নিৎ্শের ‘দ্য গে সায়েন্স’-এর সেই বিখ্যাত অংশ ব্যবহার করেছেন, যেখানে লেখা আছে,
গড ইজ ডেড। গড রিমেইনস ডেড। এন্ড উই হ্যাভ কিলড হিম। হাও শ্যাল উই কমফোর্ট আওয়ারসেলভস, দ্য মার্ডারারস অফ অল মার্ডারারস?
গোটা অমোঘ অংশটিই ব্যবহার করা হয়েছে, যেখানে নিৎ্শের নৈরাশ্যবাদীতার চরম রূপ দেখা যায়। এবং এটা শুধুই ব্যবহারের উদ্দেশ্যে ব্যবহার নয়। চরিত্রদের মিথস্ক্রিয়ায়, কথোপকথনে, তাদের মোটিফে এর প্রতিফলন পাওয়ার পাশাপাশি উপন্যাসে লেখকের নিজের যে দার্শনিক কোণ- তাতেও এর প্রতিফলন আছে। ওই নৈরাশ্যের গ্যামাট ধরেই তো উপন্যাসের এগিয়ে চলা। নৈরাশ্য বা পেসিমিজমকে কেন্দ্রে রেখে। নায়েলিস্টিক আবেদনে।
মানুষের প্রকৃতিতেই আছে হিংস্রতা। শুধুমাত্র সভ্যতার দোহাই দিয়ে মানুষ তার ভেতরকার অন্ধকার, হিংস্রতা বস্তাবন্দী করে কুয়ার অতলে ফেলে দেয়। এটাই সত্য। এবং তার পরিপ্রেক্ষিতেই লেখক এই বড় প্রশ্নটি উত্থাপন করেছেন, যদি মানুষই হয় সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ, তবে তারা কীভাবে পারে বাকিসব সৃষ্টিকে, ধরণীকে ধ্বংসের মুখে ছুড়ে দিতে? এমন গূঢ় দার্শনিক, কিন্তু খুবই বাস্তবিক জটিলতার দ্বন্দ্বে পাঠককে ফেলে দেয় এই উপন্যাস। মানবজাতির ইতিহাসের দিকে আলো ফেলে এই গল্প, যে ইতিহাস জুড়ে আছে শুধু গণহত্যা, খুন, যুদ্ধ, আর বিদ্রোহ। সেই সুমেরিয়ান সভ্যতা থেকে শুরু করে আছে মেটাফিজিক্যাল কনটেক্সট। রূপকের মাধ্যমে নতুন সময়ের ক্ষয়ে যাবার দ্বারপ্রান্তে আবারও আনা হয়েছে বিব্লিক্যাল রূপক। নূহ (আ)-এর সেই নৌকা। অমন এক নতুন রূপ এই উপন্যাসের অন্তিম পর্বে আনা হয়েছে। সাথে আরো আনা হয়েছে সমসাময়িক অস্থিরতা, নোংরা নীতি, বৈষম্য, মানবপাচারের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত।
লাভক্রাফটের অদ্ভুত সব প্রাণী, ঈশ্বর আর দানবদের নিয়ে গড়ে ওঠা সেই লাভক্রাফটিয়ান হররের ভাবটা তো আছেই। লাভক্রাফট যে অতিপ্রাকৃত আর অজানাকে আরো রহস্যময় করে তুলেছেন। লাভক্রাফটিয়ান হররের সেই ভাবটা বর্ণনায় ভিসিরাল নয়, বরঞ্চ ওই ভয়/হররকে কাজে লাগানো হয়েছে আবহের দিক থেকে। এই উপন্যাস রহস্য রেখেছে, ভয় রেখেছে। তবে সেসব শুধুমাত্র অনুষঙ্গ। ওসব ব্যবহার করা হয়েছে প্রধান চরিত্রের আধ্যাত্মিক এবং দার্শনিক জাগরণে। জার্নিতে।
লেখক অধ্যায়গুলো ভাগ করেছেন যেভাবে, সেটাও বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। যেমন: প্রথম অধ্যায়ের নামই দিয়েছেন ‘উপসংহারের আগে’। এবং আসলেই সেই গ্যামাট ধরে গোটা উপন্যাসের এগিয়ে চলা, যা পাঠক ধীরে ধীরে উপলব্ধি করে। ধ্বংসের আগে ধ্বংসের অপেক্ষায় থাকা চরিত্রের সাথেই যে পরিচয় করানো হয়। আরো কিছু অধ্যায়ের নাম নেওয়া হয়েছে ‘মেঘদল’ ব্যান্ডের কিছু গানের লাইন থেকে। এবং নামগুলো ওই অধ্যায়গুলোরই একটা ভাবপূর্ণ সারাংশ বলা যায়। লেখক নসিব পঞ্চম জিহাদীর গদ্যভাষা সুস্পষ্ট এবং গতিময়। সংক্ষিপ্ত বাক্য দিয়েই তিনি গদ্য সাজিয়েছেন। টেক্সটে অপ্রয়োজনীয় ভাষা একেবারেই অনুপস্থিত তা বলবো না, তবে খুব কমই আছে তেমন। বাহুল্যহীনই হয়েছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। তাতে তার উপন্যাসের সার্বিক ন্যারেটিভ অর্থবহ হয়ে উঠেছে। সর্বদর্শী ন্যারেশান আর ‘উত্তম জবান’ দুটোকেই দক্ষ সমতায় ব্যবহার করেছেন।
মাঝে মাঝে তার নিজের লেখা রূপক অর্থের কবিতাও রেখেছেন গল্পের ধারাক্রমের সাথে প্রাসঙ্গিক রেখে। এবং কবিতা লেখার স্বভাবের কারণেই তার গদ্যভাষায় একটা ছান্দিক ভাব ছিল। কুশলী বর্ণনায় গল্পের ছোটখাট বাঁকগুলোও প্রভাবযুক্ত লেয়ার হিসেবে উপস্থিত হয়েছে উপন্যাসে। ‘অরিত্রিকা’র রহস্য, তার ব্যাখ্যাও পাঠকের কৌতূহলকে তৃপ্ত করার মতো হয়েছে। এত এত জটিল বিষয়কে পরিপক্ব বোধ দিয়েই সামলাতে পেরেছেন লেখক।
উপন্যাসের শেষটা প্রত্যাশিতভাবেই একটা প্রকাণ্ড শো-ডাউনের প্রান্তে উপস্থিত হবার কথা ছিল। সেই ধ্বংসযজ্ঞ যে শুরু থেকেই চলছিল। অপার্থিবতার দ্বার খুলে, বিব্লিক্যাল রূপককে পুরোদমে ব্যবহার করে লাভক্রাফটিয়ান ভঙ্গীতে একটা সমাপ্তি তিনি উপহার দিয়েছেন। খুব গোলমেলে হয়ে পড়বার সবটুকু সম্ভাবনা এই জায়গায় ছিল। কিছুটা তাড়াহুড়া হয়েছে অবশ্যই। তবে লেখকের বুদ্ধিদীপ্ততার কারণে আর বর্ণনায় পরিমিতিবোধে এই নিরীক্ষাধর্মী এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী উপন্যাস ডোবেনি। পুরো উপন্যাসই এগিয়েছে একটা চরিত্রনির্ভর জার্নি হিসেবে, যা বেশ চ্যালেঞ্জিং। সেই চ্যালেঞ্জিং ব্যাপারখানি সফলতার সাথেই একটা অন্তহীন গন্তব্যের পথে নিয়ে যেতে পেরেছেন নসিব পঞ্চম জিহাদী।
“সে আছে, যে থাকবে।
যেও না, ওইখানে যেও না- অরিত্রিকা।”
… … …
বই: অরিত্রিকা, ওইখানে যেওনাকো তুমি
লেখক: নসিব পঞ্চম জিহাদী
জনরা: মিস্ট্রি-সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার /লাভক্রাফটিয়ান হরর
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১৫৩
প্রকাশনী: বুকস্ট্রীট