ততদিনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, প্রথম সিনেমাটা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে করতে চাই। এর একটা কারণও আছে- আমি যখন ছোট, তখন পাকিস্তানের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে ছিলাম। একটা ঘরের মধ্যে একটা পরিবার, সীমিত খাবার। তাই যুদ্ধের বাস্তবতা সেই ছোটবেলায়ই অনুভব করতে পেরেছিলাম আমি। অতঃপর ভাবলাম, মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে ‘জয়যাত্রা’ বানাব। মনে হচ্ছিল ‘জয়যাত্রা’ই কি তাহলে আমার মুক্তিযুদ্ধ?
নিজের প্রথম চলচ্চিত্র ‘জয়যাত্রা’ নির্মাণের পেছনে অনুপ্রেরণার গল্পটি এভাবেই এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন নির্মাতা তৌকীর আহমেদ। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এ পর্যন্ত যে কয়েকটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে সেগুলোর মধ্যে ‘জয়যাত্রা’ অন্যতম। যুদ্ধের ভয়াবহতা এবং সাধারণ নিরীহ মানুষের অসহায় অবস্থা, বেদনা ও ত্যাগের গল্প অসাধারণভাবে চিত্রিত হয়েছে এ চলচ্চিত্রে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর যথার্থ প্রতিফলন ঘটিয়ে এর কাহিনি এবং সংলাপের জীবনঘনিষ্ঠতা এক অন্য রকম মুগ্ধতার জন্ম দেয়।
‘জয়যাত্রা’ মুক্তি পেয়েছিল ২০০৪ সালের ১৫ নভেম্বর। আমজাদ হোসেনের কাহিনী অবলম্বনে এ চলচ্চিত্রের সংলাপ এবং চিত্রনাট্য লিখেছেন তৌকীর আহমেদ।
চলচ্চিত্রের শুরুতেই এ দেশের হাজারটির মাঝে একটি ছোট্ট সবুজ গ্রামের ছবি এঁকেছেন চলচ্চিত্রকার। শান্তি ও সম্প্রীতির এক কোমল পরিবেশ বিরাজ করছিল সেখানে, স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে সাংসারিক মানুষ সুখে দিনযাপন করছিল, তরুণ তরুণীরা একে অপরকে ভালবেসে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখছিল। দেশের রাজনীতি কিংবা হাল হকিকত নিয়ে তাদের খুব বেশি আগ্রহ না থাকায় মুক্তিযুদ্ধের সাথেও তাদের কোন সরাসরি যোগাযোগ ছিল না। সেই শান্তিপূর্ণ গ্রামটিতেই এক রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা এসে হাজির হল। তারা সারা গ্রাম জ্বালিয়ে দিল। অনেকে প্রাণ হারালো। এর মাঝে যারা বেঁচে গেল, তারা আশ্রয় নিল এক নৌকায়। আপন দেশ ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ভারত সীমান্ত লক্ষ করে চলতে শুরু করল নৌকা। এই মানুষগুলোর অসহায়তা, বেঁচে থাকার সংগ্রাম, মনোজাগতিক দ্বন্দ্ব এবং বিপদ সংকুল পথ অতিক্রমের যাত্রার গল্প নিয়েই নির্মিত হয়েছে ‘জয়যাত্রা’।
‘জয়যাত্রা’ এক অর্থে বিশাল পরিব্যাপ্তির একটি চলচ্চিত্র। অজস্র চরিত্রের সম্মিলন ঘটিয়ে চলচ্চিত্রকার এখানে মহান মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে সব শ্রেণির মানুষের ত্যাগ তিতিক্ষাকে যথার্থ প্রতিফলনের চেষ্টা করেছেন। যুদ্ধের ভয়াবহতার থেকে যুদ্ধকালীন সময়ে মানুষের দ্বিধাদ্বন্দ্ব, বিশ্বাসের ক্রমপরিবর্তন এবং মনস্তাত্ত্বিক লড়াই এ চলচ্চিত্রে প্রাধান্য পেয়েছে। প্রতিটি দৃশ্যেই তাই অনুভূত হয় এক একটি মানুষের নিজস্ব গল্প, হারানোর গল্প, বেদনার গল্প। তার এই নির্মাণ প্রচেষ্টার কাহিনিকেন্দ্র সম্পর্কে তৌকীর বলেছেন,
আমি ছবির শুরুতেই দেখিয়েছিলাম একটি সুখী পরিবারকে, যেখানে একটি চিল এসে মুরগির বাচ্চা নিয়ে যায়। তেমনই, হঠাৎ করেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণের কারণে একটি সুখী পরিবারের সবকিছুই তছনছ হয়ে যায়। একটি নৌকায় করে মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ছুটতে থাকে। তারপর মানুষ প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। যাত্রাকে জয় করে তারা। তবে এর মধ্য দিয়েই ঘটে যায় অনেক ঘটনা। ঝরে যায় অনেক প্রাণ। আবার নতুন প্রাণের আগমন ঘটে।
যুদ্ধের দিনগুলোতে এই প্রবাহমানতার গল্পই ধারণ করেছে ‘জয়যাত্রা।’ ‘চিলের মুরগির বাচ্চা নিয়ে যাওয়া’র সাথে ‘পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গ্রাম তছনছ করে দেওয়া’র মত রূপক তুলনাগুলোও এ চলচ্চিত্রে বিশেষভাবে লক্ষণীয়। বিপাশা হায়াত, আজিজুল হাকিম, মাহফুজ আহমেদ, হুমায়ুন ফরীদি, তারিক আনাম খান, আবুল হায়াত, মেহবুবা মাহনূর চাঁদনী, শাহেদ শরীফ খান, ইন্তেখাব দিনার, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, মোশাররফ করিম সহ বাংলাদেদের অভিনয় জগতে সুপরিচিত মুখগুলো এ চলচ্চিত্রের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
বিচিত্র চরিত্র এখানে উপস্থাপিত হয়েছে বিচিত্র রঙে। যুদ্ধ কিভাবে ধর্ম বর্ণ- সব বিভেদ ভুলিয়ে দেয়, অসহায়তা কিভাবে মানুষকে সমাবিষ্ট করে, তার চমৎকার নিদর্শন রয়েছে এ চলচ্চিত্রে। দেখা যায়, যে হিন্দু ব্যক্তিটি জাত যাওয়া, না যাওয়ার প্রশ্নে প্রচণ্ড রকমের সচেতন, তার ক্রন্দনরত অভুক্ত নাতিটিকে যখন সন্তানহারা অপর ধর্মের মা বুকের দুধ পান করায় তখন তার বিশ্বাসে ধাক্কা লাগে। হাতে থাকা পিতলের দেবীকে সে নির্দ্বিধায় পানিতে ছুঁড়ে ফেলে বলে, “তুমি যা দিলা, ঐ পিতলের মূর্তি তোমার কাছে হাইরা গেল। তুমিই তো দেবী, মা।”
আবার শহর থেকে ব্যাংকের টাকা লুট করে নিয়ে আসা ব্যক্তিটির মধ্যে প্রকটিত হয়েছে আত্মনিমগ্নতা ও স্বার্থপরতা। আপন স্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে তার কাছে অন্য সবার জীবন তুচ্ছ বোধ হয়। চলচ্চিত্রটির অজস্র চরিত্রের প্রতিটি একেক মানসিকতার মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেছে। কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে তাদের অসহায় অবস্থার সংকট থেকে সৃষ্ট সংলাপগুলোতে অনুভূত হয় জীবনের গভীরতর বোধ।
জীবনের নিরন্তরতার দিকটিও চমৎকারভাবে এসেছে এ চলচ্চিত্রে। যুদ্ধ কেড়ে নিয়েছে অজস্র প্রাণ, প্রিয়জন হারানোর বেদনা বুকে পাথর হয়ে চেপে বসেছে বটে, কিন্তু জীবনকে থামিয়ে দেয় নি। আবার সেই যুদ্ধের মাঝেই জন্ম নিয়েছে নতুন শিশু। যে সাধারন মানুষগুলো যুদ্ধ সম্পর্কে অতিমাত্রায় নিস্পৃহ ছিল, তারাও এক সময় জেগে উঠতে থাকে। প্রিয়জন হারানোর বেদনা এবং যুদ্ধের ভয়বহতা ও নির্মমতা তাদের মাঝের প্রতিবাদী সত্ত্বাটিকে ধীরে ধীরে জাগিয়ে তোলে। শুধু বেঁচে থাকা নয়, বরং রুখে দাঁড়ানোর শক্তিও যাত্রাশেষে তাদের মাঝে জন্ম নেয়।
অপূর্ব এক সম্মোহনী শক্তি রয়েছে এ চলচ্চিত্রে। দেখার এক পর্যায়ে চরিত্রগুলোর সাথে তাই দর্শকদের গাঢ় একাত্মতা অনুভূত হয়। লক্ষ মানুষের ত্যাগ তিতিক্ষা এবং হারানোর বেদনার যে রক্ত রঙিন পথে স্বাধীনতা এসেছে তার অনুভব অন্তরকে প্রবলভাবে আলোড়িত করে।
নির্মাতা তৌকীর আহমেদ তার প্রথম চলচ্চিত্রের জন্য যে সযত্ন শ্রম ঢেলে দিয়েছেন, তার পরিচয় পাওয়া যায় এর প্রতিটি ফ্রেমে। যুদ্ধের আবহকে তার যথার্থরূপে ফুটিয়ে তুলতে তিনি এ চলচ্চিত্রে একাত্তরের জিপসহ নৌ এবং বিমান বাহিনীর সহায়তায় যুদ্ধজাহাজ ও বিমান এনে হাজির করেছেন। তাছাড়া এর কাহিনির বুননটিও এতটা মন্ত্রমুগ্ধকর যে প্রায় দু’ঘণ্টা দৈর্ঘ্যের এই নির্মাণটি দেখার এক মুহূর্তেও বিচ্ছিন্নতা অনুভূত হয় না, বরং দর্শককে এক অপূর্ব ক্ষমতায় আবিষ্ট করে রাখে। ‘জয়যাত্রা’ তাই আর চলচ্চিত্রের চরিত্রগুলোর যাত্রার গল্পে সীমাবদ্ধ না থেকে দর্শকদেরও মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে পরিভ্রমণের গল্প হয়ে ওঠে। গভীর অনুভবে অনুভূতিশীল দর্শকদের প্রায়শই চোখ ভিজে ওঠে।
শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘২৯তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে‘র আসরে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের সম্মান অর্জন করে ‘জয়যাত্রা’। এর নির্মাতা তৌকীর আহমেদ অর্জন করেন শ্রেষ্ঠ পরিচালক ও শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকারের পুরস্কার। এছাড়াও শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার, শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক, শ্রেষ্ঠ পার্শ্বচরিত্রে অভিনেত্রী ও শ্রেষ্ঠ চিত্রগ্রাহক বিভাগে চলচ্চিত্রটি পুরস্কার লাভ করে।
মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক নির্মাণগুলোর মধ্যে ‘জয়াযাত্রা’ বিশেষভাবে স্মরণীয় হলেও খুব বেশি বাণিজ্যিক সাফল্যের মুখ দেখেনি চলচ্চিত্রটি। তৌকীরের ভাষায়,
খুব আশা ছিল, ছবিটি যেহেতু মুক্তিযুদ্ধের ওপর, দেশের মানুষ খুব উৎসাহ নিয়ে দেখবে। সেটা অবশ্য ঘটেনি। ট্রেলার দেখে অনেকে বলেছে, ভালো হয়েছে, কেউ টেলিভিশনে অর্ধেক দেখেছে। কেউ সিডি কিনে দেখেছে। প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে বড় পর্দায় দেখেছে কম।
এদেশের লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষের ত্যাগ তিতিক্ষা এবং হারানোর গভীর বেদনা থেকে যে স্বাধীন বাংলাদেশ জন্ম নিয়েছে, তার জন্ম ইতিহাসের রক্ত রঙিন মুহূর্তটিকে চিত্রিত করতে একটি অনবদ্য নির্মাণ তৌকীর আহমেদের ‘জয়যাত্রা’। তাই সময়ের সাথে ‘জয়যাত্রা’র আবেদন বরং আরও বেড়েছে। শুধু জন্মলগ্নের নির্মম করুণ মুহূর্তের প্রতিচ্ছবি হিসেবে নয়, স্বাধীন বাংলাদেশে আমাদের এগিয়ে চলার প্রেরণাও যোগাচ্ছে চলচ্চিত্রটি।
চলচ্চিত্রটি অনলাইনে কিনতে চাইলে ক্লিক করতে পারেন নিচের লিংকে-