ধরা যাক আপনাকে জিজ্ঞেস করা হলো বাংলাদেশের সিনেমা সম্পর্কে। হলিউড বা আইএমডিবির রেটিংধারী প্রথমসারির সবক’টা সিনেমা দেখে ফেলা কিংবা হালের নেটফ্লিক্সের সিরিজ, কোরিয়ান ড্রামা, তুর্কি সিনেমায় বুঁদ হয়ে থাকা আপনার নাক সিটকানো উত্তরটা অনুমান করতে খুব বেশি বেগ পেতে হবে বলে মনে হয় না। অবশ্য হবে না-ই বা কেন? বছর বছর ফর্মুলা সিনেমার ঘেরাটোপে বন্দি ঢাকাই সিনেমার নিম্নগামী মান আমাদের বৃহত্তর দর্শক সমাজের মনে বিতৃষ্ণারই জন্ম দিয়ে গেছে। বড় মুখ করে অবশ্যই বলার কোনো অবকাশ নেই যে সিনেমাশিল্পটা এদেশে খুব একটা সমৃদ্ধ।
কিন্তু তবু কিছু সিনেমা থাকে যেগুলো লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে যায় মূলত বাণিজ্যিকীকরণের অভাব, রুচিহীন দর্শক, মানসম্পন্ন পরিবেশকের অপ্রতুলতা এবং সমন্বয়হীনতার কারণে। এদেশের ভালো সিনেমা বা সত্যিকার অর্থের সিনেমার খোঁজ যদি করতে চান তাহলে আপনাকে একজন সচেতন দর্শক হতে হবে।
চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিবেশক সমিতির তথ্যমতে, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমার সংখ্যা ৪৫টি। অনেকেই হয়তো তাদের বেশ কিছু সংখ্যক তথাকথিত বাণিজ্যিক ধারার সিনেমার নাম বলতে পারবেন। কিন্তু দেশে মাত্র একটি হলে মুক্তি পাওয়া বিশ্বের বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত, প্রশংসিত এবং পুরষ্কৃত যে সিনেমাটি হয়তো অনেকের চোখ এড়িয়ে গেছে সেটি হলো ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’। ‘খেলনা ছবি’র ব্যানারে নির্মিত মাইক্রো বাজেটের এই সিনেমাটি পরিচালনা করেছেন তরুণ নির্মাতা আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ। অভিনয়ে ছিলেন মোস্তফা মনোয়ার (সাজ্জাদ), তাসনোভা তামান্না (রেহানা), তানভির আহমেদ চৌধুরী (মাইকেল) প্রমুখ।
দেশের গুণী নির্মাতা মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেনন, “আমি কেন এই ছবির খোঁজ জানলামই না? আমরা এক আওয়াজের দুনিয়ায় আছি। সেখানে দেখি নীরবে-নিভৃতে অনেকে শিকার করে আনতেছে বড় মাছ।” হ্যাঁ, এই ‘বড় মাছ’ই হলো আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’।
‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’র যাত্রা শুরু আরো চার বছর আগে। ২০১৬ সালে মুক্তি পায় ট্রেইলার। ২৭ তম সিংগাপুর আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয় সিনেমাটি। ৫২টি দেশের শতাধিক সিনেমার সাথে প্রতিযোগিতা করে শ্রেষ্ঠ নির্মাতা ও শ্রেষ্ঠ অভিনয়শিল্পীর (মোস্তফা মনোয়ার) পুরষ্কার জিতে নেয়। এছাড়া রটারডম, লোকার্নো, সিনেইউরোপাসহ বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয় ছবিটি।
এটি কিছু মানুষের অনিশ্চিত, অগোছালো জীবনের গল্প। ৯১ মিনিট ধরে পর্দায় ধূসর সাদা-কালো ফ্রেমের ছেঁড়া ছেঁড়া বিষণ্ণ, বিমূর্ত দৃশ্যগুলো যেন এই চলচ্চিত্রের মানুষগুলোর জীবনকে প্রতিকায়িত করে চলে। বাংলাদেশের মহান আলোকচিত্রশিল্পী ও সিনেমাটোগ্রাফার আনোয়ার হোসেন বলেছিলেন,
যে চলচ্চিত্রে চোখে পড়বার মতো আলাদা কোনো দৃশ্য মনে গেঁথে থাকবে না অথচ পুরো ছবিটিই মনে পড়বে, চলচ্চিত্রটি হন্ট করতে থাকবে, তখন বুঝবে সেই চলচ্চিত্রটি হয়েছে। নির্মাতা ও সিনেমাটোগ্রাফার দৃশ্য দিয়ে সত্য নির্মাণে সফল হয়েছে…।
লাইভ ফ্রম ঢাকায় এই অপ্রিয় সত্যটিই বার বার প্রতিফলিত হয়। চিরকুটের ‘এই শহর জাদুর শহর, প্রাণের শহর’ গানটা যেখানে রাজধানী শহরের রঙিন চিত্রকল্প আমাদের মনে গেথেঁ দেয়, সেখানে লাইভ ফ্রম ঢাকাতে সেলুলয়েডের পর্দায় দেখি ভিন্নরকম এক দৃশ্যকল্প।
“এই বালের শহরে সবকিছুই উল্টাপাল্টা! ১২ মিলিয়ন মানুষ রাতদিন কুত্তার মতো একজন আরেকজনের সামনে পিছে ঘেউ ঘেউ করে। এত মানুষের ঘাম, রক্ত, আর গুয়ের গন্ধে আমার বমি আসে।” অকপটে এই জঞ্জালে ভরা মিথ্যে কথার এই শহর সম্বন্ধে স্বীকারোক্তি রেখে যায়।
কোনো মফস্বল বা গ্রাম থেকে নিজের ভাগ্য ফেরাতে ঢাকায় আসা সাজ্জাদ শেয়ার বাজারের বিপর্যয়ে আক্রান্ত শারীরিকভাবে একজন অসুস্থ যুবক। নিজের প্রেমিকা রেহানাকে নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভোগে। “কারোর সাথে হেসে হেসে কথা বলবি? হেসে হেসে কথা বলবি আর কারোর সাথে কখনো?” নিজের একমাত্র অবলম্বন পুরোনো মডেলের বেমানান গাড়িতে বসে সে শাসায় একসময়ের প্রিয় মানুষকে অন্য কারোর সাথে হেসে কথা বলতে দেখে। যন্ত্রণায় ভোগে নিজের মাদকাসক্ত ছোট ভাই মাইকেলকে নিয়ে।
পাওনাদার এসে দরজায় কড়া নাড়ে বারবার। “আমি কোনো নবী-রাসুল না। আমি একটা মানুষ। আমার সহ্যের একটা লিমিট আছে।” নিজের মধ্যে জটিলতা বাড়তেই থাকে অনেকটা এই শহরের মতো, যে শহর ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে বেঁচে থাকার মাপকাঠিতে। সাজ্জাদ নিজের মধ্যে আবিষ্কার করে স্বার্থপরতা আর নিরাপত্তাহীনতা। সে বুঝতে পারে তার মাদকাসক্ত ছোট ভাইয়ের ভালো করা মূলত তার ভ্রাতৃপ্রেম না, তার আত্মতুষ্টি।
ড্রামা জনরার সাদা-কালো দৃশ্যকল্পের এই ইন্ডিপেন্ডেন্ট সিনেমা জানিয়ে দেয়, এই শহরে হাসিমুখ নেই, প্রাণ নেই, সুন্দরের বড় অভাব। সাজ্জাদ তার প্রায় নষ্ট পা নিয়ে ক্র্যাচে ভর করে হেঁটে বেড়ায়। পালাতে চায়। কিন্তু কোথায় পালাবে? রাশিয়া? একরাতে দেখা পেজা তুলোর মতো বরফ পড়ার স্বপ্ন সাজ্জাদের জন্য স্বপ্নই থেকে যায়। খোঁড়া পায়ে অ্যাম্বাসিতে ঘোরা বৃথা হয়ে যায়। রাশিয়া হলো না। মালয়েশিয়া? রাশিয়া নাহলে মালয়েশিয়াই স্বর্গ। কিন্তু কোথায় পালাবেন জীবনের কাছ থেকে? বাঁচা কি অত সহজ? প্রেমিকার গর্ভে সাজ্জাদের সন্তান। মধ্যরাতের নিয়নের আলো যেমন আমাদেরকে ইল্যুশনে ভোগায়, তেমনই সাজ্জাদও ভুগতে থাকে হ্যালুসিনেশনে। একটা উন্নত জীবনের স্বপ্ন নিয়ে এই নষ্ট হয়ে যাওয়া শহরে একজন কীভাবে মাথা তুলে দাঁড়ায় বা আদৌ দাঁড়াতে পারে কি না, সময়ের সাথে সেটিই দেখা যায় গল্পের বাকি অংশে।
নির্মাতা আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের ব্যতিক্রম নির্মাণশৈলীর প্রশংসা করেছেন বিভিন্ন উৎসবের বড় বড় সমালোচকেরা। অভিনেতা মোস্তফা মনোয়ার যেন একাই কাঁধে বয়ে বেড়িয়েছেন সিনেমাটি।
মাত্র দশ হাজার ডলার বা আট লাখ টাকা, একটি ৫০ মিলিমিটার লেন্স, ঢাকা শহর এবং তার কিছু চরিত্র নিয়ে বানানো সাদা-কালো এই সিনেমাটি স্টার সিনেপ্লেক্সে মুক্তি পায় ২০১৯ সালের ২৯ মার্চ। শুধু সিনেপ্লেক্সে মুক্তি প্রসঙ্গে প্রথম আলোর একটি সাক্ষাৎকারে প্রযোজক শামসুর রহমান বলেন, “আসলে হলগুলোর কাছে আমরা গিয়েছিলাম। তারা আগ্রহ প্রকাশ করেনি। শুধু সিনেপ্লেক্স ছবিটি চালাতে রাজি হয়েছে।” এবং মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে সিনেমাটি নেমে যায়। অথচ ভালো গল্প, নির্মাণ, অভিনয়ের অভাবে ভুগছে দেশের সিনেমা। এর সবগুলো থাকা সত্ত্বেও বিশ্বের বিভিন্ন সিনেমা উৎসবে যে সিনেমাটি সুনাম কুড়িয়েছে, বার্তা দিয়েছে সুদিনের দেশীয় বিপণন ব্যবস্থায় তার এমন পরিণতি। মূলত গত শতাব্দীর চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকে সৃষ্ট ইতালির ‘নব্য বাস্তবাবাদী’ ধারার চলচ্চিত্রের অনুকরণে গড়ে উঠেছে আমাদের ‘ভালো চলচ্চিত্রের’ ফর্মুলা। এই বক্সের বাইরে কোনো সিনেমা নির্মাণ করলে সেটি দর্শক টানবে না। সেখানে ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’ এই তথাকথিত ভালো চলচ্চিত্রের ফর্মুলার বাইরের ভালো চলচ্চিত্র। তাই সাধারণ দর্শকদের চোখ এড়িয়ে গেছে।
‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’ শুধু একটি সিনেমা না, এর চেয়েও বেশি কিছু। তরুণ নির্মাতাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া শুধু শিল্পজ্ঞান দিয়ে কম বাজেট থাকলেও নিজেদের গল্পটা নিজেদের মতো করে বলা সম্ভব। একইসাথে বিদগ্ধ সমালোচকদেরও জানান দেওয়া যে, দেশের সিনেমায় মেধার অভাব নেই। অভাব কেবল পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের।