শবনম: সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখা উপন্যাস কিংবা কাহিনীকাব্য

শবনম মানে শিশিরকণা, লেখকের কল্পনায় শিউলি ফুল। সমস্ত রাতের স্বপ্নকে সঙ্গী করে যেমন করে শিউলি ফুল ফোটে, শবনমও তেমনি মজনূনের অনন্ত ভালোবাসার স্বপ্নকন্যা। সকালের সোনা রোদে শিউলি ঝরে যায়, শবনমও কি তেমনি ঝরে যাবে, এর উত্তর খুঁজতে মজনূন ব্যতিব্যস্ত থাকে। কিন্তু শবনম তো কথা দিয়েছে, “বাড়িতে থেকো, আমি ফিরব”। শবনমের মতো রাজস্বী, অনন্যা, স্বয়ংবরা নিশ্চয়ই তার কথা রাখবে, এ আশা আমরা করতেই পারি।

শবনম মানে শিশিরকণা হলেও লেখকের কল্পনায় সে ছিল শবনম শিউলি; Image Source: Risingbd

শবনমের রূপের বর্ণনা লেখকের ভাষায় শোনা যাক,

“এমন সময় গটগট করে বেরিয়ে এলেন এক তরুণী। প্রথম দেখেছিলুম কপালটি। যেন তৃতীয়ার ক্ষীণচন্দ্র। শুধু, চাঁদ হয় চাপা বর্ণের, এর কপালটি একদম পাগমান পাহাড়ের বরফের মতোই ধবধবে সাদা। নাকটি যেন ছোট বাঁশী। ওইটুকুন বাঁশীতে কি করে দুটো ফুটো হয় জানি নে। নাকের ডগা আবার অল্প অল্প কাঁপছে। গাল দুটি কাবুলেরই পাকা আপেলের মত লাল টুকটুকে, তবে তাতে এমন একটা শেড রয়েছে যার থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় এটা রুজ দিয়ে তৈরী নয়। চোখ দুটি লাল না সবুজ বুঝতে পারলুম না। পরনে উত্তম কাটের গাউন। জুতো উচু হিলের।”

প্রথম দেখাতে তুর্কি বংশোদ্ভূত আফগান অষ্টাদশী তরুণী শবনমকে ভাল লেগে যায় বাঙালি যুবক মজনূনের। সর্দার আওরঙ্গজেব কন্যা শবনম, যে রাজকন্যা সমতুল্য তাকে কি ভিনদেশি বাঙালি শিক্ষকের পাশে মানায়? কিন্তু ভালোবাসা তো জাত-কূল মানে না! শবনমকে মজনূনের দেয়া প্রথম উপহার ছিল সিলেটি লেবু। আর শবনমের পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছিল কাগজে লেখা কবিতা। বাংলার সুলতান গিয়াস উদ্দীন আজম শাহের আমন্ত্রণে পারস্যের কবি হাফিজের লেখা সেই কবিতা।

সৈয়দ মুজতবা আলী। অনেকের মতে, তিনিই বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রম্য লেখক। তবে সাহিত্যের একটি অধ্যায়েই তার প্রতিভা সীমাবদ্ধ নয়। ভ্রমণ কাহিনী, গল্প কিংবা উপন্যাসের পাতায়ও নিজের জাত চিনিয়েছেন তিনি। সব্যসাচী এই লেখক ছিলেন বহুভাষাবিদ এবং সেই সঙ্গে বহুভাষার সাহিত্য তার করায়ত্ত ছিল। সাহিত্যিক ও শিক্ষক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম তাই মুজতবা আলীকে জীবদ্দশাতেই কিংবদন্তির চরিত্রধারণ করেছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন। তবে পাঠকদের জন্য হতাশার বিষয়, মুজতবা আলীর লেখালেখির খাতা তেমন বড় ছিল না। এর ব্যাখ্যাটি আলী সাহেবের মুখ থেকেই শোনা যাক,

“হাঁড়িতে ভাত থাকলে সাঁওতাল কাজে যায় না, আর আমার ড্রয়ারে টাকা থাকলে আমি লিখি না।”

তিনি অল্পবিস্তর যা-ই লিখেছেন, তা-ই সাহিত্যাঙ্গনকে সমৃদ্ধ করেছে। বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ প্রেমের উপন্যাসের তালিকা করলে তার রচিত ‘শবনম’ শীর্ষে থাকবে। নায়িকার নামে উপন্যাসের নাম। উপন্যাসের নায়ক মজনূনের সাথে শবনমের প্রথম দেখা হয় আফগানিস্তানের পাগমান শহরে। লেখক উত্তম পুরুষে উপন্যাসটি বর্ণনা করেছেন। শবনমের সাথে মজনূনের দেখা হওয়া, কাছে আসা, প্রেম, পরিণয়, বিচ্ছেদের মাধ্যমে কাহিনী এগিয়েছে। মজনূন শবনমের জন্য ফার্সি শিখতে শুরু করে। ফার্সি, উর্দু, ফরাসি, বাংলা কবিতায় সে শবনমকে মুখরিত করে রাখে। শবনমও কম যায় না, কবিতার ফুলঝুরি তার বাক্যবন্ধে লুটোপুটি খায়।

এক কাহিনীকাব্য- শবনম; Image Source: Prasongik.com

এই উপন্যাসের মূল সৌন্দর্য এখানেই। অজস্র শ্রুতিমধুর কবিতায় পাঠক মুগ্ধ হবেন। মুগ্ধতার রেশে কবি হয়ে আসবেন খাজা শামসুদ্দীন মুহাম্মদ হাফিজ, শেখ সাদী, জালালুদ্দিন রুমি, কলীম কাসানি, সত্যেন দত্ত, কালিদাস প্রমুখ জগদ্বিখ্যাত কবিগণ। প্রেমের অমিয় বানী কাব্যমধুর বর্ণনায় ফুল হয়ে উপন্যাসের পাতায় পাতায় সুবাস ছড়িয়ে দেবে। এ কারণেই বোধহয় কোনো কোনো বোদ্ধা ‘শবনম’কে কাহিনীকাব্য হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

শবনম আর মজনূনের বিয়ের মুহূর্তের প্রার্থনা ছিল একেবারেই আলাদা, যেকোনো বিশ্বাসীর হৃদয়ে তা দোলা দেবেই,

“হে খুদা, আদম এবং হাওয়ার মধ্যে, ইউসুফ এবং জোলেখার মধ্যে, হজরৎ এবং খাদিজার মধ্যে যে প্রেম ছিল, এ দুজনার ভিতর সেই রকম প্রেম হোক।”

মুজতবা আলীর ভ্রমণ কাহিনীর ঘ্রাণ শবনমেও পাওয়া যাবে, আফগানিস্তানের কাবুল, পাগমান, মাজার-ই-শরীফ তো আছেই, সাথে আছে বাংলাদেশের সিলেট। উপন্যাসটি আত্মবর্ণনায় লেখা বলে, পাঠকের বারবার মনে হবে, সত্যিই কি মুজতবা আলীর সাথে শবনম নামের কোনো নারীর প্রণয় ছিল? সে জিজ্ঞাসার উত্তর তিনি নিজেই দিয়েছেন, তার ভ্রাতুষ্পুত্র, বাংলাদেশ সরকারের সাবেক রাষ্ট্রদূত সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলীর প্রশ্নে,

বাঘে মানুষ খায়, এটা সত্যি তো, না কি? হ্যাঁ, তা তো বটেই।’ তা হলে এই বাঘে মানুষ খেয়েছে কি না তা দিয়ে কম্মটা কী? কী আর বলব, বোকার মতো মুখ করে বসে রইলাম। চাচা বললেন, “শোনো, যুবক-যুবতী প্রেম করে, সেটা যেমন সত্যি, এই গপ্পও তেমনই সত্যি! তবে তুমি যেহেতু গাড়ল, তাই খোলসা করে বলছি। কাবুলে থাকাকালীন একজন কাবুলি নারীর সঙ্গেই আমার পরিচয় হয়েছিল। সে আমার বাড়ি রোজ সকালে দুধ দিয়ে যেত। তার বয়স ৮০!” আমার বিস্ময় কাটানোর জন্যই বোধহয় আরও একটু যোগ করেছিলেন চাচা, “ভাতিজা, বাড়াও, বাড়াও! কল্পনাশক্তিটা আর একটু বাড়াও হে!”

উপন্যাসটি সৈয়দ মুজতবা আলী তার স্বভাবসুলভ বেশ কিছু চমৎকার উক্তি উপস্থাপনে ভোলেননি; তার কয়েকটি তুলে দিচ্ছি,

“আমি শ্রীকৃষ্ণ নই; জাত ধম্মো বাঁচাবার ভার আমার স্কন্ধে নয়।”

“ধারের বইয়ে নাকি বিদ্যার্জন হয় না।”

“শত্রু বেদনা দেয় মিলনে, মিত্র দেয় বিরহে”

“জীবনই অভিজ্ঞতা, আর অভিজ্ঞতাই জীবন। অভিজ্ঞতা সমষ্টির নাম জীবন, আর জীবনকে খণ্ড খণ্ড করে দেখলে এক-একটি অভিজ্ঞতা। এক-একটি অভিজ্ঞতা যেন এক এক ফোঁটা চোখের জলের রুদ্রাক্ষ। সব কটা গাঁথা হয়ে যে তসবি-মালা হয় তারই নাম জীবন।”

সুফীজম নিয়ে তার ভাবনাটিও বেশ চমকপ্রদ,

“সূফীদের অনেকেই তাই পরিপূর্ণ নিষ্ক্রিয়তায় বিশ্বাস করেন। সৎকর্ম,অসৎকর্ম, প্রয়োজনীয় কর্ম, অপ্রয়োজনীয় কর্ম, যাই কর না কেন, তার ফলস্বরূপ উৎপাদিত হবে নূতন কর্ম এবং ক্রমাগত বাড়তে থাকে সেই কর্ম-জিঞ্জির-চেইন-অ্যাকশন। এই কিস্মতের অক্ষমালার কোনও জায়গার তো গিট খুলতে হবে। না হলে এই অন্তহীন জপ-মালা তো ঘুরেই যাবে, ঘুরেই যাবে; এর তো শেষ নেই।”

সৈয়দ মুজতবা আলী; Image Source: observerbd.com

শবনম তার প্রেমিক মজনূনের প্রতি আবেদন জানিয়েছিল, “আমার মিলনে তুমি অভ্যস্ত হয়ে যেও না।” বোধকরি সে কারণে তাদের সুখের দিনগুলো বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। আবার বিপরীত আকুতিও ছিল শবনমের, “আমার বিরহে তুমি অভ্যস্ত হয়ে যেও না”। উপন্যাস পড়া শেষ করেও পাঠকের মনে হবে, শেষ হয়েও হইল না শেষ। এ আক্ষেপের উত্তরও দিয়েছে শবনম তার প্রেমিক মজনূনের কাছে,

“গোড়া আর শেষ, এই সৃষ্টির জানা আছে, বল কার?
প্রাচীন এ পুঁথি, গোড়া আর শেষ পাতা কটি ঝরা তার?”

This article is in Bangla. It s a review ofthe book 'Shobnom'.

References:

1. শবনম, সৈয়দ মুজতবা আলী, স্টুডেন্ট ওয়েজ, কলকাতা, ১৯৬০।
2. সৈয়দ মুজতবা আলীঃ গল্পের মানুষ, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, অন্য আলো, প্রথম আলো, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪।
3. মুজতবা আলীর জীবনবোধে দেশে বিদেশে, ইমরান মাহফুজ, দ্যা ডেইলি স্টার বাংলা, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০।
4. 'দীন সীতু মিয়া ভনে, শুনে পূন্যবাণ', অনন্দবাজার পত্রিকা, সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯।
5. ড্রয়ারে টাকা থাকলে আর লিখি না, সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭।

Featured Image: Meghchil

Related Articles

Exit mobile version