বাংলাদেশ নামের ভূখণ্ডটি ইতিহাসের অনেক ধাপ পেরিয়ে এসেছে। সংগ্রামের ইতিহাসে বাংলাদেশ সমৃদ্ধ একটি দেশ। এ দেশের সবচেয়ে বড় ইতিহাস হলো, এখানে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। পাকিস্তানিদের শাসন-শোষণ থেকে মুক্তির বিষয়টি আমাদের অতীতের সকল সংগ্রামের বিষয়কে পেছনে ফেলেছে।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের জন্ম। মুসলিম লীগ এই নতুন রাষ্ট্রকে তাদের নিজেদের সম্পত্তি মনে করল। সময়ের স্রোতে তারা বিলীন হয়ে গেল এবং সৃষ্টি হলো আওয়ামী লীগ। ১৯৭১ পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগও কি একই ভুল করল? বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন ‘জাসদের উত্থান পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি’ গ্রন্থের লেখক মহিউদ্দিন আহমদ। তিনি মনে করেন, মুসলিম লীগের বানানো জুতায় আওয়ামী লীগ পা রাখল। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হলো। জন্ম নিল জাসদ।
জাসদের যখন উত্থান হলো, বাংলাদেশ তখন সদ্য স্বাধীন হওয়া এক শিশু রাষ্ট্র। ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) নামে নতুন একটা রাজনৈতিক দল গঠনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়। জাসদ গঠনের কুশীলবদের মাঝে প্রধান ছিলেন সিরাজুল আলম খান ও তার দলবল।
ছাত্রলীগের জাতীয়তাবাদী অংশ, যারা ১৯৬২ সালে স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস গঠন করেছিল, তারাই মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পরে জাসদ গঠন করে। তাদের চোখে ছিল বিপ্লবের স্বপ্ন এবং এ স্বপ্নের হাত ধরে জাসদ খুব অল্প সময়ের মাঝে হয়ে ওঠে আওয়ামী লীগের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী। বিষয়টি ক্ষমতাসীনরা ভালোভাবে নিতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধের পর আওয়ামী লীগ যে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল তৈরি করতে ব্যর্থ হয়, তার সমালোচনা করতে গিয়ে লেখক, গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ রাজনীতিবিদ ও লেখক আবুল মনসুর আহমদ এবং জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাকের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। কার্যকরী বিরোধী দল না থাকলে গণতন্ত্র সমুন্নত থাকে না ।
সিরাজুল আলম খানরাই যে ষাটের দশকের পর থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর পেছনের শক্তি ছিলেন, তা প্রমাণ করতে গিয়ে একটি ঘটনা বলা যেতে পারে।
১৯৬৬ সালের আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটিতে ৬ দফা পাশ করাতে হবে। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে সভা ডাকা হলো। কিন্তু উপস্থিত অনেকেই ৬ দফা সমর্থন করতে রাজি ছিলেন না। ছাত্রলীগের একসময়ের সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল আলম খান দলবল নিয়ে ঘোরাফেরা করছিলেন। সবার হাতেই চেলাকাঠ।
কয়েকজন ভয়ে সভাস্থল ছেড়ে চলে গেলেন। যারা রয়ে গেলেন, তারা সর্বসম্মতিক্রমে ৬ দফার পক্ষে হাত তুললেন। ৬ দফা আওয়ামী লীগের কর্মসূচি হয়ে গেল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সিরাজুল আলম খান ও বঙ্গবন্ধুর মধ্যে এই সম্পর্কচ্ছেদে তারা উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। বিপুল সম্ভাবনা ও বিপ্লবের স্বপ্ন নিয়ে জাসদের উত্থান ঘটে, কিন্তু পরবর্তীতে বিপ্লবীদের হতাশ হতে হয়।
মহিউদ্দিন আহমেদের লেখার ধরন অনেকটা ফিকশনাল ছিল; এভাবে ইতিহাস লেখলে পাঠক আরো বেশি ইতিহাস পাঠে আগ্রহী হয়ে উঠবে। তিনি ব্যক্তি হিসেবে ঘটনার কুশীলবদের সঙ্গে পরিচিত। ছাত্রলীগ ও বিএলএফ-এর সক্রিয় কর্মী ছিলেন এবং জাসদ পরিচালিত দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকার সাথে সংযুক্ত ছিলেন। তিনি নিজেই অনেক ঘটনা ও প্রক্রিয়ার সাক্ষী। তার বিরুদ্ধে একটি সরল অভিযোগ করা হয়ে থাকে যে, তিনি নিজের মতো করে গল্প বলে নিজের ঢঙে ইতিহাস লিখে যাচ্ছেন। ‘জাসদের উত্থান পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি’ বইটি লেখার পর আওয়ামী লীগ ও জাসদের পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া এলো। দুই দলের পক্ষ থেকেই বলা হলো, লেখক তাদের মধ্যে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা করছেন।
রাজনীতি ও ইতিহাস-সচেতন পাঠকদের জন্য অবশ্যপাঠ্য একটি বই এটি। পুরো বইকে ভূমিকা বাদ দিয়ে ১০টি খণ্ডে বিভক্ত করা হয়েছে। পটভূমি ও উত্থান পতনের মাঝে উঠে এসেছে একটি বিরাট রাজনৈতিক ইতিহাস। এসেছে বিএনপি গঠনের প্রেক্ষাপট। লেখকের চমৎকার লেখার জন্য আগ্রহী পাঠকদের এক মুহূর্তের জন্য বিরক্ত হওয়ার উপায় নেই। ইতিহাসকে দেখতে হয় অনেকগুলো দৃষ্টিকোণ থেকে। কোনো একক ব্যক্তির বলা ইতিহাস পরখ করা ছাড়া গ্রহণযোগ্য হয় না। পুরো ইতিহাসের তা কোনোভাবেই পরিপূরক হয়ে ওঠে না। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এর পথচলা যে এত অস্থির ছিল, তা হয়তো নতুর প্রজন্ম জানেই না।
অনেক নতুন চরিত্রের সাথে পাঠকের পরিচয় ঘটবে। খুলে যাবে প্যান্ডোরার বাক্স। লেখক লিখছেন,
সত্যটা জানাজানি হয়ে গেলে আমাদের অনেকের বর্তমানটা নড়বড়ে হয়ে যেতে পারে। ইতিহাস চর্চার একটা বড় চ্যালেঞ্জ, গুম হয়ে যাওয়া সত্যকে খুঁজে বের করে আনা।
ইতিহাস কোনোকালেই কেউ লিখে রেখে যাননি। পরবর্তী সময়ে ইতিহাস মানুষের দ্বারাই রচিত হয়েছে। পাঠক হিসেবে মনে হয়েছে, তিনি গ্রন্থটিতে কিছু বিতর্কিত বিষয় উল্লেখ করেছেন; কিন্তু বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেননি। বিষয়গুলো আরো বিশদ আলোচনার দাবি রাখে। স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে ধুম্রজাল তৈরির ঘটনাও এর একটি। ১৯৭২ সালের খসড়া সংবিধান রচিত হলে তার বিপরীতে আ স ম আবদুর রব ও শাহজাহান সিরাজের নামে এক বিবৃতি বের হয়। সেখানে লেখা ছিল,
“১৯৭১ সালের ২৬ মার্চকে স্বাধীনতার ঘোষণার তারিখ বলে খসড়া সংবিধানে যে কথা লেখা হয়েছে তার সত্যতা কোথায়?
লেখক খুব সচেতনভাবেই বিষয়টির অবতারণা করেছেন। সিরাজুল আলম খানকে দিয়েও ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করতে চেয়েছেন। অথচ লেখক ঠিকই জানেন এবং বোঝেন যে একসময়ের বঙ্গবন্ধুর আস্থাভাজনদের মুখে এরকম তথ্য কখন বের হতে পারে। এটা কি শুধু তখন রাজনৈতিক কৌশল ছিল, নাকি অন্যকিছু- লেখক এ সম্পর্কে আর বিস্তারিত বলেননি।
বইটিতে লেখক মুক্তিযুদ্ধের সময় কথিত ভারত-বাংলাদেশ গোপন চুক্তিকে সামনে নিয়ে এসেছেন। রক্ষীবাহিনীর নির্যাতনের কথা বলেছেন। শেখ কামালের বিরুদ্ধে ব্যাংক লুটের যে অপপ্রচার হয়েছিল, এবং কেউ কেউ যে তা বিশ্বাসও করেছিলেন, তা তিনি তুলে ধরেছেন। তিনি মনে করেন, শেখ ফজলুল হক মনি ও শেখ কামালের কিছু কিছু কাজের ফলে তারা শুধু নিজেরাই বিতর্কিত হননি, এর দায় নিতে হয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানকেও।
সিরাজ শিকদারের মৃত্যুর বিষয়টি তুলে এনেছেন তিনি। বইটি পড়ে পাঠক হিসেবে তাকে চরমপন্থী নেতা মনে হতে পারে। তাজউদ্দিন আহমেদের দলে কোণঠাসা অবস্থানকে আওয়ামী লীগের প্রথম ক্যাজুয়ালিটি হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
অন্যসব সাবেক জাসদ কর্মীর মতোই গ্রন্থটিতে সিরাজুল আলম খানের প্রতি লেখকের ভালোলাগা ও শ্রদ্ধাবোধ অনেক বেশি ফুটে উঠেছে। এটা নিশ্চিন্তে বলা যায় যে, এই ভালোবাসা পাঠককেও আন্দোলিত করবে। এক্ষেত্রে লেখক নিরপেক্ষ থাকতে পারেননি।
গ্রন্থটি পাঠককে নিয়ে যাবে ১৯৭২ পরবর্তী রাজনীতিতে। কর্নেল তাহের ও জাসদের ভেতরের কার্যকলাপ। ৩ থেকে ৭ই নভেম্বরের ঘটনাবহুল অধ্যায়গুলো যেন চোখের সামনেই ঘটে যাবে। খালেদ মোশাররফের জন্য পাঠক-হৃদয় হাহাকার করে উঠবে। ঘটনার পরিক্রমায় জিয়াউর রহমান ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। জাসদের স্বপ্নভঙ্গ হয়। লেখক এক জায়গায় লিখেছেন,
জিয়াকে নিয়ে তাহের যে জুয়া খেলেছিলেন, তার মূল্য যে শুধু তিনি দিয়েছেন তা নয়। মূল্য দিতে হয়েছে পুরো দলকে, জাসদের হাজার হাজার কর্মীকে।
লেখক এমনভাবে চিত্রনাট্য সাজিয়েছেন যে, পাঠকের মনে হবে, স্বাধীনতার পর তৈরি হওয়া দল জাসদের মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য; ইতিহাস পাঠে যা কিছুটা বেমানান। জাসদ আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে যাওয়ার পরও মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগের অবদান মলিন হয়ে যায় না। শেষদিকে ১৯৭৫ পরবর্তী সিরাজুল আলম খানের নিস্ক্রিয়তাকে লেখক সচেতনভাবেই এড়িয়ে গিয়েছেন। অথচ জাসদের অধিকাংশ নেতা ও কর্মীরা কর্নেল তাহের বা মেজর জলিলের ভাবশিষ্য ছিলেন না। সিরাজুল আলম খানের এই হঠাৎ নিস্ক্রিয়তার কারণ লেখক আমাদের কাছে ব্যাখ্যা করতে পারেননি। তবে মনে হয়, সকল সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও তাজউদ্দিন আহমেদের অতি বিপ্লবী না হয়ে ওঠা একটি বিস্ময়। বঙ্গবন্ধু নিজেই একসময় বলেছিলেন,
আমি না থাকলে এই তাজউদ্দিন হবে তোমাদের নেতা।
বইটি থেকে জানা যায়, জাসদ গঠনের সময় সিরাজুল আলম খানরা তাজউদ্দিনকেই পাশে চেয়ে ব্যর্থ হন।
একেবারে নিরপেক্ষ না হলেও, একেবারে পক্ষপাতদুষ্ট এমন তকমা এই বইয়ের জন্য ব্যবহার করা যাবে না। সিরাজুল আলম খানকে পুরো বইয়ে আমরা নায়ক হিসেবে দেখতে পাই। বড় একটা অস্থির সময় ২৮৮ পৃষ্ঠার সীমানায় আনতে গিয়ে লেখক কিছুটা তাড়াহুড়ো করেছেন বলে মনে হয়েছে। বইয়ে প্রচুর তথ্যসূত্র ব্যবহার করা হয়েছে। লেখক বইটি লিখতে যথেষ্ট পরিশ্রম করেছেন, তা স্পষ্ট। বইটি ২০১৪ সালে প্রথমা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হওয়ার পরপরই ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়।
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশ সম্পর্কে ভিন্ন দৃষ্টিকোণে জানতে হলে ইতিহাস ও রাজনীতি বিষয়ে আগ্রহী পাঠকের এই বইটি পড়া দরকার।