‘সিংহী যতক্ষণ নিজে গল্প না বলবে, শিকারিই ততক্ষণ হিরো থাকবে।’ নিজের ডকু-ড্রামার প্রসঙ্গে আফ্রিকান প্রবাদটাকে একটু বদলিয়েই, যা কিনা বিষয়ের সাথে সাযুজ্যতা স্থাপন করতে, ব্যবহার করেছেন পরিচালক কামার আহমেদ সাইমন। এর আগে শুনতে কি পাও (২০১২) নামে আরো একটি ডকুমেন্টারি তিনি নির্মাণ করেছেন। কিন্তু তিনি নিজেই কি সেই সিংহীদের গল্প বলতে পেরেছেন? পরিবার, স্বজন ফেলে দেশের স্বার্থে বিদেশ বিভুঁইয়ে পড়ে থাকা নারী পুলিশদের নিয়ে এই ডকু-ড্রামা। নীল, বেদনার রং, ওই পরিবার-স্বজন হতে দূরত্ব বোঝানোর অর্থে আর ‘মুকুট’ তাদের ত্যাগের, সাহসিকতার পুরস্কার অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। এই মিলিয়ে নাম, ‘নীল মুকুট’।
বিষয় শুনে আগ্রহ জাগে। কিন্তু ১ ঘণ্টা ৪১ মিনিটের এই ডকু-ড্রামা আগ্রহ ধরে রাখার চাইতে ক্লেশভাব জাগানোতেই পারদর্শিতা দেখিয়েছে। ডকুমেন্টারি সিনেমা মেইনস্ট্রিমে আলোচনার জিনিস নয়। সে কথা বলছি কারণ, অনেকের ধারণা এদেশে ডকুনির্মাণ খুব নতুন জিনিস। আর সেই ধারণাই, ‘কিছু হলেই ভালো’ এই একপেশে কথাটার পাল্লা উঁচিয়ে ধরে। তো সেই ধারণা মুছে দিতেই সে কথা। আন্ডারগ্রাউন্ডে ডকুমেন্টারি ঠিকই হচ্ছে, বিভিন্ন ফেস্টিভ্যালে নিয়ে যাওয়ার তোড়জোড়ও পুরোদমে চলছে। নতুন ফিল্মমেকার’রা তো ডকু বানানোর বিষয়ে একগাল হেসে দৃপ্ত পদক্ষেপে আগান। তাই ডকুমেন্টারির গঠনরীতি এই অঞ্চলে অজানা নয়। তবে হ্যান্ডহেল্ড ক্যামেরা ধরে দৌড়ঝাঁপ, ভুরিভুরি ক্লোজ আপ, ভয়েসওভার ন্যারেশান, সাক্ষাৎকার ধরলেই ডকুমেন্টারি হয়ে যাচ্ছে; এই ধারণা বোধহয় প্রবল।
ভিজ্যুয়াল মাধ্যমে, তা যে ক্ষেত্রেই হোক, গল্প বলার দায় থাকে। গল্প বলতে আবার এই অঞ্চলে যে স্থুল ধারণা প্রচলিত, সেটা না। ৩০ সেকেন্ডের বিজ্ঞাপনেও সংসক্ত উপায়ে গল্প বলার দায় থাকে এবং বলতে জানতে হয়। আবার একটা নিঃসঙ্গ মানুষের রোজকার জীবন ক্যামেরায় তোলার ভেতর দিয়ে ছোট ছোট বিবরণের সংসক্তিতেও একটা গল্প দাঁড়ায়। সঠিক বয়ানভঙ্গিমাই গল্প দাঁড় করায়, গল্প না থাকার মাঝেই। এই কথাগুলো বলছি কারণ, নির্মাতা এখানে গল্প খুঁজতে বারণ করেছেন। সেটা যাতে কাজের দুর্বলতায় একটা সুযোগ না হয়ে যায়, ওকারণেই উল্লেখ করা।
খাবার দাবার, হাসাহাসি, ভ্রমণে সেলফি; ১ ঘণ্টা ৪১ মিনিটের ডকুড্রামা হিসেবে এগুলো যৎসামান্য উপাদান। আবার এগুলো দিয়ে ১ ঘণ্টা ৪১ মিনিট পার করাটা দীর্ঘযাত্রার ক্লান্তি আর বিরক্তি— দুয়েরই উদ্রেক ঘটায়। নির্মাতা এটিকে ডকুমেন্টেশন না বলে ডকু-ড্রামা বলছেন। তাহলে যে বিষয় কিংবা যাদের একখণ্ড জীবনচিত্র কিংবা সংগ্রাম তুলে আনবেন, তার মধ্যে কী কী দিক বা ইনসাইট তুলে ধরবেন, গভীরে যাবেন; সেটার একটা ছক তো কষেছেন চিত্রনাট্যে। কাজটা দেখে বলতে হয়, খুবই ভাসাভাসা সেই লেখা। পৃষ্ঠতল কামড়ে পড়ে থাকা। হাইতিতে পাঠানোর আগে কিছুক্ষণ প্রশিক্ষণের চিত্র, যাওয়ার সময়কার প্রক্রিয়া আর মাঝে মাঝে পরিবারের সাথে তাদের দুয়েক আলাপন কিংবা নিজেদের মাঝে এই-সেই বাক্য বিনিময়; এসব কোনো ‘রিয়েল ইনসাইট’ প্রদান করেনি। বরঞ্চ বিক্ষিপ্ততাই প্রকাশ করেছে বেশি।
কিছু উদ্দেশ্যযুক্ত সংলাপ আছে, বক্তব্য প্রকাশ করতে। এই যে পরিবার ফেলে আসার বিরহ আর ওদিকে সবার সাথে হাসি-তামাশায় মিশে সেটাকে ভুলে থাকার একটা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের যে দারুণ ব্যাপারটা, চাইলেই এটাকে অমোঘ রূপে আনা যেত। কিন্তু সেই রূপ পায়নি। শুধু ডকুমেন্টেশন যেহেতু না, স্ক্রিপ্টেড ব্যাপার আছে, তাই অবশ্যই এই প্রশ্নগুলো আসবে। তাদের একে অপরের সাথে কথোপকথনের মধ্যেই নিগূঢ় হতাশা, সেখানে মাসের পর মাস পড়ে থাকার সংগ্রাম উঠে আসতে পারত। তাদের দৃঢ়তা পর্দায় আসতে পারত আরো অভিঘাতীরূপে। যথাযথ পরিমাণ ইনসাইট ছাড়া ডকুমেন্টারি, ডকুমেন্টারিই বা হয়ে উঠছে কীভাবে! বাস্তবকে গভীরভাবে দেখা, সত্যটাকে নিজস্ব রূপে অবলোকনই তো তার কাজ। সে কারণেই তো একদম শুরুর সময়ের ‘একচুয়ালিটি ফিল্মস’ হতে আজকের ডকুমেন্টারি ফিল্মে প্রসার পাওয়া।
বিক্ষিপ্ততার বিষয়ে যদি বলা হয় ‘র’, তবে বলি, ডকুমেন্টারির কাজই বাস্তবকে বাস্তবের মতো করে উপস্থাপন করা। ফিকশনাল সিনেমার নুন, ঝাল, চিনি মেশানোর বিষয়টি এড়িয়েই। এই সময়ে সেটা বদলেছে। এখন কিছু ফিকশনাল উপাদান ডকুতে যোগ করেই আরো সিনেম্যাটিক বয়ানভঙ্গি আনা হচ্ছে এতে। ট্র্যাডিশনাল অনেক ডিভাইসই বদলেছে। সে যাক। আগের কথাতেই ফেরা হোক। তো আলাদাভাবে ‘র’ করার দরকার পড়ে না বৈ। অদক্ষতাকে র-এর মোড়কে ঢাকার চেষ্টা তাই এড়ানো উচিত। নির্মাতা কামার আহমেদ সাইমনের ফিল্মমেকিংয়ে আমাচুরিশ ব্যাপারটাই অনুভূত হয়েছে বেশি। ডকুমেন্টারির ঐতিহ্যবাহী যে ন্যারেটিভ স্টাইল, মানে; ভয়েসওভার ন্যারেশান, সাইলেন্ট ন্যারেশান কিংবা কোনো একজন ব্যক্তির বয়ান দিয়েই এগোনোর ধারা- সে রকম কোন স্টাইল কিন্তু ‘নীল মুকুট’ অনুসরণ করেনি।
এখানে ক্যামেরাটা নীরব একজন পর্যবেক্ষক হয়েই সবটা পর্যবেক্ষণ করার দায়িত্ব নিয়েছে। এটা একটা বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত অবশ্যই। এবং সেখানেই সিনেমার স্টাইলটা নজরে আসে। ডকু-ড্রামা তো। কিন্তু অমন বয়ানভঙ্গি থাকার পরও, সবকিছুতে জড়িয়ে থাকা অসংহতি আরো বেশি পোড়ায় দর্শক হিসেবে। সম্পাদনার কাজটা হবার দরকার ছিল আরো সূক্ষ্ম এবং প্রান্তঘেঁষা। অন্তত ক্লেশকর অনুভূতি তাতে কিছুটা ভোঁতা হতো।
অবশ্যই এখানে প্রফেশনাল কোনো অভিনয়শিল্পী থাকার কথা না। হাইতিতে অবস্থানরত ওই দলের প্রত্যেকেই বাস্তবের নারী পুলিশ। ক্যামেরার দিকে সরাসরি তাকিয়ে তাদের কোনো বর্ণনা দিতে হয়নি। তবে নীরব পর্যবেক্ষক হলেও, ক্যামেরার অস্তিত্ব আর উদ্দেশ্যের কথা তো তারা ভুলে যায়নি। আর সেই বিষয়টা হয়তো তাদের মাঝে আনচান তৈরি করছিল থেকে থেকে। হঠাৎ হঠাৎ শরীরী ভঙ্গিতে আড়ষ্ট হয়ে যাওয়া সেটাই বলছিল। ও নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই যদিও। তবে সংলাপ বলতে গিয়ে প্রমিত আর চলিত; দুইরূপের উচ্চারণে সমন্বয় সাধন করতে মাঝেমাঝে একটু বেগ পেতে হচ্ছিল, মূলত যাদেরকে ফোকালপয়েন্ট হিসেবে ধরেছে এই ডকু। আবার সাধারণ, আটপৌরে জীবন নিয়ে আলাপচারিতায় খুব স্বতঃস্ফূর্ত তারা। ওখানে সেই অস্বস্তি কাজ করেনি।
‘নীল মুকুট’ শেষ হবার পর ভ্রুজোড়া কুঞ্চিত থেকে যায়। ভ্রুকুটি কেটে ভেবে দেখতে হয়, এতক্ষণের যাত্রাটা আদৌ কোথাও পৌঁছেছে কি না। বিভ্রান্ত হতে হয়, তা ভেবে। অন্য দেশে পড়ে থাকা এই জীবনগুলোর জটিলতা প্রভাব রাখার মতো করে না এসেছে কথাবার্তায়, না এসেছে হাসিঠাট্টায় মুখরিত থাকা আমেজটায় একটা সূক্ষ্ম, নুন্যোক্ত টোনে। সিরিয়াস কিছু এই ডকু-ড্রামায় অনুভব করা যায় না। নিশ্চলতাই যেন ভর করে ছিল। এবং আপাত কোনো অর্থও এই গোটা সময়টায় দাঁড়ায়নি। তারা একটা অর্থ নিয়েই কিন্তু পরিবার, দেশ ছেড়েছে। অথচ তাদের নিয়ে করা কাজটাই একটা সুস্পষ্ট অর্থের জায়গায় পৌঁছাতে পারলো না। ডকুড্রামাটা শেষ হতে হতে এই প্রশ্নটাই আসলে দর্শক-মনে উঁকি মারে। কোনো উদ্দেশ্যভিত্তিক ডকুমেন্টারিও ‘নীল মুকুট’ হয়নি, আবার অর্থের জায়গা থেকেও গভীরদৃষ্টির কিছু হয়নি। আলোচনার শুরুতে আফ্রিকান প্রবাদের পিঠে ছুঁড়ে দেওয়া প্রশ্নটাও আর যথাযথ উত্তর পেল না।
‘নীল মুকুট’ হতে পারতো অনুভূতিপ্রবণ, সংবেদনশীল একটা কাজ। তাদের ত্যাগের প্রতি সহমর্মিতা রেখে দরদমাখা ফিল্মমেকিংয়ের একটি ডকুড্রামা। সেটুকু কাগজে-কলমে যদি থেকেও থাকে, ভিজ্যুয়াল ট্রিটমেন্টে আসেনি। বরং অর্থহীনই থেকেছে, যেটা হতাশার।