ম্যানচেস্টার বাই দ্য সি: অনুভূতিহীন জীবনের গল্প

একথা সত্য, কিছু কিছু মানুষের জীবনে বিষাদ আসে প্রেরণা হয়ে, দুঃখ তাদের পথচলার শক্তি যোগায় নতুন করে। তবে বেশিরভাগ মানুষের জীবনেই বিষাদ হলো এমন এক অনুভূতি, যা প্রতিনিয়ত তাদেরকে হতাশা আর বিষণ্ণতার চার দেয়ালে বন্দি করে রাখার হুমকি দেয়। চিত্রপরিচালক কেনেথ লোনেরগান ঠিক এই কথাগুলো যেন বলার চেষ্টা করেছেন ‘ম্যানচেস্টার বাই দ্য সি’ চলচ্চিত্র দিয়ে। ছবিটি মূলত বিষণ্ণতা এবং একাকীত্বে আকণ্ঠ নিমজ্জিত মিতভাষী এক মানুষকে নিয়ে, যার দুঃখময় অতীত তার স্বাভাবিক সত্ত্বাকে আবৃত করে রেখেছে অনুভূতিহীনতার খোলসে।

গল্পের শুরুতেই, মুল চরিত্র লি চ্যান্ডলারকে ভাইয়ের মৃত্যুর সংবাদ শুনে ছুটে যেতে হয় এসেক্স কাউন্টির সেই ছোট্ট শহর ম্যানচেস্টারে, সদ্য পিতৃহারা হওয়া ভাতিজার দেখভাল করতে।

অতীতের বড় অংশ কেটেছে লি’র সেখানে। একসময় তারও সুখের সংসার ছিল। কিন্তু আকস্মিক ঘটে যাওয়া কিছু দুর্ঘটনা বদলে দেয় তার জীবন। আর শহরে তার ফিরে আসার পর থেকেই ধীরে ধীরে তার চরিত্রের অদ্ভুত আচরণের কারণও স্পষ্ট হতে শুরু করে। ফুটে উঠতে থাকে তার জীবনের অনুভূতিহীন নগ্ন বাস্তবতার রূপ। অবতারণা হয় এমন এক গল্পের, যা আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ মনে হলেও আসলে বেশ জটিল এবং একই সঙ্গে বেদনাদায়ক। 

চ্যান্ডলারের ভাইয়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার দৃশ্য © Amazon Studios

বিষাদময় জীবনের কষ্ট আর হতাশার দৃশ্য ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে বেশিরভাগ সময়ই সিনেমা হারিয়ে যায় মেলোড্রামা আর ম্যানিপুলেশনের রসাতলে, যা অনেক ক্ষেত্রে ভালো গল্পেরও সর্বনাশ ডেকে আনে। কেনেথ লোনেরগান এমনটা হতে দেননি তার ছবিতে, ছবির কাহিনী তিনি তুলে ধরেছেন সুনিপুণ দক্ষতার সঙ্গে। দুঃখ-কষ্টে ভুগতে থাকা একজন মানুষের জীবন নিয়ে হিউমারে ভরপুর এরকম ছবি আগে খুব একটা দেখা যায়নি।

কীভাবে একজন মানুষ পারে তার জীবনে ঘটে যাওয়া ট্র্যাজেডির মোকাবেলা করতে, কিংবা সেগুলো বুকে চেপে বেঁচে থাকতে; ‘লি চ্যান্ডলার’ নামের বর্ণিল চরিত্রটিতে অভিনয় করে সেটাই দেখিয়েছেন ক্যাসি অ্যাফ্লেক। তিনি যে এই সময়কার সবচেয়ে ‘আন্ডাররেটেড’ অভিনেতাদের মধ্যে একজন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। যতগুলো ছবিতে তিনি ছিলেন, তার প্রায় সবগুলোতেই ভালো অভিনয় দিয়ে নজর কেড়েছেন। বিশেষ করে মূল চরিত্রে থাকা প্রত্যেকটি চলচ্চিত্রে তার অভিনয় ছিল প্রশংসনীয়।

লি চ্যান্ডলার চরিত্রে ক্যাসি অ্যাফ্লেক
চ্যান্ডলার চরিত্রে ক্যাসি অ্যাফ্লেক © Amazon Studios

এই চলচ্চিত্রেও অ্যাফ্লেকের অভিনয় ছিল স্রেফ দুর্দান্ত। পুরো সিনেমা জুড়ে তার চেহারায় ক্রোধ আর বিষণ্ণতার যে ছায়া ফুটে উঠেছিল, তা ভোলা সম্ভব নয়। আর এই চরিত্র রূপায়নের মাধ্যমে গোল্ডেন গ্লোব এবং ক্রিটিকস চয়েস অ্যাওয়ার্ডসহ তিনি জিতে নিয়েছেন প্রধান চরিত্রে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার অস্কার। মজার কথা হলো, সিনেমাটিতে প্রথমে ম্যাট ডেমনের পরিচালনার পাশাপাশি মূল চরিত্রে অভিনয় করার কথা ছিল। শিডিউল জটিলতার কারণে ম্যাট চলচ্চিত্র পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে দেন লোনেরগানকে এবং মূল চরিত্রটি দিয়ে দেন ক্যাসি অ্যাফ্লেককে। এক সাক্ষাৎকারে লোনেরগান বলেন, সিনেমাটির আইডিয়া পুরোপুরি তার ছিল না, ম্যাট ডেমন এবং জন ক্রাজিনস্কি তার হাতে গল্পটি ধরিয়ে দেন।

সিনেমায় আইস হকি, দুই গার্লফ্রেন্ড আর রক ব্যান্ড নিয়ে ব্যস্ত প্যাট্রিকের চরিত্রটি ছিল ঠিক লি’র উল্টো। এই চরিত্রে বেশ দারুণ অভিনয় করেছেন লুকাস হেজেস; সেরা পার্শ্ব চরিত্রের জন্য তিনি পেয়েছেন অস্কার মনোনয়ন এবং জিতেছেন ছোটখাটো বেশ কিছু পুরস্কার।

প্যাট্রিক চরিত্রে লুকাস হেজেস © Amazon Studios

বাকি চরিত্রগুলো খুব অল্প সময় ছবিতে দেখানো হয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে লি চ্যান্ডলারের প্রাক্তন স্ত্রী চরিত্রে অভিনেত্রী মিশেল উইলিয়ামস। পনেরো মিনিটের চেয়ে কম সময় স্ক্রিনে উপস্থিত থেকেও তিনি এত ভালো অভিনয় করেছেন যে, তাতেই চলে এসেছেন অস্কার মনোনয়ন পাওয়া শিল্পীদের তালিকায়।

চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যে লি ও তার সাবেক স্ত্রী © Amazon Studios

চরিত্রগুলোর বাস্তববাদী অভিনয়ের পাশাপাশি পরিচালক লোনেরগানের অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন চিত্রনাট্য এবং অনন্যসাধারণ পরিচালনাশৈলী ছিল ছবির সবচেয়ে শক্তিশালী দিক; বিশেষ করে লি ও তার ভাতিজা প্যাট্রিকের ঝগড়ার দৃশ্যগুলো, লি গাড়ি কোথায় পার্ক করেছে সেটা ভুলে যাওয়া, তার হাত থেকে চাবি পড়ে যাওয়ার দৃশ্য, কিংবা লি ও তার প্রাক্তন স্ত্রীর মধ্যকার কথোপকথনের দৃশ্যগুলো ছিল খুবই বাস্তবসম্মত। আর ফ্ল্যাশব্যাকের মাধ্যমে গল্পের পটভূমি এবং লি’র এই অনুভূতিহীন অবস্থার আগের স্বাভাবিক এবং সদাহাস্য রূপটিও তুলে ধরা হয়েছে নিপুণভাবে।

পরিচালকের কেনেথ লোনেরগানের সাথে ক্যাসি অ্যাফ্লেক © Amazon Studios

তবে একটি কথা বলতেই হয়, সিনেমার ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর ছিল এর একটি ‘বিউটিফুল মিসটেক’। অর্কেস্ট্রার করুণ সুর দিয়ে পরিচালক ছবির বিষণ্ণতার মাত্রা বাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও কিছু কিছু দৃশ্যের সঙ্গে তা বেশ বেমানানই ঠেকেছে।

গল্পের ধারাবর্ণনার মতো কাহিনী কিংবা অ্যাকশন এই চলচ্চিত্রের মুল উপজীব্য বিষয় নয়। বরং এর মূল আকর্ষণ ছিল সূক্ষ্ম পরিচালনার পাশাপাশি চরিত্রগুলোর বাস্তবধর্মী অভিনয়, আর সংলাপ বলার ধরন। দৈনন্দিন জীবনের যাঁতাকল থেকে এক মুহূর্তের মুক্তি যারা খুঁজছেন, সিনেমাটি তাদের জন্য নয়। কারণ এটি আপনাকে নিয়ে যাবে লি চ্যান্ডলারের একঘেঁয়ে জীবন আর উদ্দেশ্যহীন জগতের গভীরে। তবে পেঁয়াজের খোসা অবমুক্ত করার মতো যখন তার বর্তমান পরিস্থিতির কারণ দর্শকের সামনে অনাবৃত হতে থাকবে, তখনই তার মধ্যে লির জন্য প্রচণ্ড সহানুভূতির সৃষ্টি হবে। ছবিটি দেখার সময় আপনাকে জোর করে বসে থাকতে হবে না, পরিচালকের অকপটভাবে গল্প বলার ধরন আর চরিত্রগুলোর অসাধারণ অভিনয় আপনার অনুভূতিগুলোকে অদ্ভুতভাবে নাড়া দিয়ে যাবে। সেইসাথে স্বস্তির বিষয় হলো, এই ছবির যবনিকা চিরাচরিত ‘সুখে-শান্তিতে বসবাস’ ধরনের নয়, বরং আরও বিশ্বাসযোগ্য এবং আরও বেশি তৃপ্তিদায়ক কিছু।

Manchester by the Sea is a 2016 American drama film written and directed by Kenneth Lonergan, and stars Casey Affleck, Michelle Williams, Kyle Chandler, and Lucas Hedges. The plot follows a man who, after his brother dies, is entrusted with the care of his teenage nephew. The film premiered at the Sundance Film Festival on January 23, 2016, and was picked up by Amazon Studios for distribution.

Featured image © Amazon Studios

Related Articles

Exit mobile version